ঋগ্বেদ ১০।০২৭

ঋগ্বেদ ১০।০২৭
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ১০ম মণ্ডল সূক্ত ২৭
ইন্দ্র দেবতা। বসুক্র ঋষি।

১। ( ইন্দ্ৰ কহিতেছেন) –হে স্তবকারী ভক্ত! আমার এইরূপ স্বভাব যে, সোমযজ্ঞের অনুষ্ঠানকারী যজমানকে আমি অভিলষিত ফল দিয়া থাকি। আর যে হোমের দ্রব্য আমাকে না দেয়, সে সত্যকে নষ্ট করে। যে কেবল চতুর্দিকে পাপ করিয়া বেড়ায়, তাহার আমি সর্বনাশ করি।

২। (ঋষি কহিতেছেন)-যে সকল ব্যক্তি দৈবকর্মের অনুষ্ঠান না করে এবং কেবল তাহাদিগের নিজের উদর পূরণ করিয়া স্মৃতি হইয়া উঠে, আমি যখন তাহাদিগের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে যাই, তখন, হে ইন্দ্ৰ! তোমার নিমিত্ত পুরোহিতদিগের সহিত একত্র স্থূলকায় বৃষকে(১) পাক করি এবং পঞ্চদশ তিথির প্রত্যেক তিথিতে সোমরস প্রস্তুত করিয়া থাকি।

৩। (ইন্দ্র কহিতেছেন)-এমন কাহাকেও আমি দেখি না, যে ব্যক্তি দেবশূন্য ও দৈবকৰ্ম্মবর্জিত ব্যক্তিদিগকে যুদ্ধে নিধন করিয়াছে এ কথা বলিতে পারে। যখন আমি যুদ্ধে যাইয়া তাহাদিগকে সংহার করি, তখন সকলে সেই সমস্ত বীরত্বের বিষয় বিস্তারিতরূপে বর্ণন করে।

৪। যে সময়ে আমি সহসা অতর্কিতরূপে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হই, তখন যত ঋষিগণ আমাকে বেষ্টন করিয়া অবস্থিতি করেন। প্রজার মঙ্গলের জন্য আমি সর্বত্র বিহারকারী শত্রুকে পরাভব করি, তাহার চরণ ধারণ করিয়াআমি তাহাকে প্রস্তরের উপর নিক্ষেপ করি।

৫। যুদ্ধে আমাক নিবারণ করিতে পারে, এমন কেহ নাই; আমি যদি ইচ্ছা করি, পর্বতেরাও আমাকে রোধ করিতে পারে না। আমি যখন শব্দ করি, তখন যাহার কর্ণ নিতান্ত নিস্তেজ, সেও ভীত হয়, অর্থাৎ তাহার কর্ণকুহর পর্যন্ত সেই শব্দ প্রবেশ করে। এমন কি কিরণমালী সূৰ্য পর্যন্ত দিন দিন কম্পিত হইতে থাকেন।

৬। আমি ইন্দ্র, আমাকে যাহার মানে না, যাহারা দেবতাদিগের নিমিত্ত প্রস্তুত করা হইয়াছে এরূপ সোমরস বলপূর্বক পান করে, যাহারা বাহুচালনা করিতে করিতে হিংসা করিবার জন্য আসতে থাকে, আমি তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ দেখিতে পাই । আমি মহীয়ান, আমি সকলের বন্ধু, আমাকে যাহারা নিন্দা করে, আমার বজ্রের প্রহার তাহাদিগেরই প্রতি প্রেরিত হয়।

৭। (ঋষি বলিতেছেন)—হে ইন্দ্ৰ! তুমি দর্শনও দিলে, বৃষ্টিও বর্ষণ করিলে, তুমি সুদীর্ঘ পরমায়ুঃ প্রাপ্ত হইয়াছ; তুমি প্রথমেও শত্রু বিদীর্ণ করিয়াছ, পরেও করিয়াছ। সেই ইন্দ্র এই বিশ্বভুবনের অপর পারে আছেন, এই সৰ্বব্যাপী দ্যাবাপৃথিবী তাহাকে পরাভব অর্থাৎ পরিচ্ছিন্ন করিতে পারে না।

৮। (ইন্দ্র বলিতেছেন)-গাভীগণ অনেকগুলি একত্র হইয়া যবভক্ষণ করিতেছে; আমি ইন্দ্র, তাহাদিণের স্বত্ত্বাধিকারীর গায় তাহাদিগের তত্ত্বাবধান করিতেছি। দেখিতেছি, যে তাহারা রাখালের সহিত চরিতেছে। সেই সমস্ত গাভীকে আহ্বান করিবামাত্র তাহার আপনাদিগের স্বত্বাধিকারী স্বামীর নিকট উপস্থিত হইল। সেই স্বামী গাভীদিগের নিকট হইতে কতই দুগ্ধ দোহন করিয়া লইয়াছেন।

৯। তোমাতে ও আমাতে একত্র হইয়া এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর মধ্যে এই সকল যবভক্ষণকারী ও ঘাসভক্ষণকারীদিগকে দেখিতেছি। এই স্থানে অবস্থিত হইয়া, এস আমরা দাতাব্যক্তির প্রতীক্ষা করি। সেই পরোপকারী ব্যক্তি যেন পৃথগভূতকে একত্র করিতে পারে, অর্থাৎ সকল পশু একত্র সংগ্রহ করিতে পারে(২)।

১০। নিশ্চয় জানিও, আমি এই স্থানে যাহা কহিতেছি, সত্য। কি দ্বিপদ, কি চতুষ্পদ, সকলি আমি সৃষ্টি করি। যে ব্যক্তি স্ত্রীলোকদিগের সঙ্গে পুরুষকে যুদ্ধ করিতে পাঠায়, আমি বিনা যুদ্ধে তাহার ধন অপহরণ করিয়াভক্তদিগকে ভাগ করিয়া দিই(৩)।

১১। যাহার চক্ষুঃবিহীন কন্যা কখন ছিল, কোন্ বিজ্ঞ ব্যক্তি সেই অন্ধ কন্যাকে আশ্রয় প্রদান করে? যে ইহাকে বহন করে, যে ইহাকে বরণ করে, কেই বা তাহার প্রতি বর্ষাক্ষেপ করে অর্থাৎ হিংসা করে (৪)?

১২। কত স্ত্রীলোক আছে, যে কেবল অর্থেই প্রীত হইয়া নারীসহবাসে অভিলাষী মনুষ্যের প্রতি অনুরক্ত হয়? যে স্ত্রীলোক ভদ্র, যাহার শরীর। সুগঠন, সেই অনেক লোকের মধ্য হইতে আপনার মনোমত প্রিয় পাত্রকে পতিত্বে বরণ করে(৫)।

১৩। সূর্য্যদেব চরণদ্বারা অনেক উদ্গিরণ করিতেছেন, নিজ মণ্ডলস্থিত আলো গ্রাস করিতেছেন। আপন মস্তকের অবরণকারী কিরণসমূহ লোকের মস্তকের দিকে প্রেরণ করিতেছেন। উর্ধে অবস্থিত হইয়া আপন সন্নিধানে অলোক প্রেরণ করিতেছেন, আবার নিম্ন দিকে বিস্তীর্ণ পৃথিবীতে আলোক বিস্তার করিতেছেন।

১৪। যেরূপ পত্রহীন বৃক্ষের ছায়া থাকে না, তদ্রূপ এই প্রকাণ্ড চির বিচরণশীল সূর্যের ছায়া নাই। দ্যুলোকস্বরূপ মাতা স্থির হইয়া রহিলেন, সূর্য্যস্বরূপ গর্ভস্থ শিশু পৃথক্‌ হইয়া দুগ্ধ পান করিতেছে। এই গাভী অপরএক গাভীর বৎসকে স্নেহভরে লেহন করিয়া নিৰ্মাণ করিল। এই গাভী আপনার উধঃ রাখিবার স্থান কোথা পাইল?

১৫। সাত জন পুরুষ নিম্ন স্থান হইতে আগমন করিলেন; আট জন উত্তর দিক হইতে আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হইলেন। সুধীর নয় জন পশ্চিম হইতে উপস্থিত হইলেন, দশজন পূৰ্বদিক হইতে। সকলে সেই যজ্ঞভোজনকারী ইন্দ্রকে সংবর্ধনা করিতে লাগিলেন (৬)।

১৬। দশ জনের মধ্যে সর্বাঙ্গে কপিল বর্ণধারী একজন আছেন, তাঁহাকে ক্রতু সাধনের জন্য প্রেরণ করা হইল। মাতা সন্তুষ্ট হইয়া জলের মধ্যে গর্ভাধান গ্রহণ করিলেন (৭)।

১৭। পুরুষগণ স্থূলকায় মেষপশু পাক করিল। পাশক্রীড়াস্থলে পাশ গুলি নিক্ষিপ্ত হইতে লাগল। আর দুই জন প্রকাণ্ড ধনু ধারণপূর্বক মন্ত্র উচ্চারণ দ্বারা আপনাদিগের দেহ শুদ্ধ করিতে করিতে জলের মধ্যে বিচরণ করিতে লাগিল।

১৮। চীৎকার করিতে করিতে তাহারা চতুর্দিকে গমন করিল, অর্ধেক পাক করিতেছে, আর অর্ধেক পাক করিতেছে না। এই সমস্ত কথা সবিতা দেব আমাকে কহিয়াছেন। কাষ্ঠ যাহার অন্ন, অর্থাৎ অগ্নি, তিনি ঘৃতস্বরূপ অন্ন ভাগ করিয়া দিতেছেন।

১৯। দেখিলাম, বিস্তর লোক দূর হইতে আসিতেছে, অযত্নসিদ্ধ আহার দ্বারা প্রাণযাত্রা নির্বাহ করিতেছে। সেই সকল লোকের প্রভু দুই দুই ব্যক্তিকে যোজিত করিতেছে, তাহার বয়স নবীন, সে তৎক্ষণাৎ বিপক্ষ সংহার করিতেছে।

২০। আমি প্রমর, আমার এই দুই বৃষ যোজিত রহিয়াছে, ইহাদিগকে তাড়াইও না, পুনঃ পুনঃ সান্ত্বনা কর। ইহার ধন জলে নষ্ট হইতেছে। যে বীর গাভীদিগকে মাৰ্জন করিতে জানে, সে উপরে উঠিয়াছে।

২১। এই যে বজ্র প্রকাণ্ড সূৰ্য্যমণ্ডলের নিম্নভাগে ঘোরতর বেগে পতিত হইয়াছে, ইহার পর আরও স্থান আছে। যাহারা স্তব করে, তাহারা অক্লেশে সেই স্থান পার হইয়া যায়।

২২। প্রত্যেক বৃক্ষের অর্থাৎ কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত ধনুকের উপর গাভী অর্থাৎ গাভীর স্নায়ু নিৰ্ম্মিত ধনুর্গুন শব্দ করিতে লাগিল। পুরুষকে ভক্ষন অর্থাৎ শত্রুদিগকে সংহার করে এরূপ পক্ষীগণ অর্থাৎ বাণ সমস্ত নির্গত হইতে লাগিল। তাহাতে সমস্ত ভুবন ভয় পাইল, তখন সকলে ইন্দ্রকে সোমরস দিতে লাগিল এবং ঋষিও তাহা শিক্ষা করিলেন।

২৩। মেষগণ দেবতাদিগের সৃষ্টিকালে সর্ব প্রথম দেখা দিয়াছিল। ইন্দ্র সেই মেঘ ছেদন করাতে, তাহার মধ্য হইতে জল নির্গত হইল। পর্জন্য, বায়ু ও সূৰ্য্য এই তিন দেবতা যথাক্রমে পৃথিবীর উদ্ভিজদিগকে পরিপক্ক করে। আর বায়ু ও সূৰ্য্য এই দুই দেবতা প্রীতিকর জলকে বহন করতে থাকে।

২৪। সেই সূৰ্য্যই তোমার প্রাণধারণের উপায়স্বরূপ। যজ্ঞের সময় সূর্যের সেই প্রভাব গোপন করিও না, অর্থাৎ বর্ণনা ও স্তব করিতে শৈথিল্য করিও না, সেই সূর্য স্বর্গকে প্রকাশ করিয়াছেন, তিনি জলকে গোপন অর্থাৎ শোষণ করেন, তিনি পরিষ্কারক। তিনি নিজের গতি কখন ত্যাগ করেন না।

————

(১) এখানে “বৃষভ” পাক করার উল্লেখ পাওয়া যায়। ২ ও ৩ ঋকে দেবশূন্য শত্রুদিকের উল্লেখ আছে। তাহারা বোধ হয় অনার্য্যগণ।

(২) এই অনুবাদটি নিতান্ত আনুমানিকরূপে করা হইয়াছে। সায়ণ এই শ্লোকের ব্যাখ্যা করেন নাই, কেন বলিতে পারি না। এই ঋকে ও পূর্বের ঋকে পশুচারণের কথা আছে।

(৩) অর্থাৎ স্ত্রীলোকের সহিত পুরুষের যুদ্ধ করা অন্যায়।

(৪) অন্ধকন্যার বিষয়ে সায়ণ কহেন, যে জগতের মূলীভূত প্রকৃতিই সেই অন্ধকন্যা। ইন্দ্র অর্থাৎ পরমেশ্বর তাহাকে আশ্রয় দেন; অর্থাৎ প্রলয়কালে নিজের সহিত একীভূত করিয়া লন। কিন্তু এ পৌরাণিক মত সঙ্গত ব্যাখ্যা, প্রকৃতি ও প্রলয় প্রভৃতি কথা ঋগ্বেদে অপরিচিত। অন্ধকন্যার বিবাহ হয় না, এই মাত্র বোধহয় ঋকের অর্থ। পরের ঋক দেখ।

(৫) ভদ্র ও সুগঠন কন্যা অনায়াসে মনোমত পতি বরণ করিতে পারে, এই ঋকের মর্ম। তৎকালে বোধহয় কন্যা নিজ পতি বরন করিতেন। এক্ষণে পূর্ব ঋকের সায়ণের পৌরাণিক ব্যাখ্যা কি পাঠকের সঙ্গত বোধ হয়? এই দুইটি ঋকের Muir কৃত অনুবাদ ও তাঁহার মত উদ্ধৃত করিতেছি।

   11. “Who knowingly will desire the blind daughter of any man who has one? Or who will hurl a javelin at him who carries off or woos such a female?”

    12. “How many a woman is satisfied with the great wealth of him who seeks her! Happy is the female who is handsome : she herself loves (or chooses) her friend among the people.

“May we not infer from this passage that freedom of choice in the selection of their husbands was allowed, sometimes at least, to women in those times?

Sanscrit Texts, vol. V (1884), pp. 458-59.

(৬) কেহ কেহ কহেন, ইন্দ্র যখন তুমুল বেগে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তখন চতুর্দিক হইতে যে সকল ঝটিকা উঠে, তাহাদিগের কথা হইতেছে।

(৭) সায়ণ কহেন, সাংখ্যপ্রণেতা কপিল যে প্রকৃতিতত্ত্ব নিরূপণ করিয়াছেন সেই কথা এস্থলে নিগূঢ়ভাবে উল্লিখিত হইয়াছে। এ ব্যাখ্যা যে নিতান্ত অযথা ও অমূলক, সাংখ্যপ্রণেতা কপিল যে ঋগ্বেদের অপরিচিত তাহা পাঠককে বলা অনাবশ্যক। ১৪ ঋকের ন্যায় এই ঋকেও মাতা অর্থে বোধ হয় আকাশ, কপিল ও গর্ভ অর্থ বোধ হয় সূর্য্য।