০৫. মা


গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন জাহানারা ইমাম, জুরাইন গোরস্তানের বাইরে; ভেতরে অল্প কজন আত্মীয় আর বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা দাফন করছিলেন আজাদের মাকে ৷ হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে জাহানারা ইমাম বেরিয়ে আসেন গাড়ি থেকে ৷ তাঁর কী হয় তিনিই জানেন ৷ তাঁর মতো স্নিগ্ধরুচি সূক্ষ্ম আচারবোধসম্পন্ন মানুষের এ রকমটা করার কথা নয়-দিনের বেলা বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে সেধে সেধে ভেজা ৷ জাহানারা ইমাম তা করেন ৷ গোরস্তানের ফটকের কাছে বসে থাকা ভিক্ষুকেরা তাদের বিলাপ ও যাচনা বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, এক ভদ্রমহিলা অকারণে হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে ভিজছে ৷ কারণটা তারা আন্দাজ করতে পারে না, এবং সেটা নিয়ে গবেষণা করার আগেই তাদের নিজেদের মাথা বাঁচানোর জন্যে সচেষ্ট হতে হয় ৷ এভাবে বৃষ্টিতে ভেজার কারণটা স্বয়ং জাহানারা ইমামও ধরতে পারেন না ৷ শুধু আবছা একটা অনুভব, হয়তো বেহেশতের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে, আর শহীদেরা, তাঁর রুমীরা, আজাদেরা আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করছে ৷ এই বৃষ্টি যেন বৃষ্টি নয় ৷ আর এই যে সুবাসটা, না, এটা আতরের নয়, গোলাপজলের নয়, লোবানের নয়, এ হলো বেহেশ্ত থেকে নেমে আসা অপার্থিব সৌরভ ৷ দাফন শেষ করে বাচ্চু, শাহাদত, কাজী কামাল, হ্যারিস, হাবিবুল আলম প্রমুখ ফিরে এলে জাহানারা ইমাম সংবিৎ ফিরে পান ৷ তিনি গাড়িতে ওঠেন ৷ তাঁর গাড়িতে কেউ কেউ লিফ্ট নেয় ৷ গাড়িতে উঠেও এই মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই বৃষ্টিতে ভেজার ব্যাপারটা নিয়ে কোনো কথা বলে না ৷ কারণ তারা নিজেরাই ঘোরগ্রস্ত ৷ কেবল তরুণ ড্রাইভার বলে, ‘খালাম্মা, তোয়ালে দিব, মাথা মুছবেন নাকি ?’ জাহানারা ইমাম মাথা নাড়েন না-সূচক ভঙ্গিতে ৷ গাড়ি চলতে থাকে ৷ তিনি প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের শেষ গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের বাসা কণিকায় ফিরে আসেন ৷ স্মৃতির দংশন তাঁকে অস্থির করে তোলে ৷
আজাদের বাবার সঙ্গে জাহানারা ইমামদের পরিচয় মেছের নামে তাঁদের এক ভাগ্নের মাধ্যমে ৷ জাহানারা ইমাম কয়েকবার গেছেন আজাদদের ফরাশগঞ্জের বাড়িতে ৷ ইস্কাটনের বাড়িতে গেছেন অনেকবার ৷ সঙ্গে থাকত তাঁর দুই ছেলে রুমী আর জামী ৷ জামী তখন খুবই ছোট ৷ রুমীর সঙ্গে খুব সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় আজাদের ৷ এত বড় বাড়ি পেয়ে রুমী তো আনন্দে অস্থির হয়ে যেত ৷ এই লংপ্লে রেকর্ড চালাচ্ছে, এই টেপ রেকর্ডার নিয়ে ছড়া টেপ করছে, এই আবার যাচ্ছে হরিণ দেখতে ৷ আজাদ বলেছে রুমীকে, একটা বাঘও আনার কথা ছিল ৷ কিনেও নাকি ফেলেছিলেন আজাদের বাবা ৷ কিন্তু আনার পথে বাঘটা মরে যায় ৷
আজাদের মা খুবই পছন্দ করতেন রাঁধতে ৷ রেঁধে মেহমানদের খাওয়াতে ৷ বাসায় বাবুর্চি ছিল ৷ কাজের লোকে গমগম করত বাড়িটা ৷ তবু জাহানারা ইমামদের জন্যে নিজ হাতে নানান পদ রেঁধে তাঁদের খাওয়ানোর জন্যে তিনি উদ্বেল হয়ে উঠতেন ৷ জাহানারা ইমাম বলতেন, ‘আপা, আপনি বসেন ৷ আমরা কি খেতে এসেছি, নাকি আপনার সাথে গল্প করতে এসেছি ?’ আজাদের মা হাসতেন ৷ স্মিত স্নিগ্ধ হাসি ৷ কথা তিনি বেশি বলতেন না ৷ কিন্তু হাসিটা দিয়েই যেন অনেক কথা বলা হয়ে যেত ৷ বলতেন, ‘পান খান ৷ রেকর্ডের গান শোনেন ৷ আপনি তো দেখতে লোকে বলে সুচিত্রা সেনের মতো ৷ সুচিত্রা সেনের সিনেমার গানের রেকর্ড আছে শোনেন ৷ আমি আগে সিনেমা থিয়েটার দেখতাম ৷ এখন আর দেখি না ৷ আপনি বোন বসেন ৷ আমি যাব আর আসব ৷ রুমী কী খেতে পছন্দ করে ? জামীর জন্য কি আলাদা কিছু রাঁধতে হবে ? আপনার সাহেবকে আনেননি কেন ?’
পানের একটা রেকাবি জাহানারা ইমামের সামনে রেখে আজাদের মা রান্নাঘরে চলে যেতেন ৷ এই রেকাবিটাও ছিল যেন শিল্পকর্মের একটা অপূর্ব নিদর্শন ৷ কত ধরনের জর্দাই না তাতে থাকত ৷ একেকটা খোপে একেক রকম জর্দা আর তবক সাজানো ৷ আজাদের মা বলতেন, ‘এটা হলো কিমাম জর্দা, এটা হলো কস্তুরি ৷ পাকিস্তান থেকে আনানো ৷’ জাহানারা ইমাম তেমন পান খেতেন না ৷ আজাদের মাকে খুশি করার জন্যে খানিকটা মুখে দিতেন ৷
টমি নামে আজাদদের পোষা কুকুর ছিল একটা, স্প্যানিয়েল ৷ এসে জাহানারা ইমামের গায়ের ঘ্রাণ নিত ৷ এই কুকুর দেখে রুমী আর জামীর শখ হলো তারা কুকুর পুষবে ৷
রুমীদের পোষা কুকুর মিকি মারা গেছে একাত্তরের ২৫শে মার্চের রাতে ৷ আজ থেকে ১৪ বছর আগে! জাহানারার বুক চিরে শুধুই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায় ৷ রুমীর ১৪তম মৃতু্যদিনও হয়তো সামনের কোনো একটা দিন ৷ এই সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ হলেও হতে পারে ৷ রুমীর বাবা শরিফ ইমামও আজ ১৪ বছর হলো নাই ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *