রহস্যভেদী – ০৩

চা-পানের সঙ্গে সঙ্গে নানা আলাপ আলোচনা চলছিল।
হঠাৎ একসময় মধুসূদন বললেন, তুমি বোধ হয় জান না কিরীটী, ঐ দলিলটার একটা পূর্ব ইতিহাস আছে।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, সলিলের মুখে গতকাল অনেকটা শুনেছি কাকাবাবু এবং সে ইতিহাস শোনবার পর থেকেই আমার মনে একটা অদম্য স্পৃহা জেগেছে দলিলটা খুঁজে বের করবার। আচ্ছা দলিলটা চুরি যাওয়ার আগের দিন থেকে এবং আপনি যখন জানতে পারলেন দলিলটা সিন্দুকে নেই, ঐ সময়কার সমস্ত ঘটনা যতটা আপনি জানেন, একটু বাদ না দিয়ে আমাকে সব বলতে পারবেন কাকাবাবু?
মধুসূদন কী যেন একটু ভাবলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, দলিলটার পূর্ব ইতিহাস যখন তুমি সলিলের মুখে শুনেছই, তখন সেটার আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। দলিলটা যে সিন্দুক থেকে কি করে চুরি যেতে পারে, এখনো তার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই ভেবে স্থির করতে পাচ্ছি না। তবে স্থূল চক্ষে দেখতে পাচ্ছি, দলিলটা চুরি গেছে এবং এখন সেইটাই সবচাইতে বড় কথা। বাড়িতে লোকজনের মধ্যে আমি, বিপিন, দিদি, সলিলের মা আর সলিলের তিন বোন। প্রতিদিন আমি বিকেল পাঁচটার মধ্যেই দোকান থেকে ফিরি। কিন্তু পরশু ফিরতে আমার রাত্রি নটা হয়ে যায়। সকালবেলা দোকানে যাওয়ার আগে সেদিন সিন্দুক খুলে যখন কয়েকটা আবশ্যকীয় কাগজপত্র রাখছি, দলিলটা তখনো সিন্দুকেই ছিল মনে আছে।
আপনার দেখতে ভুল হয়নি তো কাকাবাবু?
দেখবার ভুল আমার কোন দিনই হয় না বাবা, তা হলে এত বড় ব্যবসাটা চালানো আজ কষ্টকর হত। যাহোক শোন। দলিলটা তখনও সিন্দুকেই ছিল। সেই রাত্রে একটা ব্যাপার ঘটেছিল; প্রথমে ভেবেছিলাম তার হয়তো কোন গুরুত্ব নেই, কিন্তু পরে অনেক ভেবে মনে মনে হচ্ছে যে ব্যাপারটার সঙ্গে কোথাও দলিল চুরি যাওয়ার একটা সূত্র জট পাকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। রাত্রি তখন বোধ করি একটা হবে। রাত্রে আমার তেমন সুনিদ্রা হয় না কিছুদিন থেকে। সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সেদিন বড় ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমটা যেন বেশ গাঢ়ই হয়ে এসেছিল। হঠাৎ একটা খস্‌খস্‌ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ভাবলাম ও কিছু নয়। কিন্তু তবুও কান খাড়া করেই রইলাম। আবার খস্‌খস্‌ শব্দ কানে এল, শব্দটা যেন পাশের ঘর থেকেই আসছে মনে হল। ভাবলাম হয়তো বেড়াল হবে। হঠাৎ একটা ক্যাঁচ করে শব্দও হল। এবার আর দেরি না করে উঠে পড়লাম। ঘরের বাতি নিভানো। ডায়নামো রাত্রি এগারটার পর বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে মোমবাতি থাকে, প্রয়োজন হলে তাই জ্বালানো হয়। শয্যা থেকে উঠে শিয়রের কাছে রক্ষিত মোমবাতিটা হায়ে নিয়ে নিঃশব্দে পাশের ঘরের দিকে চললাম। পাশের ঘরটা খালি। কিন্তু বারান্দার দিকের দরজাটা হা-হা করছে, খোলা। ও দরজাটা চিরদিন আমি নিজ হাতেই বন্ধ করে শুই, সেদিনও তাই করেছিলাম। কেমন খটকা লাগল। তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে বাইরে বারান্দায় এলাম। আকাশে সামান্য একটুখানি চাঁদ; তারই অস্পষ্ট আলোয় মনে হল, যেন কে দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। মোমবাতিটা চট্‌ করে নিভিয়ে দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম; কিন্তু আর কিছুই চোখে পড়ল না। তবু নীচে পর্যন্ত গেলাম। বাইরে যাবার দরজা বন্ধ। মানে রাত্রে ওটা তালা দেওয়া থাকে কিনা বরাবর। তোমার কাকীমাই প্রত্যহ রাত্রে শুতে যাবার আগে তালা দিয়ে যান, আবার সকালে উঠে তালা খুলে দেন। নীচের তিনটে ঘরও বন্ধ, ঠেলে দেখলাম। হয়তো ব্যাপারটা আগাগোড়া আমার চোখের ভুল হতে পারে। ঘুমের চোখে উঠে গেছি। কিন্তু মনের খুঁতখুঁতুনিটা কিছুতেই যেন গেল না। নীচেরটা পর্যন্ত তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করেও কিছু পেলাম না। সকালে উঠে দারোয়ান চন্দন সিংকে ও গুরবলিকে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তারাও বলতে পারলে না। শেষ নটার দিকে সিন্দুক খুলে দলিলটা নিতে গিয়ে দেখি সিন্দুকে দলিল নেই। যথারীতি খোঁজাখুঁজি করে বাধ্য হয়ে শেষটায় পুলিসে সংবাদ দিলাম। গতকাল রাত্রে, তখন বোধ করি সাড়ে বারোটা হবে, আমার শোবার ঘরের সংলগ্ন ব্যালকনিতে চুপচাপ চেয়ারটায় অন্ধকারে বসে আছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম ব্যালকনির নীচে থেকে যেন একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ। চমকে উঠে দাঁড়ালাম এবং অন্ধকারে ঝুঁকে নীচে বাগানের দিকে তাকালাম। অন্ধকারে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। আর দেরি না করে তক্ষুন চিৎকার করে গুরবলিকে ডাকলাম। সঙ্গে সঙ্গেই নীচের বাগানে কে যেন দ্রুতপদে ছুটে পালিয়ে গেল, তার স্পষ্ট শব্দ পেলাম। তোমার কাকীমার কাছ থেকে তখুনি চাবি নিয়ে নীচের দরজা খুলে বাইরে গেলাম। তারপর দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বাগানটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু দেখতে পেলাম না। কিন্তু টর্চের আলোয় বুঝতে পারলাম, ব্যালকনির নীচে কেউ কিছুক্ষণ আগে দাঁড়িয়ে ছিল, কেননা ঐ জায়গায় কতকগুলো নতুন ফুলের চারা লাগানো হয়েছে, মালী সেখানে বিকেলের দিকে জল দিয়েছিল। নরম মাটির ওপরে অনেকগুলো জুতোর ছাপ পড়েছে।…
কিরীটী এতক্ষণ গভীর মনোযোগের সঙ্গে মধুসূদনের কথা শুনছিল, একটা কথাও বলেনি। হঠাৎ সে ধীর সংযত ভাবে বললে, দলিলটা বোধ হয় আপনার পাওয়া যাবে কাকাবাবু। আচ্ছা পুলিসের কাছে কি এসব কথা আপনি বলেছেন কাকাবাবু?
না। হয়তো তারা হাসবে এই ভয়ে বলিনি।
বেশ করেছেন, এখনও বলবেন না। তবে একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।
কী?
দিনরাত্রি গোপনে বাড়ির আশেপাশে পাহারা রাখতে হবে এখন থেকে।
সে আর এমন কঠিন কি? আমার বাড়িতে তিনজন দারোয়ান আছে এবং দোকানে দুজন আছে। দোকান থেকে একজনকে নিয়ে আসব; চারজন অনায়াসেই পাহারা দিতে পারবে।
আপনি এখুনি সেই ব্যবস্থা করুন। আপনাকে আর আপাততঃ আমার প্রয়োজন হবে না।
এরপর মধুসূদনবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
মধুসূদন চলে গেলে কিরীটী ওঁর কাছে শোনা কথাগুলো আগাগোড়া আর একবার মনে মনে বিশ্লেষণ করে দেখল। চাবির রহস্যটা কিছুতেই সে যেন উদ্ধার করতে পারছে না। চাবিটা চুরি গিয়েছিল এ বিষয়ে কোন ভুলই নেই। কিন্তু কেমন করে চুরি গেল সেটাই রহস্য। কে চুরি করতে পারে? কার দ্বারা চুরি হওয়া সম্ভব? সহসা তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একটা পথ সে অস্পষ্ট যেন দেখতে পাচ্ছে। তাই যদি হয়, তবে চাবি চুরিরও একটা মীমাংসা পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে মধুসূদনের কাহিনীরও একটা মীমাংসা আপাততঃ খাড়া করা সম্ভবপর। কিন্তু তাও কি সম্ভব? সম্ভবই বা নয় কেন? এ দুনিয়ায় মানুষ স্বার্থের জন্য করতে না পারে এমন কিছু আছে কি? কিন্তু স্বার্থটা কোথায় এবং কার?
কি ভাবছিল কিরীটী? সলিল প্রশ্ন করে।
আজকের রাতটা জাগতে হবে সলিল, পারবি তো?
নিশ্চয়ই পারব।
তবে শোন্‌ কি করতে হবে আমাদের। ঐ আলমারিটার পিছনে তোকে আজ রাত্রি দশটার পর থেকে অতি গোপনে থাকতে হবে। আর আমি থাকব তোদের ছাদের ওপরে চিলেকোঠার মধ্যে। সন্ধ্যার পরই আমি সে ঘরে যাব। যতক্ষণ না আমার বাঁশীর আওয়াজ পাবি বের হবি না।
বেশ। কিন্তু চিলেকোঠাটা তো ভীষণ নোংরা হয়ে আছে।
ক্ষতি নেই তাতে এতটুকু।