১০. মা

১০
ইউনুস চৌধুরী আজকে বাসাতেই বসেছেন সন্ধ্যাটা যাপন করতে ৷ বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করেছে বাইরে ৷ তিনি বাগানে বসেছেন গার্ডেন-চেয়ার নিয়ে ৷ দখিনা বাতাস মসলার বাগান থেকে সুগন্ধ বয়ে আনছে ৷ বেয়ারা তৎপর ৷ বরফ আসছে ৷ পানীয় ঢালা হচ্ছে ৷ চৌধুরীকে আজ সঙ্গ দিচ্ছেন তাঁর বন্ধু খালাতো ভাই রতন চৌধুরী ৷ আকাশের গায়ে একটা প্রায় পূর্ণ চাঁদ ৷ চাঁদের পাশে ছুটন্ত মেঘগুলো দেখে মনে হচ্ছে, চাঁদটাই ছুটছে ৷ আর মেঘগুলো যেন স্থির ৷ ইউনুস চৌধুরী সেদিকে তাকিয়ে আছেন ৷ ছাত্রাবস্থায় পড়া থিয়োরি অব রিলেটিভিটির কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায় ৷ চাঁদটা স্থির, নাকি মেঘগুলো ? কে জানে রে বাবা ? রাত দশটার পরে তাঁর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না ৷ তিনি নিজের চুল ধরে নিজেই টানতে থাকেন ৷
‘রতন ৷’
‘ভাইজান ৷’
‘সাফিয়া কি আমার বাধ্য হবে না ?’
‘ভাইজান ৷’
‘আমার ছেলেকে কি আমি আর ফিরে পাব না ?’
‘আপনার তো আরেকটা ছেলে হয়েছে ভাইজান ৷ ছোট ভাবি তো মা হয়েছেন!’
‘কিন্তু আমার আজাদকে কি আমি পাব না ?’
‘আজাদ তো আপনার আছেই ভাইজান ৷ ও তো ম্যাট্রিক পাস করেই এসেছিল ৷ বাপকে কি কোনো ছেলে ভুলতে পারে ? রক্তের টান বংশের ধারা কোথায় যাবে ?’
‘কিন্তু সারেংয়ের মেয়েটা কি আমার কথা শুনবে না ?’
‘শুনবে ৷ শুনবে ৷’
‘কবে ?’
‘কোনো বাঘই তো প্রথমে বশ মানে না ৷ সার্কাসের বাঘের কথা বলছি ৷ বাঘকে ধরে ইলেকট্রিক পাওয়ারঅলা চাবুক দিয়ে ভয় দেখানো হয় ৷ আঘাত খেয়ে খেয়ে তারপর বাঘ বশ মানে ৷’
‘বাট হোয়েন উইল শি গিভ ইন ?’
‘টুডে অর টুমরো ৷’
‘তোমার টুডে কবে আসবে ?’
‘টুমরো ৷’
‘তোমার টুমরো কবে আসবে ৷ দি ডে আফটার টুমরো ?’
‘ভাইজান ৷ এক কাজ করেন ৷ ফরাশগঞ্জের বাসা থেকে ওদের উৎখাত করে দেন ৷’
‘বলো কি! আজাদ আমার ছেলে না ?’
‘আজাদকে বলেন এ বাসায় এসে থাকতে ৷’
‘সাফিয়াও তো আমার ওয়াইফ ৷’
‘তাকেও তো আমরা এ বাসায় এসে থাকতে বলছি ৷’
‘তুমি বলছ বাসা থেকে তাড়িয়ে দিলে তারা নরম হবে ?’
‘অবশ্যই ৷ তেজ কমে যাবে ৷’
‘কীভাবে তাড়াব ? আজাদ তো রিভলবার নিয়ে আমাকে মারতে আসবে ৷ ছেলেটা একদম মা-নেওটা হয়েছে ৷ আনলাইক মি ৷’
‘আপনার বাবা-মাও তো আপনার সাথেই আছে ৷ আপনি তাদের যথেষ্ট ভক্তি করেন ৷’
‘করি ৷ জন্মদাতা বাপ, জন্মদাত্রী মা ৷ না করে পারব ? কিন্তু সে তো বাপ মানে না ৷’
‘মানে ৷ তবে মাকে বেশি মানে ৷’
‘শোনো ৷ আই অ্যাম এ জমিনডার ফ্রম বিক্রমপুর ৷ আমার টাকা আছে ৷ আমার পাওয়ার আছে ৷ আমার মেয়েমানুষ থাকবে ৷ থাকবে না ?’
‘জি!’
‘জমিদারদের মেয়েমানুষ থাকত কি না!’
‘হক সাহেব তো জমিদারি রাখল না ৷ কৃষক প্রজা পার্টি করল ৷’
‘এখন হক সাহেব কোথায় ? হয়্যার ইজ হি নাউ!’
‘ভাইজান, আর খাবেন না ৷ ওঠেন ৷’
‘আরে নাইট ইজ স্টিল ইয়াং ৷ বসো বসো ৷’
‘ভাবি রাগ করবেন ৷’
‘কেন করবে ৷ সে জেনেশুনে আমার কাছে এসেছে ৷ শোনো ৷ আজাদকে বলে দাও সে জমিদারের ছেলে ৷ তারও চালচলন হবে জমিদারের মতো ৷’
‘সে তো জমিদারের ছেলে না ৷ সে ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে ৷’
‘কিসের ইঞ্জিনিয়ার ? আই অ্যাম নো মোর ইঞ্জিনিয়ার ৷’
‘দেন ইউ আর আ বিজনেসম্যান ৷ সদাগর ৷ আপনার ফিউডাল নেচার তার রক্তে যাবে কেন ?’
‘বুর্জোয়ারাও ধোয়া তুলসিপাতা নয় ৷ ক্যাপিটালিজম মানে হচ্ছে পাপ ৷ তুমি পাপী ৷ আমি পাপী ৷’
‘আপনি পাপী ৷ আমি না ৷’
‘কী! চোপ শালা! আয়ুব খানের পাকিস্তানে কোনো পাপ নাই ৷ নো ওয়াইন ৷ নো ক্রাইম ৷ চোপ শালা ৷’
‘এই, শালা বলবি না শালা!’
গার্ডেন চেয়ার উল্টে পড়ে ৷ গেলাস কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে ৷ দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে চোপ শালা চোপ শালা বলে চলেন ৷ বেয়ারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ৷
বাতাসের বেগ কমে আসছে ৷ মেঘগুলো এখন স্থির ৷ চাঁদটাকে এখন লাগছে ডিমপোচের কুসুমের মতো ৷ মেঘগুলো যেন ডিমের শাদা অংশ ৷ মসলার গন্ধের বদলে এখন নাকে এসে লাগছে নানা মৌসুমি ফুলের সুঘ্রাণ ৷ পানীয়র গন্ধের সঙ্গে মিশে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত হয়ে উঠছে ৷ দুজন মধ্যবয়স্ক লোক গালাগালি ছেড়ে এখন গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছে ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *