১৮. বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস

বিদ্যাপতির প্রথম জীবনের প্রেরণা আসিয়াছিল জয়দেবের গীত-গোবিন্দ হইতে। বাক্যের পারিপাট্যে, ছন্দের ঝঙ্কারে এবং অলঙ্কার শাস্ত্রানুগত নায়ক-নায়িকার চিত্রাঙ্কণে রাজকবি বিদ্যাপতি দরবারী সাজেই দেখা দিয়াছেন। শিবসিংহ, লছিমাদেবী ও মিথিলার বড় বড় পণ্ডিতগণ তাঁহার শ্রোতা। কোন স্থানে শব্দের অপপ্রয়োগ ছন্দ ও কাব্যশ্রীর চ্যূতি বিচ্যূতি হইলে তিনি রেহাই পাইতেন না। বিদ্যাপতি স্বয়ং সুপন্ডিত ছিলেন এবং সংস্কৃতে অনেক কাব্য প্রণয়ন করিয়াছিলেন; রাজসভা পূজিত পণ্ডিত বংশে তাঁহার জন্ম। (তিনি স্থান কাল ও পাত্রের উপযোগীভাবে রাধাকৃষ্ণের লীলা গাহিয়া ‘নবজয়দেব’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু চণ্ডীদাস নিজকে একজন পূজারী ব্রাহ্মণ (বাশুলী-পূজক) বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন। কেহ তাঁহাকে কোনও উপাধি দেন নাই। বড়ু, দ্বিজ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করিয়া তিনি যে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন–এইটুকু মাত্র জানাইয়াছেন। তাঁহার ভ্রাতা নকুলের কথা অনুসারে তাঁহাকে মহাপণ্ডিত বলিয়া মনিয়া লইলেও তিনি যে একেবারেই পাণ্ডিত্যভিমানী ছিলেন না–ইহা নিশ্চয় বলা যাইতে পারে। প্রথম বয়সের করিতায় কিছুকাল জয়দেবের লেখা মক্‌স করিলেও, অনতি পরেই সেই অনুকরণের প্রবৃত্তি ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার হৃদয়ে স্বয়ং ভারতী দেবী পদ্মাসন পাতিয়া বসিয়াছিলেন এবং মুখে কবিতার ভাষা জোগাইয়াছিলেন। কাব্য-জগতে এই সিদ্ধি লাভ করিবার পর, সমস্ত কাব্যসংস্কার এবং কবি প্রসিদ্ধির এলাকা অতিক্রম করিয়া গিয়াছিলেন।

বিদ্যাপতি-রচিত পূর্ব্বরাগের বর্ণিত রাধা অলঙ্কার-শাস্ত্রের নায়িকা, বাহ্যরূপে ঢলমল। রাধা-নাম ও রাধা-ভাবের সঙ্গে আমাদের মনে যে পবিত্র লীলা মনে পড়ে এবং মানসী-পূজার জন্য যে নৈবেদ্য সাজাইয়া থাকি, বিদ্যাপতির পূর্ব্ব-চিত্রণে তাহার লেশমাত্র নাই। সহচরীরাও তাঁহার কর্ণান্ত-অবলম্বি কেশপাশ আঁচড়াইয়া বেণী বাঁধিয়া দিতেছেন, রাধিকা অতি গোপনে তাঁহাদের কাণে কাণে প্রেমলীলা সম্বন্ধে শিষ্ট-অশিষ্ট নানারূপ প্রশ্ন করিতেছেন; কখনও নবযৌবনাগমে তাঁহার দেহ সৌন্দর্য্য স্ফুরণের আভাস মুকুরে প্রতিবিম্বিত দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। যেখানে কোনও প্রণয়ঘটিত কথাবার্ত্তা হয়, সেইখানে তিনি আনতমুখী হইয়া বাহ্যে উদাসীনতা দেখাইলেও, চৌর্য্যবৃত্তিপূর্ব্বক অতি আগ্রহে সে সকল কথা শুনিতে থাকেন (“আনতমুখে ততহি দেহি কাণে”); এইভাব যদি ধরা পড়ে এবং কোন সখী তাহা প্রচার করিয়া দেয়, তবে একবারে রৌদ্রবৃষ্টি, (‘কান্দন মাখি হাসি দেয় গারি’) রাধা তখন মুখে হাসি এবং চোখে কান্না লইয়া সখীকে গালি দিতে থাকেন। কবি বলিতেছেন—‘মনমত পাঠ পহিল অনুবন্ধ’–কামদেবের শাস্ত্রে নূতন পাঠ লইতেছেন। মোট কথা রাধিকার পূর্ব্বরাগের ছবিগুলি সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের এক একখানি পটবিশেষ। অভিসার ও স্নানের পর রাধিকার যে সকল চিত্র বিদ্যাপতি দেখাইয়াছেন, তাহা দেহনুখলোলুপ তরুণ-মনের উপাদেয় খোরাক। সেগুলি খুব সুনিপুণ কবির হাতের যোগ্য–কাব্যজগতে তাহা নিরূপম। কিন্তু তাহার উপমা ও উৎপ্রেক্ষা চোখে ধাঁধাঁ লাগাইলেও, সে চিত্র মেঘদূতের যক্ষীও নহে, কালিদাসের শকুন্তলাও নহে। ঐ দুই কবি কাব্যের উত্তরার্দ্ধে ভোগনিবৃত্তিজনিত প্রেমের নির্দ্দোষ পরিসমাপ্তি দেখাইয়াছেন। বিদ্যাপতির ভোগের চিত্র চিরকালই ভোগীকে লুব্ধ করিবে, কিন্তু চণ্ডীদাস হইতে কৃষ্ণকমল পর্য্যন্ত বৈষ্ণব কবিদের যে-সকল চিত্র আমরা দেখিয়াছি, তাহার অনেক পদই সংকীর্ত্তন-ভূমির রজঃ মা‍খা, তাহা মানব-হৃদয়ের চিরন্তন কারুণ্য ও সখাসঙ্গচ্যূত ব্যাথায় ভরপুর, তাহাতে সময়ে সময়ে ভোগের একটা বাহু রূপ আছে, কিন্তু তাহার মূল সুর–ভগবৎ প্রেম। কবিরা নারদ ও তুমুবরুর মত আমাদিগকে কৃষ্ণ কথাই শুনাইয়াছেন, এই প্রেমে দেহের তাপ বা উষ্ণত্ব নাই—জ্বর-বিকারগ্রন্থ আত্মার অতৃপ্ত পিপাসা নাই। উহা উর্ব্বশীর নৃত্য নহে–বেহুলার নৃত্য; উগ্র চাঁপা ফুলের গন্ধ নহে, বাহ্য শুভ্রতাভিমানী বিষাক্ত দূন্তর পুষ্প নহে, উহা স্নিগ্ধ সুরভিপূর্ণ সজল নলিনীদল। চণ্ডীদাসের পূর্ব্বরাগের চিত্রে রাধা প্রথম হইতেই নাম-জপের অধিকারিণী, তিনি মন্দিরের পূজারিণী–কুণ্ডলধারিণী, গেরুয়া পরিহিয়া দুশ্চর্য্য তপস্যশীলা আত্মহারা যোগিনী। তাঁহাকে বিশ্বের চতুর্দ্দিক হইতে কৃষ্ণবর্ণের আবেষ্টনী ভগবৎরূপের ধাঁধাঁ দেখাইতেছে। এই কৃষ্ণ-বর্ণের খেলা তিনি যেখানে দেখিতেছেন, সেইখানেই ভগবৎ সত্ত্বা উপলব্ধি করিয়া প্রণাম করিতেছেন। এই ধ্যানশীলা, কেশ-পাশ বেশ-ভূষার প্রতি উদাসীনা, ক্ষণে ক্ষণে প্রিয়ের আগমনের ভ্রান্তিতে চমৎকৃতা রাধিকাকে দেখিয়া সখীরা বলিতেছেন, ইঁহাকে কোথায় কোন দেবতা আশ্রয় করিয়াছে? ‍(“কোথা বা কোন্ দেব পাইল”)। সত্যই তাঁহাকে কোনো দেবতা পাইয়াছেন, মানুষ আর তাঁহার নাগাল পাইবে না। তিনি সখিগণের সঙ্গে ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া কথা বলিতে পারেন না–

‘‘দাঁড়াই যদি সখিগণ সঙ্গে,
পুলকে ভরর তনু শ্যাম পর-সঙ্গে (প্রসঙ্গে)
পুলক ঢাকিতে নানা করি পরকার (প্রকার),
নয়নের ধারা মোর বহে অনিবার।”

এই রাধার সুখ-দুঃখ মর্ত্ত্যের সুখ-দুঃখ নহে, তাহা অমর-ধামের সুখ-দুঃখ।

কিন্তু বিদ্যাপতির সব খানিই শুধু কবিত্ব বা অলঙ্কার-শাস্ত্রের পুনরাবৃত্তি নহে। চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়াছিল, পদ-কল্পতরুর অনেক পদে তাঁহাদের কথোপকথনের ‍সারাংশ সঙ্কলিত হইয়াছে। এই সাক্ষাৎকারের ফলে প্রেম যে অখণ্ড জিনিষ, সর্ব্ববর্ণের সংমিশ্রনের পরিণতি যেরূপ শ্বেত বর্ণ,–বাৎসল্য, সখ্য, ভগবদ্ভক্তি প্রভৃতি সমস্ত রসই একস্থানে যাইয়া মিশিয়া যায়–তখন ইহাদের মধ্যে কোন ভেদ থাকে না, এই সকল কথা চণ্ডীদাস বিদ্যাপতিকে সম্ভবতঃ বলিয়াছিলেন। পদ-কল্পতরুতে বর্ণিত আছে, চণ্ডীদাস মৈথিল কবিকে জিজ্ঞাসা করিয়া ছিলেন, যৌন-লালসা হইতেই শুদ্ধ প্রেম হয়, কিম্বা প্রেমেরই স্বাভাবিক ক্রমে যৌনভাব শেষে আসিয়া পড়ে। (বিদ্যাপতির প্রথম ‍অধ্যায়গুলি সমস্তই অলঙ্কার শাস্ত্রের অনুযায়ী, কিন্তু মাথুর ও ভাব সম্মেলনে তিনি ভাবরাজ্যে বাঙালী বৈষ্ণব কবিদের মুল সুর ধরিয়াছেন, ইহাতে বোধ হয়, এই পরিবর্ত্তন চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁহার দেখাশুনার ফলে ঘটিয়াছিল।) বিদ্যাপতি ‘মাথুর’ বর্ণনায় সেই রসের পরিপূর্ণ আস্বাদ আমাদিগকে দিয়াছেন। আমরা দেখাইয়াছি—“সোহি কোকিল অব লাথ ডাকউ”–পদটি তিনি চণ্ডীদাস হইতে গ্রহণ করিয়া পল্লবিত করিয়াছেন। তাঁহার ছিল অপ্রতিদ্বন্দী কবির ভাষা, সেই ভাষায় যখন তিনি মাথুর বর্ণনা করিলেন, তখন তাঁহার পদাবলীতে সমস্ত ভোগের চিহ্ন মুছিয়া গিয়াছে; তখন তিনি পবিত্র তিলক-কন্ঠী-ধারী বৈষ্ণবগুরু—“শ্রবণে হি শ্যাম করু গান, শুনইতে নিকলাউ কঠিন পরান”, তখন “শঙ্খ-করহুঁ দূর, ভূষণ করহুঁ চুড়, তোঁড়হি গজ-মতি হায় রে। শিখাঁক সিন্দুর, মুছিয়া করহ দূর, পিয়া বিনা সকলই আঁধার রে”–ইহাই তাঁহার ভাষা। তখন তাঁহার ভাব-সম্মেলনের “সখি আজি সুখের নাহিক ওর, চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর” প্রভৃতি গান বৈষ্ণবদের জপমন্ত্র হইল, চৈতন্যদেব সারারাত্রি গাম্ভীরায় স্বরূপের সঙ্গে এই সকল গান গাইয়া প্রেমের অপূর্ব্ব আস্বাদ পাইতেন।

চণ্ডীদাস একটি পদে বলিয়াছন, কৃষ্ণরূপের ধাঁধায় পড়িয়া আমার দেহ-মন একেবারে আত্ম-বিস্মৃত হয়, তখন চক্ষুর দৃষ্টি বর্ণ-বৈষম্য ভূলিয়া যায়, তিনি কৃষ্ণবর্ণ অথবা গৌর-বর্ণ, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। (“দেখিতে দেখিতে না চিনিয়ে কাল কিম্বা গোরা”)। কেহ কেহ এই পদটিতে গৌর আগমনের সূচনা বুঝিয়াছেন, এবং কেহ কেহ আবার ত্যজন্য উহা প্রক্ষিপ্ত মনে করিয়াছেন, কিন্তু কথাটা এরূপভাবে লিখিত হইয়াছে যে, তাহাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত কিছুই নাই। কথাগুলি প্রক্ষিপ্ত হইলে, প্রক্ষেপকারী এরূপ অস্পষ্ট ইঙ্গিত দিতেন না, স্পষ্ট করিয়া বলিয়া ফেলিতেন। বহু পুরাণে বৈষ্ণবেরা চৈতন্য-আগমনের ভবিষ্যৎবাণীসূচক শ্লোক প্রক্ষেপ করিয়াছেন, তাহার সকলগুলিই স্পষ্ট সরল কথা, তাহাতে ব্যর্থ কিছু নাই। কিন্তু চণ্ডীদাসের আর একটি পদে ইঙ্গিতটা স্পষ্টতর—“আজু কে গো মুরলী বাজায়–এতো কভু নহে শ্যাম-রায়–ইহার গৌর বরণে করে আলো”–এখানে গৌরাঙ্গের কথা কিছুই নাই; রাধা মুরলী শিক্ষা উপলক্ষে কৃষ্ণের বেশ-ভূষা চাহিয়া নিজে পরিয়াছেন “তুমি লহ মোর নীল শাড়ী তব পীত ধটা দেহ পরি” (বৃন্দা), চণ্ডীদাস এই রূপের কথাই বলিয়াছেন, সুতরাং কথাটা সহজেই বোঝা গেল। কিন্তু এই সুদীর্ঘ পদটির শেষ দুই পংক্তি গূঢ় অর্থ-ব্যঞ্জক—“চণ্ডীদাস মনে মনে হাসে, এরূপ হইবে কোন দেশে?” এই গৌর মূর্ত্তির আর্বিভাব কোন্ দেশে হইবে, তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া কবি মুখ টিপিয়া হাসিতেছেন, অর্থাৎ গৌরাঙ্গ যে আসিতেছেন, তাহার আভাস তিনি মনে মনে পাইয়া হৃষ্ট হইয়াছেন। এবার সমালোচকদের কেহ কেহ জোর গলায় বলিতেছেন, এই পদ প্রক্ষিপ্ত না হইয়া যায় না। কিন্তু ইংরাজীতে একটা কথা আছে, “Coming events cast their shadows before”, ভল্টেয়ার ও রসো যে-সকল কথা বলিয়াছিলেন, কিছু পরে নেপোলিয়ান সেইসকল কথার মূর্ত্তরূপে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। কবি ও দ্রষ্টাদের মনে ভবিষ্যাৎ ঘটনার এইরূপ প্রতিবিম্ব পড়িয়া থাকে, তাহা ছাড়া সেই দুইটি পংক্তি যে নিশ্চিতরূপে গৌরাঙ্গ-আবির্ভাবের সূচক–তাহাই বা কিরূপে বলা যায়? রাধিকার বেশভূষা দেখিয়া কবি বলিতেছেন, এ আবার কেমন বেশ, এরূপ কোন দেশে পাইলে? তিনি হাসিয়া এই কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। এই ভাবের ইঙ্গিত পদটির পূর্ব্ব একটি ছত্রেও পাওয়া যাইতেছে–এ না বেশ কোন দেশে ছিল? অতিরিক্ত মাত্রায় বিজ্ঞানবিৎ পণ্ডিতগণের অনুমানগুলিকে আমরা অনুমান বলিয়াই গ্রহণ করিব, সেগুলি সিদ্ধান্ত নহে। রাধাকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গে চণ্ডীদাস এত কথা লিখিয়াছেন যে, শুধু এই দুটি পদে নহে, অনেক স্থলে টানিয়া বুনিয়া অর্থ করিলে তাহা চৈতন্য আবির্ভাবের আভাস বলিয়া ধরা যাইতে পারে–তাঁহার সেই সেই পদে চৈতন্যের পাদক্ষেপের নূপুরধ্বনি শোনা যায়, কেবল অনুমান ও খামখেয়ালীর বলে এইসমস্ত পদ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া আমরা স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহি। চণ্ডীদাসের আর একটি পদ এইঃ–

‘‘অকখন বেরাধি এ কথা নাহি যায়,
যে করে কানুর নাম তার ধরে পায়।
পায়ে ধরি কাঁদে সে চিকুর গড়ি যায়,
সোণার পুতলী যেন ধুলায় লুটায়।”

চৈতন্য দেব যাঁহার মুখে কৃষ্ণ-নাম শুনিয়াছেন, তাঁহারই পায়ে লুটাইয়া পড়িয়াছেন; তাই বলিয়া এই ধ্রুব-প্রহ্লাদ-নারদ-মাধবেন্দ্র পুরীর দেশে যে কৃষ্ণ নামের এই মাহাত্ম্য সমন্তই চৈতন্যে আরোপ করিয়া কবির উক্তি প্রক্ষিপ্ত বলিতে হইবে–বৈজ্ঞানিকের এই বাড়াবাড়ি তো অসহ্য!

অষ্ট সাত্ত্বিক বিকার সম্বন্ধে চৈতন্যের বহু পূর্ব্ব হইতে এইদেশীয় লোকেরা অবহিত ছিলেন। কাহারও যদি কৃষ্ণ-নাম বলিতে রোমাঞ্চ হয়, কিম্বা কেহ যদি নির্জ্জনে তমাল তরুকে আলিঙ্গন করে। বিজনে আলিঙ্গই তরুণ তমাল। তবে সে সকলই চৈতন্য প্রভাবান্বিত, সুতরাং পূর্ব্ববর্ত্তী কবির পদে ঐরূপ কিছু পাওয়া গেলে তাহা প্রক্ষিপ্ত ইহা বলা সঙ্গত হইবে না।

চণ্ডীদাস প্রেম সম্বন্ধে কয়েকটি সার কথা বলিয়াছেন–তাহা অন্যত্র সুলভ নয়;

‘‘পীরিতি করিয়ে ভাঙ্গরে যে

সাধন সঙ্গ পায়না সে।’’

পরস্পরের প্রতি গভীর অন্যায় প্রমাণিত হইলে দাম্পত্য বর্জ্জননীতি সমর্থিত হয়। হিন্দুদিগের মধ্যে যদিও স্বামী স্ত্রীকে বর্জ্জন করিতে পারেন কিন্তু স্ত্রী স্বামীকে বর্জ্জন করিতে পারেন না। এই তালাকের ব্যবস্থা যে অন্যায় তাহা চণ্ডীদাস বলেন নাই। একজনকে বর্জ্জন করিয়া নূতন একজনকে গ্রহণ করিয়া অনেক স্থলে লোকে সুখী হইয়া থাকে। চণ্ডীদাস তাহাও অস্বীকার করেন নাই। কিন্তু তিনি বলিয়াছেন, প্রেম সাধনার পথে বর্জ্জননীতি একবারেই অচল। বর্জ্জন করিয়া অন্যকে গ্রহণপূর্ব্বক কেহ সুখী হইতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি প্রেমের সাধনা করিতে চান–তবে তাঁহার সঙ্কল্প বিফল হইবে। বর্জ্জনের আইন সাংসারিকের পক্ষে, কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভ করিতে হইলে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মাথায় লইয়া সেই পথে দৃঢ় থাকিতে হইবে। চন্দ্রের জ্যোৎস্না কন্টকের পথ দেখিয়া ফিরিয়া যায় না, সেই কন্টকের ’পরেই লুটাইয়া পড়ে; ফুলের গন্ধ বিষাক্ত স্থান দেখিয়া ফিরিয়া যায় না, তাহার প্রবাহ অব্যাহত থাকে। দানেই প্রেমের তৃপ্তি, সে দান একেবারে নির্ব্বিচার! সেখানে প্রেম পণ্যদ্রব্য নহে, দেওয়ার মধ্যে ফিরিয়া পাইবার কোন সত্ত্ব নাই, সে কেবলই দেওয়া। যাহাকে একবার ভালবাসিয়াছ–সে যেমনই হউক, তাহাকে চিরকাল ভালবাসিতে হইবে। হয়ত সংসারে এ রকম নিষ্কাম প্রেমে অনেক সময়ে দুঃখ পাইতে হয়, কিন্তু যিনি প্রেমের সাধন অঙ্গ খোঁজেন, প্রেম তো তাঁহার কাছে তপস্যা। সে তপস্যা ভাঙ্গিলে তাঁহার আর সাধনার পথে যাওয়া চলে না।

‘‘চণ্ডিদাস কহে পীরিতি না কহে কথা
পীরিতি লাগিয়া পরাণ ত্যজিলে পীরিতি মেলয়ে তথা।

প্রেম ঘোষণা বা বক্তৃতা নহে। জগতের সমস্ত কষ্ট নীরবে সহ্য করিয়া প্রেমের জন্য যে প্রাণত্যাগ করিতে পারে- সে ই প্রকৃত প্রেমিক।

‘‘ব্রহ্মাণ্ডব্যাপিয়া আছয়ে যে জন
কেহ না জানয়ে তারে,
প্রেমের আরতি জেনেছে যে জন
সেই সে চিনিতে পারে।’’ (চ)

চণ্ডীদাসের মতে সুখ-দুঃখ, আশা নিরাশার মধ্য দিয়া যে পার্থিব প্রেমের মর্ম্ম বুঝিয়াছে, সেই মাত্র ভগবৎ প্রেম বুঝিবার অধিকারী–অন্য পথে তাঁহাকে পাওয়া যায় না।

‘‘শুষ্ক কাষ্ঠসম দেহকে করিতে হয়।’’ (চ)

দৈহিক ইন্দ্রিয়ের বিকার যতদিন থাকিবে, ততদিন প্রেমের আস্বাদ দুর্লভ। বহিরিন্দ্রিয়ের তথাকথিত রস শুকাইয়া গেলে, যখন দেহে সুখ-দুঃখ বোধ থাকিবে না, তখন প্রকৃত প্রেমের সন্ধান মিলিবে; তখন নিজের দেহের সুখ-দুঃখ বোধ থাকিবে না;–প্রিয়জনের সুখেই সুখ, তাহার দুঃখেই দুঃখ। কবি অন্যত্র বলিয়াছেন–

‘‘আমি নিজ সুখ দুখ কিছু না জানি’’

সাধারণ প্রেমে করাঙ্গুলি গুণিয়া গুণিয়া যদি বা কিছু দেওয়া হয়–তাহার বিনিময়ে প্রণয়ী কতটা পাইলেন সেই দিকে তাঁহার সতর্ক দৃষ্টি থাকে, এক পাই কম হইলে অমনি প্রেমের পালা শেষ করিয়া ফেলেন। এবম্বিধ প্রণয়ীর পক্ষে দুঃখ সুখ বোধবিবর্জ্জিত ‘শুষ্ক কাষ্ঠসম দেহ’ সাধকের–প্রেমতত্ত্ব বোঝা একেবারে অসম্ভব।

‘‘শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।” (চ)

এই পদটি সাধারণ পাঠকেরা অনেক সময়েই উদ্ধৃত করেন, কিন্তু আমার মনে হয়, তাঁহারা অনেক সময়েই সহজিয়া বৈষ্ণবেরা ইহার যে অর্থ বুঝেন তৎসম্বন্ধে অজ্ঞ। মানুষ অর্থ এইখানে যে-সে নয়। সহজিয়ারা মানুষ অর্থে এইখানে গুরুকে বোঝেন। তাঁহারা কোন দেবদেবী মানেন ‍না। গুরুর বাক্যই তাঁহাদের কাছে বেদ। ইহা বৌদ্ধ ধর্ম্মের সহজ-বাদের একটি সুত্র। নেপালে হিন্দুদিগকে দেভাজু ও বৌদ্ধদিগকে গুভাজু বলে। দেভাজু অর্থ দেবতার ভজনকারী এবং গুভাজুর অর্থ গুরুর ভজনকারী।

‘‘চণ্ডিদাস কহে সুখ দুখ দুটি ভাই,
সুখের লাগিয়া যে করিবে আশ
দুঃখ যাবে তার ঠাঁই।’’ (চ)

খাঁটি প্রেম সুখ-দুঃখের উর্দ্ধের আনন্দলোক। সাংসারিক সুখ-দুঃখ দুটি যমজ ভ্রাতা। যেখানে সুখ আছে সেইখানেই দুঃখ। এই পদাবলীর মধ্যে উচ্চাঙ্গের সাধনা আছে, তাহা আমি বলিবার অধিকারী নহি; তাহা শুনিবার অধিকারও সাধারণ শ্রোতার নাই।

সহজিয়া বৈষ্ণবসমাজে অনেক ব্যভিচার হইয়া থাকে, কিছু দু’-একজন এরূপ দুশ্চর তপস্যশীল সাধক আছেন–যাঁহার সংবাদ এদেশ ছাড়া এন্যত্র কোথাও পৌঁছায় নাই। যিনি মন্দ জিনিষটাই দেখিবেন তাঁহার কোনও লাভই হইবে না; ভগবানের শ্রেষ্ঠদান এই দুটি চক্ষু তাহা যেন খনির মধ্যে মণির সন্ধান করে; শুধু লোহা খুঁজিয়া কোনও লাভ নাই।

এই পদাবলী-সাহিত্যের স্ফুরণ হইয়াছে মহাপ্রভুর লীলায়। পৃথিবী এই যুগে রণদুন্দুভিনিনাদে বধির হইয়া আছে। কোন্ যুগে এই দিব্যসঙ্গীত জগতের প্রতি কোণে ধ্বনিত হইয়া স্বর্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিবে–তাহা জানি না। পৃথিবীর অন্য কোথাও শুধু এক মানব দেবতার রূপ ও গুণের আস্বাদ করিবার জন্য এরূপ বিশাল রসসাহিত–এরূপ অক্ষয় মধুচক্র রচিত হয় নাই। বৈষ্ণবকবিগনের প্রত্যেকের মধ্যেই ন্যূনাধিক পরিমাণে চৈতন্যের নামের ছাপ আছে। তন্মধে শ্রীখণ্ডবাসী নরহরি সরকারের প্রতিটি পদেই গৌরাঙ্গের শীলমোহরাঙ্কিত বাসুদেব ঘোষও চৈতন্যকথা ছাড়া কোনও কবিতা লেখেন নাই এবং কৃষ্ণকমল গোস্বামীর দিব্যোন্মাদ (রাই উন্মাদিনী) চৈতন্যচরিতামৃতের অঙ্কিত গৌরের ভাবাবিষ্ট মূর্ত্তি একেবারে জীবন্ত করিয়া তুলিয়াছে সহস্র সহস্র লোক সেইসব গান শুনিয়া অশ্রুজলে ভাসিয়া গিয়াছে।

হে মহাভাগ, তুমি কে, কেন আসিয়াছিলে–জানি না। যোগীর যাহাকে ক্ষণমাত্র ধ্যানে পাইয়া পুনরায় পাইবার জন্য যুগ যুগ তপস্য করেন, তুমি কি সেই তপস্যার ধন? সংসারে ত কেবল স্ত্রী-পুত্রের ভালবাসার জন্য দিবারাত্র কাঁদিয়া থাকে, সন্ন্যাসীরা তোমাকে খুঁজিয়া বেড়ায়, সিদ্ধপুরুষেরা কতকগুলি অলৌকিক শক্তি অর্জ্জন করে কিন্তু তোমার মত কোন্ যুগে কোন্ দেশে ভগবানের জন্য এমন করিয়া কাঁদিয়াছে? নিজের মূর্ত্তিতে ভগবৎমূর্ত্তি কে এমন ভাবে অঙ্কিত করিয়া দেখাইয়াছে এবং তোমার মত এরূপ প্রত্যক্ষ দর্শন পাইয়া কে উন্মত্ত হইয়াছে? তোমার অশ্রুপ্লাবিত চক্ষে যাঁহার প্রতিবিম্ব পাঠিয়াছিল–তাঁহাকে তোমারই মধ্যে বাংলাদেশ একবারমাত্র দেখিয়াছিল–সেই রূপের ছাড়া এখনও পদাবলীর স্বর্ণপটে লিখিত রহিয়াছে।

সমাপ্ত। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *