একটি তুলসীগাছের কাহিনী

একটি তুলসীগাছের কাহিনী

ধনুকের মতো বাঁকা কংক্রিটের পুলটির পরেই বাড়িটা। দোতলা, উঁচু এবং প্রকাণ্ড বাড়ি। তবে রাস্তা থেকেই সরাসরি দণ্ডায়মান। এদেশে ফুটপাত নাই বলে বাড়িটারও একটু জমি ছাড়ার ভদ্রতার বালাই নাই। তবে সেটা কিন্তু বাইরের চেহারা। কারণ, পেছনে অনেক জায়গা। প্রথমত প্রশস্ত উঠান। তারপর পায়খানা-গোসলখানার পরে আম-জাম-কাঁঠালগাছে ভরা জঙ্গলের মতো জায়গা। সেখানে কড়া সূর্যালোকেও সূর্যাস্তের ম্লান অন্ধকার এবং আগাছা আবৃত মাটিতে ভাপসা গন্ধ 

অত জায়গা যখন তখন সামনে কিছু ছেড়ে একটা বাগান করলে কী দোষ হত? 

সে-কথাই এরা ভাবে। বিশেষ করে মতিন। তার বাগানের বড় শখ, যদিও আজ পর্যন্ত তা কল্পনাতেই পুষ্পিত হয়েছে। সে ভাবে, একটু জমি পেলে সে নিজেই বাগানের মতো করে নিত। যত্ন করে লাগাত মৌসুমি ফুল, গন্ধরাজ-বকুল-হাস্নাহানা, দু-চারটে গোলাপও তারপর সন্ধ্যার পর আপিস ফিরে সেখানে বসত। একটু আরাম করে বসবার জন্যে হালকা বেতের চেয়ার বা ক্যানভাসের ডেকচেয়ারই কিনে নিত। তারপর গা ঢেলে বসে গল্প-গুজব করত। আমজাদের হুঁকার অভ্যাস। বাগানের সম্মান বজায় রেখে সে না হয় একটা মানানসই নলওয়ালা সুদৃশ্য গুড়গুড়ি কিনে নিত। কাদের গল্পপ্রেমিক। ফুরফুরে হাওয়ায় তার কণ্ঠ কাহিনীময় হয়ে উঠত। কিংবা পুষ্পসৌরভে মদির জ্যোৎস্নারাতে গল্প না করলেই-বা কী এসে যেত? এমনিতে চোখ বুজে বসেই নীরবে সান্ধ্যকালীন স্নিগ্ধতা উপভোগ করত তারা। 

আপিস থেকে শ্রান্ত হয়ে ফিরে প্রায় রাস্তা থেকেই চড়তে-থাকা দোতলায় যাবার সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে মতিনের মনে জাগে এসব কথা। 

বাড়িটা তারা দখল করেছে। অবশ্য লড়াই না করেই; তাদের সামরিক শক্তি অনুমান করে বাড়ির মালিক যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল তা নয়। দেশভঙ্গের হুজুগে এ-শহরে এসে তারা যেমন-তেমন একটা ডেরার সন্ধানে উদয়াস্ত ঘুরছে, তখন একদিন দেখতে পায় বাড়িটা। সদর দরজায় মস্ত তালা, কিন্তু সামান্য পর্যবেক্ষণের পর বুঝতে পারে বাড়িতে জনমানব নাই এবং তার মালিক দেশপলাতক। পরিত্যক্ত বাড়ি চিনতে দেরি হয় না। কিন্তু এমন বাড়ি পাওয়া নিতান্ত সৌভাগ্যের কথা। সৌভাগ্যের আকস্মিক আবির্ভাবে প্রথমে তাদের মনে ভয়ই উপস্থিত হয়। অবশ্য সে-ভয় কাটতে দেরি হয় না। সে-দিন সন্ধ্যায় তারা সদলবলে এসে দরজার তালা ভেঙে রৈ রৈ আওয়াজ তুলে বাড়িটায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে তখন বৈশাখের আম-কুড়ানো ক্ষিপ্র উন্মাদনা বলে ব্যাপারটা তাদের কাছে দিন-দুপুরে ডাকাতির মতো মনে হয় না। কোনো অপরাধের চেতনা যদি-বা মনে জাগার প্রয়াস পায় তা বিজয়ের উল্লাসে নিমেষে তুলোধুনো হয়ে উড়ে যায়। 

পরদিন শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়লে অনাথিতদের আগমন শুরু হয়। মাথার ওপর একটা ছাদ পাবার আশায় তারা দলে-দলে আসে। 

বিজয়ের উল্লাসটা ঢেকে এরা বলে, কী দেখছেন? জায়গা নাই কোথাও। সব ঘরেই বিছানা পড়েছে। এই যে ছোট্ট ঘরটি, তাতেও চার-চারটে বিছানা পড়েছে। এখন তো শুধু বিছানা মাত্র। পরে ছ-ফুট বাই আড়াই ফুটের চারটি চৌকি এবং দু-একটা চেয়ার-টেবিল এলে পা ফেলার জায়গা থাকবে না। 

আপনাদের তকলিফ আমরা কি বুঝি না? একদিন আমরা কি কম কষ্ট পেয়েছি? তবে আপনাদের কপাল মন্দ। সে-ই হচ্ছে আসল কথা। 

যারা হতাশ হয় তাদের মুখ কালো হয়ে ওঠে সমবেদনা-ভরা উক্তিতে। 

ঐ ঘরটা? 

নিচের তলায় রাস্তার ধারে ঘরটা অবশ্য খালিই মনে হয়। 

খালি দেখালেও খালি নয়। ভালো করে চেয়ে দেখুন। দেয়ালের পাশে সতরঞ্চিতে বাঁধা দুটি বেডিং। শেষ জায়গাটাও দু-ঘণ্টা হল অ্যাকাউন্টস-এর মোটা বদরুদ্দিন নিয়ে নিয়েছে। শালার কাছ থেকে বিছানা-পত্তর আনতে গেছে। শালাও আবার তার এক দোস্তের বাড়ির বারান্দায় আস্তানা গেড়েছে। পরিবার না থাকলে শালাটিও এসে হাজির হত। 

নেহাত কপালের কথা। আবার একজনের কণ্ঠ সমবেদনায় খলখল করে ওঠে। যদি ঘণ্টাদুয়েক আগে আসতেন তবে বদরুদ্দিনকে কলা দেখাতে পারতেন। ঘরটায় তেমন আলো নেই বটে কিন্তু দেখুন জানালার পাশেই সরকারি আলো। রাতে কোনোদিন ইলেকট্রিসিটি ফেল করলে সে-আলোতেই দিব্যি চলে যাবে। 

বা কিপ্পণতা যদি করতে চায়— 

অবশ্য এ-সব পরাহত বাড়ি-সন্ধানীদের কানে বিষবৎ মনে হয়। 

যথাসময়ে বে-আইনি বাড়ি দখলের ব্যাপারটা তদারক করবার জন্যে পুলিশ আসে। সেটা স্বাভাবিক। দেশময় একটা ঘোর পরিবর্তনের আলোড়ন বটে কিন্তু কোথাও যে রীতিমতো মগের মুলুক পড়েছে তা নয়। পুলিশ দেখে তারা ভাবে, পলাতক গৃহকর্তা কি বাড়ি উদ্ধারের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছে? তবে সে-কথা বিশ্বাস হয় না। দু-দিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করে দিয়ে যে দেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে, বর্তমানে তার অন্যান্য গভীর সমস্যার কথা ভাববার আছে। সন্দেহ থাকে না যে, পুলিশকে খবর দিয়েছে তারাই যারা সময়মতো এখানে না এসে শহরের অন্য কোনো প্রান্তে নিষ্ফলভাবে বাড়ি দখলের ফিকিরে ছিল। মন্দভাগ্যের কথা মানা যায় কিন্তু সহ্য করা যায় না। ন্যায্য অধিকার-স্বত্ব এক কথা অন্যায়ের ওপর ভাগ্য লাভ অন্য কথা। হিংসাটা ন্যায়সঙ্গত-তো মনে হয়-ই, কর্তব্য বলেও মনে হয়। 

এরা রুখে দাঁড়ায়। 

আমরা দরিদ্র কেরানি মানুষ বটে কিন্তু সবাই ভদ্র ঘরের ছেলে। বাড়ি দখল করেছি বটে কিন্তু জানালা-দরজা ভাঙি নাই, ইট-পাথর খসিয়ে চোরাবাজারেও চালান করে দিই নাই। 

আমরাও আইনকানুন বুঝি। কে নালিশ করেছে? বাড়িওয়ালা নয়। তবে নালিশটাও যথাযথ নয়। 

কাদের কেবল কাতর রব তোলে। যাব কোথায়? শখ করে কি এখানে এসে উঠেছি? 

সদলবলে সাব-ইনস্পেক্টর ফিরে গিয়ে না-হক না-বেহক না-ভালো না-মন্দ গোছের ঘোর-ঘোরালো রিপোর্ট দেয় যার মর্মার্থ উদ্ধারের ভয়েই হয়তো ওপরওয়ালা তা ফাইল চাপা দেয়া শ্রেয় মনে করে। অথবা বুঝতে পারে, এই হুজুগের সময় অন্যায়ভাবে বাড়ি দখলের বিষয়ে সরকারি আইনটা যেন তেমন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। 

কাদের চোখ টিপে বলে, সত্য কথা বলতে দোষ কী? সাব-ইনস্পেক্টরের দ্বিতীয় বউ আমার এক রকম আত্মীয়া। বোলো না কাউকে কিন্তু। 

কথাটা অবশ্য কারোই বিশ্বাস হয় না। তবে অসত্যটি গোড়ায় যে কেবল একটা নিৰ্মল আনন্দের উস্কানি, তা বুঝে কাদেরকে ক্ষমা করতে দ্বিধা হয় না। 

উৎফুল্ল কণ্ঠে কেউ প্রস্তাব করে, কী হে, চা-মিষ্টিটা হয়ে যাক। 

.

রাতারাতি সরগরম হয়ে ওঠে প্রকাণ্ড বাড়িটা। আস্তানা একটি পেয়েছে এবং সে-আস্তানাটি কেউ হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে না—শুধু এ-বিশ্বাসই তার কারণ নয়। খোলামেলা ঝরঝরে তকতকে এ-বাড়ি তাদের মধ্যে একটা নতুন জীবন সঞ্চার করেছে যেন। এদের অনেকেই কলকাতায় ব্লকম্যান লেন-এ খালাসি পট্টিতে, বৈঠকখানায় দফতরিদের পাড়ায়, সৈয়দ সালেহ লেন-এ তামাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বা কমরু খানসামা লেন-এ অকথ্য দুর্গন্ধ নোংরার মধ্যে দিন কাটিয়েছে। তুলনায় এ-বাড়ির বড়-বড় কামরা, নীলকুঠি দালানের ফ্যাশনে মস্ত-মস্ত জানালা, খোলামেলা উঠান, আরো পেছনে বনজঙ্গলের মতো আম-জাম-কাঁঠালের বাগান—এসব একটি ভিন্ন দুনিয়া যেন। এরা লাটবেলাটের মতো এক-একখানা ঘর দখল করে নাই সত্য, তবু এত আলো-বাতাস কখনো তারা উপভোগ করে নাই। তাদের জীবনে সবুজ তৃণ গজাবে ধমনিতে সবল সতেজ রক্ত আসবে, হাজার-দু-হাজারওয়ালাদের মতো মুখে ধন-স্বাস্থ্যের জলুস আসবে, দেহও ম্যালেরিয়া-কালাজ্বর-ক্ষয় ব্যাধিমুক্ত হবে। রোগাপট্‌কা ইউনুস ইতিমধ্যে তার স্বাস্থ্যের পরিবর্তন দেখতে পায়। সে থাকত ম্যাকলিওড স্ট্রিটে। গলিটা যেন সকালবেলার আবর্জনাভরা ডাস্টবিন। সে-গলিতেই নড়বড়ে ধরনের একটা কাঠের দোতলা বাড়িতে রান্নাঘরের পাশে স্যাতস্যাতে একটি কামরায় কচ্ছদেশীয় চামড়া-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চার বছর সে বাস করেছে। পাড়াটি চামড়ার উৎকট গন্ধে সর্বক্ষণ এমন ভরপুর হয়ে থাকত যে রাস্তার ড্রেনের পচা দুর্গন্ধ নাকে পৌঁছত না, ঘরের কোণে ইঁদুর-বেড়াল মরে পচে থাকলেও তার খবর পাওয়া দুষ্কর ছিল। ইউনুসের জ্বরজ্বারি লেগেই থাকত, থেকে-থেকে শেষরাতে কাশির ধমক উঠত। তবু পাড়াটি ছাড়ে নি এক কারণে। কে তাকে বলেছিল, চামড়ার গন্ধ নাকি যক্ষার জীবাণু ধ্বংস করে। দুর্গন্ধটা তাই সে অম্লানবদনে সহ্য-তো করতই, সময়-সময় আপিস থেকে ফিরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির নিশ্ছিদ্র দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বুকভরে নিশ্বাস নিত। তাতে অবশ্য তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি দেখা যায় নাই। 

খানাদানা না হলে বাড়ি সরগরম হয় না। তাই এক সপ্তাহ ধরে মোঘলাই কায়দায় তারা খানাদানা করে। রান্নার ব্যাপারে সকলেরই গুপ্ত কেরামতি প্রকাশ পায় সহসা। নানির হাতে শেখা বিশেষ ধরনের পিঠা তৈরির কৌশলটি শেষ পর্যন্ত অখাদ্য বস্তুতে পরিণত হলেও তারিফ-প্রশংসায় তা মুখরোচক হয়ে ওঠে। গানের আসরও বসে কোনো-কোনো সন্ধ্যায়। হাবিবুল্লা কোথেকে একটা বেসুরো হারমোনিয়াম নিয়ে এসে তার সাহায্যে নিজের গলার বলিষ্ঠতার ওপর ভর করে নিশীথ রাত পর্যন্ত একটি অব্যক্তব্য সঙ্গীতসমস্যা সৃষ্টি করে। 

এ-সময়ে একদিন উঠানের প্রান্তে রান্নাঘরের পেছনে চৌকোণা আধ-হাত উঁচু ইটের তৈরি একটি মঞ্চের উপর তুলসীগাছটি তাদের দৃষ্টিগত হয়। 

সেদিন রোববার সকাল। নিমের ডাল দিয়ে মেছোয়াক করতে-করতে মোদাব্বের উঠানে পায়চারি করছিল, হঠাৎ সে তারস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। লোকটি এমনিতেই হুজুগে মানুষ। সামান্য কথাতেই প্রাণ-শীতল-করা রৈ রৈ আওয়াজ তোলার অভ্যাস তার। তবু সে-আওয়াজ উপেক্ষা করা সহজ নয়। শীঘ্রই কেউ-কেউ ছুটে আসে উঠানে। 

কী ব্যাপার? 

চোখ খুলে দেখ! 

কী? কী দেখব? 

সাপখোপ দেখবে আশা করেছিল বলে প্রথমে তুলসীগাছটা নজরে পড়ে না তাদের। দেখছ না? এমন বেকায়দা আসনাধীন তুলসীগাছটা দেখতে পাচ্ছ না? 

উপড়ে ফেলতে হবে ওটা। আমরা যখন এ-বাড়িতে এসে উঠেছি তখন এখানে কোনো হিন্দুয়ানির চিহ্ন আর সহ্য করা হবে না। 

একটু হতাশ হয়ে তারা তুলসীগাছটির দিকে তাকায়। গাছটি কেমন যেন মরে আছে।। গায় সবুজ রঙের পাতায় খয়েরি রং ধরেছে। নিচে আগাছাও গজিয়েছে। হয়তো বহুদিন তাতে পানি পড়ে নি। 

কী দেখছ? মোদাব্বের হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। বলছি না, উপড়ে ফেল! 

এরা কেমন স্তব্ধ হয়ে থাকে। আকস্মিক এ আবিষ্কারে তারা যেন কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েছে। যে-বাড়ি এত শূন্য মনে হয়েছিল, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা–ক-টা নাম থাকা সত্ত্বেও যে বাড়িটা এমন বেওয়ারিশ ঠেকেছিল, সে-বাড়ির চেহারা যেন হঠাৎ বদলে গেছে। আচমকা ধরা পড়ে গিয়ে শুষ্কপ্রায় মৃতপ্রায় নগণ্য তুলসীগাছটি হঠাৎ সে-বাড়ির অন্দরের কথা প্রকাশ করেছে যেন। 

এদের অহেতুক স্তব্ধতা লক্ষ্য করে মোদাব্বের আবার হুঙ্কার ছাড়ে। 

ভাবছ কী অত? উপড়ে ফেল বলছি! 

কেউ নড়ে না। হিন্দু রীতিনীতি এদের তেমন ভালো করে জানা নাই। তবু কোথাও শুনেছে যে, হিন্দুবাড়িতে প্রতি দিনান্তে গৃহকর্ত্রী তুলসীগাছের তলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়, গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে। আজ যে-তুলসীগাছের তলে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সে-পরিত্যক্ত তুলসীগাছের তলেও প্রতি সন্ধ্যায় কেউ প্রদীপ দিত। আকাশে যখন সন্ধ্যাতারা বলিষ্ঠ একাকিত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তখন ঘনায়মান ছায়ার মধ্যে আনত সিঁদুরের নীরব রক্তাক্ত স্পর্শে একটি শান্ত-শীতল প্রদীপ জ্বলে উঠত প্রতিদিন। ঘরে দুর্দিনের ঝড় এসেছে, হয়তো কারো জীবন-প্রদীপ নিভে গেছে, আবার হাসি-আনন্দের ফোয়ারাও ছুটেছে সুখ সময়ে, কিন্তু এ-প্রদীপ-দেওয়া অনুষ্ঠান একদিনের জন্যেও বন্ধ থাকে নাই। 

যে-গৃহকর্ত্রী বছরের পর বছর এ-তুলসীগাছের তলে প্রদীপ দিয়েছে সে আজ কোথায়? মতিন একসময়ে রেলওয়েতে কাজ করত। অকারণে তার চোখের সামনে বিভিন্ন রেলওয়ে-পট্টির ছবি ভেসে ওঠে। ভাবে, হয়তো আসানসোল, বৈদ্যবাটি, লিলুয়া বা হাওড়ায় রেলওয়ে-পট্টিতে সে-মহিলা কোনো আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। বিশাল ইয়ার্ডের পাশে রোদে শুকোতে-থাকা লাল পাড়ের একটি মসৃণ কালো শাড়ি সে যেন দেখতে পায়। হয়তো সে-শাড়িটি গৃহকর্ত্রীরই। কেমন বিষণ্নভাবে সে-শাড়িটি দোলে স্বল্প হাওয়ায়। অথবা মহিলাটি কোনো চলতি ট্রেনের জানালার পাশে যেন বসে। তার দৃষ্টি বাইরের দিকে। সে-দৃষ্টি খোঁজে কিছু দূরে, দিগন্তের ওপারে। হয়তো তার যাত্রা এখনো শেষ হয় নাই। কিন্তু যেখানেই সে থাকুক এবং তার যাত্রা এখনো শেষ হয়েছে কি হয় নাই, আকাশে যখন দিনান্তের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে তখন প্রতিদিন এ-তুলসীতলার কথা মনে হয় বলে তার চোখ হয়তো ছলছল করে ওঠে। 

গতকাল থেকে ইউনুসের সর্দি-সর্দি ভাব। সে বলে, 

থাক্‌না ওটা। আমরা-তো তা পূজা করতে যাচ্ছি না। বরঞ্চ ঘরে তুলসীগাছ থাকা ভালো। সর্দি-কফে তার পাতার রস বড়ই উপকারী। 

মোদাব্বের অন্যদের দিকে তাকায়। মনে হয়, সবারই যেন তাই মত। গাছটি উপড়ানোর জন্যে কারো হাত এগিয়ে আসে না। ওদের মধ্যে এনায়েত একটু মৌলবী ধরনের মানুষ। মুখে দাড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও আছে, সকালে নিয়মিতভাবে কোরান-তালাওয়াত করে। সে-পর্যন্ত চুপ। প্রতি সন্ধ্যায় গৃহকর্ত্রীর সজল চোখের দৃশ্যটি তার মনেও জাগে কি? 

অক্ষত দেহে তুলসীগাছটি বিরাজ করতে থাকে। 

তবে এদের হাত থেকে সেটি রেহাই পেলেও এরা যে তার সম্বন্ধে পর মুহূর্তেই অসচেতনায় নিমজ্জিত হয়, তা নয়। বরঞ্চ কেমন একটা দুর্বলতার ভাব, কর্তব্যের সম্মুখে পিছপা হলে যেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা আসে তেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা তাদের মনে জেগে থাকে। তারই ফলে সে-দিন সান্ধ্য আড্ডায় তর্ক ওঠে। তারা বাক-বিতণ্ডার স্রোতে মনের সে-দুর্বলতা-অস্বচ্ছন্দতা ভাসিয়ে দিতে চায় যেন। আজ অন্য দিনের মতো রাষ্ট্রনৈতিক– অর্থনৈতিক আলোচনার বদলে সাম্প্রদায়িকতাই তাদের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। 

—ওরাই তো সবকিছুর মূলে, মোদাব্বের বলে। উলঙ্গ বাল্ব-এর আলোয় তার সযত্নে মেছোয়াক করা দাঁত ঝকঝক করে।—তাদের নীচতা হীনতা গোঁড়ামির জন্যেই তো দেশটা ভাগ হল। 

কথাটা নতুন নয়। তবু আজ সে-উক্তিতে নতুন একটা ঝাঁঝ। তার সমর্থনে এবার হিন্দুদের অবিচার-অত্যাচারের অশেষ দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাস সংকীর্ণ হয়ে আসে। 

দলের মধ্যে বামপন্থী বলে স্বীকৃত মকসুদ প্রতিবাদ করে। বলে, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে না কি?

মোদাব্বেরের ঝকঝকে দাঁত ঝিলিক দিয়ে ওঠে। 

বাড়াবাড়ি মানে? 

বামপন্থী মকসুদ আজ একা। তাই হয়তো তার বিশ্বাসের কাঁটা নড়ে। সংশয়ে দুলে-দুলে কাঁটাটি ডান দিকে হেলে থেমে যায়। 

.

কয়েকদিন পরে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তুলসীগাছটা মোদাব্বেরের নজরে পড়ে। সে একটু বিস্মিত না হয়ে পারে না। তার তলে যে-আগাছা জন্মেছিল সে-আগাছা অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। যে-গাঢ় সবুজ পাতাগুলি পানির অভাবে শুকিয়ে খয়েরি রং ধরেছিল, সে-পাতাগুলি কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। সন্দেহ থাকে না যে তুলসীগাছটির যত্ন নিচ্ছে কেউ। খোলাখুলিভাবে না হলেও লুকিয়ে-লুকিয়ে তার গোড়ায় কেউ পানি দিচ্ছে। 

মোদাব্বেরের হাতে তখন একটি কঞ্চি। সেটি শাঁ করে কচু-কাটার কায়দায় সে তুলসীগাছের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। কিন্তু ওপর দিয়েই। তুলসীগাছটি অক্ষত দেহেই থাকে। 

অবশ্য তুলসীগাছের কথা কেউ উল্লেখ করে না। ইউনুসের সর্দি-সর্দি ভাবটা পরদিন কেটে গিয়েছিল। তুলসীপাতার রসের প্রয়োজন হয় নাই তার। 

তারা ভেবেছিল ম্যাকলিওড স্ট্রিট খানসামা লেন ব্লকম্যানের জীবন সত্যিই পেছনে ফেলে এসে প্রচুর আলো-হাওয়ার মধ্যে নতুন জীবন শুরু করেছে। কিন্তু তাদের ভুলটা ভাঙতে দেরি হয় না। তবে শুধু ততখানিই দেরি হয় যতখানি দরকার, সে-বিশ্বাস দৃঢ় পরিণত হবার জন্যে। ফলে আচম্বিত আঘাতটা প্রথমে নিদারুণই মনে হয়। 

সেদিন তারা আপিস থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরে সকালের পরিকল্পনা মোতাবেক খিচুড়ি রান্নার আয়োজন শুরু করেছে এমন সময় বাইরের সিঁড়িতে ভারি জুতার মচমচ্ আওয়াজ শোনা যায়। বাইরে একবার উঁকি দিয়ে মোদাব্বের ক্ষিপ্রপদে ভেতরে আসে। 

পুলিশ এসেছে আবার। সে ফিসফিস করে বলে। 

পুলিশ? আবার কেন পুলিশ? ইউনুস ভাবে, হয়তো রাস্তা থেকে ছ্যাঁচড়া চোর পালিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকেছে এবং তারই সন্ধানে পুলিশের আগমন হয়েছে। কথাটা মনে হতেই নিজের কাছেই তা খরগোশের গল্পের মতো ঠেকে। শিকারির সামনে আর পালাবার পথ না পেয়ে হঠাৎ চোখ বুজে বসে পড়ে খরগোশ ভাবে, কেউ তাকে আর দেখতে পাচ্ছে না। আসলে তারাই কি চোর নয়? সব জেনেও তারাই কি সত্য কথাটা স্বীকার না করে এ-বাড়িতে একটি অবিশ্বাস্য মনোরম জীবন সৃষ্টি করেছে নিজেদের জন্যে? 

পুলিশদলের নেতা সাবেকি আমলের মানুষ। হ্যাট বগলে চেপে তখন সে দাগ-পড়া কপাল থেকে ঘাম মুছছে। কেমন একটা নিরীহ ভাব। তার পশ্চাতে বন্দুকধারী কনস্টেবল দুটিকেও মস্ত গোঁফ থাকা সত্ত্বেও নিরীহ মনে হয়। তাদের দৃষ্টি ওপরের দিকে। তারা যেন কড়িকাঠ গোনে। ওপরের ঝিলিমিলির খোপে একজোড়া কবুতর বাসা বেঁধেছে। হয়তো সে কবুতর দুটিকেই দেখে চেয়ে। হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও দৃষ্টি পড়ে পশু-পক্ষীর দিকে। 

সবিনয়ে মতিন প্রশ্ন করে, কাকে দরকার? 

আপনাদের সবাইকে। পুলিশদের নেতা একটু খনখনে গলায় ঝট্ করে উত্তর দেয়। আপনারা বে-আইনিভাবে এ-বাড়িটা কজা করেছেন। 

কথাটা না মেনে উপায় নাই। ওরা প্রতিবাদ না করে সরল চোখে সামান্য কৌতূহল জাগিয়ে পুলিশদের নেতার দিকে চেয়ে থাকে। 

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে। সরকারের হুকুম। 

এরা নীরবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অবশেষে মোদাব্বের গলা সাফ করে প্রশ্ন করে, কেন, বাড়িওয়ালা নালিশ করেছে নাকি? 

অ্যাকাউন্টস আপিসের মোটা বদরুদ্দিন গলা বাড়িয়ে কনস্টেবল দুটির পেছনে একবার তাকিয়ে দেখে বাড়িওয়ালার সন্ধানে। সেখানে কেউ নেই। তবে রাস্তায় কিছু লোক জড়ো হয়েছে। অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা। 

কোথায় বাড়িওয়ালা? না হেসেই গলায় হাসি তোলে পুলিশদলের নেতা।

এদের একজনও হেসে ওঠে। একটা আশার সঞ্চার হয় যেন।

তবে? 

গভর্নমেন্ট বাড়িটা রিকুইজিশন করেছে। 

এবার আর হাসি জাগে না। বস্তুত অনেকক্ষণ যেন কারো মুখে কোনো কথা সরে না। তারপর মকসুদ গলা বাড়ায়। 

আমরা কি গভর্নমেন্টের লোক নই? 

এবার কনস্টেবল দুটির দৃষ্টিও কবুতর কড়িকাঠ ছেড়ে মকসুদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়। তাদের দৃষ্টিতে সামান্য বিস্ময়ের ভাব। মানুষের নির্বুদ্ধিতায় এখনো তারা চমকিত হয়। 

তারপর প্রকাণ্ড সে-বাড়িতে অপর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকলেও একটা গভীর ছায়া নেবে আসে। প্রথমে অবশ্য তাদের মাথায় খুন চড়ে। নানারকম বিদ্রোহী-ঘোষণা শোনা যায়। তারা যাবে না কোথাও, ঘরের খুঁটি ধরে পড়ে থাকবে; যাবে-তো লাশ হয়ে যাবে। তবে মাথা শীতল হতে দেরি হয় না। তখন গভীর ছায়া নেবে আসে সর্বত্র। কোথায় যাবে তারা? 

পরদিন মোদাব্বের যখন এসে বলে তাদের মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা থেকে সাত দিন হয়েছে তখন তারা একটা গভীর স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেও সে-ঘন ছায়াটা নিবিড় হয়েই থাকে। এবার মোদাব্বের পুলিশ সাব-ইনস্পেক্টরের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তার আত্মীয়তার কথা বলে না। তবু না-বলা কথাটা সবাই মেনে নেয়। 

তারপর দশম দিনে তারা সদলবলে বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। যেমনি ঝড়ের মতো এসেছিল, তেমনি ঝড়ের মতোই উধাও হয়ে যায়। শূন্য বাড়িতে তাদের সাময়িক বসবাসের চিহ্নস্বরূপ এখানে-সেখানে ছিটিয়ে-ছড়িয়ে থাকে খবর কাগজের ছেঁড়া পাতা, কাপড় ঝোলাবার একটা পুরোনো দড়ি, বিড়ি-সিগারেটের টুকরো, একটা ছেঁড়া জুতোর গোড়ালি। 

.

উঠানের শেষে তুলসীগাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরি রং। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয় নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়ে নি। 

কেন পড়ে নি সে-কথা তুলসীগাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা। 

***

‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’রও প্রাথমিক একটি পাঠ আছে যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। অধ্যাপক-সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ তা আবিষ্কার করে সর্বপ্রথম বিদ্বৎসমাজে জ্ঞাত করান। 

এখানে গল্পটির সেই আদি রূপ পরিবেশিত হল : 

ধনুকের মত বাঁকা ইট সিমেন্টের চওড়া পুলটির একশ’ গজ পরে বাড়ীটা। দোতলা, মস্ত; রাস্তা থেকে খাড়া উঠে গেছে। এদেশে ফুটপাত নেই, তাই বাড়ীটারও একটু জমি ছাড়বার ভদ্রতার বালাই নেই। তবে বাড়ীটার পেছনে কিন্তু অনেক জায়গা। গোসলখানা-পাকঘর-পায়খানার মধ্যেকার খোলামেলা পরিষ্কার স্থানটি ছাড়াও আরো ঢের জায়গা। সেখানে আম-জাম-কাঁঠালের দুর্ভেদ্যপ্রায় জঙ্গল, মোটা ঘাসে আবৃত স্যাঁতসেঁতে মাটিতে ভাপসা গন্ধ, আর প্রখর সূর্যালোকেও সূর্যাস্তের ম্লান অন্ধকার। 

অত জায়গা যখন, সামনে খানিকটা ছেড়ে একটা বাগানের মত করলে কি দোষ হতো? সে কথাই এরা ভাবে। মতিন ভাবে, বাগান না থাক, সামনে একটু জমি পেলে ওরা নিজেরাই বাগান করে নিতো, যত্ন করে লাগাতো মওশুমী ফুল, গন্ধরাজ-বকুল-হাস্নাহানা, দু’চারটে গোলাপও। তারপর সন্ধ্যার দিকে আপিস থেকে ফিরে ওখানে বসতো। বসবার জন্য না হয় একটা হাল্কা বেতের চেয়ার নয় ক্যানভাসের আরামকেদারা কিনে নিতো। গল্প করতো বসে-বসে। আমজাদের হুঁকোর অভ্যাস। সে না হয় বাগানের সম্মান বজায় রাখার মত মানানসই একটা নলওয়ালা সুদৃশ্য গুড়গুড়ি কিনে নিতো সন্ধ্যার বিশ্রামবিলাসের জন্য। গল্প জমিয়ে কাদেরও ছিলো। ফুরফুরে খোলা হাওয়ায় তার গলাটা কাহিনীময়, হাস্নাহানার গন্ধের সঙ্গে মিশে মধুর হয়ে উঠতো। কিংবা, জ্যোৎস্নারাতে কোন গল্প না করলেই বা কি এসে যেতো? মুখ বরাবর আস্ত চাঁদটার পানে চেয়ে চুপচাপ কি বসে থাকা যেতো না? আপিস থেকে শ্রান্ত হয়ে ফিরে প্রায় রাস্তা থেকে ওঠা দোতলায় যাবার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে সে কথা তাদের আরো বারবার মনে হয়। 

এরা দখল করেছে বাড়ীটা। অবশ্য দখল করবার সময় লড়াই করতে হয়নি, অথবা তাদের সাময়িক শক্তি অনুমান করে কেউ এমনি হার মেনে নেয়নি। দেশ-ভঙ্গের হুজুগে এ শহরে আসা অবধি উদয়াস্ত তারা একটা যেমন-তেমন ডেরার সন্ধানে ঘুরছিলো। একদিন দেখলো এই বাড়ীটা, মস্ত বড় বাড়ী জনমানবহীন অবস্থায় খাঁ-খাঁ করছে। প্রথমে তারা বিস্মিত হয়েছিলো পরে সদলবলে এসে দরজার তালা ভেঙে রৈ-রৈ আওয়াজ তুলে বাড়ীটায় প্রবেশ করে বৈশাখের আমকুড়ানো ক্ষিপ্র উন্মাদনায় এমন মত্ত হয়ে উঠলো যে ব্যাপারটা তাদের কাছে দিনদুপুরে ডাকাতির মত মোটেই মনে হলো না। মনে কোন অপরাধের চেতনা যদি বা ভার হয়ে নাব্বার প্রয়াস পেতো সে ভার তুলোধুনো হয়ে উড়ে যেতো তীক্ষ্ণ সে হাসির ঝলকে। 

বিকেলের দিকে শহরে যখন খবরটা ছড়িয়ে গেলো তখন অবাঞ্ছিতদের আগমন শুরু হলো। মাথার উপর একটা ছাতের আশায় তারা দলে দলে আসতে লাগলো। এরা কিন্তু রুখে দাঁড়ালো। ডাকাতি নাকি? যথাসম্ভব মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে বললে, জায়গা কোথায়, সব ঘর ভর্তি। বললে, দেখুন সাহেব, এই ছোট অন্ধকার ঘরেও চার-চারটে বিছানা পড়েছে। এখন তো বিছানা, পরে ছ ফুট বাই তিন ফুটের চারটে চৌকি, খান ছয়েক চেয়ার বা টেবিল এনে ঘরে জায়গা বলে কোন বস্তু থাকবে না। কেউ সমবেদনা করে বললো, আপনাদের তকলিফ বুঝতে পারছি। আমরা কি এক দিন কম কষ্ট করেছি? তা ভাই আপনার কপাল মন্দ। যদি চার ঘণ্টা আগে আসতেন। চার ঘণ্টা কেন, ঘণ্টা দুয়েক আগেও তো নিচে কোণের ঘরটা এ্যাকাউন্টস আপিসের মোটামত একটা লোক এসে দখল করলো। রাস্তার উপর ঘর, তবু মন্দ কি। জানালার কাছেই সরকারী আলো, কোন দিন যদি আলো নিভে যায় রাস্তার ওই আলোতেই তোফা চলে যাবে। 

দেশময় একটা ঘোর পরিবর্তনের আলোড়ন হয়েছে বটে তবু কোন প্রান্তে সঠিক মগের মুল্লুক বসেনি। কাজেই পরে এ বেআইনী কাজের তদারক করতে পুলিশ এসেছিলো। 

পলাতক গৃহকর্তা যে বাড়ী উদ্ধারের জন্য সরকারের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন তা নয়। দখলের কথা জানলে দিতেনও কিনা সন্দেহ। যিনি প্রাণের ভয়ে এত বড় একটা পরিবার দু’দিনের জন্য স্রেফ দেশ থেকে উধাও করে দিতে পারেন, তাঁর সম্পর্কে সেটা আশা করা বাড়াবাড়ি। পুলিশে খবর দিয়েছিলো ওরাই যারা শহরের অন্য কোন প্রান্তে তখন ডাকাতির ফিকিরে ছিলো বলে এখানে চারঘণ্টা আগে, বা দু’ঘণ্টা আগেও এসে পৌঁছুতে পারেনি। নেহাৎ কপালের কথা। তবে ওদের কথা হচ্ছে, এদের কপালেও মন্দ হবে না কেন। ভাগ্যের ফল রক্ষার্থে নিরীহ লোকেরাও আবার রীতিমত লেঠেল হয়ে উঠতে পারে। সত্যি সত্যি লাঠালাঠি না করলেও তার জন্য তৈরী হয়ে থেকে এরা সমগ্র ব্যাপারটা পুলিশকে এমনভাবে বুঝিয়ে দিলো যে সাব-ইনসপেক্টর দ্বিরুক্তি না করে সদলবলে ফিরে গেলো। রিপোর্ট দেবার কথা। তা এসব ঘোরালো করে রিপোর্ট দিলে যে সমার্থ উদ্ধারের ভয়ে তার ওপরওয়ালার কাছে সে রিপোর্ট ফাইল চাপা দিয়ে রাখাই শ্রেয় মনে হলো। তাছাড়া তাড়াতাড়িই বাকী যারা পালিয়ে গেছে তাদের প্রতি সমবেদনার কোন কথা ওঠে না এবং বাড়ীর নিরুদিষ্ট মালিক যদি এসে কিছু না কয় তবে কেন অনর্থক মাথা ব্যথা করা। তাছাড়া, এরা কেরানী হলেও ভদ্রলোকের ছেলে, দখল করে আছে বলে জানলা দরজা ভেঙে ফেলছে বা ছাতের আস্ত আস্ত বীম সরিয়ে সোজা চোরাবাজারে চালান করে দিচ্ছে, তা নয়। 

রাতারাতি সরগরম হয়ে উঠলো বাড়ীটা। এদের অনেককেই কলকাতায় ব্লকম্যান লেনে খালাসী পট্টিতে, বৈঠকখানায় দফতরীদের পাড়ায়, সৈয়দ সালেহ লেনে তামাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অথবা চমরু খানসামা লেনের অকথ্য দুর্গন্ধ নোংরার মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। এ বাড়ীর বড় বড় কামরা, নীলকুঠি দালানের ফ্যাশানে দেয়ালে মস্ত মস্ত জানালা, পেছনে খোলামেলা উঠান, আরো পেছনে বনজঙ্গলের মত আম, জাম, কাঁঠালের বাগান এদের কি যে ভালো লেগেছে বলবার নয়। একেকজন লাট বেলাটের মত এক-একখানা ঘর দখল করে নেই সত্যি তবু বড় বড় ঘরে নির্ঝঞ্ঝাট হাওয়া চলাচল, এবং আলোর ছড়াছড়ি দেখে অত্যন্ত খুশী। মনে হয় এবার বাঁচলাম, ফরাকত মত থেকে আলোবাতাস খেয়ে জীবনে এবার সতেজ সবুজ রক্ত ধরবে, হাজার দু’হাজার ওয়ালাদের মত মুখে জৌলুস আসবে, দেহ ম্যালেরিয়া কালাজ্বরের জীবাণু থেকে মুক্ত হবে। 

যেমন ইউনুস থাকতো ম্যাকলিওড স্ট্রীটে। সাহেবী নাম হলে কি হবে, গলিটার এক এক অংশ যেন সকালবেলাকার আবর্জনা ভরা আস্ত ডাস্টবিন। সে-গলিতেই একটা নড়বড়ে ধরনের কাঠের দোতলায় কর্চ দেশীয় চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সে থাকতো। কে কবে বলেছিলো চামড়ার গন্ধ নাকি ভালো, যক্ষ্মার বীজাণু ধ্বংস করে। তাছাড়া সে উৎকট গন্ধ ড্রেনের পচা ভোসকা গন্ধও বেমালুম ডুবিয়ে দিত; ঘরের কোণে দশ দিন ধরে ইঁদুর কিংবা বিড়াল মরে পচে থাকলেও নাকে টের পাবার জো ছিল না। ইউনুস ভাবতো মন্দ কি। অন্ততপক্ষে যক্ষ্মার বীজাণু ধ্বংস হবার কথাটা মনে বড় ধরেছিলো। শরীরটা তার ভালো নয় তেমন; রোগাপটকা দুর্বল মানুষ। এখানে দোতলার দক্ষিণ দিকের বড় ঘরটায় জানালার পাশে শুয়ে সূর্যালোকের সোনালী ঝলকানি দেখে ম্যাকলিওড স্ট্রীটের আস্তানার কথা মনে করে শিউরে ওঠে। ভাবে, এতদিনে কি হয়ে গেছে কে জানে। টাকা থাকলে বুকটা একবার দেখিয়ে আসতো ডাক্তারকে। সাবধানের মার নেই। 

ভেতরে রান্নাঘরের বাঁ ধারে একটা চৌ’কোনো আধ হাত উঁচু ইটের মঞ্চের ওপর একটি তুলসী গাছ। একদিন সকালবেলায় নিমের ডাল দিয়ে মেছোয়াক করতে করতে মোদাব্বের উঠোনে পায়চারী করছে হঠাৎ তার নজরে পড়লো তুলসী গাছটা। মোদাব্বের হুজুগে মানুষ, একটু কিছু হলেই প্রাণ শীতল করা রৈ রৈ আওয়াজ উঠিয়ে দেয়। এরা সব উঠে এলো। যতটা আওয়াজ ততটা গুরুতর না হলেও কিছু তো অন্তত ঘটেছে। 

এই তুলসী গাছটা। এটাকে উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা যখন এসেছি বাড়ীতে কোন হিন্দুয়ানী চিহ্ন থাকবে না। 

সবাই তাকালো সেদিকে। খয়েরী রঙের আভায় গাঢ় সবুজ পাতাগুলো কেমন ম্লান হয়ে আছে। নীচে ক’দিনের অযত্নে ঘাস গজিয়ে উঠেছে। আশ্চর্য, এটা এতদিন চোখেই পড়েনি। কেমন যেন লুকিয়ে ছিলো। 

ওরা কিন্তু হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো। যে বাড়ী এত শূন্য মনে হয়েছে, সিঁড়ির ঘরের দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা কটা নাম থাকলেও এমন বেওয়ারিশ ঠেকেছে, যে বাড়ীর চেহারা হঠাৎ বদলে গেলো। তুলসী গাছটা আচমকা ধরা পড়ে গিয়ে অনেক কথা যেন বলে উঠলো। 

এদের স্তব্ধতা দেখে মোদাব্বের আরেকটা হুঙ্কার ছাড়লো। ভাবছো কি? কথা নেই, উপড়ে ফেলো। 

হিন্দু রীতিনীতি এদের ভালো জানা নেই। তবু কোথায় শুনেছে হিন্দু বাড়ীতে প্রতি দিনান্তে গৃহকর্ত্রী তুলসী গাছের তলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়, গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে। ঘাস গজিয়ে ওঠা পরিত্যক্ত চেহারার এ তুলসী গাছের তলেও প্রতি সন্ধ্যায় কেউ প্রদীপ দিতো। আকাশে যখন সন্ধ্যাতারাটি বলিষ্ঠ একাকিত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো ঠিক সে সময়ে ঘনায়মান ছায়ার মধ্যে আনত সিঁদুরের নীরব রক্তাক্ত স্পর্শে একটি শান্ত ধীর প্রদীপ জ্বলে উঠতো, প্রতিদিন হয়তো বছরের পর বছর এমনি জ্বলেছে। ঘরে দুর্দিনের ঝড় এসেছে, হয়তো কারো জীবন-প্রদীপ নিভে গেছে, তবু হয়তো এ প্রদীপ দেয়া অনুষ্ঠান একদিনের জন্যও বন্ধ থাকেনি। 

যে গৃহকর্ত্রী বছরের পর বছর এ তুলসীতলে প্রদীপ দিয়েছে সে আজ কোথায়? কেন চলে গেছে? মতিন এক সময়ে রেলওয়েতে কাজ করতো। সে ভাবে হয়তো কলকাতায়, নয় আসানসোল, নয়তো বৈদ্যবাটি হাওড়ায় কোন আত্মীয়ের আস্তানায় লিলুয়া বা নয় কেন। বিশাল রেলইয়ার্ডের পাশে মসৃণ একটি কালো দোতলা বাড়ীর ছাত থেকে চওড়া লাল পাড়ের শাড়ীটা ঝুলছে হয়তো সেটা এ গৃহকর্ত্রীরই। কিন্তু যেখানেই থাকুন, আকাশে যখন দিনান্তের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে তখন হয়তো প্রতি সন্ধ্যায় এ তুলসীতলার কথা মনে করে গৃহকর্ত্রীর চোখ ছলছল করে। 

গতকাল থেকে ইউনুসের সর্দি সর্দি ভাব। সে কথা বললে, 

—থাক না ওটা। আমরা তো আর পূজা করতে যাচ্ছি না। বরঞ্চ ঘরে একটা তুলসীগাছ থাকলে ভালোই। সর্দিককে তার পাতার রস উপকারী। 

—মোদাব্বের এধার ওধার চাইলো। সবার যেন তাই মত। ওদের মধ্যে এনায়েত মৌলভী ধরনের মানুষ। মুখে দাড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আছে, সকালে নাকি সুরে কোরান তালাওয়াতও করে। সে পর্যন্ত চুপ। প্রতি সন্ধ্যায় ছলছল করে ওঠা গৃহকর্ত্রীর চোখের কথা কি ওরও মনে হলো? অক্ষতদেহে তুলসী গাছটা বিরাজ করতে থাকলো। বাড়ীটার আবহাওয়া ভালো। কলকাতার ঝিমিয়ে-আসা নিস্তেজ ভাবটা যেন কেটে গেছে। আড্ডাও তাই জমে ভালো, দেখতে না দেখতে মুখে ফেনা-ওঠা তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক সব রকম আলোচনা। সাম্প্রদায়িকতার কথাও ওঠে মাঝে মাঝে 

—ওরাই তো মূল, সবের বলে। বলে, হিন্দুদের নীচতা ও গোঁড়ামির জন্যই তো আজ দেশটা এমন ভাগ হয়ে গেলো। তারপর তাদের অবিচার-অত্যাচারের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত দেয়। রক্ত গরম হয়ে ওঠে সবার। দলের ভেতর বামপন্থী নামে চালু মকসুদ মিঞা কখনো কখনো প্রতিবাদ করে। বলে, অতটা নয়। এতটা হলেও আমরা বা কম কি। মোদাব্বের দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে। দেখে তথাকথিত বামপন্থীর কাঁটা নড়ে। সে হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবে, কে জানে বাবা, আমরাও হলফ করে বলতে পারি দোষটা ওদের, ওরাও শালা তেমনি হলফ করে বলতে পারে দোষটা আমাদের, ব্যাপারটা বড় ঘোরালো, বোঝা মুকিল। ভাবে, হয়তো আমরাই ঠিক। আমাদের ভুল হবে কেন। আমরা কি জানি না আমাদের। 

কাঁটা সংশয়ে দুলে দুলে হঠাৎ ডানে হেলে গিয়ে স্থির হয়ে গেলো। কাঁটাটি কখনো কখনো না বুঝে বাঁয়ে হেলে আসে বলেই ওর বামপন্থীর অপবাদ। 

পায়খানার দিকে যেতে যেতে রান্নাঘরের পাশে তুলসীগাছটি চোখে পড়ে। কে আগাছা সাফ করে দিয়েছে। পাতাগুলো শুকিয়ে উঠে খয়েরী রঙ ধরেছিল আবার যেন গায়ের রঙের মধ্যে কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। কে তার গোড়ায় পানি দিচ্ছে। অবশ্য খোলাখুলিভাবে, লোক দেখিয়ে দিচ্ছে না। সমাজে চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা তো আছে। 

ইউনুস ভেবেছিলো ম্যাকলিওড স্ট্রীটের চামড়া ব্যবসায়ীদের নোংরা আস্তানায় আর কখনো ফিরে যেতে হবে না—এখানে আলো-বাতাসের মাঝে জীবনের জন্য সে বেঁচে গেলো। কিন্তু সে ভুল ভেবেছিলা। শুধু ইউনুস কেন সবাই—যারা ভেবেছিলো এ মাঙ্গার দিন ভালো করে খেতে না পাক, বাড়ীতে প্রয়োজন মত টাকা পাঠাতে না পারুক, কিন্তু আলো হাওয়ার ভেতরে ফরাগত মত থেকে জীবনের দুষ্প্রাপ্য আরামটুকু করবে—তারা প্রত্যেকে ভুল করেছিলো। তবু যাহোক সামনে জমি নেই। থাকলে ওরা আজ বাগান করতো এবং এই সময়ে অন্য কিছু না হোক, গাঁদাফুলের গাছ বড় হয়ে উঠতো। তাহলে কি প্রচণ্ড ভুলই না হতো। 

মোদাব্বের হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো, পুলিশ এসেছে। –কেন? ভাবলো, হয়তো রাস্তা থেকে পালিয়ে একটা ছ্যাচড়া চোর বাড়ীটায় এসে ঢুকেছে। কিন্তু সেটা খরগোসের মত কথা হলো। শিকারীর সামনে পালাবার আর পথ না পেয়ে হঠাৎ বসে পড়ে চোখ বুজে খরগোস ভাবে, কই আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তারাই তো চোর, কেবল গা ঢাকা দিয়ে না থেকে চোখ বুজে আছে। 

পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর সাবেকী আমলের হ্যাট বগলে রেখে তখন দাগ পড়া কপালের ঘাম মুছছে। কেমন একটা নিরীহ ভাব। পেছনে বন্দুকধারী কনস্টেবল দুটোকে মস্ত গোঁফ থাকা সত্ত্বেও আরো নিরীহ দেখাচ্ছে। ওরা নিস্তব্ধভাবে কড়িকাঠ গুনতে লাগলো। ওপরে গুলগুলির খোপে এক জোড়া কবুতর বাসা বেঁধেছে। একটা সাদা আরেকটা ধূসর। তাও দেখতে পারে তারা তাকিয়ে তাকিয়ে। হাতে বন্দুক আছে কিনা। 

মতিন সবিনয়ে বললে, 

—আপনার কাকে দরকার? 

—আপনাদের সবাইকে। আপনারা বে-আইনীভাবে এ বাড়ী কবজা করেছেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনাদের এ বাড়ী খালি করে দিতে হবে—বলে অর্ডার দেখালো। 

বাড়ীর কর্তা তাহলে ফিরে এসেছে। ট্রেন থেকে নেমে এখানে এসে কাণ্ডটা দেখে সোজা থানায় চলে গেছে। এখন সঙ্গে এসেছে কিনা দেখবার জন্য আফজল একবার গলা উঁচিয়ে দেখলো। কেউ নেই। পেছনে কেবল গোঁফওয়ালা বন্দুকধারী কনস্টেবল দুটো। 

—কেন? বাড়ীওয়ালা কি নালিশ করেছে? 

—গভমেণ্ট বাড়ী রিকুইজিসন করেছে। 

অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলো তারা। অবশেষে মতিন বললে,– 

—আমরা তো গভমেন্টেরই লোক। 

মাঝে মাঝে মানুষের নির্বুদ্ধিতা দেখে অবাক হতে হয়। কথা শুনে নিস্তব্ধ কনস্টেবল দুটো পর্যন্ত কড়িকাঠ থেকে চোখ নামিয়ে তাকালো তাদের পানে, ভাবাচ্ছন্ন চোখ হঠাৎ কথা কয়ে উঠলো। 

বাড়ীতে এর পর একটা ছায়া নেমে এলো। ভাবনার অন্ত নেই। কোথায় যাই এই চিন্তা। কেউ কেউ রেগে উঠে বলে, কোথাও যাব না, এইখানেই থাকবো। দেখি কে উঠায়। কেউ যদি এ বাড়ীর চৌকাঠ পেরোয় তবে সে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে আসবে। ( কোথায় ছাত্ররা নাকি এমনি গায়ের জোরে একটা বাড়ী দখল করে আছে। তাদের ওঠাবার চেষ্টা করে সরকারের উচ্চতম কর্তারা পর্যন্ত নাকি নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে। সে কথাই স্মরণ হয়।। অবশেষে রক্ত তাদের গরম হয়ে ওঠে। বলে, কখনো ছাড়বো না। যে আসে আসুক, কিন্তু সে যেন এ কথা জেনে রাখে যে, তাকে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে আসতে হবে। 

ক-দিন গরম রক্ত টগবগ করলো। কাজে মন নেই, খাওয়ায় মন নেই। কেবল কথা, তিক্তরসে সিঞ্চিত ঝাঁঝালো কথা। কিন্তু ক্রমশ কথা কমতে লাগলো। এবং এদের কথা থামলে রক্ত ঠাণ্ডা হতে ক-দিন। 

এরা তো আর ছাত্র নয়। এরা যে কি, সে কথা দর্প করে সেদিন পুলিশকে নিজেরাই তো বলেছিলো। বাড়ী রিকুইজিসন হবার কথা শুনে কিছুক্ষণ বিমুখ থেকে বলেছিলো, কেন, আমরা তো গভর্ণমেন্টেরই লোক। 

একদিন তারা সদলবলে চলে গেলো। যেমন ঝড়ের মত এসেছিলো তেমনি ঝড়ের মত চলে গেলো, ঘরময় ছিটিয়ে রেখে গেলো পুরোনো খবর কাগজের টুকরো, কাপড় ঝোলাবার দড়ির একটা দুর্বল অংশ, বিড়ি-সিগারেটের মোতা, বা ছেঁড়া জুতোর গোড়ালীটা। নীল কুঠি-বাড়ীর ফ্যাশানে তৈরী দরজা-জানালা গুলো খাঁ-খাঁ করতে লাগলো। কিন্তু সে আর ক-দিন। রঙ বেরঙের পর্দা ঝুলবে সেখানে। 

পেছনে রান্নাঘরের পাশে তুলসীগাছটা কেমন শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় আবার খয়েরী রঙ ধরেছে। যেদিন পুলিশ এসে বাড়ী ছাড়বার কথা জানিয়ে গেলো সেদিন থেকে তার গোড়ায় কেউ পানি দেয়নি। তুলসীগাছের কথা না হোক, গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও কি এদের আর মনে পড়েনি? 

কেন পড়েনি সে কথা কেবল তুলসীগাছ জানে, যে তুলসীগাছকে মানুষ বাঁচাতে চাইলে বাঁচাতে পারে, ধ্বংস করতে চাইলে এক মুহূর্তে ধ্বংস করতে পারে অর্থাৎ যার বাঁচা বা সমৃদ্ধ হওয়া আপন আত্মরক্ষার শক্তির উপর নির্ভর করে না। 

***

5 Comments
Collapse Comments

গল্পটা অনেক ভালো।পড়ে ভালো লাগলে

ড. হাসিবুশ শাহীদ August 23, 2021 at 8:25 am

এই কালজয়ী গল্প প্রকাশ করায় ধন্যবাদ!
ড. হাসিবুশ শাহীদ, বিভাগীয় প্রধান( ভূগোল) কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, কুষ্টিয়া।

কী আবল তাবল গল্প লেখছো? ভালো কিছু বিষয় নিয়ে গল্প লিখেন।

এক সময় স্কুলের পাঠও ছিলো, সেই সময় যে গভীরতা অনুভব করেছি, আজও তার দিগুন অনুভব করলাম। এই সময় দাঁড়িয়ে থেকে এরকম সামাজি গল্প মানবতার শ্রী বৃদ্ধি করে। ধণ্যবাদ এই গল্পটির জন্যে।

dada amader o pathyo chilo…aj hotat porlam…ki osadharon laglo…ekhon mone hoche koto choto chilam class 12 e…protita line, protita shobdo jano muktor moto jhokjhoke..kurnish janai tader jara school er syllabus e ei golpoti diechilen

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *