২৮. মা

২৮
ক্রিকেট খেলা চলছে ঢাকা স্টেডিয়ামে ৷ পাকিস্তান বনাম নিউজিল্যান্ড ৷ ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ থেকে শুরু হয়েছে এই টেস্ট ৷ আজ ফোর্থ ডে ৷ পাকিস্তান দলে বাঙালি আছে প্রথম একাদশে রকিবুল হাসান ৷ টুয়েলভ্থ ম্যান হিসাবে সুযোগ পেয়েছে তান্না ৷ নিউজিল্যান্ডের টার্নার সেঞ্চুরি করেছে ৷ পাকিস্তান দলের পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা যে ব্যাট নিয়ে নেমেছে, তার পেছনে রঙিন হাতলটা চিকন হয়ে ব্যাটের ঘাড় থেকে পিঠের দিকে নেমে গেছে ৷ দেখতে তলোয়ারের মতো লাগে ৷ তলোয়ার ছিল ভুট্টোর পিপিপির নির্বাচনী প্রতীক ৷ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তাই নিয়ে গুঞ্জন ৷ দেখছস, মাউড়াগুলান তলোয়ার মার্কা ব্যাট নিয়া নামছে ৷ এবার দেখা যাক রকিবুল হাসান কী ব্যাট নিয়ে নামে ৷ সবার মধ্যে এই ঔৎসুক্য ছিল ৷ রকিবুল হাসান নেমেছিল জয় বাংলা লেখা ব্যাট নিয়ে ৷ গ্যালারি তালি দিয়ে উঠেছিল সোল্লাসে ৷ তবে এই তালি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি ৷ জিরো আর ১ রান করে দু ইনিংসে আউট হয়ে গিয়েছিল রকিবুল ৷
গ্যালারিতে বসে আছে আজাদ, কাজী কামাল আর হিউবার্ট রোজারিও ৷ তারা বাদাম চিবাচ্ছে ৷ একটা চানাচুরঅলা ঢুকে পড়েছে গ্যালারিতে ৷ তার পরনে লাল রঙের পোশাক, মাথায় কোণাকার টুপি, পায়ে ঘুঙুর ৷ তার হাতে চোঙ ৷ চোঙে মুখ লাগিয়ে সে হাঁক ছাড়ছে : চানাচুর গরম, জয় বাংলা চানাচুর ৷
কাজী কামাল সেদিকে দেখিয়ে হাসে-‘বেটা ব্যবসা ভালো বুঝেছে ৷’ একটা সিগারেটঅলা সিগারেট নিয়ে গ্যালারির আসনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে ৷ আজাদ বলে, ‘কিরে, তোর সব সিগারেট কি জয় বাংলা নাকি!’
সিগারেটঅলা বুঝতে পারে না ৷ বোকার মতো হাসে ৷ আজাদ বলে, ‘বিদেশী সিগারেট আছে ?’
‘নাই স্যার’-সিগারেটঅলা লোকটা দ্রুত পায়ে চলে যায় ৷
কাজী কামাল বলে, ‘বাংলা সিগারেট আর বাংলা মদ, এসবের বেলায় জয় বাংলা না হইলেই ভালো ৷’
আজাদ বলে, ‘এসবের বেলায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ কিন্তু আরো খারাপ ৷’
কামাল বলে, ‘ক্যান দোস্তো ৷ তুমি না করাচি থাইকা পইড়া আইলা ৷’
আজাদ বলে, ‘আরে দেখে এসেছি না ৷ দেখেশুনেই তো বলছি ৷ ওদের সাথে থাকা যাবে না ৷’
রুমী আর জামীকে দেখা যায় ৷ তারা চানাচুরঅলাটাকে ধরে নিয়ে এসেছে ৷
রুমী বলে, ‘আজাদ, খাবে নাকি! জয় বাংলা চানাচুর ৷’
আজাদ বলে, ‘নাও না দেখি ৷ কেমন লাগে!’
ছক্কা ৷ স্টেডিয়ামে হৈ ওঠে ৷ কে মারল ? লোকজন সব রেডিওতে কান পাতে ৷ অনেকেই সঙ্গে করে রেডিও নিয়ে এসেছে ৷ রেডিওঅলারা ভলুম বাড়াতে নব ঘোরায় ৷
জুয়েল আসে গ্যালারিতে ৷ জুয়েল পূর্ব পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান ৷ আজাদ বয়েজে খেলেছে ৷ এখন খেলে মোহামেডানে ৷ তার খেলায় একটা মারকুটে ভাব আছে ৷ ৪৫ ওভারের সীমিত ম্যাচে সে ঝড়ের মতো পেটায় ৷ বল জিনিসটা যে পেটানোর জন্যে, এটা তার ব্যাটিং দেখলে বোঝা যায় ৷ উইকেটকিপিংও করে ৷ সে এসে বসে কাজী কামালের পাশে ৷ কাজী কামাল প্রদেশের সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড় ৷
জুয়েল বলে, ‘কামাল, তোরে নাকি পাকিস্তান ন্যাশনাল টিমে ডাকছে!’
‘হ ৷’
‘গেলি না ?’
‘কিয়ের ন্যাশনাল টিম ৷ ওয়েস্ট পাকিস্তানে যাব না ৷ জয় বাংলা টিম হইলে যাব ৷’
রুমী বলে, ‘এ্যাসেম্বলিতে যে কী হবে! ভুট্টো তো বলে দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেউ এলে কসাইখানা বানানো হবে ৷’
জুয়েল বলে, ‘জনা তিরিশেক নাকি আইসা গেছে অলরেডি পাকিস্তান থাইকা ৷’
আজাদ বলে, ‘ঢাকাকে রাজধানী বানাতে হবে ৷ সব হেডকোয়ার্টার ঢাকায় আনতে হবে ৷ আর্মিতে বেশি বেশি বাঙালি রিক্রুট করতে হবে ৷ পাটের টাকা সব বাংলায় আনতে হবে ৷ এত দিন ওরা আমাদেরকে কলোনি বানিয়ে রেখেছে, এবার আমরা ওদেরকে কলোনি বানাব ৷ তাইলে না শোধ হয় ৷’
রুমী বলে, ‘ওসব হবে না ৷ তার চেয়ে স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করে দেওয়া ভালো ৷ লেফ্টরা যে ফরমুলা দিয়েছে, ওটাই ভালো ৷ মাও সে তুং তো বলেই দিয়েছেন, বন্দুকের নল সব ক্ষমতার উৎস ৷’
আবার বাউন্ডারি ৷ দর্শকদের হৈ-হল্লা ৷
খেলায় এখন বিরতি ৷ লাঞ্চ পিরিয়ড চলছে ৷ রেডিওতে বারবার বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবেন ৷ সবাই অধীর আগ্রহে রেডিও ধরে বসে আছে ৷ বেলা ১টার দিকে রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা প্রচারিত হতে থাকে ৷ ইয়াহিয়ার নিজের মুখে নয় ৷ অন্য একজন পড়ে শোনায় ৷ পরশুদিন ৩ মার্চ ১৯৭১ থেকে জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন ঢাকায় বসার কথা ছিল, তা অনির্দিষ্ট কালের জন্যে স্থগিত করা হয়েছে ৷ ঘোষণা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো গ্যালারি একযোগে স্লোগান দিয়ে ওঠে, ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা, মানি না মানব না’ ৷ ‘ভুট্টোর পেটে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ৷ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ৷ ‘জয় বাংলা’ ৷ তাকিয়ে দ্যাখো পূর্ব গ্যালারির দিকে ৷ সমস্ত গ্যালারি আগুনে জ্বলে উঠেছে যেন ৷ যার কাছে যা আছে, তাতেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছে দর্শকরা ৷
আজাদ, জুয়েল, রুমী, জামী, কামাল, হিউবার্ট রোজারিও-সবাই সেই মিছিলের অংশ হয়ে যায় আপনা-আপনিই ৷ খেলা বন্ধ ৷ সবাই বেরিয়ে আসছে স্টেডিয়াম থেকে ৷ বিশাল মিছিল শুরু হয়ে যায় স্টেডিয়াম এলাকায় ৷
ঢাকার অন্য এলাকা থেকেও মিছিল আসতে থাকে ৷ পুরো ঢাকাই যেন একটা বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্র ৷ ফুঁসছে, গর্জে উঠছে ৷
রুমী বলে, ‘জামী, চল তোকে আব্বার অফিসে রেখে আসি ৷ নাহলে আবার আব্বা চিন্তা করবে ৷’
রুমী আর জামী মিছিল থেকে বেরিয়ে যেতে চায় ৷ কিন্তু মিছিল থেকে বেরুনো কি সোজা কথা ? চারদিকেই তো মিছিল ৷ চারদিক থেকেই তো আসছে মানুষের স্রোত ৷ সহস্র কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে গগনবিদারী স্লোগান ৷ সবার হাতে লাঠি, রড ৷ মুখে স্লোগান, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ৷
পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিং চলছে ৷ শেখ সাহেব ওখানে আছেন ৷ জনতা পূর্বাণী হোটেলের দিকে চলেছে ৷
আজাদ বলে, ‘এইখানে থেকে লাভ নাই ৷ চল, ইউনিভার্সিটি যাই ৷ ওখানে কী হয় দেখে আসি ৷’ জুয়েল, কাজী কামাল রাজি হয় ৷ তারা হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটির দিকে রওনা দেয় ৷ ওখানেও একই অবস্থা ৷ পুরোটা ক্যাম্পাস একটা বিশাল মিছিলে পরিণত হয়েছে ৷ ‘এক দাবি, এক দফা, বাংলার স্বাধীনতা’ ৷ ‘ভুট্টোর পেটে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ৷
বাসায় ফিরতে ফিরতে মেলা রাত ৷ মা জায়নামাজে ৷ আজাদ এসেছে টের পেয়ে তিনি উঠে আসেন ৷ বলেন, ‘সারা দিন কই ছিলি না ছিলি কোনো খবর নাই ৷ চোখমুখের অবস্থা কী করেছিস! যা, হাতমুখ ধুয়ে আয়!’
আজাদ হাতমুখ ধুয়ে আসে ৷ মা টেবিলে খাবার বেড়ে দেন ৷ আজাদ টিভিটা ছেড়ে খানিক দেখে টেবিলে চলে আসে ৷ ছেলের প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে মা বলেন, ‘আজকেও মিছিলে গিয়েছিলি ?’
আজাদ হাসে ৷ ‘আজকে মা কাউকে মিছিলে যেতে হয় নাই ৷ যে যেইখানে ছিল, সেই জায়গাটাই মিছিল হয়ে গেছে ৷ আমি ছিলাম স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে ৷ গ্যালারিটাই মিছিল হয়ে গেল ৷ তুমি তো স্টেডিয়াম থেকে বের হবে, মানুষের স্রোত ধরে বের হতে হবে, সবাই তো স্লোগান ধরেছে, তারপর রাস্তা, পুরা রাস্তাই মানুষে সয়লাব ৷’
মা বলেন, ‘জায়েদও গিয়েছিল মিছিলে ৷ বাবা রে, মিছিল করা কি তোদের কাজ ? তোরা কি পলিটিঙ্ করে মিনিস্টার হবি! মজিবর মন্ত্রী হলে আমাদের কী, আর ভুট্টো হলেই আমাদের কী!’
‘কী বলো ৷ ভুট্টো কেমনে মন্ত্রী হয়! শেখ মুজিব মেজরিটি পেয়েছে না! আর এইবারের সংগ্রাম তো কে মিনিস্টরা হবে তার জন্যে না, এইবার পাকিস্তানের সাথে বাঙালির ফাইট ৷ এটাতে মা আমাদের অনেক কিছু যায়-আসে ৷’
‘দ্যাখ বাবা ৷ তুই লেখাপড়া শিখেছিস ৷ এখন তো তুই আমার চেয়ে বেশিই বুঝবি ৷ কিন্তু তুই কোনো বিপদ-আপদের মাঝে যাবি না ৷ আহা রে, কত মায়ের ছেলে মারা গেছে জয় বাংলা জয় বাংলা করে ৷ খারাপ লাগে না! আমি তো আমাকে দিয়ে বুঝি ৷ তোর কিছু হলে, আল্লাহ না করুক, আমি সইতে পারব না ৷ শোন, দেশের যা পরিস্থিতি ৷ কখন কী হয়ে যায় ৷ আমি তোকে এমএ পাস করিয়েছি ৷ এখন আমি আমার শেষ কাজটা করে যেতে চাই ৷’
‘কী কাজ ?’ মুখে ভাত থাকতেই গেলাস তুলে পানি মুখে দিয়ে তারপর আজাদ বলে ৷
‘তোর জন্যে আমি পাত্রী দেখছি ৷ আশরাফুলও তো বিয়ে করে ফেলল ৷’
‘তুমি তো মা পাগল আছ ৷ আগে আমার ব্যবসাটা আরেকটু সেটল করুক ৷ হরতাল হরতাল করে তো ব্যবসার দিকে নজরই দিতে পারলাম না ৷’
‘ব্যবসা হবে ৷ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, বিয়ে করলে ভাগ্য খোলে’-মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ৷ হয়তো তাঁর নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে যায় ৷ সবাই বলে, ইউনুস চৌধুরীর সৌভাগ্যের পেছনে ছিল সাফিয়া বেগমের অবদান ৷
‘জুরাইনের বড় হুজুরও বলে দিয়েছেন তোকে বিয়ে দিতে ৷’ মা আরেক চামচ তরকারি আজাদের পাতে তুলে দিতে দিতে বলেন ৷
‘হুজুররে কও আরেকটা বিয়া করতে ৷ তার কপাল খুলুক ৷’
‘তওবা তওবা, এটা তুই কী বললি ?’
‘না, আমি ঠিক তোমাকে হার্ট করার জন্যে বলি নাই ৷ কথার পিঠে বললাম আর -কি এই যে তওবা পড়লাম, তওবা, তওবা…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *