শিলাদের অনেকটা জমে ভাঁড়ার থইথই টসটস রসরস, কিন্তু ছুঁড়ে অপচয়ের মানে হয় না বলে যোগ্য-অযোগ্য যে-কাউকে খুঁজে বেড়িয়েও জোটাতে পারেনি। নিঋিতি কোনারের সঙ্গে ইঁদুরচন্দ্রিমায় পুরো ভাঁড়ার সাফ হয়ে গিয়েছিল; তারপর মিস ওরফের সঙ্গে কুইকিতে অবশিষ্ট যা ছিল ঝাড়পোঁছ করে। আবার জমে-জমে আনচান। মাছসমাজে সমকামের গোপন গোষ্ঠীটার সাকিন-ঠিকুজি জানলে কিছুটা অন্তত দুঃখামৃত বেরিয়ে যেত।
কেয়ারফ্রি রঙ্গিলা জীবনে তো বস্তু-অবস্তু কিছুই তেমন পাওয়া হল না; সবই জলে-জলে জলক্ষয়। বিশুদ্ধ শান্তিকল্যাণও নেই, যত্তো সব দেখনদারি। শ্যাওলার স্কোয়াশ আর ভেসে আসা পান্তাপোকার পাস্তা খেয়ে একঘেয়ে ঘুলুরঘুলুর ঘুলুরঘুলুর ঘুলুরঘুলুর ঘুলুর ঘুলুর । হাই তুলে-তুলে চোয়াল আটকাবার রোগ হয়ে গেল। পটকা ঝুলে গেল হাহাকার জমে-জমে। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় আঁশ ঝরে টাক পড়ে যাচ্ছে। অসিদ্ধির অনবস্হায় ফিকে হয়ে যাচ্ছে নীল-কমলা জ্যোতি। এরকম একটা জীবন নিয়ে আমি কী করব? পাথরের ফাটলে শুয়ে কাঁদতে থাকে শিলাদ।
বর্ষার অতিবন্যা আর ষাঁড়াষাঁড়ির বাড়াবাড়িতে পাড় ভেঙে ঘরসংসার ভেঙে জল এমন ঘোলাটে হয়ে গেল যে হাউহাউ-কান্না চাপাকান্না ফূঁপিয়েকান্না ককিয়েকান্না ডুকরেকান্না গুমরেকান্না মায় বুকফাটা কান্নাও মুশকিল হল শিলাদের। গরু মোষ ছাগল হাঁস কুকুর মুরগি শুয়োরের পচাফোলা দাঁদুড় লাশের বাড়াবাড়ন্তিতে ওর শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। জোয়ার-ভাটা টের পাওয়া কঠিন হল হুলুস্হুলু জলে। জলের তোড়ে কোথায় একানি খাল আর কোথায় ছিল মরানি খাল ঠাহর করা দায়। বোঝা মুশকিল দেয়ানি খালে ভাসছে না ভারানি খালে। এবার আবার দেবীর দোলায় আগমন; শেষে মহামারিতে না পটল তুলতে হয়।
কাঁদতে-কাঁদতে, শ্বাস নেবার জন্যে জলের ওপর মাথা উঁচিয়ে, শিলাদ দেখতে পেল, গরান গর্জন সুন্দরীদের সবুজাভ আবছা। স্পষ্ট যা, তা কিছুটা দূরে, বাতাসে এলোচুল শুকোচ্ছে ছনঘাসের জঙ্গল। ওর গলা বন্ধ হয়ে আরও কান্না পেল।
জলভিড়ের ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি একটু থিতিতে, চারিদিকে তাকিয়ে শিলাদ বুঝতে পারল, পরিচিত প্রতিবেশিদের অলিগলি ছেড়ে ও চলে এসেছে চেটাল জলের অপরিচিত পাড়ায়। ওর পাশে নিচে ওপরে খেলাখেলি করছে কারপরদাজি চিংড়ি কাঁকড়া সাগরকীট সি-আর্চিন সেপিয়া ললিগো কড়ি তারামাছ জেলিফিশ গুগলি শামুক ঝিনুক সাদাগেঁড়ি পরিবারের লোকজন, যারা অবাক হচ্ছে ওকে দেখে। নিজেকে বড্ডো একলা মনে হল শিলাদের, বড়ই একাকী, পরিত্যক্ত নিঃসঙ্গ নির্বাসিত ফেফাতুড়া অসহায় বন্ধুবান্ধবহীন।
জলের সঙ্গে কাৎরে সাঁৎরে এগিয়ে পেছিয়ে পাক খেয়ে ধাক্কা খেয়ে খাবি খেয়ে হাবুডুবু খেয়ে চরকি খেয়ে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে অবসাদগ্রস্ত আর অবসন্ন আর বিষণ্ণ শিলাদ, ডানাজোড় করে প্রার্থনা করতে-করতে মাছের জীবন থেকে মুক্তি চাইল। হে বনবিবি উদ্ধার করো, হে ভিনমনসিয়াদেবী থই দাও, হে প্রভু অঘোরসিদ্ধি মোচনের পথ বাতলাও, জপে চলল চোখ বুজে, জল-বুদবুদের জপমালা ওড়াতে-ওড়াতে। হে চোরগণেশ হেরুকদেব চণ্ডরোষণ বজ্রবারাহী ডোম্বী ত্রিবর্চস শুনঃশেফ ব্যূষিতাশ্ব বহিষ্মর্তী বলে-বলে সবায়ের কাছে বিড়বিড়-ঠোঁটে বুদবুদ অঞ্জলি দিয়ে অনুনয়-বিনয়-আবেদন-নিবেদন করতে থাকে ও, বাচারা শিলাদ।
হাভাতে কাভাতে বানভাসিতে বয়ে-আসা অনাথ খুদকুঁড়ো পেলে দুডানা মুখে পোরে।
কেমন লোকমাছ হে আমি, আত্মচিন্তায় কানকো খচখচ করতে লাগল শিলাদ তরফদারের নীল-কমলা মুড়োয়, কেমনধারা আমার মেছো বাছবিচার! জগৎসংসারের মানে বের করে, তাকে যুক্তিপূর্ণ কায়দায় বুঝতে পারা কি সম্ভব? নানা পর্বের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে সন্দেহ ধরে গেল যে জগৎসংসার সম্ভবত বোধগম্য, সুসংহত, আসঞ্জনশীল ব্যবস্হা নয়। উদাসীন পৃথিবীটা আমাকে লাথিয়ে-লাথিয়ে আমারই সা্বাধীনটায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আর আমি, পাখনা চাপড়ে বিলাপ করতে বাধ্য হচ্ছি। সম্ভাবনার সুযোগ সুবিধের মধ্যেই আমাকে কাৎ মেরে-মেরে খতিয়ে বেরোতে হবে। না কি?
প্রার্থনা বজায় রাখল শিলাদ।
দিন কতকের বর্ষায়, খাঁড়ির গায়ে অমুক কোটি তমুক লক্ষ তুসুক হাজার ছোট-বড়-মাঝারি সোজা-সোজা বেঁকা-বেঁকা ঝিরিঝিরি ঝোড়োঝোড়ো বৃষ্টিফোঁটার পর, আকাশ যখন ঝকঝকিয়ে তকতকিয়ে নীল, শিলাদের লাঞ্চের সময়, দেখল পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে পদ্মপাতার ওপর ঝিনুকপ্রদীপে রাখা ঋতুমতী কোনো বাঘিনীর কয়েকফোঁটা গন্ধোত্তমা। যোনি থেকে ভাসিয়ে দেয়া ওই কয়েক ফোঁটা তরলচুনি কাছে আসামাত্র গিলে ফেলল শিলাদ।
বত্রিশ প্রহর পর খোঁয়ারি কাটলে, খাঁড়ির আবরা থেকে ডাঙায় ওঠার সময় ডমরুর মতন মাথা ঝাঁকিয়ে জল ঝাড়ল শিলাদ, তারপর গা কাঁপিয়ে আর ল্যাজের ঝাপট দিয়ে জলের ফোঁটা উড়িয়ে, অনেক বড় হাঁ-মুখ করে, মুখ বন্ধ করার সময় বলল, হা-লু-ম। ওর বদগন্ধ আর বদগর্জনে, ভয়ে ডানা ফড়ফড়িয়ে এডাল-সেডাল এগাছ-সেগাছ করে উঠল মাছমুরাল, গোবরে শালিক, সুইচোরা, সরালি, লোহারজঙ, মেছোবক, খুন্তেবক। দাঁত বের করে মুখ খিঁচিয়ে চে#চামেচি লাফালাফি শুরু করল মধুখোর কাঁকড়াখোর ল্যাজতোলা রাঙাপোঁদা নস্যিলোম চিচকেরে বাঁদরেরা। শিলাদকে দেখে গ্রীবা উঁচিয়ে দলের সবাইকে সতর্ক করে জঙ্গলের ভেতরে পালাল হরিণের দল।
আত্মগর্বিত শিলাদ, কানের কলার তুলে, আরেকবার হালুম ফতোয়া জারি করে, ভাদাইল ধনিচা শোলা করচা বিন্না ঝোপের আড়ালে গিয়ে, আয়েসে হেঁতালগুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে শুয়ে, জিভ দিয়ে চেটে-চেটে গোঁফ থাবা আর লেংটু সাফ করতে লাগল।
রোদটা হেজিয়ে ম্যাড়মেড়ে হলে, রোদে রোদিয়ে, খানিক এগিয়েই তিতিবিরক্ত আর অপমানিত হল শিলাদ। কোন হাড়হাভাতে ছ্যাঁচড়া বুড়ো বাঘ ওর চত্বরের গাছগুলোয় মুতে দাদাগিরির সীমানা দেগে গেছে। ফোকলা হাবড়াটাকে দেখতে পেলেই দুচার থাবার কড়া মুঠকি দিতে হবে। শিলাদ তরফদার হাওয়া শুঁকতে-শুঁকতে এগোল, পা তুলে ছিড়িক-ছিড়িক মুতে-মুতে পুনর্দখল করতে থাকল তল্লাট। পেচ্ছাপ দিয়ে দখলের বছর আর কতকাল দখলে রাখবে তার দিনক্ষণসহ নিজের নাম লিখে বুড়ো বাঘটার চিহ্ণ মুছে ফেলার পর, ঘাসে পায়ের গন্ধ শুঁকে আরেকটু এগিয়ে বিরোধী বাঘটার এলাকায় ঢুকে কয়েকটা গাছে নিজের মুতের সংখ্যাছাপ এঁকে বাড়তি দখলের হুমকি দিয়ে রাখল ও। বলল, হা-লু-ম।
পুবের ক্যাঁকড়াঢল ভারানিখাল সাঁতরে পেরিয়ে শিলাদ দেখল, কিছুটা দূরে চি১ড়িচাষিদের হইচই, গরু-ছাগল চরছে। ভালই। অভাব দেখা দিলে তুলে আনা যাবে। উত্তরদিকের জঙ্গল পেরিয়ে যে গাঙটার কাছে পৌঁছল, দেখল কয়েকটা হরিণ সাঁতরে ওপারে তলতাবাগানে যাচ্ছে। এরাই ওকে দেখে একটু আগে পালিয়ে পোঁপিত্তান দিয়েছিল। এপারে মানুষদের যে যাতায়াত আছে তা টের পাওয়া গেল মৌমাছির চাকের ঙিক তলায় পোড়া-মাটির ডাবুহাঁড়ি দেখে; পরে মধু আর মোম কেটে নিয়ে যাবে মৌয়ালিরা। রানিকে ঘিরে রাখা মৌমাছিদের কোর গ্রুপকে মৌয়ালিরা চটাতে চায় না বলেই ওই চাকটায় ফুটো করে ডাবু হাঁড়ি ঝুলিয়েছে, অনুমান করল শিলাদ তরফদার। উত্তর-দক্ষিণে হেঁতালের বন, ঘনবুনোটের গরান, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পশুর আর কেওড়া। ভালই মনে হচ্ছে। নির্বিবাদে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দায়া যাবে।
পেচ্ছাপের তরতিম লিখে সংরক্ষিত নিজের এলাকায় দিনে-রাতে টহল দিয়ে, খেয়ে, গোঁফে তা দিয়ে, আরামে একবাঘতন্ত্রী সময় কাটতে লাগল শিলাদের। হরিণের কলজের পরোটা, তলপেটের চাপড়ঘণ্ট, গলদা চিংড়ির চানাচুর, কাঁকড়াদাড়ার ফুলুরি, আড়মাছের চিলিচিকেন, ভেটকিমাছের লুচি, বাছুরমাংসের ভাত, হালুম ডাকলেই পাওয়া যায়। শুয়োর বাঁদর মানুষ এখনও খাওয়া হয়নি। তার কারণ অনভ্যাসে হা-লু-ম চেঁচিয়ে ফ্যালে। আর শোনামাত্র শিকার ভাগলবা। পিছু ধাওয়া করে হেরে যাওয়ার আশঙ্কায় এখনও ওদের তাড়া করেনি।
হারার কথা জানতে পারলে নিউজ চ্যানেলরা বলবে নিজের মুত্রাঙ্কিত নির্বাচনক্ষেত্রে শিলাদ তরফদারের কোনও প্রতিপত্তি নাই। ব্রেকিং নিউজের খাতিরে আজকাল তো ধর্ষকদের ক্যামেরার সামনে আবার ধর্ষণ করে ঘটনা তুলে ধরতে হয়, যাতে জনসাধারণ স্বচক্ষে দেখতে পায়। অবশ্য তার জন্যে সস্তার অভিনেতা-অভিনেত্রী ভাড়া করতে হয়। একদিন প্রায় তিরিশজন মাগিমরদ কোমরজলে নেমে ছাঁকনজাল দিয়ে চিংড়িপোনা ধরছিল যখন, শিলাদ আনন্দের অতিশয়োক্তির কারণে হালুম বলে ফেলায় ছাঁকনজাল আর হাঁড়ি ফেলেই লোকগুলো দেদ্দৌড়। পরের দিন সকালে থানার পেটমোটা পেটুক পয়সাখেগো ও সি আর বনবাবুদের নিয়ে লোকগুলো এসেছিল, গাছের আড়াল থেকে দেখেছে শিলাদ। থলথলে ঘাড়েগর্দান বনবাবু বলছিল, আরে ওখানে একটা আধফোকলা বুড়ো বাঘ থাকে যার এই বয়সে ম্যানইটার হওয়া অসম্ভব; আপনারা নিশ্চিত হয়ে চিংড়িপোনা ধরুন, আমরা তো আছি, ভয় কিসের।
বনের ভেতরে যে খাল নদী গাঙে, ওর, শিলাদের এলাকায়, চরপাটা খালপাটা আর বিন্দিজাল বেছান, সেগুলো সাবধানে দেখে এসেছে শিলাদ যাতে রাত-বিরেতে রোঁদে বেরিয়ে না ফেঁসে যায়। তবে, পাতরি পায়রাতলি মেদ ছোটভেটকি কাকিলা পারশে ভাঙন রামশোষ দাতিনা চাকা মা্ছ, যেগুলো এদিকে পাওয়া যায় বলে জাল ফেলা, সেসব মাছ খেয়ে ওর পেট ভরে না, খাবার হ্যাঙ্গামও অনেক, মুখে জল সেঁদিয়ে যায়। অহেতুক মুখ নষ্ট। ওসব মাছ শিলাদ খেতে নেমেছে জানতে পারলে খ্যাঁকশেয়ালরা কলঙ্ক রটাবে। এই তো কিছুকাল আগে, কৃষ্ণতৃতীয়ার রাতে, শেওড়ার জঙ্গলে, ফেউশেয়ালরা ওপর পানে তাকিয়ে হিমেশ রেশমিয়ার ঢঙে রাতভর হুঁক্কা-হুঁরুর হুঁক্কাহুঁরুউউউউউর গাইছিল নাকিসুরে।
মাতলা নদীর পুবপাড়ে টাইগার প্রোজেক্টের ওয়াচ টাওয়ারে বসে দুবিন চোখে এদিকে নজর রাখে চাকুরিয়া দেখনদাররা। চামটা জঙ্গলে দেখনদাররা লঝঝড়ে সরকারি জিপে চেপে ঢোকে, হাতে ভয় কাটাবার বন্দুক যা থেকে শেষবার ইংরেজরা গুলি ছুঁড়েছিল। ওদের চোখে না পড়াই ভাল। নজরে পড়লেই সংবাদ মাধ্যমের ছোঁড়াছুঁড়িরা আজেবাজে কথা রসিয়ে-খসিয়ে লিখে দেবে। ও হয়ত বলল হা-লু-ম। ওরা লিখে দেবে শিলাদ তরফদার বলেছেন, মুখে হাগুম। তার চায়ে মাতলা মোহনার দক্ষিণে ঠাকুরান, সপ্তমুখ আর মুড়িভাঙা নদীর আসেপাশে ঘোরাঘুরি কম বিপজ্জনক, কেননা শিকারী বাওয়ালি বাঘালি আর থলেট ডাকাতদের রমরমা ওখানে কম।
শিলাদের মুতের বদগন্ধের সৌরভ অনুসরণ ও অনুধাবন করে, কালো হলুদ জামদানিতে, গতরের তাপে গরম এক বাঘিনী, নখে শিশিরের নখপালিশ আর ঠোঁটে ছাগল-রক্তের লিপস্টিক মেখে, ওর, শিলাদের, এলাকায় এসে হাজির। বয়সে শিলাদের চেয়ে বড়ই হবে। কুছ পরোয়া নেই। অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে প্রচুর, কত প্রেমিককে খেলিয়েছে, তুলেছে-নামিয়েছে, তার ইয়ত্তা বনবাবুদেরও নেই। শিলাদের তো প্যাঁচা-প্রতিস্বের অভিজ্ঞতা আর গিরগিটির ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, যার সঙ্গে বাঘ-বাঘিনীর কর্মকান্ডের দেহকান্ডের রসকেলির কোনো সম্পর্কই নেই। নিজের আবিসার গোঁফ চেটে, ল্যাজের কেতন উড়িয়ে, বাঘিনীর গায়ে গা ঘষে, শিলাদ জিগ্যেস করল, তোমার নাম কি ডার্লিং? সুরাইয়া না শেফালি?
কর্মজ্ঞ বাঘিনী মুচকি হেসে লিপ্সটিক চেটে বলল, আমার নাম সদুর্জয়া বৈরাগ্য, হালুম, তুমি আমাকে সদু বা সদুদি বলে ডাকতে পারো, হালুম, কিছু না ডাকলেও ক্ষেতি নেই, হালুম, কিন্তু হাই-হ্যালো ছাড়ো, আমি এসেছি হাওয়ায় জোয়ান তরতাজা মরদের বদগন্ধের সৌরভের খবর পেয়ে, হালুম, বয়েস হয়ে যাচ্ছে, হালুম, তাই তোমার বীজ সংগ্রহ করতে এলুম, হালুম, যত জোয়ান বাঘ এই এলাকায় ছিল। হালুম, সব কটাকে চিনের চোরাকারবারীরা হাড়মাসের লোভে নিকেশ করে নিয়ে চলে গেছে, হালুম, পড়ে আছে শুধু বুড়োগুলো, হালুম।
আমি তো ফার্স্ট-টাইমার। খি করে কী করতে হয়, তাই জানি না। ইউ হ্যাভ টু গাইড মি হাঊ টু ডু ইট উইথ এ সুইট টাইগ্রেস লাইক ইউ।
অত ইংরেজি না কপচালেও চলবে। ল্যাজের অবগুন্ঠন সরিয়ে আগে আমার স্ত্রীযন্ত্রের অগরু শোঁকো মুখপোড়া, হালুম, তবে তো বুঝবে, হালুম, আমি অনঘ-নিরঞ্জন হিটে আছি কি না, হালুম, নাক দিয়ে হৃদয়ে সৌরভবার্তা গেলেই, হালুম, দেখবে বাদবাকি কাজ আপনা-আপনি ঘটে যাচ্ছে, হালুম।
শিলাদ তাই করল, আর লো অ্যান্ড বিহোল্ড, নিজের অজান্তেই বাঘিনীর পিঠে সামনের দুই পা দিয়ে দাঁড়াল। নিজের অজান্তেই ওর পিছনের দুই পায়ের নখ মাটি আঁকড়ে ধরল আর কোমর মুহূর্মুহূ আগুপিছু হতে থাকল। সঙ্গে-সঙ্গে কিন্দম কিন্দম কিমাশ্চর্যম, নিজের অজান্তেই ওর ভাঁড়ার কিলবিলিয়ে সরসরিয়ে খালি হয়ে গেল। নিজের অজান্তে সামনের ঠ্যাঙ দুটো তৃপ্তিতে নেমে পড়ল। নিজের অজান্তে সদুর্জয়ার স্ত্রীযন্ত্র জিভ দিয়ে নিকিয়ে পরিষ্কার করে দিল।
শিলাদ যখন ভাবছে এবার দুজনে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোন যাবে, আর ব্যাপারটা অহরহ রিপিট করা যাবে, সদুর্জয়া হাসিমুখে বলল, হালুম, থ্যাংক ইউ মাই চাইল্ড, হালুম, পরের বছর দেখা হলেও হতে পারে, হালুম, যদি না চিনের ডলার-কমরেডরা তোমায়ও ধরে নিয়ে যায়, যাক, হালুম, ভারজিন যুবকের বীজ নিলুম, হালুম, আনন্দ নিলুম, হালুম, চললুম, হালুম।
সে কি? ব্যাস হয়ে গেল? আবার কোথায় বাঘিনী খুঁজতে যাব? এ কীরকম চোরপ্রপাত লোনলি প্ল্যানেট জীবন রে বাবা! সদুর্জয়া চলে যেতে শিলাদের মন খারাপ হয়ে গেল। তল্লাট ছাড়িয়ে রাতবিরেতে এ-জঙ্গল সে-জঙ্গল ঢুঁ মারল, যদি কোনো বাঘিনীর বদগন্ধের সৌরভ পাওয়া যায়। কত ঘোরা কত ফেরা কত এদিক কত সেদিক করেও কোনও বাঘিনীর দেখা পেল না। মেজাজ খিঁচড়ে গেল শিলাদের । ভাঁড়ার বাড়ছে বলে গায়ের বোটকা গন্ধও বাড়ছে, অথচ কোনো প্রেমিকার হিসি-হাগুর চিহ্ণমাত্র নেই ঘাসে।
নতুন বাঘিনীর খোঁজে বেরিয়ে একদিন বুড়ো চৌগোঁপপা বাঘের সঙ্গে দেখা হতে গোঁফে তা দিয়ে সামনের উরুতে পেছনের পা দিয়ে তালঠোকাঠুকির শেষে বুড়ো বাঘ বলল, এই মরসুমে বহু হালুম-হূলুম সত্বেও, বুড়ি-যুবতী-খুকি, খেঁদি-পেঁচি, নুলো-কানি কোনো বাঘিনী পায়নি। শিলাদ পেয়েছে শুনে বুড়ো বাঘ বলল, হ্যাঁ, আজকার তো বয়স্কা বাঘিনীরা টয়বয় খোঁজে।
আরেকদিন খোঁজে বেরিয়ে, সাঁতরে ফেরার সময়ে, ঘুম ভাঙিয়ে ফেলার দরুন, কুমিরের খাঁজখোদরানো ভারিভরকম ল্যাজের ঝাপটানি খেয়ে গর্দানে ব্যথা ধরে গেল শিলাদের। এমন ব্যথা যে দিনপনেরো কেটে যাবার পরও গেল না; উল্টে বেড়ে গেল। ঘাড় বেঁকিয়েই কোনোরকমে একটা হরিণবাচ্চা ধরে কাজ চালাতে বাধ্য হল শিলাদ। তারপর বেশ কিছুদিন খালিপেটে চালাল। বাঘিনী না পেয়ে হাল ছেড়েই দিয়েছিল; আর এখন পেলেও বেঁকা ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে কী করেই বা কী করবে।
নিজেকে শুধোল শিলাদ, বাঘজীবন তো দেখছি প্যাঁচা গিরগিটি মাছের চেয়েও ফালতু। বাঘিনী মেলে না। তার ওপর ভাঙা ঘাড় নিয়ে আজেবাজে বাতিল মাছ খেয়ে সারাজীবনম চালাতে হবে।
বিকেলের আগে একদিন, সকালে সূর্যগ্রহণ হয়ে গেছে, কাশাড় বনের উইংসের আড়াল থেকে ধুমসি শরভ-হরিণদের নৃত্যনাট্য দেখছিল শিলাদ। নিচু দিয়ে উড়তে-উড়তে একটা ফেকনতোলা টিয়া আরেকটা টিয়াকে বলল, এই বোটকা মালটা কোথজথেকে এল রে সুনন্দা, আমেরিকা না ইজরায়েল? সেই বুড়ো বাঘটার এলাকা গায়ের জোরে জবরদখল করে বসে আছে। এদিকে ভাবখানা এমন যে কতই না দুঃখ অবসাদ মনোকষ্ট। অন্যের মোতা গাছে পেচ্ছাপ করা তো মতাদর্শগত বিচ্যুতি।
সুনন্দা নামের টিয়া যা বলল , তা দূরে চলে যাবার দরুণ পুরোটা শুনতে না পেলেও এই কথা গুলো কানে এল শিলাদের, ‘নিজেকে আলেকজান্ডার কিংবা দারিয়ুস ভাবছে, মুতে-মুতে জবরদখল আর পাকাপাকি রাজ্যপাট, হাঃ হাঃ হাঃ…’
পিত্তি জ্বলে গেল শিলাদের। বুড়ো বাঘটা শিলাদের গর্দান ব্যথার খবর পরয়ে ওর এলাকায় আধ-খাওয়া শুয়োর ফেলে গেছে কোন ফাঁকে, ঠাট্টা করে, জানে যে শিলাদ এখন কোনো শিকার ধরতে পারছে না। শিলাদের মুত পুঁছে তার ওপর নিজের হিসি দিয়ে নাম আর এলাকাচিহ্ণ দিয়ে হক প্রতিষ্ঠার হুমকি দিয়ে গেছে।
গর্দানটা ঠিক হোক, ব্যথা কমুক, তারপর যে যে অপমান করেছে তার তার টেঁটা মটকে টিভি কোম্পানিদের রান্না শেখাতে পাঠাবে শিলাদ। এই সব সাত-পাঁচ সাত-সতের চিন্তার খেই নয়ছয় করে ওর মাথা ঘঁষে উঢ়তে উড়তে ধীবরকান্তি সেনগুপ্ত নামের এক দাঁড়কাক পুচ করে মুখে হেগে দিয়ে বলে উঠল, হেঃ হেঃ, আমাগো বাপও কম্যুনিস্ট আছিল। থাবা দিয়ে মুখ পুঁছে নিল শিলাদ। দাঁত খেঁচানো ছাড়া আর উপায় নেই। থাকত শকুন তো এক লাথি মেরে আকাশ থেকে জলে ফেলে দিত। প্যাঁচা থাকলে মাঝরাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কাউয়া তন্দুরি বানিয়ে অয়েস্টার সস দিয়ে খেত। গিরগিটি থাকলে বদ্যি বামুনটার ডিম ফি বছর খেয়ে-খেয়ে করে দিত নির্বংশ।
নিঃসঙ্গ একা নির্বান্ধব অসহিষ্ণু সাহেবান অন্তর্মুখী উপাংশু থাকাটা, শিলাদ অনুভব করল, বাঘ হবার বিড়ম্বনা; একলষেঁড়ে হয়ে থাকতে হবে, আর তা এনজয় করতে হবে। অথচ তেমন প্রক্রিয়া ঘটছে কই! এই জীবন তো আমি বাছাই করে নিইনি; এ তো অ্যাকসিডেন্টাল, ঘটনাক্রমের চাপিয়ে দেয়া, বরং বলা যায় নিছক রাসায়নিক দুর্ঘটনা।
ঘাড়ে ব্যথা সারছে না; কে জানে, হাড়ই ভেঙে গিয়ে থাকবে। বাঘ মাছ গিরগিটি প্যাঁচার জীবনে শকুনের মতন গ্রীবার গর্ব নেই । আর কি ফিরে শকুন হওয়া যায় না? লেসারস্কোপিক চোখ দিয়ে পরখ করে, মাথাসুদ্ধ পুরো গলা ঢুকিয়ে দেয়া যেত খাবারের হৃদয় অব্দি, মগজ অব্দি, কলজে অব্দি। জল স্হল অন্তরীক্ষ সবই তো দেখা হল।
বোয়াল-মাছের ভুনিখিচুড়ি আর ভেটকি ফ্রাই খেয়ে দুপুরের ন্যাপ নিচ্ছিল শিলাদ তরফদার। রাঙাপোঁদা বাঁদরদের মহাসমাবেশের স্লোগানধর্মী চেঁচামেচি শুনে চানাকানি ভাদাইল ঘাসের মাঝে আড়মোড়া ভেঙে উৎকর্ণ বাধ্য হল। মানুষের পিতামহ-পিতামহীদের নিয়ে এই-ই সমস্যা, নিরিবিলিতে তিষ্ঠোতে দেয় না। কমান্ডো না রেখে বুনো মৌমাছিদের শ্রমিক টাস্কফোর্স হয়ত পিকনিক করতে গেছে ভাটফুলের শাহীবাগানে, আর সেই ফাঁকে মৌচাকে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে মধু আর মোম তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে রাঙাপোঁদারা।
কিন্তু না। চুলেল পানার শ্যাওলা সরিয়ে, সুন্দরীর আকাশমুখো শেকড়ে নৌকোর কাছি বাঁধছে জনা-আটেক তুন্দিভ ডাকাত। তিন জনের কাঁধে মাস্কেট, কোমরে বুলেটের বেল্ট। জমধর, ন্যাপালা, কিরিচ, কেঁচা, মুগুর, আসানড়ি, পেটো, নৌকোয় তেরপল চাপা দিয়ে রাখা আছে নিশ্চয়।
ডাকাতগুলো এখন পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খাবে। তারপর ছ-জন নাক ডেকে ঘুমিয়ে রাতে বেরোবে গেরস্ত জেলেদের নৌকোসুদ্ধ বমাল ধরতে। কাদের ধরতে হবে সে খবর ওরা পঞ্চায়েতের লোকেদের ভাঙিয়ে জেনেছে। ছাপোষা জেলেগুলোকে ধরে একজনকে বলবে বাড়ি থেকে টাকা সোনাদানা এনে মানুষগুলোকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। পুলিশে খবর দিলে সবাইয়ের গলার নলি কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেবে। শকুন থাকলে সেসব লাশ খাওয়ায় নিষেধ ছিল না শিলাদের; কিন্তু বাঘ হবার ফলে মরা মানুষ খাওয়া যাবে না। জীবজগতের অবমাননা হবে তাতে।
এসব আন্তর্জাতিক ঝুঠঝামেলায় জড়িয়ে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, নিজেকে বোঝাল শিলাদ। নয়তো বাঁটকুল ভুঁড়িদাস গদাইলস্করটাকে টুঁটি কামড়ে কেওড়াঝোপে তুলে নিয়ে গেলে সত্তর কিলোর মত গলস্তানি হাড়মাংস তো বটেই, দু কিলো গর্মাগরম চর্বিও খাওয়া যেত সুড়ুপ-সুড়ুপ করে। দুটো মাস্কেটধারী জেগে পাহারা দেবে, অতএব গতিক সুবিধের নয়। হাল্কা থাবায় ঘন জঙ্গলের ভেতর কেটে পড়ল ও, শিলাদ তরফদার। দাদু যে কেন এই জলজঙ্গলের ধারেকাছে না যেতে পইপই করে বলত, তা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে।
বসন্তৃতুর মাঝ-দুপুরে, শিষে খালের দলুজে গলা ওব্দি চুবিয়ে আমেজ নিচ্ছিল শিলাদ। দেবী দোলায় এসে চলে গেছেন ঘোড়ায় চেপে। মড়ক লেগেছে বটে, নয়তো এতো মাটিগলা রঙওঠা প্রতিমার খড়বিচালি আসছেই বা কোথ্থেকে? তার আগে বিশ্বকর্মার এসেছিল। সেদিনকে একটা আড়মাছ ধরেছিল শিলাদ; ছেড়ে দিতে হল। মহিষাসুরের গায়ের তিতকুটে সবুজ রঙ খেয়ে মায়ের দয়া হয়েছিল মাছটার।
ঘাড়ের আনচান ব্যথাটা ডানকাঁধ অব্দি ছড়িয়েছে। ফলে, গরম রক্তের ডিশ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। ফাল্গুনের শেষাশেষি, গাছে-গাছে লাল-হলুদ ফুল, খালের কমজোরি সোঁতায় নিজেকে চুবিয়ে, যাতে বাঘিনী না পাবার তাপ কমে, শিমুল-পলাশের ডালে-ডালে ঠাকুরাল-বাঁদর শিক্ষ-শিক্ষিকাদের ছাত্র পড়ানো দেখছিল শিলাদ।প্রগতিশীল বাঁদর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশ হোঁতকা-হোঁতকি রাঙা পোঁদা রাঙামুখো। কারোর চতুর্থ হাতে বিপত্তারিণির হর্তুকি, কারোর তৃতীয় হাতে জয় বজরংবলির মাদুলি, কারোর দ্বিতীয় হাতে রুপোর চেনে মাকলা-বাঁশের শেকড় বাঁধা। ছাত্র-ছাত্রীরা রোগা টিংটিঙে।
একজন টিচার বেশ ঠাটি, ফুটেক ল্যাজের ছড়ি উঁচিয়ে, মগডাল থেকে তাক-তিড়িং-তুং লাফ মেরে ক্লাসে নামল, তারপর, হেঁচকা মেরে, এক মাওরা ছাত্রীকে চামড়াসুদ্ধ এক-খাবলা লোম তুলে নিয়ে যেতে, বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা পেছনের দুহাতে তালি বাজিয়ে বাহবা দিল। এরপর এক ধিঙ্গিনাচন শিক্ষিকা, পলাশের কাঁটাদার জি১গলকাঠি ভেঙে তিন হাত দিয়ে এক কচি ছাত্রকে দমাদম উত্তম-মাধ্যম দিতে, সে আধমরা হয়ে গাছের নমনা আঁকড়ে ঝুলতে লাগল। অন্যসব পিশিনচি শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রশংসায় এডালে-সেডালে হুপহাপ লাগাল। পরের ক্লাসের শিক্ষক অন্য গাছ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে তিন ছাত্রীকে বলল, চার হাতের মুঠোয় মৌমাছির ঝাঁক ধরে রাখতে; ছাত্রীদের অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে হেসে-হেসে ছ্যাদলাপড়া দাঁত বের করে বাদবাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা হুটোপাটি-লুটোপাটি করতে লাগল। এবার তিনজন কেঁদো শিক্ষক মিলে এক ছাত্রকে কিল-চড়-থাপ্পড় মেরে-মেরে অজ্ঞান করে ফেলল। পুরো শিক্ষকমণ্ডলী আনন্দে ছৌনাচ নাচতে লাগল সরকারের এবং নিজেদের প্রগতিশীল শিক্ষাধারা অনুযায়ী।
শিলাদ তরফদার নিজেকে বোঝাল, ভাগ্যিস ও মানবজীবন চায়নি বা পায়নি। সেক্ষেত্রে ছাত্র আর শিক্ষক দুটো স্তরের রাঙাপোঁদা রাঙামুখো পর্ব পেরোতে হতো। শিক্ষকরা তো মানব গড়ার কারিগর।
চৈত্রের শুক্লা ত্রয়োদশীতে, চিংড়িচাষির পোষা দলছুট ছাগল ধরে এনে খেয়ে-দেয়ে খালের জলে আঁচিয়ে ঝিমোচ্ছিল শিলাদ। বিটকেল পেঁকো গন্ধ আর তার চেয়ে বিটকেল আওয়াজে তন্দ্রা কেটে গেল। ভোঁদাকালুটুয়া দুলকিপোঁদা দুটো শুয়োর গদাম-গদাম করে মারামারি করছে হিন্দি সিনেমার গাঁটকাটা তিলেখচ্চরদের ঢঙে। মজা দেখতে ভিড় করেছে জনাদশেক বয়স্ক শুয়োর-শুয়োরনি আর তাদের খানচল্লিশের অ্যান্ডাবাচ্চা। শুকনো ছনঘাসের ফিকেহলুদ পর্দার আবডাল থেকে ওদের গেঁতোমি ভালই দেখতে পাচ্ছিল শিলাদ।
খোটেল শুয়োর দুটো পেছিয়ে যাচ্ছে, তার পর নানা অভিযোগ তুলে কাঁচা খিস্তি দিতে-দিতে একজন আরেকজনের মাথায় দড়াম, আবার দড়াম, তারপর আবার দড়াম। অভিযোগের ফিরিস্তি শিলাদের কানে আসছিল: সুপারির ট্যাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করিস না, বিরোধী প্রর্থীকে মাস্তান সাপ্লাই দিয়েছিস, ধর্ষণে যাবার আগে আমাদের সঙ্গী করিস না, আমার এলাকায় ট্রাক লুটিস, পুকুর বোজাবার আমাদের গুয়ের গাড়ি ছিনিয়ে নিস, আমাদের এলাকার ঠিকেদারি নিয়ে নিস, পুজোয় তোলা আদায় করে পুরোটা রেখে নিস, আমার চুল্লুঠেকের খবর পুলিশকে দিস, আমাদের পাচারের মাগিদের পেছন শুঁকে বেড়াস, ইত্যাদি।
ওসব রাজনৈতিক চাপান-উতোর শুনতে-শুনতে নিদারুণ বিরক্ত শিলাদ হা-লু-ম হাঁক পেড়ে ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করল। শুয়োর পাকড়াও করতে গেলে তেঁদুলে টুঁটির তল ভাঙা ঘাড় নিয়ে পারা যায় না বলে এই র্যাশান বড় একটা তোলে না শিলাদ। স্টক হিসাবে দেখে রেখেছে। কোনো কিছুই না পাওয়া গেলে তখন দেখা যাবে। আসলে পেট ফাঁসিয়ে কব্জা করলে পাঁক আর গুয়ের মিক্সচারের এমন পচা দুর্গন্ধ বেরোয় যে খেতে গেলে বমি পেয়ে যায়। ব্যাটাদের ধরে-ধরে মানুষদের হরিণবাড়িতে পাঠানো উচিত। অভাবী মানুষরা বাঁচুক খেয়ে-পরে।
শুয়োরের চেয়ে শকুন জীবন অনেক শ্রেয়। গু-গোবর ঘাঁটতে হয় না। নোংরা করার বদলে পরিষ্কার করার কাজে আত্মনিয়োগ করা যায়। আবার কি শকুন হওয়া সম্ভব? শিলাদের আফশোষ হয়। ইচ্ছে করে প্রঅয়শ্চিত্ত করতে। বাঘ হয়ে নীলাকাশ নেই, উড়াল নেই। প্যাঁচা থাকতে ছুটকো-ছাটকা উড়াল ছিল, সবই প্রায় অন্ধকারে। শকুনের ভাগ্যে কত আলো, কত রুপালি-সোনালি মেঘ, অফুরন্ত আকাশ। গিরগিটির কেবল পালিয়ে বেড়াও, লুকিয়ে বেড়াও; কোনো স্বাধীনতা নেই, পরোপকার নেই। মাছের তো খোলা হাওয়াও নেই, সবুজ প্রান্তর আর বন নেই, নিঃশেষ নীলিমা তো নেইই। মনমরা লাগে শিলাদের। নিজেকে নিজের কাছে, নিজের বাছবিচারের সম্ভবানার কাছে, বেঁচে থাকার খামখেয়ালি অথচ নির্বিকার স্রোতের কাছে, নিজেকে পরাজিত লাগে, হেরো, পরাভূত।
এই-ই উন্নততম প্রাপ্তি, মেনে নিয়ে, জঙ্গলে ঝোপে বাদায় খালে গাঙে নদীর চরে দ্বীপে একা-একা ঘুরে বেড়ায় শিলাদ তরফদার। মাঝে-মাঝে তাকায় আকাশপানে। দাদু এত দিনে বুড়ো থুথ্থুড়ে হয়ে গিয়ে মারা গিয়ে থাকবে নিঋিতির সংঙ্গে মেয়াদি করারের সংসার করে উড়ে গিয়ে থাকবে ওর একের পর এক স্বামীরা। মণীশ মলহোত্রা আর রিতু বেরির নকশায়িত পোশাকে দেশে-বিদেশে নানা নদী-সাগরে খাঁজের আলো-অন্ধকার দেখিয়ে চলেছে বুক-পাছা দোহারা আর কোমর একহারা ঝলমলে সুন্দরীরা, বা হয়ত ঘর বেঁধেছে প্রবালঘাটা-শৈবালঘাটায়। খোকাখুকু বাঘের সঙ্গে খেলছে সদুর্জয়া কোনো গরানবাগিচা বা সুন্দরী ফরেস্টে। রংবেরং ডিম ফুটে বেড়া টপকে গুবিস্ফোরক নিয়ে ঘাপটি মারছে জঙ্গিলারা ।
বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে, গাঙের টলটলে জলে, কুলকুচো করার জন্যে নেমেছিল শিলাদ। দুঃখ কষ্ট ক্রোধ ক্ষোভ গ্লানি উদ্বেগ উৎকন্ঠা অবসাদ বিরক্তি, মনের অবস্হা যেমনই হোক না কেন, বাঘ হয়ে ওর প্রতিবিম্বটা হাসিমুখ দেখায়, সম্ভবত নাকের দুপাশে গোঁফের ঢেউ-এর জন্য। প্রতিবেশি বলে তো কেউ নেই, বাঘ হবার ফলে তা থেকে ও বঞ্চিত; নয়তো তারা ওর মুখ দেখলে ভাবত যে শিলাদ বেশ আনন্দেই জীবন কাটাচ্ছে। কোথায় শকুনের টিকোলো নাক আর কোথায় বাঘের অতি-থ্যাবড়া নাক। চোখ দুটো ঘোড়েলের মতন; শকুনের দার্শনিক গাম্ভীর্য নেই।
প্রতিবিম্ব দেখতে মশগুল ছিল ও, শিলাদ তরফদার। শুকনো পাতার ওপর কিছু চলছে অনুমান করে পেছন ফিরে দেখতে চাইল। তখনই রাইফেলের বুলেটটা ওর কপালে লেগে খুলি ঝাঁঝরা করে দিল। তবু, দ্রুত বাঁক নিয়ে আক্রমণকারী যেদিকে সেইদিকে লাফ মারল। মাত্র পাঁচ ফিট উঠে ছিটকে পড়ল। পর-পর চারটে গুলি লাগল বুকে আর পেটে। শিলাদ বুঝতে পারল ও মরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর টের পেল ওর পা বাঁধা হচ্ছে নাইলনের দড়ি দিয়ে ; চোখে-মুখে আর বুলেটের চ্যঁদাগুলোয় মাছি বসছে, সেই সঙ্গে জংলি পিঁপড়েরা সার বেঁধে কুচকাওয়াজ করতে-করতে রক্তাক্ত আঘাতে ঢুকছে।
নিথর নিস্পন্দ মৃত শিলাদ আক্রমণকারীদের এই কথাগুলো বলতে শুনল:
—-কপালে গুলি মারলি কেন? মাথার চামড়াটা ড্যামেজ হলে ভাল দাম পেতে অসুবিধা হবে জানিস না?
—-আমি ঠিকই এইম করেছিলাম। টার্গেট হঠাৎ নড়ে যাওয়ায় মাথায় লেগে গেল।
—-মাথায় লেগে বরং ভাল হয়েছে। বারো ফিট লম্বা শিকার। তিনশো কিলোর হেভি-বডির একখানা মরা থাবাও কাৎ করে দিতে পারত যে কাউকে।
—-কারেক্ট। ও হল রয়াল বাঙালি টাইগার; ও জানে যে মানুষকে বিশ্বাস করা পাপ্্র জিন্নত-উল-বিলাদ বলে কথা।
—-অলরেডি ডেড; রক্ত গরম থাকতে স্কিনটা বের করে নে।
—-পেট থেকে লম্বালম্বি চিরবেন, জানেন তো?
—-আরে ও যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ওর নিজের পোচিং কিট আছে। রণথম্ভোর আর সারিস্কায় ও শিকারদের প্রতিবারেই ভালভাবে ছাড়িয়েছিল।
—-হ্যাঁ, তিব্বতের সেই চিনেটা ভাল পেমেন্ট করেছিল। তবে ও ব্যাটা ছ্যাঁচড়া। ডলারে পেমেন্ট করতে চায় না, তার ওপর ওকে হাড় মাংস নাড়িভুঁড়ি সব শুকিয়ে সাপলাই দেবার ঝক্কি। ও সব ইউপি সাইডাররা করতে পারে। আমি বিজনেসে পরিচ্ছন্নতায় বিশ্বাস করি।
—-এবারের পার্টি কুয়েতের শেখ, তাই চিন্তা নেই।
—-সবাই মিলে টানতে-টানতে গাছের তলায় নিয়ে চলুন, নয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে বনবাবুদের সন্দেহ হবে।
শুকনো পাতার ওপর বেছানো বাঁশের টুকরো বা হেঁতালখুঁটির ওপর দিয়ে ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল, পায়ের বাঁধন খুলে অতিযত্নে চামড়া ছাড়ানো হল, ওর ছাড়ানো দেহটা একইভাবে ঠেলে গাঙের জলে ফেলে দেয়া হল, ও চলে গেল জলের তলায়, সবই বুঝতে পারছিল শিলাদ।
জলের তলায় ওর পরিচিত মাছেরা কাঁকড়ারা পোকারা ওর টাটকা মাংস খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে-তুলতে চলে গেল। জলে দুবে থেকে, রক্ত বয়ে গিয়ে, কয়েক দিনে ফ্যাকাশে হয়ে ভেসে উঠল শিলাদ তরফদার।
বড়-বড় মাছেরা ঠোকরাতে থাকলে, ভাসতে-ভাসতে স্রোতের অপলকা ধারায় পড়ল শিলাদ। ও বুঝতে পারছিল খাল থেকে বেরিয়ে, নদীর ভাটার টানে পড়ে বয়ে চলেছে। সমুদ্রের দিকে।
কয়েকটা কাক এসে ওর ওপর বসল, ঙোঁটের কাঁটাচামচ দিয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে, অন্য কাকদের বলতে গেল। অন্য কাকের দল এল। তাদের তাড়িয়ে কয়েকটা ভূবনচিল এল । তাদের তাড়িয়ে, বিশাল ডানা দুদিকে ছড়িয়ে ওর ওপর এসে বসল দীর্ঘদেহী, উন্নতনাসা এক শকুন।
বৃদ্ধ শকুন নিজের মনে বিড়বিড় করছিল, নাতিটা কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, কোনো খোঁজখবর নেই, কত জায়গায় যে ওড়াউড়ি করলুম, কোথাও খুঁজে পেলুম না, কেমন আছে কে জানে।
দাদুকে চিনতে অসুবিধা হয়নি শিলাদের। দাদু-দাদু চিৎকার করেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না। নিজের শবের ওপর দাদুকে নিয়ে ভেসে চলল শিলাদ তরফদার।
( রচনাকাল: এপ্রিল-জুন ২০০৬ । কবিতীর্থ পত্রিকার মে ২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত )
Leave a Reply