আত্মজ – ৩য় অংশ

তিন

আজ নিয়মভঙ্গ ছিল। ভালোয় ভালোয় চুকে গেল সব কাজ।
নিমন্ত্রিতরা প্রায় সবাই এসেছিল। দু-তিনজন ছাড়া। চন্দন আর চন্দনের বউ শেষ মুহূর্তে আটকে গেল। ওদের বাচ্চাটা নেহাতই দুগ্ধপোষ্য, সকাল থেকে বমি পায়খানা করে ভাসাচ্ছে। আর এলো না সন্তুদার বউ। শুক্রবার তার কী সব তন্তোষী মা-ফা থাকে, এদিন বাড়ির বাইরে তার খাওয়া নিষেধ।
খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরে আড্ডা হলো জমিয়ে। এ-প্রসঙ্গ, সে-প্রসঙ্গ, এ-কথা সে-কথা। রনিদা আজ ন পিস্ তপসে মাছের ফ্রাই খেয়েছে, সন্তুদা চোদ্দোখানা রসগোল্লা,—বেচারা ক্যাটারারের মুখটা কেমন আমসি হয়ে গিয়েছিল বলতে বলতে টুসিদি খুকুদির কী হাসি। ব্যাস, চলতে লাগল খাওয়ার গল্প। কে কোন নেমন্তন্ন বাড়িতে কোন সিঁটকে প্যাংলাকে আশি পিস মাছ খেতে দেখেছে, কোথায় কে কবে চার হাঁড়ি দই শেষ করেছিল, কার বাড়িতে বরযাত্রীরা নুন মাখিয়ে খেয়ে পুরো মিষ্টি সাবাড় করে দিয়েছিল, এসব। সন্তুদার স্টকে প্রচুর মড়া পোড়ানো স্টোরি, গুছিয়ে গুছিয়ে ছাড়ল কয়েকখানা। তার মধ্যেই মার কথাও উঠছিল হঠাৎ হঠাৎ, শ্রাদ্ধের দিনের মতোই। কলরোল রঙ্গরসিকতার মাঝে চাপাও পড়ে যাচ্ছিল মা। এমনই হয় বোধ হয়। শ্রাদ্ধের আড়ম্বরে মৃত মানুষটা ফিকে হয়ে যায় অনেকটাই। শোক থাকলেও তা তেমন প্রকট হওয়ার সুযোগ পায় না।
আসর ভাঙল সন্ধ্যের মুখে। একে একে বিদায় নিল সবাই।
যাওয়ার সময়ে খুকুদির বর বলল, বুঝলে বাবলু, আমার মনে হয় এবার তোমাদের কটা দিন একটু বাইরে ঘুরে আসা উচিত।
খুকুদি বলল, হ্যাঁ রে, পারলে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আয়। মাসির জন্য তোদের যা অবস্থা গেল …। শরীর-মন দুটোই চাঙ্গা হওয়া দরকার।
যেতে পারলে তো ভালোই হতো। রোগী-রোগ, ওষুধ ও ডাক্তার করতে করতে সত্যি তো হাঁপিয়ে উঠেছি। কিন্তু এক্ষুনি, এক্ষুনি বেরোই কী করে? মা নেই বটে, কিন্তু ধারদেনাগুলো তো আছে।
উদাস মুখে বললাম, দেখি। কয়েকটা দিন যাক।
বাড়ি খালি হতেই হাতে রাশি রাশি কাজ। পরশু থেকে সোফা-টেবিলগুলো দেয়ালে ঠেলা রয়েছে, সন্তুদা যাওয়ার আগে কিছুটা টেনেটুনে দিয়ে গেছে, ধরাধরি করে ফেরালাম স্বস্থানে। রান্নাঘরে অবশিষ্ট খাবার-দাবারের ডাঁই, ছোট ছোট গামলায় ঢেলে খানিক ঢোকানো হলো ফ্রিজে। মাছ ভাজাগুলো বাইরেই রইল, শীতকালে কি আর পচবে? মেঝেটেঝেরও অকহতব্য দশা, মোটামুটি পদে আনতে হিমশিম খাওয়ার জোগাড়। মাঝে ক্যাটারিংয়ের লোকটাও এলো, হিসাবপত্র করে মিটিয়ে দিলাম তার টাকা। আটটা নাগাদ দুম করে চন্দন। বসব না বসব না করেও বসল একটুক্ষণ, জোর করে তাকে দুপুরের খাওয়াটা খাইয়ে দিল সুপ্তি।
রাতে অবশ্য আমি কিছু ছুঁলাম না। সুপ্তিও না। আঁশটে গন্ধে চতুর্দিক ম ম, গা গুলোচ্ছিল। মামপি গোগোলও বেজায় ক্লান্ত, গোগোল তো সন্ধে থেকেই ঢুলছিল, চন্দনের সঙ্গে বসে যৎসামান্য খেয়ে দুই ভাইবোনই বিছানায় ধপাস।
শোয়ার আগে সোফায় বসে সিগারেট টানছিলাম। সামনে টিভি চলছে, স্পোর্টস চ্যানেল। উত্তেজক এক ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে, সম্ভবত স্প্যানিশ লিগ। শব্দ কমিয়ে পর্দার দিকে তাকিয়ে আছি, দেখছি না কিছুই। মাথাটা কেমন জ্যাম হয়ে গেছে। কদিন ধরে যা দৌড়ঝাঁপ গেল।
সুপ্তি মামপি গোগোলের ঘরে মশারি টানাতে গিয়েছিল। পাশে এসে বসল। তার চোখও খানিকক্ষণ পর্দায় স্থির।
হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বাড়িটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল, না?
কথাটা ঠিক বোধগম্য হলো না। ফাঁকা কেন বলছে? কদিন বাড়িতে ভিড় লেগে ছিল, তাই?
সুপ্তি আবার একটা শ্বাস ফেলল, যেভাবেই থাক, তবু তো মা ছিলেন।
—হুঁ।
—তোমার আর কী, অফিস চলে যাবে। একা বাড়িতে আমার যে কী করে কাটবে!
—হুঁ।
—খুকুদি তখন ঠিকই বলছিল। আমাদের কোথাও থেকে ঘুরে আসা উচিত। বেশি দূরে নয় নাই গেলাম, কাছাকাছি যাওয়াই যায়, কী বলো? এই ধরো দিঘা কিংবা পুরী কিংবা ঘাটশিলা মধুপুর …
—বুঝলাম। কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে?
—আর অত টাকা টাকা করে মাথা খারাপ কোরো না তো। সুপ্তি দু-এক সেকেন্ড চুপ থেকে গলা নামাল, মার খরচটা তো কমে গেল… তা ছাড়া এক্ষুনি তো আর যাচ্ছি না, মামপি গোগোলের পরীক্ষাটা হোক, গরমের ছুটি পড়ুক …
টিভিতে একটা গোল হলো এইমাত্র। কৃষ্ণকায় গোলদাতা জার্সি খুলে ফেলেছে, বিপুল উৎসাহে খালি গায়ে দৌড়োচ্ছে মাঠময়। দর্শকরা পতাকা নাড়ছে। ভেঁপু বাজাচ্ছে, ক্যানেস্তারা পেটাচ্ছে আনন্দে।
রিমোট টিপে টিভি অফ করে দিলাম। শব্দহীন শব্দটাও উধাও। অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছে হঠাৎ। ডাইনিং স্পেসে ফ্রিজটা গোঁও করে উঠল। গোঙাতে গোঙাতে সে আওয়াজও বোবা হয়ে গেল আচমকাই।
সুপ্তি উঠে দাঁড়িয়েছে। হাই তুলতে তুলতে বলল, শোবে না?
—চলো। যাচ্ছি।
দু পা গিয়েও ফিরে এলো সুপ্তি। বলল, একটা কথা ভাবছিলাম, বুঝলে?
—কী?
—তোমার তো সোমবার থেকে অফিস, কাল-পরশুর মধ্যে … ভাবছিলাম ঘরগুলোকে একটু রিওরিয়েন্ট করব।
—কী রকম?
—মামপি গোগোল একসঙ্গে থাকলেই ঝগড়া হয়, মামপির পড়ার জায়গাটা আলাদা করে দিলে হয় না? ধরো যদি মার ঘরে …
—মামপি মার ঘরে একা থাকতে পারবে?
—আহা, থাকার কথা কে বলছে? টেবিল-চেয়ার পেতে ওটা যদি ওর স্টাডিরুম করে দিই …
ওখানে টেবিল ঢুকবে?
—মার কিছু জিনিস যদি ও ঘর থেকে বার করে দেওয়া যায় … ধরো, মার সেলাই মেশিনটা, ছোট মিটসেফটা, ডাউস আলনাটা … আমি অনেকটাই সাফসুতরো করেছি, আরো কিছু মাল যদি …
—আঃ সুপ্তি! মানুষটা এখনো ওপারে পৌঁছল কি না ঠিক নেই …
স্বরে বুঝি আমার ঝাঁজ ফুটেছিল একটু। সুপ্তি থমকে গেছে। ভার ভার গলায় বলল, আমি অত ভেবে বলিনি। স্যরি।
—ঠিক আছে। দেখব কী করা যায়।
সুপ্তি তবু ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর চলে গেল শুতে।
আবার একটা সিগারেট ধরালাম। হাত বোলাচ্ছি মুণ্ডিত মস্তকে। সুপ্তি খারাপ কী বলেছে? সত্যি তো, মার ঘর তো আর চিরকাল খালি পড়ে থাকবে না, আজ নয় কাল মামপি গোগোল কেউ একজন দখল নেবেই। এক্ষুনি এক্ষুনি অবশ্য পারবে না, ভয় পাবে। থাক, দু-চারটে মাস যাক। তারপর নয় পুরনো খাট-আলমারি সরিয়ে, দেয়াল-টেয়ালের রং ফিরিয়ে নতুন চেহারা দেওয়া যাবে ঘরখানাকে। আপাতত সুপ্তি যা চাইছে …
ভাবতে ভাবতে কখন উঠে পড়েছি। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছি মার দরজায়। চিন্তাটাকে মাথায় নিয়েই ঘরের আলো জ্বালালাম।
সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ছ্যাঁত। মা একেবারে আমার মুখোমুখি!
উঁহু, মা নয়। মার ছবি।
বেঁটে আলমারির মাথায় জ্বলজ্বল করছে বাঁধানো ফটোখানা। পরশু ছবিটা ফুলে ফুলে ঢেকে ছিল। আজ একটাই মোটা মালা। রজনী গন্ধার। সামান্য শুকিয়েছে ফুলগুলো, তবু একটা পলকা গন্ধ যেন বিছিয়ে রেখেছে ঘরময়। ছবির সামনে ধূপের ছাই, নিবে যাওয়া প্রদীপ।
কী অদ্ভুত রকমের জ্যান্ত ছবিটা! ঠিক মনে হয় সোজাসুজি আমার দিকেই তাকিয়ে!
সরে গেলাম একটু। আশ্চর্য, মার চোখও সরছে! ডান দিকে যাচ্ছি, বাঁয়ে …। আমার দিকেই ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে মার দৃষ্টি! খাটের ওপাশটায় গিয়ে দাঁড়ালাম, চোখের মণি দুটো সেখানেও পৌঁছে গেছে! আলমারির পাশে চলে গেলাম, সেখানেও …।
অবিকল সেই বাঙ্ময় চোখ! আমাকেই দেখছে! শুধু আমাকে।
গা ছমছম করে উঠল। প্রাণপণে যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করছি। এটা তো স্রেফ ছবি। ফটো। আমারই তোলা। ক্লোজআপ। মামপির পাঁচ বছরের জন্মদিনে। কারেন্ট কোনো সিঙ্গল ফটো নেই বলে এটাকেই এনলার্জ করে শ্রাদ্ধের জন্য বাঁধিয়ে দিয়েছে সন্তুদা। এ ছবি তো কদিন ধরে বারবারই দেখছি। লেন্সের দিকে সরাসরি তাকালে সব চোখই এরকম লাগবে …।
নাহ্, এ আমার মনেরই ভুল।
নিজেকে খানিকটা স্থিত করে আলো নিবিয়ে দিলাম। বেরিয়ে আসছি, হঠাৎই স্পষ্ট ডাক, বাবলু …?
মার গলা! মারই গলা!
এও কি বিভ্রম? আমার পা মাটিতে গেঁথে গেল। সম্মোহিতের মতো বলে উঠেছি, কী হলো মা? কিছু বলবে?
চেনা স্বর কেমন দুলে দুলে গেল, আমায় মাপ করে দিস বাবলু। মৃত্যুটা যে আমার হাতে ছিল না রে।
আমূল কেঁপে গেলাম। এই কথাটুকু উচ্চারণ করার জন্যই কি ছটফট করত মা? মা কি আমার ভেতরটা টের পেয়ে গিয়েছিল?
ভীষণ কান্না পাচ্ছিল আমার। মার মৃত্যুর পর এই প্রথম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *