১৭. মা

১৭
আজাদ টমাস মানের লেখা দি ম্যাজিক মাউন্টেইন পড়ছিল ৷ সম্প্রতি সে পেঙ্গুইনের মডার্ন ক্লাসিক সিরিজের এ বইটা কিনেছে ৩১১ সরকারি নিউমার্কেটের গ্রীন বুক সেন্টার থেকে ৷ কদিন হলো মায়ের শরীর অনেকটা ভালো ৷ মা আগের মতোই হাঁটাচলা করছেন ৷ ছেলের জন্যে নিজ হাতে ভালোমন্দ কোনো কিছু রাঁধা হয়নি ভেবে তিনি অস্থির ৷ বারবার করে বলছেন, ‘ডালু, ও ডালু, একটু বাজার সওদা কর না বাবা ৷ আমি একটু রাঁধি ৷’ আজাদ বলে দিয়েছে, ‘খবরদার মা, শ্বাসকষ্ট নিয়ে চুলার ধারে যাওয়া একদম মানা ৷ ডাক্তার শুনলে মেরে ফেলবে ৷’
মাকে আজকে আর আটকে রাখা যাচ্ছে না ৷ তিনি রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছেন ৷ ভালো ভালো রান্না হচ্ছে ৷
ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে যায় ৷ আজাদের নামে আসা চিঠি ৷ জায়েদ চিঠিটা গ্রহণ করে ৷ দৌড়ে দিয়ে যায় আজাদকে ৷
হাতের লেখা দেখেই আজাদ বুঝতে পারে বাশার লিখেছে ৷ চিঠিটা দেখে তার ভালো লাগে ৷ আবার সে খানিক লজ্জিতও বোধ করে ৷ বাশার বেশ কটা চিঠি তাকে লিখল ৷ কিন্তু সে তার উত্তর দিতে পারেনি ৷ কারণ মায়ের অসুখ ৷ তার ব্যস্ততা ৷ আর চিঠি লেখার ব্যাপারে তার আলস্য ৷ করাচি থেকে মাকে সে বহু চিঠি লিখেছে বটে, কিন্তু ঢাকায় এসে বন্ধুকে চিঠি লেখাটার সঙ্গে তার তুলনা চলে না ৷ প্রথমত মানুষ বিদেশে গেলে মারাত্মকভাবে ভুগতে থাকে আত্মপরিচয়ের সংকটে ৷ তার মনে হতে থাকে, সে যেন নাই হয়ে যাচ্ছে ৷ ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে, প্রথম প্রথম প্রবাসজীবনে প্রবেশ করা মানুষ তেমনি দু হাতে খুঁজে ফেরে তার যত শেকড়-বাকড় ডালপালা ৷ আমি আছি ৷ আমি আছি ৷ তোমরা আমাকে ভুলো না ৷ আর তা ছাড়া মায়ের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, এটা আর কারো সঙ্গে তার সম্পর্কের পাশে তুল্য হতে পারে না ৷ করাচি থেকে হরতালের দিনগুলোতে মাকে সে একবার লিখেছিল :
মা,
কেমন আছ ? আমি ভালোভাবেই পৌঁছেছি ৷ এবং এখন ভালোই আছি ৷ হরতাল বন্ধ হয়ে গেছে ৷ রীতিমতো ক্লাস হচ্ছে ৷ পরীক্ষা শীঘ্রই শুরু হবে ৷ দোয়া কোরো ৷ তোমার দোয়া ছাড়া কোন উপায় নাই ৷ আমি নিজে কী ধরনের মানুষ আমি নিজেই বুঝতে পারি না ৷ আচ্ছা, তুমি বল ত, সব দিক দিয়ে আমি কী ধরনের মানুষ ৷ আমি তোমাকে আঘাত না দেওয়ার অনেক চেষ্টা করি ৷ তুমি আমার মা দেখে বলছি না; তোমার মতো মা পাওয়া দুর্লভ ৷ এই বিংশ শতাব্দীতে তোমার মতো মা যে আছে কেউই বিশ্বাস করবে না ৷ আমি এগুলি নিজ হৃদয় থেকে বলছি, তোমার কাছে ভালো ছেলে সাজবার জন্য নয় ৷ যদি আমি পৃথিবীতে তোমার দোয়ায় বড় বা নামকরা হতে পারি, তবে পৃথিবীর সবাইকে জানাব তোমার জীবনী, তোমার কথা ৷
আমি ভালো পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি ৷
এবং অনেক দোয়া দিয়ে চিঠির উত্তর দিও ৷
ইতি তোমার
অবাধ্য ছেলে আজাদ
আজাদ সত্য সত্য বিশ্বাস করে তার মার মতো মা আর হয় না ৷ বিশ্বাস করে এই মায়ের জীবনী লিখিত হওয়া উচিত ৷ সে যদি কোনো দিন নামকরা হয়, তাহলেই কেবল এই মায়ের জীবনী লিখিত হওয়া সম্ভব ৷ সে-ই লিখবে ৷ লোকে পড়বে, দ্যাখো অমন যে বিখ্যাত লোক আজাদ, তার মায়ের আছে সংগ্রামের এক আশ্চর্য কাহিনী ৷ সেই মাকে সে চিঠি না লিখে কি পারে ? বাশারকেও সে খুব পছন্দ করে ৷ তার চিঠির উত্তরও সে দিতে চায় ৷ দেওয়া হয়ে ওঠে না আর-কি!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আজাদ বাশারের চিঠি খোলে ৷
বাশার লিখেছে :
আজাদ,
প্রীতি আর শুভেচ্ছা রইল ৷ একাধিক পত্র লিখেও কোন উত্তর পেলাম না আমরা ৷ রানাও দুঃখ করে কখনও ৷ আশা করি আল্লাহ্তাযালার কৃপায় ভালো আছ ৷ তোমার ভর্তির কী হলো ? বর্তমানে কোথায় আছ আর কীইবা করছ ? কিছুদিন পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক-ছাত্ররা করাচি এসেছিল ইকোনমিক সেমিনারে ৷ আমরাও তোমাকে আশা করেছিলাম ৷ তাই সেই রাত্রে এয়ারপোর্টেও গিয়েছিলাম রানা আর আমি ৷
আনোয়ারও তোমাকে স্মরণ করে মাঝে মাঝে ৷ আমরা এক প্রকার ৷ তোমরা কেমন ? সামনের জুনের ১০ তাং থেকে আমার এক্সাম শুরু ৷ দোআ কোরো ৷
যাক্ ৷ হোস্টেলে তোমার বেশ কিছু টাকা জমা আছে ৷ তুমি একটা অথরাইজড লেটার আমার নামে পাঠিয়ে দিও- লেটারটাতে প্রভোস্টকে এড্রেস করো ৷
তোমার মা-বাবাকে আমার সালাম দিও ৷ তোমার বন্ধুবান্ধবকে আমার শুভেচ্ছা জানিও ৷ ফরিদের খবর কী ? ওকে আমার কথা বোলো ৷
নববর্ষের শুভেচ্ছা নিয়ে
ইতি
বাশার
পত্রের উত্তর দিও; রানাকে লিখো কিন্তু ৷
চিঠি পড়ে আজাদের করাচির দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায় ৷ রানা, আনোয়ার-এরা সবাই তাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছিল ৷ আসলে বাঙালি সমিতি করতে গিয়ে এদের সবার সঙ্গে সে বেশ প্রীতির বন্ধনেই জড়িয়ে গেছে ৷ ওরা এবার পহেলা বৈশাখ নববর্ষে নিশ্চয় বড় অনুষ্ঠান করেছে ৷ ঢাকাতেও ছায়ানট এবার রমনায় বড় করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসর বসিয়েছিল ৷ কেন যে সরকার এসবে বাধা দেয় ৷ বাধা যত বড় হবে, বাঁধভাঙা স্রোত তত প্রবল হবে ৷ তার সামনে কিছুই টিকবে না ৷ আইয়ুব খান একটা গাধা, মোনায়েম খান আরেকটা বড় গাধা ৷
মা ডাকে, ‘বাবা, গোসল করে তারপর খাবি ?’
‘তাই খাই ৷’
‘যা, তাহলে গোসল করে আয় ৷ তোর বন্ধুদের কেউ আজকে যে এল না ৷’
‘কী জানি! গন্ধ পায় নাই বুঝি ৷ পেলেই আসবে ৷’
আজাদ গোসল করতে যায় ৷ বড় গরম পড়েছে ৷ বৈশাখ মাস ৷ গুমোট গরম ৷ মনে হয় ঝড় আসবে ৷ মা যে কেন গেল এই গরমের মধ্যে রান্নাবাড়া করতে! আবার না তার হাঁপানির টান ওঠে ৷
গোসল করতে বেশ আরাম লাগে ৷ গায়ে অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালার ইচ্ছা হয় ৷ কিন্তু এটা করা উচিত হবে না ৷ এই বাসায় আবার পানির সমস্যা ৷ হিসাব করে পানি খরচ করতে হয় ৷
গোসল করে বেরিয়ে বাইরে এসে দেখে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ৷ এক্ষুনি ঝড় আসবে ৷ কালবৈশাখীর ঝড় ৷ বাতাস বইতে শুরু করেছে ৷ ঠাণ্ডা বাতাস ৷ মেঘের ছোঁয়া লাগা ভেজা বাতাস ৷ কিন্তু সঙ্গে ধুলাবালিও প্রচুর ৷ মা বলছেন, ‘এই, জানলা বন্ধ কর ৷ ঘরে গিয়ে বস, ধুলা ঢুকে পড়ল ৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *