২০. মা

২০
গোয়েন্দা হিসাবে জায়েদের তুলনা মেলা ভার ৷ ক্লাস নাইনে পড়া জায়েদ, বাসায় ফিরতে না ফিরতেই আজাদ তার সামনে পড়ে, ‘দাদা, তিনটা টাকা দ্যাও তো!’
‘ক্যান, টাকা দিয়া তুই কী করবি!’
‘টাকা দিয়া আমি কী করি, তুমি তো জানোই ৷ সিনেমা দেখুম ৷’
‘আজকে তো হরতাল ৷ সিনেমা হল খুলবে না ৷’
‘কালকা দেখুম ৷’
‘কালকেও খুলবে না ৷’
‘যেদিন খুলব সেইদিন দেখুম ৷’
‘এখন খুচরা নাই ৷ পরে আসিস ৷’
‘দাদা, আমি কিন্তু আম্মারে কই নাই, তুমি মিছিলে গেছলা!’
‘আমি মিছিলে গেছি তোকে কে বলেছে!’
‘গেছলা ৷ আমি জানি!’
এর পরে তিন টাকা না দিয়ে আর আজাদের কোনো উপায় থাকে না ৷ জায়েদের মুখ বন্ধ করা যায় বটে, কিন্তু মার কাছে ব্যাপারটা গোপন থাকে না ৷
‘কিরে, তোকে দেখতে এমন লাগে কেন ?’ মা তাকে দেখামাত্রই বলেন ৷
‘কেমন লাগে!’
‘চোখ লাল ৷ গা ঘামে ভিজে গেছে!’
‘আরে হরতাল না! গাড়িঘোড়া কিছু আছে নাকি! হেঁটে যেতে হলো ৷ রোদ চড়চড় করছে ৷ তাই ঘেমে গেছি ৷’
আজাদ বারান্দায় গিয়ে জগের পানিতে চোখ ধোয় ৷
‘চোখে কী হলো ?’
‘আরে টিয়ার গ্যাস মেরেছে ৷ মিছিলের পেছনে পড়েছিলাম ৷’
‘তুই মিছিলে গেছিস!’
‘যাই নাই ৷ আমি তো নয়াপল্টন যাচ্ছি ৷ মিছিল আমার আগে আগে যায় ৷ আমি কি আর অত বুঝেছি ৷’
‘না, আম্মা, দাদায় স্লোগানও দিছে’-জায়েদের গলার স্বর ৷
‘ওই ৷ তিন টাকা ফেরত দে’-আজাদ বলে ৷
মা বলেন, ‘আজাদ, তোকে না বলেছি মিছিলে যাবি না ৷ আমার কি সাত-আটটা ছেলে ৷ আমার ছেলে একটাই ৷ তুই ৷ তোকে আমি কি জালিমদের গুলিতে মরতে দেব! কী গোলাগুলিই না করছে ৷ আজকে শুনি ঢাকায় মরেছে তো কালকে টঙ্গীতে, পরশু নারায়ণগঞ্জে ৷ খবরদার, তুই এইসবে যাবি না ৷ নেতারা তো কেউ মরে না, খালি পাবলিক মরে ৷’
জায়েদ বলে, ‘নেতাও মরতেছে ৷ আসাদ মারা গেল না ?’
‘ওই একজন দুইজন ৷ পাবলিক মরে শয়ে শয়ে’-মা বলেন ৷
‘নেতা কি শয়ে শয়ে আছে নাকি! আর আওয়ামী লীগের গুলান তো সব জেলে ৷ বাইরে আছে খালি মওলানা ভাসানি’-আজাদ বলে ৷
মা জগ থেকে পানি ঢালেন আজাদের হাতে ৷ আজাদ চোখ ধোয় ৷ আসলে তার উচিত ছিল রুমাল ভিজিয়ে পকেটে নিয়ে যাওয়া ৷ তাহলে কাঁদানে গ্যাসে তাকে কাবু করতে পারত না-সে ভাবে ৷
মা বলেন, ‘তুই পলিটিক্সের মধ্যে যাবি না ৷ আমাদের কী ?’
আজাদ বলে, ‘পলিটিসিয়ানদের কী ? আমাদের দেশ ৷ করাচি গিয়ে দেখে এসেছি না ওরা আমাদের কী রকম ঠকাচ্ছে ৷’
মা বলেন, ‘আপন বাঁচলে তার পরে না দেশ ৷ তোর কিছু হলে দেশ নিয়ে আমি কী করব!’
আজাদ বলে, ‘আমার কিছু হবে না ৷’
মা আজাদের হাত ধরে বলেন, ‘বাবা রে, তুই এসবের মধ্যে যাবি না ৷ দোহাই লাগে ৷’ মার চোখ জলে ভিজে আসে ৷
আজাদ একটু বিস্মিত হয় ৷ মাকে সে সাধারণত কাঁদতে দেখে না ৷ মাকে তার সব সময়ই মনে হয়েছে যেন এক আশ্চর্য পাথর, যা সব অশ্রু শোষণ করে নেয়, কিন্তু নিজে কখনও গলে না ৷
আজাদ মায়ের কথামতো চলে কিছুদিন ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে সে যায় ৷ ক্লাস হলে ক্লাস করে ৷ ইদানীং প্রায়ই ক্লাস হয় না ৷ ছাত্ররা ১১ দফা দাবি দিয়েছে ৷ তার সমর্থনে মিছিল-মিটিং করে ৷ প্রায়ই সারা প্রদেশে ছাত্রধর্মঘট ডাকে ৷ হরতালও হয় প্রায়ই ৷ আজাদ মিছিলে যায় না ৷ তবে বটতলায় সভা থাকলে মাঝে মধ্যে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গিয়ে অশেপাশে দাঁড়ায় ৷ বক্তৃতা শোনে ৷ বাদাম খায় ৷ সেখান থেকে চলে যায় ব্যবসার ধান্দায় ৷ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয় বলে ব্যবসাপাতিও ভালো হচ্ছে না ৷
ঢাকা যেন তপ্ত কড়াই হয়ে আছে ৷ গতকালকে (১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) সারাটা ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে ৷ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক আর ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক সেনানিবাসের ভেতরে বন্দি অবস্থায় বাথরুমে যাওয়ার পথে গার্ডের বন্দুকের গুলিবষর্ণের শিকার হয়েছেন-এ রকম খবরে এমনিতেই সারাটা বাংলাদেশ ছিল বিক্ষুব্ধ ৷ কালকে সকালে সরকারিভাবেই যখন স্বীকার করা হলো, সার্জেন্ট জহুরুল হক মারা গেছেন, তখন মনে হলো, ঢাকা যেন একটা বারুদের স্তূপ, আর কে যেন তাতে দিয়াশলাইয়ের কাঠি ধরল ৷ মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়ে গেল পুরোটা শহর ৷ যেন এত বিদ্রোহ কখনও দেখেনি কেউ ৷ মিছিল, আগুন, টিয়ার গ্যাস, ফায়ার ৷ সে এক অন্য রকম ঢাকা ৷
আজকে হরতাল ৷ হরতালের পাশাপাশি শুরু হয়েছে নতুন উপদ্রব ৷ কারফিউ থাকে প্রতিদিনই প্রায় ৷ এভাবে ঘরের মধ্যে বসে থাকা যায় ? আজাদ চলে যায় বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় ৷ সৈয়দ আশরাফুল হকদের বাসায় ৷ ওখানে কার্ড খেলাটা জমে ভালো ৷ কিন্তু সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফিরে আসতে হয় ৷ বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ ৷ কারফিউয়ের মধ্যে আটকা পড়লে রাতটা মেসে কাটাতে হবে ৷ চিন্তায় চিন্তায় মা কলজে পুড়িয়ে ফেলবে ৷ পৌনে ৫টার সময় ইস্কাটন থেকে বেরিয়ে আজাদ দৌড় ধরে ৷ তেজকুনিপাড়ায় পৌঁছতে হবে ১৫ মিনিটে ৷ এই সময় কোনো যানবাহন পাওয়া যায় না ৷ সবাই ঊর্ধশ্বাসে যে যার গন্তব্যে ছুটতে থাকে ৷ ব্যাপারটা দেখতে লাগে ভয়াবহ রকম হাস্যকর ৷ মনে হয় বনে আগুন লেগেছে আর চতুষ্পদ প্রাণী সব দৌড়ে পালাচ্ছে ৷
তেজগাঁওয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ৫টা বেজে গেছে ৷ এখনও বাসায় পৌঁছতে অন্তত ১০ মিনিট ৷ তবে বড় রাস্তা ছেড়ে সে ঢুকে পড়েছে পাড়ায়, এটাই ভরসা ৷ বড় রাস্তায় ট্রাকের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে জল্লাদের মতো ভঙ্গি করে সামরিক যান সব চলতে শুরু করেছে ৷ সে চলার গতি দ্রুত করে ৷ একটা বাঁক ঘুরলেই বড় রাস্তা থেকে তাকে আর দেখা যাবে না ৷ সৈন্যরা পাগলা কুত্তার মতো হয়ে গেছে ৷ ইচ্ছা হলেই বন্দুক চালাচ্ছে ৷
আরে বন্দুক চালানোর মধ্যে বাহাদুরি কী আছে! আজাদও বহুত বন্দুক চালাতে পারে ৷ তার বাবার বন্দুকের দোকান ছিল ৷ সে সেখান থেকে বন্দুক ধার নিয়ে শিকারে যেত ৷ তার নিজের কাছে এখনও একটা রিভলবার আছে ৷ লাইসেন্স করা রিভলবার ৷ তার বন্দুকের হাতও খুব ভালো ৷ উড়ন্ত পাখি মেরে ক্লাস এইটে থাকতেই সে সবাইকে একবার তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ৷ ‘বাবা রে ও বাবা, আমারে নিতে যে আইল না, আমি অহন কী করুম ৷ আমারে তো গুলি কইরা মাইরা ফেলাইব’-একটা খোঁড়া ভিক্ষুক চেঁচিয়ে কাঁদছে ৷ আজাদ তাকায় ৷ সন্ধ্যার ফ্যাকাসে আলোয় দেখতে পায়, ভিক্ষুকটার দু পা হাঁটু পর্যন্ত কাটা ৷ একটা বিয়ারিংয়ের চাকার ট্রলিতে সে বসে আছে ৷ আজাদের মায়াই হলো লোকটার জন্যে ৷ তবে পুলিশ মিলিটারি তাকে গুলি করবে-এ রকম ভাবাটা বাড়াবাড়ি ৷ এ গলিতে পুলিশের ঢোকার কারণ আজাদ দেখে না ৷ তার মধ্যে একটা খঞ্জ ফকিরকে ওরা মারবে কেন ? ও কি ৬ দফা চায় নাকি! গুলি না খেলেও লোকটার কপালে দুর্ভোগ থাকতে পারে ৷ আজ রাতে হয়তো তাকে নিতে কেউ আসবে না ৷ লোকটাকে সারা রাত শীতের মধ্যে এখানে থাকতে হবে ৷ আজাদ লোকটার কাছে ফিরে যায় ৷ গায়ের সোয়েটারটা খুলে তার হাতে দিয়ে বলে, ‘তুমি আইয়ুব খান না ৬ দফা ?’
ফকির বলে, ‘আল্লাহ ভরসা বাবা, আমারে যে নিতে আইল না ৷’
আজাদ বলে, ‘আল্লাহর নাম লও আর-কি!’
বাসার সামনে গিয়ে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায় ৷ ‘এটা তোর কী বিচার-’ মা বলেন, ‘কারফিউ শুরু হয়েছে কখন, আর তুই এতক্ষণে এলি! নাহ ৷ এটা তোর একদম উচিত হয়নি ৷ আমি তো চিন্তায় চিন্তায় কাহিল ৷’
‘তুমি চিন্তা মা একটু বেশিই করো ৷ আমি তো ৫টার আগেই গলিতে ঢুকে পড়েছি ৷ একটা নুলা ফকির পড়ে আছে ৷ তাকে নিতে কেউ আসে নাই ৷ আমি তাকে সোয়েটারটা দান করে দিয়ে এলাম ৷ যদি তাকে নিতে না আসে ৷’
মা বলেন, ‘ভালো করেছিস বাবা ৷ তোর অন্তরটা বড় হয়েছে, আমি খুব খুশি ৷’
জায়েদ বলে, ‘ওইটা ফকির না ৷ ওইটা পুলিশের গোয়েন্দা ৷’
মা বিস্মিত, ‘বলিস কি তুই!’
আজাদ বলে, ‘চোপ ৷ বেশি কথা বলে ৷’
এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আজাদের দমবন্ধ লাগে ৷ কী করবে সে! মা চা বানিয়ে মুড়ি মেখে দেন ৷ আজাদ তার ঘরে বসে মুড়ি চিবোয় ৷ বই নিয়ে বসা যায় ৷ এখনও বই পড়ার নেশাটা তার আছে ৷ থ্রি কমরেডস বইটা নিয়ে সে পড়তে বসে ৷ মশা বড় জ্বালাচ্ছে ৷ তা ছাড়া ঠাণ্ডাও খুব ৷ আজাদ বিছানায় উঠে বসে পায়ের ওপরে লেপ টেনে দেয় ৷
সারাটা পাড়া স্তব্ধ ৷ মাঝে মধ্যে কুকুরের ডাক ৷ মনে হয় ভোল্টেজ কম ৷ আলোটা অনুজ্জ্বল দেখায় ৷ লাইটের চারদিকে পোকা উড়ছে ৷ একটা টিকটিকি তার কাছে বসে আছে ওত পেতে ৷
মা রান্নাঘরে ৷ পিচ্চিগুলো তাঁকে সাহায্য করছে ৷ কেউ কেউ পড়তে বসেছে ৷ জায়েদ সব সময়ই শব্দ করে পড়ে ৷ আজও তার ব্যতিক্রম নয় ৷ শব্দ করে পড়ার উদ্দেশ্য যতটা না পড়াটা আত্মস্থ করা, তার চেয়েও বেশি মাকে বোঝানো যে সে পড়ছে ৷
মা মনে হয় মুরগি রাঁধছেন ৷ গরম ঝোলের মসলাঅলা গন্ধ আসছে ৷ আজাদের পেটে খিদেটা চাড়া দিয়ে ওঠে ৷ সে বিছানা ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে যায় ৷ বলে, ‘মা, দেখি তোমার মুরগির ঝোলে লবণ হয়েছে কি না!’
মা একটা চামচে ঝোল তুলে দেন ৷ আজাদ দুবার ফুঁ দিয়ে ঝোলটা মুখে দিয়ে বলে, ‘ফার্স্ট ক্লাস ৷ তবে মা তুমি যে রোজ রাঁধো, নিশ্চয় ঝোল চাখো, নাইলে বুঝবা কেমন করে লবণ হয়েছে কিনা, তাইলে তুমি যে বলো তুমি আমিষ খাও না, এটা তো ঠিক না ৷’
মা হাসেন ৷ বলেন, ‘আমার খাওয়া লাগে না ৷ আমি এমনিই রাঁধতে পারি ৷’
চুলার কমলা আলো এসে পড়েছে মায়ের মুখে ৷ মাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ৷
ঠিক এই সময় বাইরে থেকে স্লোগানের শব্দ আসতে থাকে ৷ এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে মানুষজন সব বেরিয়ে রাস্তায় নেমে যাচ্ছে ৷ জায়েদ ছুটে আসে ৷ ‘দাদা, সবাই রাস্তায় যাইতেছে ৷ চলো আমরাও যাই ৷’
মা বলেন, ‘ব্যাপার কী না বুঝে তোরা কই যাস ৷’
আজাদ বাসার বাইরে এসে দেখে আশপাশের বাসার ছেলেপুলে সব বেরিয়ে এসেছে ৷
‘কী হয়েছে ?’ আজাদ জিজ্ঞেস করে ৷
‘আরে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে মিলিটারি গুলি কইরা তিনজন প্রফেসররে মাইরা ফেলছে ৷ বিবিসিতে কইছে ৷ আবার কালকা সারা দিন কারফিউ ডিক্লেয়ার করছে ৷ তাই শুইনা ক্ষেইপা লোকজন রাস্তায় নাইমা পড়তেছে’-একজন জবাব দেয় ৷
আজাদ ঘরে ফিরে এসে তাড়াতাড়ি একটা প্যান্ট পরে নেয় ৷ একজোড়া কেডস পায়ে দেয় ৷ বিবিসির খবরটা এখন থেকে নিয়মিত শুনতে হবে-আজাদ ভাবে ৷ পারফিউম স্প্রে করার সময় এখন নাই ৷ সে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে ৷ এখানে ওখানে খণ্ড খণ্ড মিছিল ৷ নুলো ফকিরটা পর্যন্ত তার ঠেলাগাড়িতে চড়ে চলেছে স্লোগান দিতে দিতে ৷ তাকে ঠেলছে আরেক ভিক্ষুক ৷
মগবাজার মোড়ে আসতে আসতে মিছিল মহা মানবসমুদ্রে পরিণত হয় ৷ আজাদ মগবাজার মোড়ে তার পরিচিত বন্ধুবান্ধবদেরও দেখতে পায় ৷ আশরাফুল, ওমর, ফারুক, কাজী কামাল, হাবিব-সবাই মগবাজারের মোড়ে মিছিলে অংশ নিচ্ছে ৷ কাজী কামাল আজাদকে দেখে বলে, ‘দোস্তো, সিগারেট দ্যাও ৷’ আজাদ সিগারেটের প্যাকেট বের করে ৷ তারা স্লোগান ধরে : ‘রক্ত দিলেন গুরু, সংগ্রাম হলো শুরু ৷’
দৈনিক ইত্তেফাক-এর রিপোর্টারও শহরে চক্কর দিচ্ছেন ৷ কিছুদিন আগে ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে ৷ আজাদদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ৷ ওমর তাঁকে চেনে ৷ ওমর বলে, ‘ভাইয়া, কী খবর ৷’
রিপোর্টার বলেন, ‘সারাটা শহর মনে হচ্ছে অগি্নগিরি ৷ লাভা বেরুচ্ছে ৷ আজকেই আইয়ুব খানের দিন শেষ ৷’
রিপোর্টার টিকাটুলির মোড়ে অফিসে ফিরে গিয়ে লিখতে বসেন :
গত রাত্রে রাজধানী ঢাকা নগরীতে অকস্মাৎ সান্ধ্য আইনের কঠিন শৃঙ্খল এবং টহলদানকারী সামরিক বাহিনীর সকল প্রতিরোধ ছিন্নভিন্ন করিয়া হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আকিস্মক জলোচ্ছ্বাসের মত পথে নামিয়া আসে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মু্িক্ত ও ‘আগরতলা’ ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে ৷
ইন্ট্রোটা লিখে তিনি চিৎকার ওঠেন, ‘আসগর, চা দে ৷’ আসগর হলো অফিসের পিয়ন ৷ তাকে পাওয়া যায় না ৷ আর দুই বার চিৎকার করার পর একজন সাব-এডিটর এসে জানায়, ‘অফিসে পিয়নরা কেউ নাই ৷ সবাই মিছিলে গেছে ৷’
‘আরে, এ যে কুত্তা খুঁজতে গিয়ে পত্রিকা বের হলো না অবস্থা ৷ কম্পোজিটররা আছে তো!’
‘আছে ৷ আপনে তাড়াতাড়ি লেখেন ৷ সিরাজ স্যারে বইসা আছে ৷ মিজান ভাইয়ে রাজশাহীর নিউজ বানাইতেছে ৷ প্রোক্টর শামসুজ্জোহা মারা গেছেন ৷ আরো ১ জন নিহত, ৪ জন গুলিবিদ্ধ ৷’
‘যতটুকু লিখছি কম্পোজে ধরিয়ে দেন ৷ আমি বাকিটা লিখতে থাকি ৷’
তিনি লিখে চলেন : এই অবস্থার মধ্যে আজ সকাল ৭টা হইতে বৈকাল ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইনের যে বিরতি ঘোষণা করা হইয়াছিল, তাহা অকস্মাৎ প্রত্যাহার করা হয় এবং কোনওরূপ বিরতি ছাড়াই পরবতর্ী ২৪ ঘন্টা সান্ধ্য আইন জারি করা হয় ৷
খোঁজ লইয়া জানা যায়, গতকল্য রাজশাহীতে জনৈক অধ্যাপকের হত্যা এবং সান্ধ্য আইন জারির খবর এখানকার ছাত্র ও সর্বশ্রেণীর নাগরিকের মনে প্রবল অসন্তোষের সঞ্চার করে ৷ তদুপরি গতকল্যকার সংবাদপত্রে আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি সম্পর্কে আশাবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরেও শেখ সাহেব গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের উদ্দেশ্যে গতকাল ঢাকা ত্যাগ না করায় ছাত্র জনমনে এই বিশ্বাস দানা বাঁধিয়া উঠে যে, শেখ সাহেবের মুক্তির ব্যাপারে সরকার আন্তরিক নহেন ৷ বর্তমান প্রচণ্ড গণজাগরণের পটভূমিতে উপরোক্ত দুইটি ঘটনা ছাত্র-জনতাকে ক্ষিপ্ত করিয়া তোলে এবং তাহারা সান্ধ্য আইনের অনুশাসন উপেক্ষা করিয়া দাবি-দাওয়ার প্রতিধ্বনি করিবার জন্য অকস্মাৎ রাস্তায় নামিয়া আসে ৷
কোনও রকম পূর্ব ঘোষণা বা পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই প্রায় একই সঙ্গে শহরের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এইভাবে ছাত্র-জনতাকে রাস্তায় বাহির হইতে দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হয় ৷ রাত্রি ৮টার পর হইতে মধ্য রাত্রি পার হইয়া যাওয়া পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে সমানে বিক্ষোভ চলিতে থাকে ৷
সামরিক বাহিনীর গাড়ির শব্দ এবং বিক্ষিপ্তভাবে বন্দুকের গুলির আওয়াজ পরিবেশকে আতঙ্কগ্রস্ত করিয়া তোলে ৷
পরের দিন ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯-এর দৈনিক ইত্তেফাকে এই রিপোর্ট ছাপা হয় ৷
রাত্রি বেড়ে চলে ৷ বাসার আর সবাই ঘুমে অচেতন ৷ শুধু আজাদের মা জেগে আছেন ৷ আজাদ আর জায়েদ বাইরে গেছে ৷ এখনও ফিরল না ৷ একেকটা বন্দুকের গুলির আওয়াজ হয়, আর মায়ের হৃৎপিণ্ড কেঁপে কেঁপে ওঠে ৷ এই শীতের রাতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যায় ৷
রাত দুটোর দিকে আজাদ আর জায়েদ ফেরে ৷
মা কোনো কথা না বলে খাবার টেবিলের সরপোশগুলো সরাতে থাকেন ৷ বলেন, ‘হাত-পা ধুয়ে আসো ৷ আমি খাবার গরম করি ৷’
ভাত খেতে খেতে আজাদ আর জায়েদ রাস্তায় কোথায় কী ঘটেছে, তার গল্প করতে থাকে ৷
মা বলেন, ‘আজাদ, তোকে যে বলেছিলাম, তুই মিছিলে যাবি না ৷’
আজাদ বলে, ‘মা, আজকা তো এটা মিছিল না ৷ এটা হলো গিয়ে আইয়ুব খানের কুলখানি ৷ আইয়ুব খান আজকেই শেষ ৷ রাস্তায় মানুষ আর মানুষ ৷ এইটাতে যাওয়ায় দোষ নাই ৷ না গেলে দোষ আছে ৷’
মা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন ৷ ছেলে বড় হয়ে গেলে সে বাইরের ডাকে সাড়া দেবেই ৷ মা কি আর তাকে আটকে রাখতে পারবে ? সব মা-ই আটকে রাখতে চায়, কিন্তু কোন মা-ই বা পারে ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *