আত্মজ – ১ম অংশ

আত্মজ
সুচিত্রা ভট্টাচার্য

মা আজ চলে গেল। একটু আগে বৈদ্যুতিক চুল্লির গহ্বরে ঢুকে গেছে মা। পুড়ছে। পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
আমার যেন এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। সকালে যখন অফিসে বেরোই, তখনো তো সব ঠিকঠাক ছিল। যেমন থাকে।
দিনটাও আজ শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। মাঘের শুরুতে এবার শীতটা বেশ জাঁকিয়ে এসেছে, সকালে লেপ ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করছিল না যথারীতি। শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছিলাম সংসার নিয়ে হুড়দ্দুম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সুপ্তি। দুধ খাওয়া নিয়ে রোজকার মতোই গাঁইগুঁই করছে মামপি গোগোল, জোর কিচিরমিচির জুড়েছে, সুপ্তি কষে ধমকাল ছেলেমেয়েকে, এক ফাঁকে চা দিয়ে গেল আমায়, মার আয়াকে ডেকে কী যেন নির্দেশ দিল। রুটিনমাফিক শব্দ বেজে চলেছে সংসারে। মার স্পঞ্জের জন্য জল গরম করছে আয়া, ঠিকে ঝিয়ের সঙ্গে কী যেন কথা চালাচালি হলো, সুপ্তি ছেলেমেয়ের টিফিন বানাচ্ছে …। দ্যাখ না দ্যাখ মামপি গোগোল স্কুলবাস এসে গেল, আমিও লাফ দিয়ে উঠে বাথরুমে ফিরেই ঝটপট দাড়ি কামানো, কনকনে জলে কাকস্নান…। ডাইনিং টেবিলে সুপ্তি একখানা লিস্ট ধরিয়ে দিল। পরশু মামপিদের স্কুলে স্পোর্টস, মেয়ের জন্য লাল বর্ডার দেওয়া এক জোড়া জুতা চাই। ওয়াটার ম্যাট্রেসে শুয়েও টুকটাক বেডশোর বেরোচ্ছে মার, শয্যাক্ষতর মলম আনতে হবে। মনে করে চা। অফিসপাড়ার দোকানটা থেকে। এরপর মিনিবাসে লাইন, কান ঘেঁষে লেট বাঁচিয়ে অফিসে প্রবেশ, বারতিনেক জিএমের আসা-যাওয়া, ফাইল কম্পিউটার আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে সহকর্মীদের সঙ্গে মৃদু আলাপচারিতা। তপন বাবু সাতচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছে, তাকে আমরা উইগ্ প্রেজেন্ড করব, না ফলস টিথ তা নিয়েও হাসাহাসি হলো একচোট।
সবই চলছিল গতানুগতিক ছন্দে কিংবা নিতান্তই ছন্দহীন।
ছবিটা বদলে গেল দুপুরে। হঠাৎই।
টিফিন আওয়ারে তখন একটু ক্যারাম পিটিয়ে নিচ্ছিলাম। আজকাল ছুটির পর আর রিক্রিয়েশান রুমে ঢোকার জো নেই, ফিরতে সামান্য দেরি হলেই যা খিটখিট করে সুপ্তি। আমি ঘরে বন্দি, আর তুমি ফুর্তি মেরে বেড়াচ্ছ …! সত্যি তো, বেচারা এখন একদমই ঘরে আটকা। একদিকে ছেলেমেয়ে, সংসার, অন্যদিকে অনন্তশয্যায় শুয়ে থাকা পক্ষাঘাতগ্রস্ত শাশুড়ি, সুপ্তির এখন একেবারে চিঁড়েচ্যাপটা দশা। এদিক-ওদিক ঘোরা, সিনেমা-থিয়েটার সবই তো গেছে, রুগ্ন শাশুড়ি ফেলে বাপের বাড়িই বা যেতে পারে কদিন। গেলেও প্রতি মুহূর্তে হানটান, এই ফিরতে হবে, এই ফিরতে হবে। অগত্যা গৃহশান্তি বজায় রাখতে আমাকেও গুহায় সেঁধতে হয় জলদি জলদি।
তো আজ সবে দ্বিতীয় বোর্ড খেলছি, রবীনদার ডাক, অমিত, তোমার টেলিফোন।
রেডটা পকেটের মুখে। ঝুলছে প্রায়। স্ট্রাইকার সেট করতে করতে বললাম, কার ফোন?
—তোমার বাড়ি থেকে। মনে হলো তোমার গিন্নি।
শুনেই কেমন খটকা লেগেছিল। সুপ্তি তো তেমন দরকার ছাড়া ফোন করে না? লাল ঘুঁটি রয়েই গেল। তাড়াতাড়ি এসে রিসিভার তুলেছি, হ্যালো, কী হলো?
—অ্যাই শোনো, মা কেমন করছেন!
—সে কী? কেন? কী হয়েছে?
—ভয়ানক নিশ্বাসের কষ্ট… চোখটোখ কেমন উলটে যাচ্ছে।
—সর্বনাশ, কখন থেকে?
—এই তো … আমি একটু মণিকাদিদের ফ্ল্যাটে গেছিলাম, রমা ডেকে আনল। বলছে গলা ভাত খাওয়ানোর পর থেকেই নাকি কেমন কেমন করছিলেন।
—কখন খাইয়েছে?
—যেমন খাওয়ায়। বারোটা-সওয়া বারোটা।
—সঙ্গে সঙ্গে বলেনি কেন?
—অতটা নাকি বুঝতে পারেনি। … মার হাত-পাও কেমন ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে!
—ডাক্তার বাবুকে ডেকেছ?
—এক্ষুনি আসবেন। … তুমি চটপট চলে এসো। আমার কিন্তু ভালো ঠেকছে না।
তখনো চরম কিছু ঘটার কথাটা মাথায় আসেনি। ট্যাঙ্েিত আসতে আসতেও ভাবছিলাম এমন হলো কেন? লাঙ্ ইনফেকশন। ডাক্তার বাবু রুটিন চেকআপের সময়ে একদিন বলছিলেন, শুয়ে থাকতে-থাকতে এসব রোগীর পেশি নাকি আপনি শিথিল হয়ে আসে, তখন ফুসফুসে খাদ্যকণা ঢুকে যাওয়া অসম্ভব নয়। তার থেকেই সংক্রমণ! কী একটা যেন নামও বলেছিলেন রোগটার। কী এক নিউমোনিয়া। অবশ্য ঠাণ্ডাটাণ্ডা লেগেও …। কতদিন রাত্তিরে পেচ্ছাপ করে মা তার ওপরেই পড়ে থাকে, রমা ওঠেও না, ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়। ক্যালাস মেয়েছেলে। আবার একটা আতান্তরে ফেলল। তেমন বাড়াবাড়ি হলে এক্ষুনি হয়তো নার্সিং হোমে রিমুভ করতে হবে। বাড়িতে কত টাকা আছে? আজ মাসের উনিশ, মেরেকেটে হাজার দুই। ওতে কি-ই হবে? ব্যাংক তো প্রায় ফরসা… আবার ধার করব? আবার? শালা ধারে ধারে এবার ন্যুব্জ হয়ে যাব। কার কাছে চাওয়া যায়? প্রবীরদা একবার গেয়েছিল, দরকার লাগলে বোলো। সুপ্তি অবশ্য ওর দাদার কাছে টাকা চাওয়াটা পছন্দ করে না। খুকুদিকেও অ্যাপ্রোচ করা যায়। বোনঝি হলেও খুকুদি তো মার মেয়েরই মতন। খুকুদির বিয়েতে মা নিজের একটা নেকলেস্ ভেঙে গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল। খুকুদি হয়তো ফেরাবে না, কিন্তু আমি ফেরত দেব কোত্থেকে? ফের একটা পিএফ লোন? নাকি নার্সিং হোমে না নিয়ে গিয়ে হাসপাতাল …। খরচাটা তাও একটা মাপের মধ্যে থাকে।
কিছুরই প্রয়োজন হলো না। বাড়ি এসে দেখি সব শেষ। আশপাশের ফ্ল্যাটের বেশ কয়েকজন ঘরে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে, সুপ্তি মায়ের খাটের বাজু ধরে স্থির, রমা পায়ের কাছে, মামপি গোগোল তখনও স্কুল থেকে ফেরেনি।
আমার কেমন ঘোর ঘোর লাগছিল। এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর অধ্যায়ের এত আকস্মিক পরিসমাপ্তি?
টানা দুই বছর মা শয্যাশায়ী। সেরিব্রাল অ্যাটাকের দিনটা থেকে ধরলে তারও বেশি। প্রায় পঁচিশ মাস। নিখুঁতভাবে গুনে গেঁথে দেখলে সাতশো চুয়ান্ন দিন। এর মধ্যে একটি দিনের তরেও উঠে বসা দূরে থাক, নিজে নিজে নড়াচড়াও করতে পারেনি মা, পাশটুকুও ফিরিয়ে দিতে হতো। এই পঁচিশ মাসে একটা শব্দ পর্যন্ত বেরোয়নি মার গলা থেকে, গোঙানির আওয়াজও না। আমিও ধরে নিয়েছিলাম মা এভাবেই পড়ে থাকবে। রোজই মনে হতো মা আজকের দিনটাও রয়ে গেল, কালকের দিনটাও থাকবে, তার পরের দিনটাও …
কিংবা হয়তো আলাদা করে এত কথাও মনে হতো না। শুধু হৃদয়ের গভীরে গেঁথে গিয়েছিল একটা ধারণা—নিছক অস্তিত্ব হয়েই মা বুঝি কাটিয়ে দেবে অনন্তকাল। এর বাইরে অন্য কিছু ঘটা বুঝি সম্ভবই নয়।
খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজন আসছিল একে একে। সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ি ভিড়ে ভিড়। অনেকটা সেই নার্সিং হোমে যেমন দল বেঁধে সবাই মাকে দেখতে যেত, সেরকম। কিংবা তার চেয়েও বেশি।
এরকমই বুঝি হয়। মানুষের কাছে বিপন্নতার দাম আছে। মৃত্যুরও। মার মৃত্যু-সম্ভাবনাটা দড়কচা মেরে যাওয়ার পর উদ্বেগ ক্ষয়ে গিয়েছিল ধীরে ধীরে। আমাদের কাছেও। আত্মীয়দের কাছেও। শেষ দেড়টা বছরে কে কবার দেখতে এসেছে মাকে? ওই মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজখবর নেওয়া, কালেভদ্রে হয়তো সশরীরে আগমন, ব্যাস ওইটুকুই। অথচ শ্মশানেও আজ আমার পাশে কত লোক। জাঠতুতো দাদারা, খুড়তুতো ভাই, মাসির ছেলে, পিসির ছেলে, শালা, ভায়রাভাই, বন্ধুবান্ধব …
হিমেল রাতে মাকে যন্ত্র-চিতায় চড়িয়ে এখন সবাই দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক। প্রবীরদা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে খুকুদির বরের সঙ্গে। কিশোর আর সমু পায়চারী করছে। পল্টুরা চা খেতে চলে গেল।
ঠাণ্ডাটা আজ বেড়েছে। নাকি খোলা জায়গা বলে বেশি লাগছে কামড়টা? চারদিকে ধোঁয়াশার পাতলা আস্তরণ, হ্যালোজেন বাতিগুলোয় কেমন মরা মরা ভাব। রেলিংঘেরা জায়গাটায় মরশুমি ফুল ফুটে আছে কয়েকটা, ফুলেরাও যেন মলিন এখন। শ্মশান বলেই কি? গর্জন করতে করতে একটা ম্যাটাডোর হানা দিল চত্বরে, বিটকেল হরিধ্বনি সহকারে খাট নামাচ্ছে একপাল যুবক। কে যেন চেঁচিয়ে ডাকল কাকে। দূরে কোথাও ছররা চলছে হাসির। ভেতরের হলঘরে জোর একটা কান্নার রোল উঠল। থেমেও গেল।
চন্দন আর রনিদা উঠে গিয়েছিল পাশ থেকে, ফিরেছে। সিগারেট টানছিল রনিদা, টোকা মেরে ফেলে দিল পোড়া টুকরোটা। কাঁধে আলগা হাত রেখে বলল, অ্যাই, এখানে ঠাণ্ডায় কাঁপছিস কেন? চল্, ভেতরে গিয়ে বসি।
—না না, এখানেই ঠিক আছে। ভেতরে বিশ্রী গন্ধ, হইহট্টগোল, কান্নাকাটি … ওখানে দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
—তাহলে শালটা ভালো করে জড়িয়ে নে। কান ঢাক। এ সময়ে ঠাণ্ডা লেগে যাওয়াটা মোটেই কাজের কথা নয়।
—বলছি তো ঠিক আছি। তোমরা ব্যস্ত হয়ো না।
রনিদা আর জোরাজুরি করল না। বসেছে পাশে, সিমেন্টের বেঞ্চিতে। চোখ তুলে আকাশ দেখল একটুক্ষণ। আবার সিগারেট ধরাল। লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে।
হঠাৎই বলল, পিসিকে আজ একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছিল, না রে বাবলু?
ছোট্ট একটা শ্বাস পড়ল আমার। বললাম, হুঁ।
—মুখে কণামাত্র রোগের চিহ্ন নেই … হুবহু সেই আগের রং ফিরে এসেছিল। মনে হচ্ছিল সেই পুরনো পিসিকে দেখছি।
চন্দন বলে উঠল, কাকির মুখে কী রকম একটা হাসি লেগেছিল লক্ষ করেছ রনিদা?
—হুম। কত কষ্টের অবসান হলো।
—বটেই তো। কিছু বলতে পারে না, বোঝাতে পারে না, কী খারাপ যে লাগত! এবার পুজোর পর প্রণাম করতে গিয়ে মুখের দিকে তো তাকাতেই পারছিলাম না। কী মানুষ তার কী হাল!
—অথচ দ্যাখো, পিসি কিন্তু কখনো কারো পাকা ধানে মই দেয়নি। মা তো সেদিনও বলছিল, ভগবান কিন্তু এটা ন্যায় করলেন না। এত ভালো মানুষ, তারই কি না এই দুর্দশা! … সারা জীবন কী স্ট্রাগলটাই না করেছে পিসি। অসুখ-বিসুখ কিছু নেই, দুম করে পিসে মশাই মারা গেল … বিনা মেঘে বজ্রপাত … বাবলু তো তখন হাফপ্যান্ট। অত বড়ো একটা ধাক্কা সামলেও তো পিসি মাথা উঁচু করে থেকেছে। চাকরি-বাকরি করে একাই মানুষ করেছে বাবলুকে। যখন নিজস্ব ঘরদোর হলো, নাতি-নাতনি নিয়ে একটু সুখের মুখ দেখছিল, তখনই ভগবান ডাণ্ডা মেরে দিল।
—আমরা তো মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতাম, কাকি চলে যাক, কাকি এবার চলে যাক।
—রিয়েলি, ওরকম ভেজিটেবল বনে যাওয়াটা কি বেঁচে থাকা?
—পুরো ভেজিটেবল কোথায়? কাকির তো সেন্স ছিল, ইভন্ ইন দ্যাট হ্যাপলেস সিচুয়েশান। সেটাই তো আরো প্যাথেটিক।
আঃ, কী আরম্ভ করল এরা? এসব কি এখন আলোচনা করার সময়? মা কী ছিল আমার জন্য কত করেছে, সব তো অনেক পুরনো কথা। সবাই জানে। আমিও জানি। আমিও প্রাণপণ চেষ্টা করেছি মার সেই ঋণ শোধ করার। সাধ্যের অতিরিক্ত করেছি। মার যখন স্ট্রোকটা হলো খরচার পরোয়া না করে মাকে নিয়ে ছুটেছি বড় নার্সিং হোমে। সেখান থেকে মা ফিরল জড়বস্তু হয়ে, তবুও কি আমি হাল ছেড়েছিলাম? টানা ছয় মাস ফিজিওথেরাপি, প্রথমে তিনটা মাস তো সকাল-বিকেল। এর সঙ্গে ডাক্তার, নার্স ও আয়া …। মা সন্তানকে ভালোবাসবে, তার জন্য প্রাণপাত করবে এ তো স্বতঃসিদ্ধ, কিন্তু আমিও কি মাকে কম ভালোবাসতাম? আমার উদ্বেগ ছিল না? নার্সিং হোমে কত রাত জেগেছি পরপর, অমুক নিউরোলজিস্টের কাছে যাচ্ছি, তমুক নিউরোলজিস্টের কাছে যাচ্ছি, তমুক নিউরোলজিস্টের কাছে ছুটছি। বিরল ওষুধ খুঁজতে ঘুরে বেড়াচ্ছি শহরময়…। এর পরও যদি মা সুস্থ না হয় সেটা তো মার কপাল। তবু চেতনা যেটুকু ফিরেছিল সেও আমার চেষ্টার জোরেই। আশ্চর্য, আমার এই চেষ্টার দিকটা কেউ বলে না।
নার্ভের মোটর সিস্টেম প্রায় অকেজো হয়ে গেলেও মার মস্তিষ্ক বেশ খানিকটা সচল হয়েছিল। ব্যাপারটা আমার নজরে আসে মাকে নার্সিং হোম থেকে ফিরিয়ে আনার মাস তিন-চার পর। চৈতন্য ফেরার প্রকাশ অবশ্য ছিল মাত্র একটাই। চোখে। আমাকে দেখলেই মার চোখ দুটো ঘুরতে থাকত। যেদিকেই যাই, ডাইনে-বাঁয়ে, জানালায়, দরজায়, মার চোখ অনুসরণ করছে আমাকে। হ্যাঁ, শুধু আমাকেই। সুপ্তি কত সেবা করেছে মার, গোগোল মামপি তো তাদের ঠাম্মার প্রাণ ছিল। অথচ ওদের দেখে মার দৃষ্টি কিন্তু ও রকম চঞ্চল হতো না।
প্রথম প্রথম আমার গা শিরশির করত। কতদিন মার মাথার পাশে বসে প্রশ্ন করেছি, কী দেখছ মা? কিছু বলবে?
মার দুই মণিতে অদ্ভুত এক কাঁপন জাগত তখন। যেন একটা ভাষা ফুটেও ফুটছে না। গোমরাচ্ছে।
ক্রমেই ওই দৃষ্টিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। পরের দিকে তো দিব্যি একটা খেলায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। মাকে কেউ দেখতে এলেই বলত, ওই আলমারিটার পাশে গিয়ে দাঁড়া তো বাবলু, দেখি এবার চোখ কোনদিকে যায়। … খাটের পেছনে চলে যা, এবার আর চোখ তোকে খুঁজে পাবে না। … ওমা দ্যাখো দ্যাখো, বাবলু বেরিয়ে যাচ্ছে অমনি রেণুদির দৃষ্টিও … আহা রে, একেই বলে চোখে হারানো!
ইদানীং মার কাছে তেমন বসা হতো না। কী করব বসে থেকে? তা ছাড়া আমারও তো ছেলেমেয়ে বউ অফিস সংসার এসব আছে, না কী? তার মধ্যেও রুটিন করে যেতাম এক-দুবার। দাঁড়াতাম একটু, মার পালস দেখতাম, আয়ার কাছে হালহকিকত জেনে নিতাম। সম্প্রতি একটা প্রেসার মাপার যন্ত্রও কিনেছিলাম, নিজেই মেপে নিতাম, রক্তচাপ। কাঁহাতক আর ওইটুকুর জন্য রোজ রোজ দশ টাকা করে গোনা যায়! রমাটা একেবারে টিপিকাল আয়া, ওর শেখার ইচ্ছেও নেই, ওকে দিয়ে ওসব কাজ হয়ও না। অফিস বেরোনোর আগেও নিয়ম করে একবার উঁকি দিতাম মার দরজায়…
আজ কি দাঁড়ানো হয়েছিল? মনে পড়ছে না। মোজা না রুমাল কী একটা যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাড়াহুড়োয় বোধ হয় …। তুত, এত খুঁটিনাটি কি মনে রাখা সম্ভব? বিশেষ করে যে মানুষ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একইভাবে টিকে আছে তার সম্পর্কে?
আবার একটা ডেডবডি এলো। কাচের গাড়িতে। বয়স্ক মহিলা।
রনিদা যান্ত্রিকভাবে কপালে হাত ছোঁয়াল। আলগাভাবে বলল, আমাদের কপালটা ভালো।
ঘুরে তাকালাম, মানে?
—পিসিকে একেবারে জাস্ট টাইমে আনা হয়েছে। দেকছিস না, তার পরই কেমন লাইন পড়ে গেল! আর দশটা মিনিট দেরি করলে তোকে তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হতো।
এমন একটা ভার মুহূর্তেও হাসি পেয়ে গেল। পঁচিশ মাস টানতে পারলাম আর তিন ঘণ্টায় কি-ই বা ফারাক হতো?
সন্তুদা আর দুলু কথা বলতে বলতে আসছে। পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া সন্তুদার এক আশ্চর্য গুণ আছে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারও মৃত্যুর খবর পেলেই সন্তুদা যেখানে থাক হাজির। কাজকর্ম পুরোপুরি না মেটা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় সব দায়িত্ব তুলে নেবে কাঁধে। আজও টেলিফোন পেয়েই এসে পড়েছিল, বড় মাইমা আর রেখা বউদিকে সঙ্গে নিয়ে। এসেই ঝটপট সব বন্দোবস্ত করে ফেলল সন্তুদা। কাচের গাড়ি, ফুল-খই-ধুপ অগুরু …। মার বুকে গীতা রাখা হয়েছে কি না, খইয়ের ঠোঙায় খুচরো পয়সা দেওয়া হলো কি না, প্রতিটি খুঁটিনাটিতেই সন্তুদার খুব নজর। শ্মশানে পৌঁছেও চরকি খাচ্ছে অনবরত। করপোরেশনের ঘরে দৌড়াদৌড়ি, পুরুতের সঙ্গে দর কষাকষি …। আমি যখন আগুন হাতে মাকে প্রদক্ষিণ করছি তখনও সন্তুদা আমার পাশেপাশে।
সন্তুদার হাতে একখানা প্লাস্টিকের প্যাকেট। প্রবীরদাকে প্যাকেটখানা ধরিয়ে এলো আমার কাছে, বাবলু, তোদের কাপড়-জামা কেনা কমপ্লিট। প্রবীর বাবুর কাছে রইল, চান করে পরে নিস।
—এত ঠাণ্ডায় রাত্তিরে চান করবে কি? না না, একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিলেই হবে।
—আহা, আমি কি গঙ্গায় ডুব দিতে বলছি? বাড়ি গিয়ে তো করবে। কী রে বাবলু, পিসির জন্য এইটুকু পারবি না?
বটেই তো। এটুকুই তো করছি!
আমার মুখের ভাঙচুর লক্ষ করেনি সন্তুদা। ফের বলল, পিসির ডেথ সার্টিফিকেটটা এখন আমার কাছেই রইল, বুঝলি। তিন কপি জেরঙ্ করে দিয়ে দেব, যত্ন করে রাখিস। হারালে কিন্তু পিসির কিছু পাবি না।
হায় রে, পিসির যেন কত ধনদৌলত আছে! রিটায়ারমেন্টের সময়ে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা পেয়েছিল তার সিংহভাগই তো গেছে ফ্ল্যাটে। বারণ করেছিলাম, শোনেনি। ও টাকা পুষে আমি কী করব রে বাবলু! বরং যতটা পারিস ক্যাশ দিয়ে দে, তোর ব্যাংক লোন তাহলে কম হবে! রাগ করিস কেন, তোর বাড়ি তো আমারও রে, তুই কি আর আমায় তাড়িয়ে দিবি! ব্যাস্, সঞ্চয় প্রায় সাফ। তাও যেটুকু তলানি পড়ে ছিল তাই দিয়ে নাতনির জন্য সোনার চেইন বানাচ্ছে, দুম করে গোগোলের নামে একটা ক্যাশ সার্টিফিকেট কিনে ফেলল …। ওসব না করে কিছু যদি রাখত, বিপদের সময়ে তাও কাজে আসত।
পল্টু দিপুরা কখন যেন ফিরে হলঘরে ঢুকেছিল। বেরিয়ে ডাকছে, বাবলুকে নিয়ে চলে আসুন। আমাদেরটা হয়ে গেছে।
সন্তুদা সঙ্গে সঙ্গে টানটান, আয় আয়। … বেশ তাড়াতাড়িই হয়ে গেল দেখছি।
রনিদা একদিক থেকে ধরেছে, অন্যদিক থেকে প্রবীরদা। আমাকে নিয়ে চলেছে মার ভস্মাবশেষের দিকে। এত জোরে হাত চেপেছে কেন? ভাবছে আমি পড়ে যাব? ভেঙে পড়ব?
হলঘর পেরিয়ে উঁচু জায়গাটায় উঠলাম। আগুনে যাওয়ার অপেক্ষায় চ্যাঙারিতে শায়িত পর পর চারটে মৃতদেহ, তাদের টপকে নামছি সিঁড়ি বেয়ে। চুল্লি থেকে বিকিরিত হচ্ছে তাপ। বিচিত্র এক ওমে শরীরটা উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে আমার।
উষ্ণ? না হালকা?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *