রহস্যভেদী – ০৫

কিরীটী ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিতে যেতেই আর্তস্বরে পিসিমা বলে উঠলেন, না না–নিভিও না।
কিন্তু তবু কিরীটী আলোটা নিভিয়ে দিল, না পিসিমা, আলোটা না নিভিয়ে দিলে সে ধরা পড়বে। তাতে আপনার লজ্জা আরো বেশী হবে।
নিঃশব্দে সে পালিয়ে যাক। ধরা পড়লে যে কলঙ্ক হবে, তা থেকে তাকে বাঁচানো মুশকিল হবে। ভয় নেই পিসিমা আপনার কোন ক্ষতি হবে না। কত বড় দুঃখে যে আপনি এ কাজে হাত দিয়েছেন, আপনি না বললেও তা আমি বুঝতে পারছি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। কিরীটীর কথার কখনো খেলাপ হয় না।
সহসা পিসিমা কিরীটীর দু হাত চেপে ধরে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়লেন, শম্ভুকেও বাঁচাও কিরীটী। সে আমার ছেলে। আজ তোমাকে আমি সব খুলে বলব। দীর্ঘদিন এই দুঃসহ ব্যথা ও লজ্জা আমি বুকে চেপে বেড়াচ্ছি। লোকে জানে শম্ভু মারা গেছে, কিন্তু আসলে তা নয়। শম্ভুর যখন তেরো বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে মানুষ করতে আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু অসৎ সঙ্গে মিশে সে গোল্লায় গেল। চোদ্দ বছরের বয়সের সময় সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। দু বছর কত খুঁজছিলাম, কিন্তু তার কোন সন্ধানই পেলাম না। শেষে দাদার এখানে চলে এলাম। দীর্ঘ এগার বছর পরে দিনদশেক আগে কালীঘাটের মন্দিরে সন্ধ্যার সময় তার সঙ্গে দেখা হল। তাকে দেখেই আমি চিনেছিলাম। সে আমাকে কালীমন্দিরে দেখা করবার জন্য আগে একটা চিঠি দিয়েছিল। সঙ্গদোষে আজ সে অধঃপতনের শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। রোগজীর্ণ কঙ্কালসার দেহ। বোধ হয় আজ আর তার কোন নেশাই বাদ নেই।
আর তার নেশাই বাদ নেই।
কাঁধের ওপরে তার একরাশ ধার। যার কাছ থেকে সে টাকা ধার নিয়েছে, সে শাসিয়েছে আগামী দশদিনের মধ্যে টাকা না শোধ করতে পারলে তাকে তারা জেলে দেবে। তাই সে আমার শরণাপন্ন হয়েছে। কিন্তু আমি বিধবা, মান খুইয়ে ভাইয়ের সংসারে এসে পড়ে আছি, কোথায় আমি টাকা পাব? একটা কাজ করতে পারলে একজন তাকে এক হাজার টাকা দেবে বলছে। সে কাজ হচ্ছে দাদার সিন্দুক থেকে সোনারপুরের বাড়ির দলিলটা এনে দেওয়া। শুনে ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু সে কাঁদতে লাগল, টাকা না পেলে তাকে জেলে যেতে হবে। আর কোন উপায়ই নেই। হায় রে মায়ের প্রাণ!…তিন রাত বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করছি; শেষে সন্তানের দাবিই জয়ী হল। কি করে যে দলিলটা চুরি করেছিলাম, সে লজ্জার কথা আর বলতে চাই না বাবা তোমার কাছে। কথা ছিল পরের দিন রাত্রে সে বাগানে এসে দাঁড়াবে এবং শিস দেবে, আমি দলিলটা জানালা দিয়ে নীচে ফেলে দেব। কিন্তু সব গোলমাল হয়ে গেল। তাই আজ এসেছিলাম এ ঘরে–আলোর নিশানা তাকে জানাতে।…আমার মানসম্ভ্রম আজ সবই তোমার হাতে বাবা। পিসিমা কাঁদতে লাগলেন।
কাঁদবেন না পিসিমা, চুপ করুন। আমি জানি দলিলটা কোথায়। এ কাহিনী আমি ছাড়া আর কেউই জানতে পারবে না। আপনি নীচে যান। যা করবার আমি করব।
পিসিমা নিঃশব্দে নীচে চলে গেলেন। কিরীটীও নীচে গেল। সলিল তখনো আলমারির পিছনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।
সলিল বেরিয়ে আয়! ডাকলে কিরীটী।
সলিল আলমারির পিছন থেকে বের হয়ে এল, কি ব্যাপার?
দলিল পাওয়া গেছে।
সত্যি?
হ্যাঁ–বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে কিরীটী মধুসূদনের বাবার ফটোর পিছন থেকে খামসমেত দলিলটা বের করে দিল।…পাশের ঘরে মধুসূদনবাবু তখনো জেগেই বসে ছিলেন, কিরীটীর সঙ্গে সলিল গিয়ে মধুসূদনের হাতে দলিলটা দিল।
মধুসূদন বিস্ময়ে একেবারে থ হয়ে গেছেন যেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে পেলে?
ঐটি আমাকে মাফ করতে হবে কাকাবাবু। আমি বলতে পারব না কেমন করে কোথায় পেলাম এবং কে চুরি করেছিল!
বেশ। কিন্তু অপরাধীর শাস্তি হওয়া প্রয়োজন, এ কথা তো মানো তুমি?
কাকাবাবু, পৃথিবীতে সব অপরাধেরই কি শাস্তি হয়? আপনার দলিলের প্রয়োজন, দলিল পেয়েছেন। আর একটা অনুরোধ আপনার কাছে–এ বিষয় নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতে পারবেন না আপনি।
বেশ তাই হবে।
এর পরদিন কিরীটী এক হাজার টাকা এনে পিসিমার হাতে দিল।
এ টাকা কিসের কিরীটী? পিসিমা জিজ্ঞেসা করলেন।
শম্ভুকে দেবেন পিসিমা। আর তাকে বলবেন এবার সৎপথে চলতে। ওপথে কেবল দুঃখই বাড়ে, সুখ নেই। এটা আমার প্রণামী পিসিমাকে।
একটা কথা কাল থেকে কেবলই আমার মনে হচ্ছে বাবা, কী করে তুমি জানতে পেরেছিলে?
কিরীটী তখন মধুসূদনের কথাগুলো আগাগোড়া বলে গেল। প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, কোন বাইরের লোক দলিল চুরি করতে পারে না। নিশ্চয়ই কোন ঘরের লোক এ কাজ করেছে। কিন্তু কে? বাড়ির লোকজনের মধ্যে আপনি, সলিলের কাকা, এ ছাড়া আর কাউকেই সন্দেহ করা যায় না–এবং বুঝেছিলাম দলিল এখনও বাড়ির বাইরে যায়নি এবং শীঘ্রই সেটা বাইরে যাবে। দ্বিতীয় রাত্রে চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সংগ্রহকারী বিফল হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। আবার সে আসবেই, তাই সব আঁটঘাট বেঁধে আমি কাজে নেমেছিলাম। তবে আপনাকে আমি একেবারেই সন্দেহ করিনি–করেছিলাম সলিলের কাকাকে। আপনাকে চিলেকোঠায় দেখে সত্যিই চমকে গিয়েছিলাম। কাকাবাবুও বাবার ফটোটা একটা কাত হয়ে ছিল, কিন্তু মনে একটা খটকা লাগলেও সেটা খুঁজে দেখিনি। পরে আপনার কথা শুনে বুঝেছিলাম, তাড়াতাড়িতে আপনি ফটোর পিছনে দলিলটা রেখে পালিয়ে এসেছিলেন।
সত্যিই তাই, দাদার পায়ের শব্দ পেয়ে আমি ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঘরের লোকই যে নিয়েছে তা তুমি বুঝলে কি করে?
কাকাবাবুর একটি মাত্র কথায়। পায়ের শব্দ শুনে তিনি যখন পাশের ঘরে আসেন, তখন দরজাটা খোলা ছিল পাশের ঘরের এবং তিনি দেখেছিলেন কাউকে পালিয়ে যেতে, তারপর নীচে গিয়ে দেখলেন, বাইরে যাওয়ার দরজাটা তালা দেওয়া। তাতেই বুঝেছিলাম বাইরের কেউ নয়, ভিতরেরই কেউ।…আচ্ছা পিসিমা, আজ তবে আসি।
কিরীটী পিসিমাকে প্রণাম করে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

(সমাপ্ত)