২৫. মা

২৫
আজাদের মায়ের মৃত্যুর পরে আজাদের খালাতো বোন কচিরও কত কথা মনে পড়ে ৷ জন্মাবধি সে তার এই খালার কাছেই মানুষ ৷ ১৯৬৯-৭০ সালে তার বয়স কত আর হবে, ১০/১১ বছর ৷ এই সব সময়ের মধুর সব স্মৃতি তার মনে উঁকি দেয় ৷ তার মনে পড়ে, তাদের খালা সাফিয়া বেগম, যাকে তারা ডাকত আম্মা বলে, সব সময় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন ৷ একবার কী উপলক্ষে কচি বলেছিল দুবলা ঘাস, আম্মা বলেছিলেন, ‘কী বললে, দুবলা নয়, বলবে দূর্বা ৷ শোনো, কলকাতার ভিখারিরাও সুন্দর করে কথা বলে ৷ এসে বলে, মা দুটো চাল দিন না মা! শুনতেও কত ভালো লাগে ৷’
আম্মা সব সময় বই পড়তেন ৷ শরৎচন্দ্র তাঁর ছিল সবচেয়ে প্রিয় লেখক ৷ রবীন্দ্রনাথের বই পড়তেন খুবই মন দিয়ে ৷ বাসায় উল্টোরথ রাখা হতো ৷ আম্মার হাতে থাকত এই পত্রিকাটা ৷ উল্টোরথ-এর গল্প-উপন্যাস তিনি মন দিয়ে পড়তেন ৷
কচিও ছিল গল্পের বইয়ের পোকা ৷ একটা নতুন বই বাসায় এলে কে আগে পড়বে, এই নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো আম্মার সঙ্গে তার ৷ শেষে আম্মাও পড়ছেন, তিনি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে কচিও পড়ছে, এই রকম চলত ৷ তারপর আবার অবসর পেলে আম্মা পড়ার জন্যে বই হাতে নিতেন ৷ নিয়েই বলতেন, ‘কচি…’
‘জি আম্মা ৷’
‘আমার চিহ্ন কই ?’
কচি জিভে কামড় দিত ৷ আম্মা কোন পাতা পর্যন্ত পড়েছেন, একটা চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলেন ৷ এটা সে হারিয়ে ফেলেছে ৷ আজকে যে প্রথম সে পেজ মার্কার হারাল, তা নয় ৷ প্রায়ই সে এই কর্মটি করছে ৷ আম্মার পেজ মার্কার হারিয়ে ফেলছে ৷ বা নিজে পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে গিয়ে পেজ মার্কার ফেলে দিচ্ছে মাটিতে ৷ পরে সেটা তুলে যে পাতায় রাখছে, সেটা আর যা-ই হোক, আম্মার কাঙ্ক্ষিত পাতা নয় ৷
আজাদ দাদাও খুব বই পড়ত ৷ আজাদ দাদা শুধু যে ইংরেজি বই পড়ত, তা নয়, বাংলা বইও পড়ত খুব ৷ আর তার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বন্ধুদের বলত, তোদের জন্যে আমার খুব আফসোস হচ্ছে রে ৷ তোরা রবীন্দ্রনাথ পড়িস না! শরৎচন্দ্র পড়িস না! মানিক, তারাশঙ্কর পড়িস না! তোদের হবে কী ?
একবার আজাদ দাদা একটা মজার কাণ্ড করেছিল ৷ কচিরা গিয়েছিল জোনাকি সিনেমা হলে ছবি দেখতে ৷ মহুয়া, তার বর, আর সে ৷ তারা ফিরে আসার পরে আজাদ দাদার সঙ্গে দেখা ৷
‘কই গিয়েছিলি ?’ আজাদ দাদা বলে ৷
‘সিনেমা দেখতে’-কচি বাসার ভেতরে দৌড় ধরে ৷
‘এই এই, কই যাস ? এদিকে আয় ৷ শোন, হাতমুখ ধুয়ে খেয়েদেয়ে একটা রচনা লিখবি ৷ এই যে সিনেমা হলে যাওয়া থেকে শুরু করে পুরা সিনেমাটা কী দেখলি, এই অভিজ্ঞতাটা নিজের ভাষায় লিখবি ৷’
দাদার আদেশ, তারা ফেলতে পারে না ৷ কচিকে ঠিকই লিখতে বসতে হয় ৷ সিনেমা হলে রিকশায় চড়ে যাওয়া আর ফিরে আসা, মধ্যখানে বাদাম খাওয়া-এসব না হয় সে লিখল ৷ কিন্তু রাজ্জাক আর কবরীর মধ্যে যে ভাব-ভালোবাসা হলো, এই কাহিনী সে এখন কীভাবে লেখে ? রচনার ভেতরে সেসব লেখা যায় ? কচি খুবই মুশকিলে পড়ে যায় ৷
মাঝে মধ্যে আজাদ ডাকত কচিকে, ‘কচি, এদিকে আয় ৷ একটা গান শোনা তো ৷’
আজাদ দাদাকে গান শোনাতে কচির তেমন সংকোচ নাই ৷ কিন্তু পাশেই বাশার দাদা যে রয়ে গেছে ৷ বাইরের মানুষ ৷ তার সামনে কি কচির লজ্জা লাগে না!
‘কী, গা ৷’
কচি হাত কচলায় ৷
‘এখন গান না শোনালে সিনেমা দেখতে যাওয়া বন্ধ ৷ জোনাকিতে ভালো সিনেমা এসেছে ৷’
কচি বলে, ‘কোন গানটা শোনাব ?’
বাশার বলে, ‘ওইটা শোনাও ৷ আমি যে কেবল বলেই চলি, তুমি তো কিছুই বলো না ৷’
কচি আরো লজ্জা পায় ৷ এটা হলো আগন্তুক ছবিতে কবরীর গাওয়া গান ৷ এই গান এখানে গাওয়া যায় ? শেষে আজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর নতুন ছবি দেখতে যাওয়ার লোভে সে গলা খোলে, আমি যে কেবল বলেই চলি, তুমি তো কিছুই বলো না ৷
আর কচির মনে পড়ে, আম্মা তাদের ভাত তুলে খাওয়াতেন ৷ আম্মার প্রত্যেকটা আঙুল সে চেটে চেটে খেত ৷ তবে আম্মার সঙ্গে মাঝখানে তার আর থাকা হয়নি ৷ যুদ্ধের পরে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করেছিল আম্মা রাগ করেছিলেন তার ওপরে ৷ কচি ওই বাসায় যায়নি বহুদিন ৷ এই তো কদিন আগে আম্মা তাঁর জীবনের শেষের দিকে এসে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *