মহরম পর্ব
উদ্ধার পর্ব
1 of 2

উদ্ধার পর্ব ২২ প্রবাহ

নিশার অবসান না হইতেই উভয় দলে রণবাদ্য বাজিতে লাগিল, এক পক্ষে হানিফার প্রাণবিনাশ, অপর পক্ষে এজিদের পরমায়ু শেষ দুই দলে দুই প্রকার আশা। দামেস্ক নগরবাসীরা কে কোন পক্ষের হিতৈষী, তাহা সহজে বুঝিবার সাধ্য নাই। কারণ মোহাম্মদ হানিফার পক্ষে কেহ কোন কথা বলিলে, জয়নাল আবেদীনের জন্য কেহ দুঃখ করিলে, সে রাজদ্রোহী মধ্যে গণ্য হয়, কোতোয়ালের হস্তে তাহার প্রাণ যায়-এ অবস্থায় সকলেই সন্তুষ্ট, সকলেই আনন্দিত। কেহ দূরে, কেহ অদূরে, কেহ নগর-প্রাচীরে, কেহ কেহ উচ্চ বৃক্ষোপরি থাকিয়া উভয় দলের যুদ্ধ দেখিবার প্রয়াসী হইল। মোহাম্মদ হানিফার পক্ষ হইতে জনৈক আম্বাজী সৈন্য যুদ্ধার্থে রণপ্রাঙ্গণে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। প্রতিযোধ না পাঠাইয়া উপায় নাই। মারওয়ান বাধ্য হইয়া বাল্লকীয়া নামে জনৈক বীরকে আম্বাজীর মস্তক শিবিরে আনিতে আদেশ করিলেন। যেই আজ্ঞা-সেই গমন। সকলেই দেখিল উভয় বীর অস্ত্র চালনায় প্রবৃত্ত হইয়াছে, অস্ত্রে শস্ত্রে সংঘর্ষণে সময়ে সময়ে চঞ্চলা চপলাবৎ অগ্নিরেখা দেখা দিতেছে। অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর আম্বাজী বল্লকীয়া হস্তে পরাস্ত হইল। পরাভব স্বীকার করিলেও বল্লকীয়া অস্ত্র নিক্ষেপে ক্ষান্ত হইলেন না। সকলেই দেখিলেন, ইসলাম শোণিতে দামেস্ক-প্রান্তর প্রথমে রঞ্জিত হইল-এজিদের মন মহাহর্ষে নাচিয়া উঠিল।

বল্লকীয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, “আয় কে যুদ্ধ করিবি, আয়! শুনিয়াছি আম্বাজীরা বিখ্যাত বীর। আয় দেখি! বীরের তরবারির নিকটে কোন্ মহাবীর আসিবি আয়!”

আহ্বানের পূর্বেই দ্বিতীয় আম্বাজী বল্লকীয়ার সহিত যুদ্ধ করিতে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু তাঁহাকে অধিকক্ষণ যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকিতে হইল না। উষ্ণীষ সহিত দ্বিতীয় আম্বাজী-শির ভূমিতে গড়াইয়া পড়িল। ক্রমে সপ্তজন আম্বাজী বল্লকীয়া-হস্তে শহীদ হইল।

এজিদ্ হর্ষোফুল্ল-বদনে বলিতে লাগিল, “মারওয়ান! আজ কি দেখিতেছ? এই সকল সৈন্যই তো তোমাদিগকে পরাস্ত করিয়াছে, শৃগাল কুকুরের ন্যায় তাড়াইয়া আনিয়াছে! তাহারাই তো ইহারা?”

“মহারাজ! ইহার কিছুই কারণ বুঝিতে পারিতেছি না। আমাদের একটি সৈন্য হস্তে মোহাম্মদীয় সাত জন সৈন্য কোন যুদ্ধেই যমপুরী দর্শন করে নাই। সকলই মহারাজের প্রসাদাত, আর দামেস্ক প্রান্তরের পবিত্রতার গুণে।”

এজিদের পক্ষে উৎসাহসূচক বাজনার দ্বিগুণ রোল উঠিয়াছে। বল্লকীয়ার সম্মুখে কেহই টিকিতেছে না! হানিফার সৈন্যশোণিতেই রণপ্রাঙ্গণ রঞ্জিত হইতেছে!-এজিদ্ মহা সুখী!

গাজী রহমান মোহাম্মদ হানিফাকে বলিলেন, “বাদশা নামদার! এ প্রকারের যোধ শত্রু-সম্মুখে পাঠান আর উচিত হইতেছে না। বুঝিলাম দামেস্ক রাজ্যের সৈন্যবল একেবারে সামান্য নহে।”

মস্‌হাব কাক্কা, ওমর আলী, প্রভৃতি বল্লকীয়ার যুদ্ধ বিশেষ মনোযোগে দেখিতে ছিলেন। একা বল্লকীয়া কতকগুলি সৈন্য বিনাশ করিল দেখিয়া তাঁহারা সকলেই যুদ্ধে গমন করিতে প্রস্তুত হইলেন।

মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! আমার সহ্য হইতেছে না, সমুদয় শরীরে আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে। আর শিবিরে থাকিতে পারিলাম না। তোমরা আমার পশ্চাৎ রক্ষা করিবে, গাজী রহমান শিবিরের তত্ত্বাবধানে থাকিবে, সৈন্যদিগের শৃঙ্খলার প্রতি দৃষ্টি রাখিবে। -আমি চলিলাম। আমি হানিফার অস্ত্র আর এজিদের সৈন্য, দুইয়ে একত্র করিয়া দেখিব বেশি বল কাহার।”

হানিফা ঐ কথা বলিয়া অশ্বারোহণ করিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যাইয়া বলিলেন, “বীরবর! তোমার বীরপনায় আমি সন্তুষ্ট হইয়াছি। কিন্তু তোমার জীবনের সাধ সকলই মিটিল। ইহাই আক্ষেপ!”

বল্লকীয়া বলিলেন, “মহাশয় আর একটি সাধের কথা বাকী রাখিলেন কেন?”

“আর কি সাধ?”

“হানিফার মস্তকচ্ছেদন। দোহাই আপনার, আপনি ফিরিয়া যাউন। কেন আপনি আপনার সঙ্গী ভ্রাতৃগণ সদৃশ অসময়ে জগৎ ছাড়িবেন। আপনি ফিরিয়া যাউন। বল্লকীয়ার হস্তে রক্ষা নাই। আমি হানিফার শোণিতপিপাসু! আপনি ফিরিয়া যাউন।”

“তোমার সাধ মিটিবে। আমারই নাম মোহাম্মদ হানিফা।”

“সে কি কথা? এত সৈন্য থাকিতে মোহাম্মদ হানিফা সমরক্ষেত্রে!-ইহা বিশ্বাস্য নহে। আচ্ছা এই আঘাত!”

সে আঘাত কে দেখিল? পরে যাহা ঘটিল তাহাতে এজিদের প্রাণে আঘাত লাগিল। বল্লকীয়ার শরীরের দক্ষিণভাগে দক্ষিণ হস্তসহ এক দিকে পড়িল, বাম ঊরু, বাম হস্ত, বাম চক্ষু, বাম কর্ণ লইয়া অপরার্ধ ভাগ অন্য দিকে পড়িল।

এজিদ্ অলীদকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওহে, বলিতে পার এ সৈন্যের নাম কি?”

অলীদ্ মনোযোগের সহিত দেখিয়া বলিলেন, “মহারাজ! ইনিই মোহাম্মদ হানিফা।”

এজিদ্ চমকিয়া উঠিলেন, কিন্তু সাহসে নির্ভর করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “সৈন্যগণ! অসি নিষ্কোষিত কর, বর্শা উত্তোলন কর, যদি দামেস্কের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে চাও, মহাবেগে হানিফাকে আক্রমণ কর। এমন সুযোগ আর হইবে না। তোমাদের বল বিক্রমের ভালরূপে পরিচয় পাইতে হানিফা যুদ্ধক্ষেত্রে আর আসিবে না! নিশ্চয় পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিবে। যাও, শীঘ্র যাও, শীঘ্র হানিফার মস্তকচ্ছেদন করিয়া আন। তোমরাই আমার দক্ষিণ বাহু, তোমরাই আমার বল বিক্রম, তোমরাই আমার সাহস, তোমরাই আমার প্রাণ। ঘোর বিক্রমে হানিফাকে আক্রমণ কর। হয় বন্ধন-নয় শিরচ্ছেদ, এই দুইটি কার্যের একটি কার্য করিতে আজ জীবন পণ কর। বীরগণ! বীরদর্পে চলিয়া যাও। তোমাদের পারিতোষিক আমার প্রাণ, মন, দেহ-মণিমুক্তা হীরক আদি অতি তুচ্ছ কথা।”

সৈন্যগণ অসিহস্তে মার মার শব্দে সমরাঙ্গণে যাইয়া হানিফাকে আক্রমণ করিল। এজিদের চক্ষু হানিফার দিকে। এজিদ্ দেখিলেন হানিফার তরবারি ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুতের ন্যায় চাক্চিক্য দেখাইয়া ঊর্ধ্বে, নিন্মে, বামে, দক্ষিণে ঘুরিল এবং লোহিত রেখায় তাহার পূর্ব চাক্চিক্য কিঞ্চিৎ মলিন ভাব ধারণ করিল। সম্মুখের একটি প্রাণীও নাই। চক্ষুর পলকে যেন স্থির বায়ুর সহিত মিশিয়া অশ্ব হইতে অন্তর্ধান হইল।
মারওয়ান বলিল, “বাদশা নামদার! দেখিলেন অলীদ সহজে মদিনার পথ ছাড়িয়া দেয় নাই। এই যে হানিফার অস্ত্র চলিল, আমরা পরাজয় স্বীকার না করিলে এ অস্ত্র আর থাকিবে না, দিবারাত্র সমান ভাবে চলিবে, হানিফার মন কিছুতেই টলিবে না, রক্তের স্রোত বহিয়া দামেস্ক প্রান্তর ডুবিয়া গেলেও সে বিশাল হস্তের বল কমিবে না,-অবশ হইবে না;-তরবারির তেজ কমিবে না, ক্লান্ত হইয়া শিবিরেও যাইবে না।”

এজিদ্ রোষে জ্বলিতেছে। পুনরায় পূর্বপ্রেরিত সৈন্যের দ্বিগুণ সৈন্য হানিফা বধে প্রেরণ করিল। সৈন্যগণ মহাবীরের সম্মুখে যাইয়া একযোগে নানাবিধ অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিল। যে যেরূপ অস্ত্র নিক্ষেপ করিল, ঈশ্বরেচ্ছায় হানিফা তাহাকে সেই অস্ত্রেই যমপুরী পাঠাইয়া দিলেন। এজিদের ক্রোধের সীমা রহিল না। পুনরায় চতুর্গুণ সেনা পাঠাইল। সেবার এজিদ্ হানিফাকে তরবারি হস্তে তাঁহার সৈন্যগণের নিকট যাইতে দেখিল মাত্র। পরক্ষণেই দেখিল যে, প্রেরিত সৈন্যের অশ্বসকল দিগ্বিদিক্ ছুটিয়া বেড়াইতেছে, একটি অশ্বপৃষ্ঠেও আরোহী নাই।

এজিদ্ যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ং যাইতে প্রস্তুত হইল। মারওয়ান করযোড়ে বলিল, “মহারাজ! এমন কার্য করিবেন না, আজ মোহাম্মদ হানিফার সম্মুখে কখনোই যাইবেন না। এখনও দামেস্কের অসংখ্য সৈন্য রহিয়াছে, আমরা জীবিত আছি; আমাদের প্রাণ শেষে যাহা ইচ্ছা করিলেন। আমরা জীবিত থাকিতে মহারাজকে হানিফার সম্মুখীন হইতে দেব না।”

এজিদ্ মারওয়ানের কথায় ক্ষান্ত হইল। সে দিন আর যুদ্ধ করিল না। সে দিনের মত শেষ বাজনা বাজাইয়া, নিশান উড়াইয়া মারওয়ান সহ শিবিরে আসিল। মোহাম্মদ হানিফাও তরবারি কোষে আবদ্ধ করিয়া অশ্ববল্গা ফিরাইয়া শিবিরে গমন করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *