২৩. মা

২৩
বাশার চিঠি লিখেছে আজাদকে ৷ তার পড়াশোনা শেষ ৷ এখন সে আর করাচিতে থাকতে নারাজ ৷ ঢাকায় চলে আসবে ৷ ঢাকায় তার কিছু আত্মীয়স্বজন আছে বটে ৷ তবে সেখানে সে উঠতে চায় না ৷
আজাদ তাকে তাড়াতাড়ি চিঠির জবাব লেখে ৷ ‘তোমার কোনো চিন্তা করার দরকার নাই ৷ তুমি শুধু চলে আসো ৷ ঢাকার মাটিতে পা রাখো ৷ বাকি দায়িত্ব আমার ৷’
এয়ারপোর্টে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আজাদ ৷ বাশার বের হয় ৷ আজাদ তাকে জড়িয়ে ধরে ৷ কত দিন পরে দেখা হলো দুবন্ধুর ৷ প্রায় দেড় বছর ৷
আজাদ ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েই রেখেছিল ৷ তারা ট্যাঙ্েিত ওঠে ৷ তেজগাঁও থেকে মগবাজার ৷ পৌঁছতে বেশি দেরি হয় না ৷
মা তৈরি হয়েই ছিলেন ৷ জানেন আজকে আজাদের করাচির বন্ধু আসবে ৷ তিনি ভালো-মন্দ রান্না করেই রেখেছেন ৷
মগবাজারের বাড়িটায় রুম আছে তিনটা ৷ একটা রুম বাশারের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে ৷
পরদিন বাশার যায় টাঙ্গাইল ৷ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ৷ তার বাবা পুলিশে চাকরি করেন ৷ টাঙ্গাইলে তাদের অনেক বিষয়-সম্পত্তি ৷
দুদিন পরে বাশার ফিরে আসে আজাদদের বাসায় ৷ পড়াশোনা শেষ ৷ এখন চাকরি-বাকরি খোঁজা দরকার ৷ ঢাকায় থাকতে হবে ৷ কোথায় থাকবে!
আজাদের মা মানুষের জন্যে করতে পারলে খুশি হন ৷ আজাদও ভয়ানক বন্ধুবৎসল ৷ আজাদ স্পষ্ট করে বলে দেয় বাশারকে, ‘যত দিন তোমার চাকরি না হচ্ছে, ততদিন তুমি এ বাসায় থাকবা ৷ এই রুমটা তোমার ৷’
বাশার বলে, ‘তা কী করে হয় ৷ আমি একটা রীতিমতো বাইরের লোক ৷ আমার খাওয়া-দাওয়া, থাকা, একটা খরচ আছে না! আজাদ তো এখনও ভালো কিছু করে না ৷ ওর পড়াশোনাও শেষ হয় নাই ৷ এমন না যে বাবার কাছ থেকে ও সাহায্য নেয় ৷’
আজাদের মা বলেন, ‘বাবা, তোমাকে এত চিন্তা করতে হবে না ৷ আমরা যদি খাই, তুমিও খাবে, আমরা যদি না খেয়ে থাকি, তুমি না খেয়ে থাকবে ৷ পারবে না ?’
‘তা পারব ৷’ বাশার মাথা নাড়ে ৷
সেই থেকে বাশার রয়ে যায় এ বাসাতেই ৷
পরে, ইতিহাসের আরেক প্রান্তে দাঁড়িয়ে জায়েদের মনে হবে, আজাদের মায়ের মনে হবে, বাশার এ বাসায় না উঠলেই ভালো করত ৷ মৃত্যুই বোধ করি তাকে টেনে এনেছিল এ বাসায় ৷
বাশার চাকরি খুঁজতে থাকে ৷ কয়েক দিনের মধ্যেই মর্নিং নিউজ পত্রিকায় চাকরিও পেয়ে যায় সে ৷
আজাদের মতো বাশারেরও ঝোঁক ছিল সাহিত্যপাঠের দিকে ৷ নিউমার্কেট গিয়ে সেও বই কেনে ৷ চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে সবার আগে সে আজাদের মায়ের হাতে দেয় কিছু টাকা, বলে, ‘খালাম্মা, আমি তো আপনার ছেলের মতোই ৷ আপনার ছেলে চাকরি করলে নিশ্চয় আপনার হাতে টাকা দেবে ৷ আমিও বেতন পেয়েছি, প্রত্যেক মাসে কিছু কিছু টাকা আমি আপনাকে দেব ৷ আপনি না করতে পারবেন না ৷’
এ কথা শোনার পরে আজাদের মা না-ই-বা করেন কী করে ?
তারপর বাশার যায় নিউমার্কেটে ৷ কিনে আনে পেঙ্গুইন ক্লাসিকের কয়েকটা বই ৷ টলস্টয়ের চাইল্ডহুড, বয়হুড, ইয়ুথ বইটা তার মধ্যে একটা ৷ কিন্তু যতই সে মন দিয়ে বই পড়ুক না কেন, টেলিভিশনে শাহনাজ বেগমের (পরবর্তীকালে রহমতুল্লাহ) গান হলে তাকে ডাকতেই হবে ৷
সে হা করে তাকিয়ে থাকে শাহনাজ বেগমের মুখের দিকে ৷
আজাদ বলে, ‘বাশার, তুমি কি গান শোনো, না গেলো ? তারপর নিজেই খোলাসা করে, মনে হয় তুমি কান দিয়া গান শোনো, আর চোখ দিয়া ছবি গেলো ৷’
বাশারের কানে এসব টিপ্পনি ঢোকে না ৷ সে শাহনাজ বেগমের মুখের দিকে হা করে তাকিয়েই থাকে ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *