২৪. মা

২৪
আজাদের পরীক্ষা ৷ বাসার সবাই সন্ত্রস্ত ৷ মা কাউকে কথা বলতে দেন না ৷ শব্দ করতে দেন না ৷ সবাই কথা বলে ফিসফিস করে ৷ বাসায় ডিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ ৷ ছেলে যদি পরীক্ষায় যাওয়ার আগে ডিম দেখে তাহলে সে পরীক্ষায় গোল্লা পেয়ে যেতে পারে ৷
সকালবেলা মা চিনির শরবত বানিয়ে আনেন আজাদের সামনে ৷ ‘এই চিনিটা পড়া চিনি ৷ জুরাইনের বড় হুজুর নিজে চিনিতে ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন ৷ বাবা, বিসমিল্লাহ বলে খা ৷ তিন ঢোকে খাবি ৷ আরে কী করিস, বসে খা ৷’
‘কী জিনিস ?’
‘আছে ৷ হুজুর দিয়েছেন ৷’
আজাদ প্রশ্ন না করে খায় ৷ মা আজাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ইনশাল্লাহ পরীক্ষা ভালো হবে ৷’
আজাদ বলে, ‘তুমি দোয়া করলে তো ভালো হবেই ৷’
‘আল্লাহর রহমতে ৷ তবে চেষ্টাও করতে হবে ৷ তুই তো এবার অনেক পড়াশোনা করেছিস ৷’
গোসল সেরে নিয়ে কাপড়-চোপড় পরে আজাদ প্রস্তুত হয় ৷ পাইলট কলম ৷ ইয়ুথ কালি ৷ কলমে সে সকালেই কালি ভরে নিয়েছে ৷ সঙ্গে আরেকটা কলম ৷ পকেটে আইডি কার্ড ৷ সব ঠিক আছে ৷ আজাদ মাকে কদমবুসি করে ৷ মা বলেন, ‘বাবা, বিসমিল্লাহ করে বের হ ৷ ডান পা আগে দিস ৷ পরীক্ষার খাতা হাতে পেয়ে বিসমিল্লাহ বলে আগে রাবি্ব জেদনি এলমান তিনবার পড়বি ৷ ইনশাল্লাহ পরীক্ষা ভালো হবে ৷’
আজাদ বেরিয়ে যায় ৷
মা তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন ৷ ছেলে হেঁটে চলে যায় দৃষ্টির আড়ালে ৷ তবু মা গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন ৷ এটাই ছেলের শেষ পরীক্ষা ৷ এমএ ফাইনাল ৷ এই পরীক্ষায় পাস করলেই মায়ের মিশন শেষ ৷ ছেলেকে নিয়ে তিনি একদিন একবস্ত্রে ইস্কাটনের বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিলেন ৷ তখনও সে স্কুলে পড়ে ৷ ম্যাট্রিকও পাস করেনাই ৷ নাবালক ৷ তাঁর নিজের কী হবে তিনি জানেন না ৷ ছেলের কী হবে, তাও জানেন না ৷ স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসার পর ছেলে স্কুল ছেড়ে দিল ৷ সাফিয়া বেগমের বোন মারা গেল ৷ কী ভীষণ দিন গেছে একেকটা ৷ এমন দিনও গেছে, চাল কেনারও টাকা ছিল না ৷ ছেলে উচ্ছন্নে যাওয়ার জোগাড় ৷ সেখান থেকে সে ফিরে এল ৷ ম্যাট্রিক পাস করল ৷ আইএ পাস করল ৷ বিএ পাস করেছে ৷ এবার এমএ ৷ কূলে এসে গেছে তরী ৷ অচিন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ৷ এখন শুধু বন্দরে ভিড়বার অপেক্ষা ৷ তাঁর নিজের জীবনে তিনি আর কিছু চান না ৷ ছেলের পরীক্ষাটা এখন ভালোয় ভালোয় শেষ হলে হয় ৷ তারপর ছেলের নিজের জীবন সে নিজে গড়ে নেবে ৷ তাঁর কিছু বলার নাই ৷ বাবার বিষয়-সম্পত্তির ভাগ সে পেলে পেল ৷ না পেলেও কিছু যায় আসে না ৷ তিনি নিজের চোখের সামনে আজাদের বাবাকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছেন ৷ বিষয়-সম্পত্তি আসল কথা নয় ৷ আসল কথা হলো ঘরের শান্তি ৷ মনের শান্তি ৷ ছেলেকে তিনি খুব ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দেবেন ৷ লক্ষ্মী শান্ত একটা মেয়ে দেখে ৷ তারপর সংসারের ভার ছেড়ে দেবেন বউমার হাতে ৷ তিনি সংসারের নিত্যদিনের কচকচানির ঊর্ধে উঠে যাবেন ৷ বই পড়বেন ৷ ইদানীং কাজের চাপে আর দুশ্চিন্তায় গল্পের বই পড়া হয় না ৷ শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ বইটা আলমারি থেকে নামিয়ে রেখেছেন, কিন্তু পড়া আর হচ্ছে না ৷
‘আম্মা, কালা মুরগিটা কোনখানে ডিম পাড়ছে দ্যাখো’-মহুয়া চিৎকার করে ৷
‘কোনখানে ?’
‘এই যে স্টোরের চিপায় ৷’
‘কই, দেখি দেখি ৷’
‘দেখবা ৷ তোমার ছেলে না পরীক্ষা দিতে গেছে ৷ তুমি ডিম দেখলে হে ফির গোল্লা পাইব না তো!’
‘তাও তো কথা ৷ তাহলে আমি আর দেখি না ৷ তুই বুঝমতো মিছিল করে রাখ ৷’
মহুয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে-’আম্মা, তুমি যে কী না ৷ দাদায় দেয় পরীক্ষা, আর তুমি ডিম না দেখা নিয়া শাস্ত্র মানো ৷ হিহিহিহিহি ৷ মুরগির ডিম না দেখলেই যদি এমএ পাস দেওন যাইত, তাইলে বহু লোকে এমএ বিএ হইয়া যাইত ৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *