ঋগ্বেদ ১০।০১০

ঋগ্বেদ ১০।০১০
ঋগ্বেদ সংহিতা।। ১০ম মণ্ডল।। সূক্ত ১০ (১)
যম ও যমী দেবতা। এবং তাঁহারাই ঋষি।

১। [যমী ও যম যমজ ভ্রাতৃভগিনী, তন্মধ্যে যমী যমকে কহিতেছেন]–বিস্তীর্ণ সমুদ্রমধ্যবর্তী এই দ্বীপে আসিয়া এই নির্জন প্রদেশে তোমার সহবাসের জন্য আমি অভিলাষিণী, কারণ গর্ভাবস্থা অবধি তুমি আমার সহচর। বিধাতা মনে মনে চিন্তা করিয়া রাখিয়াছেন, যে তোমার ঔরসে আমার গর্ভে আমাদিগের পিতার এক সুন্দর নপ্তা (নাতি) জন্মিবে।

২। [ যমের উত্তর ]–তোমার গর্ভসহচর তোমার সহিত এপ্রকার সম্পর্ক কামনা করেন না। যেহেতু তুমি সহোদর ভগিনী অগম্যা। আর এস্থান নির্জন নহে, যেহেতু সেই মহান্ অসুরের স্বর্গধারণকারী বীরপুত্রগণ পৃথিবীর সর্বভাগ দেখিতেছেন (২)।

৩। [ যমীর উক্তি ]—যদিচ কেবল মনুষ্যের পক্ষে এপ্রকার সংসর্গ নিষিদ্ধ, তথাপি দেবতারা এরূপ সংসর্গ ইচ্ছাপূৰ্ব্বক করিয়া থাকেন। অতএব আমার যেরূপ ইচ্ছা হইতেছে,তুমিও তদ্রূপ ইচ্ছা কর। তুমি পুত্ৰজন্মদাতা পতির ন্যায় আমার শরীরে প্রবেশ কর।

৪। [যমের উত্তর]-একাৰ্য পূর্বে কখন আমরা করি নাই। আমরা সত্যবাদী, কখন মিথ্যা কহি নাই। গন্ধর্ব আমাদিগের পিতা, আর আপ্যা যোষা আমাদিগের উভয়ের মাতা (৩); সুতরাং আমাদিগের উভয়ের অতি নিকট সম্পর্ক।

৫। [যমীর উক্তি]–নির্মাণকর্তা ও প্রসবিতা ও বিশ্বরূপ দেবত্বষ্টা (৪), আমাদিগকে গর্ভাবস্থাতেই বিবাহিত স্ত্রীপুরুষবৎ করিয়াছেন। তাহার অভিপ্রায় অন্যথা করিতে কাহারও সাধ্য নাই। আমাদিগের এই সম্পর্ক পৃথিবী ও আকাশ উভয়েই জানেন।

৬। [যমের উক্তি]—এই প্রথম দিন কে জানে? কে বা দেখিয়াছে? কেই বা প্রকাশ করিয়াছে? মিত্র ও বরুণের আবাসভূত এই বিশ্বজগৎ অতি প্রকাণ্ড। অতএব হে আহন (৫)! তুমি নরদিগকে ইহার কি বল?

৭। [যমীর উক্তি] তুমি যম, আমি যমী, তুমি আমার প্রতি অভিলাষযুক্ত হও, এস এক স্থানে উভয়ে শয়ন করি। পত্নী যেমন পতির নিকট, তদ্রূপ আমি তোমার নিকট নিজ দেহ সমৰ্পণ করিয়া দিই। রথ ধারণকারী চক্রদ্বয়ের ন্যায় এস, আমরা এক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হই।

৮। [যমের উত্তর]–এই যে সকল দেবতাদিগের গুপ্তচর, ইহাদের সর্বত্র গতিবিধি, ইহারা চক্ষুঃ নিমীলন করে না। হে ব্যথাদায়িনি (৬) যাও, শীঘ্র অন্যের নিকট গমন কর; রথধারণকারী চক্রদ্বয়ের ন্যায় তাহার সহিত এক কাৰ্য্য কর।

৯। [যমীর উক্তি]–কি দিবসে, কি রাত্রিতে, যজ্ঞের ভাগ যেন যমকে দান করা হয়, সূর্যের তেজঃ যেন পুনঃ পুনঃ আবির্ভূত হয়। দ্যুলোক ও ভূলোক স্ত্রীপুরুষবৎ সম্বন্ধ। যমী যাইয়া ভ্রাতা যমের আশ্রয় গ্রহণ করুক (৭)।

১। [যমের উক্তি]–ভবিষ্যতে এমন যুগ হইবে, যখন ভ্রাতা ভগ্নীর সহিত সহবাস করিবে। হে সুন্দরি! এক্ষণে আমা ভিন্ন অন্য পুরুষকে পতিত্বে বরণ কর। তিনি যখন তোমাকে গ্রহণ করিবেন, তখন তাকে বাহুদ্বারা আলিঙ্গন

১১। [যমীর উক্তি]–সে কিসের ভ্রাতা, যদি সে থাকিতেও ভগিনী অনাথ হয়? সে কিসের ভগিনী, যদি সেই ভগিনী সত্ত্বেও ভ্রাতার দুঃখ দূর না হয়? আমি অভিলাষে মূর্ছিতা হইয়া এই করিয়া বলিতেছি; তোমার শরীরে আমার শরীরে মিলাইয়া দাও।

১২। [যমের উত্তর]—তোমার শরীরের সহিত আমার শরীর মিলাইতে ইচ্ছা নাই। ভগিনীতে যে ব্যক্তি উপগত হয়, তাহাকে পাপী কহে। আমি ভিন্ন অন্য পুরুষের সহিত সুখ সম্ভোগের চেষ্টা দেখ। হে সুন্দরি! তোমার তার তাদৃশ অভিলাষ নাই।

১৩। [যমীর উক্তি]–হায়! যম! তুমি নিতান্ত দুর্বল পুরুষ দেখি তেছি। এ তোমার কি প্রকার মন, কি প্রকার অন্তঃকরণ, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। রজ্জু যেরূপ ঘোটককে বেষ্টন করে, কিংবা যেরূপ লতা বৃক্ষকে আলিঙ্গন করে, তদ্রূপ অন্য নারী অনায়াসেই তোমাকে আলিঙ্গন করে, অথচ তুমি আমার প্রতি বিমুখ!

১৪। [যমের উত্তর ]–হে যমি! তুমি ও অন্য পুরুষকে আলিঙ্গন কর। যেরূপ লতা বৃক্ষকে, তদ্রূপ অন্য পুরুষই তোমাকে আলিঙ্গন করুক। তাহারই মন তুমি হরণ কর, সেও তোমার মন হরণ করুক। তাহারই সহবাসের ব্যবস্থা স্থির কর, তাহাতেই মঙ্গল হইবে।

———

 (১) এই সুক্তটী অতি প্রসিদ্ধ। ইহাতে ভগ্নী যমী ভ্রাতা যমকে আলিঙ্গন করিবার অভিলাষ প্রকাশ করিতেছেন, কিন্তু যম সেই পাপকার্যে অসম্মতি প্রকাশ করিতেছেন। যম ও যমীর আদি অর্থ দিন ও রাত্রি; রাত্রি দিবার পশ্চাতে আইসে, কিন্তু তাঁহাদিগের সঙ্গম হয় না। এই প্রসিদ্ধ সুক্তের মৌলিক অর্থ আমি এইরূপ বুঝিয়াছি।

 (২) অসুরের বীর পুত্রগণ বোধ হয় স্বর্গধারী দেবগণ। দশম মণ্ডলে “অনুর” শব্দ ১৯ বার ব্যবহৃত হইয়াছে…
দশম মণ্ডলের শেষ ভাগের সূক্তগুলি অপেক্ষাকৃত আধুনিক। সুতরাং সেই সূতগুলিতে “অসুর” শব্দ অনেকটা পৌরাণিক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে।

 (৩) সায়ণ গন্ধর্ব অর্থে বিবশ্বান বা সূৰ্য্য এবং আপ্যা। যোষা অর্থে সরণ্যু বা সূৰ্য্যপত্মী উষা করিয়াছেন। আচাৰ্য মক্ষ মুলর এই অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন।

(৪) মূলে “জনিতা * * দেব ত্বষ্টা সবিতা বিশ্বরূপঃ” আছে। সায়ণ “সবিতা” শব্দ বিশেষ্য করিয়া জনিতা ও ত্বষ্টা ও বিশ্বরূপ শব্দকে তার বিশেষণ শব্দ করিয়াছেন। কিন্তু অষ্টাই বোধ হয় বিশেষ, সবিতা প্রভৃতি শব্দগুলি বিশেষণ। “The divine Twashtri, the creator, the vivifier, the shaper of all forms.” – Muir.

(৫) এই শব্দের অর্থ সম্বন্ধে সন্দেহ আছে। সায়ণ এই ষষ্ঠ ঋক্‌টী যমীর উক্তি করিয়াছেন। সুতরাং “আহনঃ” যমের বিশেষণ করিয়াছেন। মিউয়র এই ঋক্ যমের উক্তি করিয়া “আহ” অর্থে “O? Wanton woman!” করিয়াছেন। আমি সেই অর্থ গ্রহণ করিয়াছি কেন না অষ্টম ঋকে “অহনঃ” শব্দ যমী সম্মন্ধেই ব্যবহৃত হইয়াছে।

(৬) এখানে “অহনঃ” শব্দ আছে।

(৭) পণ্ডিতবর মিউয়র এই ঋক্ যমীর উক্তি করিয়াছেন। আমি তাহাই সঙ্গত বলিয়া গ্রহণ করিয়াছি।