১৯. মা

১৯
শীতকাল ৷ ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকটায় এসে শীতটা বোধহয় একটু বেশিই পড়েছে ৷ আজাদের ঘুম থেকে ওঠার কথা ছিল সকাল ৮টায় ৷ সকাল ৯টার মধ্যে সে হাজির হবে নয়াপল্টনে ৷ মিন্টু সাহেবের বাসায় ৷ তাঁর সঙ্গে যাওয়ার কথা মতিঝিলে, একটা বীমা অফিসে ৷ ওই অফিসের স্টেশনারি সরবরাহের কাজটা পাওয়ার জন্যে দরবার করতে ৷ কিন্তু সকাল ৮টায় লেপের নিচ থেকে বের হওয়ার ঝক্কিটা কে সামলাবে ? মা এসে দুবার ডেকে গেছেন, ‘আজাদ, আজাদ, ওঠ ৷ ৮টা তো কখন বেজে গেছে!’
আজাদ নিদ্রাজড়িত কন্ঠে বলে, ‘বাজুক ৷ আমাকে ৯টায় ডেকো ৷’ সে মাথার ওপরে লেপ মুড়ে দিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ৷
ও-ঘর থেকে জায়েদের পড়ার আওয়াজ আসছে ৷ জায়েদ জোরে জোরে সুর করে পড়ে ৷
খানিকক্ষণ লেপের ওমের ভেতরে শুয়ে জেগেই ছিল আজাদ ৷ তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে ৷ ঘুমের মধ্যে একটা মিষ্টি স্বপ্ন দেখছিল ৷ এমন সময় আবার মায়ের ডাক ৷ ‘আজাদ, তোর ৯টাও তো পার হয়ে যায় ৷ উঠবি না!’
আজাদ ধড়পড় করে ওঠে ৷ লেপটা গায়ে জড়িয়ে ধরে বিছানা থেকে নামে ৷ ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে লেপটা ছুড়ে মেরে কলতলার দিকে যায় ৷ এক মিনিটে প্রাতঃক্রিয়াদি সেরে প্যান্ট পরে সে রেডি ৷
‘মা, যাইগা ৷’
মা বলেন, ‘নাশতা খেয়ে তারপরে যা ৷ না খেয়ে কই যাবি ?’
আজাদ জানে, মা নাশতা না খেয়ে বাইরে বের হতে দেবেন না ৷ আবার এখন নাশতা খেতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলে তার বড় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৷ মিন্টু ভাই বেরিয়ে যাবেন ৷ কাজেই একটা মিথ্যা কথা তাকে বলতে হবে ৷ ‘মা, নাশতার দাওয়াত আছে এক বাড়িতে ৷ তোমার নাশতা তো এখন খাওয়া যাবে না ৷’
‘একটা টোস্ট বিস্কুট খেয়ে এক কাপ চা খেয়ে যা অন্তত ৷’
‘সময় নাই ৷ ৯টার মধ্যে পৌঁছানোর কথা ৷ এইখানেই ৯টা বেজে গেছে ৷’
‘দ্যাখো তো ছেলের কাণ্ড’-মা হাসেন, ‘তোকে তো আমি ৮টাতেই ডেকে দিয়েছিলাম ৷’
আজাদ একটা সোয়েটার গায়ে চড়াতে চড়াতে দৌড়ে ঘরের বাইরে যায় ৷ তেজকুনিপাড়া থেকে নয়াপল্টন ৷ অনেক দূর ৷ একটা রিকশা নেওয়া দরকার ৷ কিন্তু রাস্তায় আশপাশে সে কোনো রিকশা দেখে না ৷ দোকানপাটও এখনও খোলেনি ৷ ঢাকার দোকানদাররা সব সাহেব, ১০টা-১১টার আগে সাধারণত দোকানের ঝাপ খোলে না, কিন্তু রিকশাঅলাদের কী হলো ? আরেকটু এগিয়ে গেলে আজাদের মনে হয়, এত লোক হেঁটে যাচ্ছে, ব্যাপার কী ? আজকে স্ট্রাইক নাকি ? তাই তো! আজ তো হরতাল হতেই পারে ৷ দুরো শালা, হরতালের দিনে বীমা অফিসের কর্মসূচি রাখাই ঠিক হয়নি ৷ এখন সে এতটা পথ খালি পেটে হেঁটে হেঁটে যাবে নাকি ? পেট খালি, শৌচাগারেও যাওয়া হয়নি, অথচ সামনে দুস্তর পারাবার ৷ আগে মোড়ের চায়ের দোকানে গিয়ে পরোটা আর ডালভাজি খেয়ে নেবে নাকি! কিন্তু চায়ের দোকানটা ঠিক তার মতো ভদ্রলোকের বসার জন্যে উপযুক্ত নয় ৷ রিকশাঅলা শ্রেণীর লোকেরা এটাতে বসে ৷ মাটিতে পুঁতে রাখা গাছের ডালের ওপরে পাতা তক্তা, এই হলো এর আসন, আর তাতে পা তুলে বসে থেকে রিকশাঅলারা ছোট ছোট চায়ের কানা ভাঙা কাপ থেকে চা পিরিচে ঢেলে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে খাচ্ছে, এ দৃশ্য কল্পনা করার সঙ্গে সঙ্গে আজাদ ওখানে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেয় ৷ শীতটা তার শরীর থেকে এখনও যাচ্ছে না ৷ সে তার বিদেশী সিগারেটের প্যাকেটে হাত দেয়, একটা সিগারেট বের করে, লাইটার বের করে অগি্নসংযোগ করে তাতে ৷ খালি পেটে সিগারেট, মা শুনলে কতই না রাগ করবেন, তার মনে হয়!
জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো-স্লোগান শোনা যায় ৷ আজাদ দেখে, অল্প কয়েকজন লোকের একটা মিছিল ৷ মিছিলের মধ্যে আবার বস্তির কয়েকটা ছেলে-ছোকরা ৷ মিছিল তার আগে আগে যাচ্ছে ৷ সে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মনে মনে বলে, আগুন জ্বালিয়েই তো বাবা সিগারেট ধরালাম, আমার কাজ আমি করেছি, এবার তোরা তোদের কাজ কর ৷
সে এগিয়ে যায় ৷ রোদ উঠছে ৷ কুয়াশা কেটে যাচ্ছে ৷ তার এখন একটু একটু করে গরম লাগছে ৷ সে সোয়েটারটা খুলে কোমরে বাঁধে ৷
মিছিলটা ধীরে ধীরে ফার্মগেটের দিকে এগিয়ে যায় ৷ এবং আশ্চর্য, মিছিলের আকার বড় হতে থাকে ৷ আইয়ুব শাহির গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে; আইয়ুব মোনেম দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই ৷ এই স্লোগান শুনে আজাদ একটু চিন্তিত হয় ৷ একটা দড়িতে দুজনকে ফাঁসি দেওয়া বাস্তবে সম্ভব হবে কি না ৷ শুধু দড়ির খরচ বাঁচাতে গিয়ে না আবার আইয়ুব আর মোনায়েম দুই খানই বেঁচে যায় ৷ প্রথম কথা হলো একটা দড়িতে একটা বড় ফাঁস বানিয়ে দুজনের কল্লা একসঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়ার পর তাদের দুজনের গলায় ফাঁস লাগবে কি না ৷ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ না হলে তারা দুজন কি মারা যাবে ? না গেলে কী হবে ? আবার দুজনের ভর একসঙ্গে একটা দড়ি সইতে পারবে কি না ? যদি দড়ি ছিঁড়ে যায়, তাহলে কী হবে ? পড়ে গিয়ে বেটারা ব্যথা পাবে কি পাবে না! ফাঁসির আসামি কোনো কারণে বেঁচে গেলে নাকি মাফ পেয়ে যায়, এই শোনা কথাটা কি ঠিক ?
মিছিল বড় হচ্ছে, আর তার দৈর্ঘ্য বাড়তে বাড়তে একেবারে আজাদের কাছে পর্যন্ত এসে যাচ্ছে ৷ আরে, মুশকিল তো, সে তো মিছিলে নামবে বলে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পথে নামেনি ৷ তার উদ্দেশ্য অত মহৎ নয় ৷ নিতান্তই একটা সাপ্লাইয়ের কাজ পটানোর জন্যে না সে…
‘দোস্তো, আইসা পড়ছ, ভালো ভালো ৷ তুমগো মতো বড়লোকের পোলা আইসা পড়লে না মিছিলে জোশ আহে ৷’ কে ? না খসরু ৷ তার একজন ক্লাসমেট ৷ নিজেও সে বড়লোকের ছেলে ৷ তবে সে নিজেকে শ্রেণীচ্যুত বলে মনে করে ৷ এখন কৃষক-শ্রমিকের নেতৃত্বে একটা বিপ্লব-টিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন দেখছে ৷
জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব ৷
খসরু স্লোগানে কন্ঠ মেলায় ৷ আজাদ বিস্মিত ৷ কারণ শেখ মুজিবকে খসরু নেতা মানে না ৷ মনে করে বুর্জোয়া স্বার্থের বাঙালি প্রতিনিধি ৷
‘কী ব্যাপার, তুমিও শেখ সাহেবের মুক্তি চাও নাকি ?’ আজাদ বলে ৷
‘অফকোর্স চাই ৷ মওলানা কইয়া দিছেন, মজিবররে ছাড়তে হইব ৷ ব্যস, আমি তার লাইনে আছি ৷’
মিছিল আরো বড় হচ্ছে ৷ এখন আজাদের পেছনেও মানুষ ৷ তার পরিচিত আরো আরো লোকজন বন্ধুবান্ধবকে দেখা যাচ্ছে ৷
আজাদ বিস্মিত হয়ে খেয়াল করে, মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে তার ক্লান্তি লাগছে না, অনেকটা পথ যে সে ইতিমধ্যেই পাড়ি দিয়ে এসেছে সে খেয়ালই করেনি ৷ জ্বালো জ্বালো… আবার ধ্বনি ওঠে ৷ আগুন জ্বালো, আজাদ স্লোগানের জবাব দেয় ৷ সে ভেবেছিল, এই জবাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আরেকটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করবে ৷ কিন্তু তা আর করা হয় না ৷ তার হাত আপনা-আপনি মুঠো হয়ে আকাশের দিকে উড়তে থাকে ৷ তখন তার নিজেকে বেশ শক্তিশালী বলে মনে হয় ৷ ইতিমধ্যে তাদের পাশে একটা রায়ট পুলিশভ্যান উদিত হয়েছে ৷ কিন্তু আজাদের বিন্দুমাত্র ভয় লাগে না ৷ মনে হয় এত এত মানুষের শক্তির কাছে ওরা খুবই নগণ্য, খুবই তুচ্ছ ৷
আজাদ মনে মনে বলে, বাবারা, তোমরা আস্তে আস্তে নয়াপল্টনের দিকে চলো ৷ আমার রাস্তা সংক্ষিপ্ত হয় ৷ গন্তব্য কাছে আসতে থাকে ৷ তার মনে হয় এই মিছিলটা একটা ট্রেন, আর সে বিনা টিকেটে এই ট্রেনে উঠে পড়েছে ৷ সে বিনা টিকেটে উঠেছে, কারণ তার উদ্দেশ্য আর মিছিলকারীদের উদ্দেশ্য এক নয় ৷ সে শুধু নয়াপল্টনে মিন্টু সাহেবের বাসা পর্যন্ত পৌঁছতে চায় আর মিছিলকারীরা চায় রাজবন্দিদের মুক্তি, ছাত্রদের ১১ দফার বাস্তবায়ন, আওয়ামী লীগের ৬ দফা অর্জন ৷ কী জানি, সবাইকে সে তো চেনে না ৷ ওদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয় চায় স্বাধীন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা ৷
আজাদ এসবের ঠিক কোনটা যে চায়, সে জানে না ৷ তবে এই শালা আইয়ুব খানটা গেলে সে খুশি হয় ৷ আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকাটা ঠিক পোষাবে না ৷ ওরা শালা বাঙালিদের ঠিক মানুষই মনে করে না, মুসলমানও মনে করে কি না সন্দেহ ৷ করাচিতে দীর্ঘদিন থেকে এ কথাটা সে বুঝে এসেছে ৷ শেখ সাহেব ৬ দফার ব্যাখ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের উদ্দেশে বলেছেন, পাকিস্তানের মোট রাজস্বের শতকরা ৬২ টাকা খরচ হয় দেশরক্ষা বাহিনীতে আর ৩২ টাকা খরচ হয় কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় ৷ এই ৯৪ টাকা পুরাটাই খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানে ৷ অথচ পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস ৷ পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার দুই তৃতীয়াংশ আয় হয় পূর্ব পাকিস্তানের পাট থেকে ৷ শেখ মুজিব এইটা ঠিক বলেছেন ৷ ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাঘডাশে ৷ এত বৈষম্য সহ্য করা যায় না ৷ আবার প্রতিবাদ করলেই গুলি ৷ মিছিল অনেক বড় হয়ে গেছে, আর সামনে কাকরাইলের মোড়ে পুলিশ আর ইপিআর কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে মিছিলের গতিরোধ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে ৷
আজাদের রক্ত গরম হতে থাকে ৷ সে চেয়েছিল অন্তত পল্টন পর্যন্ত মিছিলের সঙ্গে হেঁটে যেতে, আর এ শালারা সেটা করতে দেবে না ৷ কেন ? মিছিল করার অধিকার কি আমাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না ? ওই শালারা, রাস্তা কি তোগো বাপের ? মিছিল করতে দিবি না, কোন আইনে ? আমার টাকায় কেনা গুলি আমার বুকেই মারো ?
হালা, এই ঢিল ল তো ৷
আজাদ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে ৷
মিছিলকারীরা ঢিল পাটকেল সংগ্রহ করতে ব্যস্ত ৷ রাস্তার পিচ্চিগুলোর উৎসাহ, তৎপরতা, সাহস আর সাফল্য বেশি ৷ তাদের ঢিল গিয়ে পড়ছে পুলিশের গায়ে ৷
গুড়ুম ৷ কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়ে মিছিলের অনেক সামনে ৷ জনতা সেই শেল ফেটে যাওয়ার আগেই তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে উল্টো পুলিশের দিকেই ৷ আবার কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়তে থাকে পরপর ৷
ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে এলাকাটা ৷ আজাদের চোখ জ্বালা করতে থাকে ৷ এখন সে করবেটা কী ? সামনের দিকে জনতা, বিশেষ করে খেটে খাওয়া ধরনের মানুষগুলো ঢিল ছুড়েই চলেছে ৷ রাস্তার পিচ্চিগুলোর সাহস তো একেবারেই আকাশছোঁয়া ৷
আজাদ আগুন দেওয়ার জন্যে পকেটের লাইটারটা বের করে, হাতের কাছে কী পাওয়া যায় যাতে আগুন দেওয়া যায় ৷ একটা ইপিআরটিসির বাস পেলে ভালো হতো ৷ কিন্তু চোখ এমন জ্বলছে যে সে আর কিছুই দেখে না ৷ খসরু তার হাতে ধরে টান দিয়ে বলে, ‘আগে চউখে পানি দেওন লাগব ৷ চলো ওই গলির হোটেলে ঢুইকা পড়ি ৷’
আজাদ বাঁয়ের একটা গলির দিকে যেতে থাকে ৷
খসরু বলে, ‘ওইটায় যাইও না, ওইটা কানাগলি ৷ আমার লগে আহো ৷’
আজাদ খসরুর হাত ধরে তার সঙ্গে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *