আমরা তিনজন – ২য় অংশ

মোনালিসা, কোনোদিন জানলে না তুমি, কোনোদিন জানবে না, কী ভালো আমাদের লেগেছিলো, কী সুখী আমরা হয়েছিলাম, সেই সাতাশ সনের বর্ষায়, পুরানা পল্টনে, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, সেই জ্বরে ঝড়ে, বৃষ্টিতে থমথমে অন্ধকারে, ছমছমে ছায়ায়। দেড় মাস তুমি শুয়ে ছিলে, দেড় মাস তুমি আমাদের ছিলে। দেড় মাস ধ’রে সুখের স্পন্দন দিনে-রাত্রে কখনো থামল না আমাদের হৃৎপিণ্ডে। তোমার বাবা আপিস যান, ফিরে এসে রোগীর ঘরে উঁকি দিয়েই হাত-পা এলিয়ে শুয়ে পড়েন ইজি-চেয়ারে; তোমার মা-র সারাদিন পায়ের পাতা দাঁড়ায় না, কিন্তু রাত্তিরে আর পারেন না তিনি, রোগীর ঘরেই ক্যাম্পখাটে ঘুমোন, আর সারারাত পালা ক’রে ক’রে জেগে থাকি আমরা—কখনো একসঙ্গে দুজনে, ক্বচিৎ তিনজনেই, বেশির ভাগ একলা একজন। আর তোমাকে নিয়ে এই একলা রাত-জাগায় সুখ আমিই পেয়েছি বেশি—অসিত সারাদিন ছুটোছুটি করেছে সাইকেলে, হিতাংশুও বারবার। সবচেয়ে কাছের বরফের দোকান এক মাইল দূরে, ওষুধের দোকান দুই মাইল, ডাক্তারের বাড়ি সাড়ে তিন মাইল—কোনোদিন অসিত দশবার যাচ্ছে, দশবার আসছে, কতবার ভিজে কাপড় শুকোল তার গায়ে, কোনোদিন রাত বারোটায় হিতাংশু ছুটল বরফ আনতে, সব দোকান বন্ধ, রেলের স্টেশন নিঃসাড়, নদীর ধারে বরফের ডিপোতে গিয়ে লোকজনের ঘুম ভাঙিয়ে বরফ নিয়ে আসতে-আসতে দুটো বেজে গেলো তার, এদিকে আমি আইসব্যাগে জলের পরিমাণ অনুভব করছি বারবার, আর অসিত বাথরুমে বরফের ছোট ছোট ছড়ানো টুকরো দু-হাতে কুড়োচ্ছে। সাইকেলে আমার দখল নেই ব’লে বাইরের কাজ আমি কিছুই প্রায় পারি না, সারাদিন ঘুর-ঘুর করি তোমার মা-র কাছে কাছে, হাতের কাছে এগিয়ে দিই সব, ওষুধ ঢালি, টেম্পারেচার লিখি, ডাক্তার এলে তাঁর ব্যাগ হাতে ক’রে নিয়ে আসি, নিয়ে যাই। তারপর সন্ধ্যা হয়, রাত বাড়ে, বাইরে অন্ধকারের সমুদ্র, সে-সমুদ্রে ক্ষীণ আলো-জ্বলা একটি নৌকোয় তুমি আর আমি চলেছি ভেসে, তুমি তা জানলে না মোনালিসা, কোনোদিন জানবে না। সারাদিন, সারারাত মোনালিসা মূর্ছিতের মতো প’ড়ে থাকে, ভুল বকে মাঝে মাঝে—এত ক্ষীণ-স্বর যে কী বলছে বোঝা যায় না—তবু যে ক’টি কথা আমরা কানে শুনেছি তা-ই যত্ন ক’রে তুলে রেখেছি মনে, একের শোনা কথা অন্য দুজনকে বলাই চাই; কখনো হঠাৎ একটু অবসর হলে তিনজন ব’সে সেই কথা ক’টি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, যেন তিনজন কৃপণ সারা পৃথিবীকে লুকিয়ে তাদের মণি-মুক্তো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে, বন্ধ ঘরে, অন্ধকার রাত্রে। যদি বলেছে ‘উঃ’, সে যেন বাঁশির ফুঁয়ের মতো আমাদের হৃদয়কে দুলিয়ে গেছে; যদি বলেছে ‘জল’, তাতে যেন জলের সমস্ত তরলতা ছলছল ক’রে উঠেছে আমাদের মনে।
এক রাত্রে হিতাংশু বাড়ি গেছে আর অসিত বারান্দায় বিছানায় ঘুমুচ্ছে, আমি জেগে আছি একা। টেবিলের উপর জ্বলছে মোমবাতি, দেওয়ালের গায়ে ছায়া কাঁপছে বড়-বড়, অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে ঐ আলোটুকু যেন আর পারছে না; আমিও আর পারছি না ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে, ডাকাতের মতো ঘুম আমার হাত-পা কেটে-কেটে টুকরো ক’রে দিলো, মোমের মতোই গলে যাচ্ছে আমার শরীর। যতবার চাবুক মেরে নিজেকে সোজা করছি; লাফিয়ে উঠছে অতল থেকে বিশাল ঢেউ। ডুবতে ডুবতে মনে হ’লো মোনালিসা তুমিও কি এমন করেই যুদ্ধ করছ মৃত্যুর সঙ্গে, মৃত্যু কি এই ঘুমের মতোই টানছে তোমাকে, তবু তুমি আছো—কেমন ক’রে আছো! মনে হ’তেই ঘুম ছুটল। সোজা হ’য়ে বসলাম, তাকিয়ে রইলাম তোমার মুখের দিকে সেই ক্ষীণ আলোয় কাঁপা-কাঁপা ছায়ায় রাত চারটের স্তব্ধ মহান মুহূর্তে। তুমি কি মরবে? তুমি কি বেঁচে উঠবে? কোনো উত্তর নেই। তোমার কি ঘুম পেয়েছে? উত্তর নেই। তুমি ঘুমিয়েছ না জেগে আছো? উত্তর নেই। তবুও আমি তাকিয়ে থাকলাম, মনে হ’লো এর উত্তর আমি পাবই, পাব তোমারই মুখে, তোমার মুখের কোনো একটি ভঙ্গিতে হয়তো—কে জানে—তোমার কণ্ঠেরই কোনো একটি কথায়। আর, আমি অবাক হ’য়ে দেখলাম, আস্তে আস্তে চোখ তোমার খুলে গেলো, মস্ত বড় হ’লো, উন্মাদের মতো ঘুরে ঘুরে স্থির হ’লো আমার মুখের উপর। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল—‘কে?’
আমি তাড়াতাড়ি আইসব্যাগ চেপে ধরলাম।
‘কে তুমি?’
‘আমি।’
‘তুমি কে?’
‘আমি বিকাশ।’
‘ও, বিকাশ। বিকাশ, এখন দিন, না রাত্রি?’
‘রাত্রি।’
‘ভোর হবে না?’
‘হবে, আর দেরি নেই।’
‘দেরি নেই? আমার ঘুম পাচ্ছে, বিকাশ।’
আমি তার কপালে আমার বরফে-ঠাণ্ডা হাত রাখলাম।
‘আহ্, খুব ভালো লাগছে আমার।’
‘আমি বললাম, ‘ঘুমোও।’
‘তুমি চলে যাবে না তো?’
‘না।’
‘যাবে না তো?’
‘না।’
‘আমি তাহলে ঘুমুই, কেমন?’
নিশ্বাস উঠলো আমার ভিতর থেকে, নিশ্বাসের স্বরে বললাম,—‘ঘুমোও, ঘুমোও, আমি জেগে আছি, কোনো ভয় নেই।’
তুমি ঘুমিয়ে পড়লে আর বাইরে, দু-একটা পাখি ডাকল। ভোর হ’লো।
প্রলাপ, জ্বরের প্রলাপ, তবু এটা আমারই থাক। একলা আমার। এই একটা কথা ওদের দুজনেক বলি নি, হয়তো ওদেরও এমন কিছু আছে যা আমি জানি না, আর-কেউ জানে না। তুমি, মোনালিসা, তুমিও জানলে না, জানবে না কোনোদিন।
তারপর একদিন তুমি ভালো হলে। সে তো খুব সুখের কথা, কিন্তু আমরা যেন বেকার হ’য়ে পড়লাম। আর তুমি ভাতটাত খাবার দিন-পনের পরে যে-রবিবারে তোমার মা আমাদের তিনজনকে নিমন্ত্রণ ক’রে খাওয়ালেন, সেদিন আমার অন্তত মনে হ’লো যে এই খাওয়াটা আমাদের ফেয়ারওএল পার্টি।
কিন্তু তা-ই বা কেন? এখনো আমরা যেতে পারি, বসতে পারি কাছে, গ্রামোফোন বাজিয়ে শোনাতে পারি, সে ক্লান্ত হলে পিঠের বালিশটা দিতে পারি ঠিক ক’রে। এদিকে আকাশে কালো মেঘের সঙ্গে সাদা মেঘের খেলা, আর ফাঁকে-ফাঁকে নীলের মেলা, এই ক’রে-ক’রে আশ্বিন যেই এলো, ওঁরা চলে গেলেন মেয়ের শরীর সারাতে রাঁচি।
বাঁধাছাঁদা থেকে আরম্ভ ক’রে নারায়ণগঞ্জে স্টিমারে তুলে দেয়া পর্যন্ত সঙ্গে-সঙ্গে থাকলাম আমরা তিনজন।
ফার্স্ট ক্লাসের ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়ানো মোনালিসার ছবিটি যখন চোখের সামনে ঝাপসা হ’লো তখন আমাদের মনে পড়লো যে ওঁদের রাঁচির ঠিকানাটা জেনে রাখা হয়নি আমার ইচ্ছে করছিলো বাড়ি ফিরেই একটা চিঠি লিখে ডাকে দিই, তা আর হ’লো না।
অসিত বললো, ‘ওরই তো আগে লেখা উচিত।’
‘তা কি আর লিখবে?’ একটু হতাশভাবেই বললো হিতাংশু।
‘কেন লিখবে না, না-লেখার কী আছে।’
কী আছে কে জানে, কিন্তু কুড়ি দিনের মধ্যেও কোনো চিঠি এলো না। এলো হিতাংশুর বাবার নামে মনি-অর্ডার, বাড়ি-ভাড়ার টাকা। তাই থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে আমরা চিঠি লিখব স্থির করলাম। ও লেখে নি বলে আমরাও না-লিখে রাগ দেখাব, এটা কোনোরকম যুক্তি বলেই মনে হলো না আমাদের। অসুখ থেকে উঠে গেছে, হয়তো এখনো ভালো ক’রে শরীর সারেনি—কেমন আছে সে খবরটা আমাদেরই তো নেয়া উচিত। কিন্তু চিঠিতে পাঠে কী লিখব? আপনি লিখব, না তুমি? মুখে ও অবশ্য আমাদের তুমিই বলেছে, আমরাও তা-ই, কিন্তু কতটুকু কথাই বা এ পর্যন্ত বলেছি আমরা—এতখানি কথা নিশ্চয়ই বলি নি যার জোরে কালির আঁচড়ে জ্বলজ্বলে একটা তুমি লিখে ফেলা যায়। তাছাড়া, কী লিখবই বা চিঠিতে? কেমন ভালো তো? এতেই তো সব কথা ফুরিয়ে গেলো। আমরা কেমন আছি, কী করছি, সে-সব লিখলে তো কতই লেখা যায়—কিন্তু মোনালিসা কি আমাদের খবর জানতে ব্যস্ত?
অনেকক্ষণ ধ’রে জটলা ক’রেও কোনো মীমাংসা যখন হ’লো না, তখন ওরা আমাকেই বললো চিঠিখানা রচনা ক’রে দিতে। আমি কবিতা-টবিতা লিখি, তাই।
সে-রাত্রেই লণ্ঠনের সামনে ঘামতে ঘামতে আমি লিখে ফেললাম :
সুচরিতাষু,
ভেবেছিলাম একখানা চিটি আসবে, চিঠি এলো না। ভাবতে-ভাবতে একুশ দিন কেটে গেলো। খুবই ভালো লাগছে বুঝি রাঁচিতে? অবশ্য ভালো লাগলেই ভালো, আমরা তাতেই খুশী। তারা-কুটিরের একতলা বন্ধ, পুরানা পল্টন তাই অন্ধকার। ওখানে পেট্রোম্যাক্স জ্বলত কিনা রোজ সন্ধ্যায়।
বসে বসে রাঁচির ছবি দেখছি আমরা। পাহাড়, জঙ্গল, লাল কাঁকরের, কালো-কালো-সাঁওতাল। হাসি, আনন্দ, স্বাস্থ্য। সত্যি, কী বিশ্রী অসুখ গেলো—আর যেন কখনো অসুখ না ক’রে।
কারো কোনো অসুখ না ক’রেও এমন কি হয় না যে আমাদের খুব খাটতে হয়? সত্যি, শুয়ে-ব’সে আর সময় কাটে না। চিঠি পেলে আবার আমাদের চিঠি লিখতে হবে, কিছু কাজ তবু জুটবে আমাদের।
মাসিমা মেসোমশায়কে প্রণাম।
আপনি তুমি দুটোই বাঁচিয়ে এর বেশি পারলাম না। এটুকুতেই রাত তিনটে বাজল। তাকিয়ে দেখি, কাটাকুটির ফাঁকে-ফাঁকে এই ক’টি কথা যেন কালো জঙ্গলে ঝিকিমিকি রোদ্দুর। বার-বার পড়লাম; মনে হ’লো বেশ হয়েছে, আবার মনে হ’লো ছি-ছি, ছিঁড়ে ফেলি এক্ষুনি। ছিঁড়ে ফেললামও, কিন্তু তার আগ ভালো একটি কাগজে নকল ক’রে নিলাম, আর পরদিন তিনজন বসিয়ে দিলাম যে যার নাম সই, চোখ বুজে ছেড়ে দিলাম ডাকে।
ঢাকা থেকে রাঁচি, রাঁচি থেকে ঢাকা। চারদিন, পাঁচদিন—আচ্ছা ছ-দিন। না, চিঠি নেই। সন্ধ্যায় কুয়াশা, একটু একটু শীত; চিঠি নেই। শিউলি ফুরিয়ে স্থলপদ্ম ফুটল; চিঠি নেই।
চিঠি এলো শেষ পর্যন্ত, হিতাংশুর নামে শীর্ণ একটা পোস্টকার্ড, লিখেছেন ওর মা। অনেকটা এই রকম :
কল্যাণীয়েষু,
হিতাংশু, অসিত, বিকাশ, তোমরা তিনজনে আমাদের বিজয়ার আশীর্বাদ জেনো। আমাদের রাঁচির মেয়াদ শেষ হ’লো, শিগগিরই ফিরব। ইতিমধ্যে, হিতাংশু তুমি যদি আমাদের ঘরগুলি খুলিয়ে তোমাদের চাকর দিয়ে ঝাঁটপাট করিয়ে রাখো, তাহলে বড় ভালো হয়। চাবি তোমার বাবার কাছে।
আশা করি ভালো আছো সকলে। তরুর শরীর এখন বেশ ভালো হয়েছে, মাঝে মাঝে সে তোমাদের কথা ব’লে। ইতি—তোমাদর মাসিমা।
মাঝে মাঝে আমাদের কথা ব’লে! আর আমাদের চিঠি? পোস্টকার্ডটি তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজেও কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলো না যে চিঠিটা পৌঁছেছিলো। কি হ’লো চিঠির? কিন্তু সে কথা বেশিক্ষণ ভাববার সময় কই আমাদের, তক্ষুনি লেগে গেলাম কাজে। একদিনের মধ্যেই তারা-কুটিরের একতলাকে আমরা এমন ক’রে ফেললাম যে মেঝেতে মুখ দেখা যায়। কয়েকদিন পরে আর-একটি পোস্টকার্ড : ‘রবিবার ফিরছি, স্টেশনে এসো।’ শুধু স্টেশনে। আমরা ছুটলাম নারায়ণগঞ্জে।
আ, কী সুন্দর দেখলাম মোনালিসাকে, কচিপাতার রঙের শাড়ি পরনে, লাল পাড়, লালচে মুখের রং, একটু মোটা হয়েছে, একটু যেন লম্বাও। পাছে কাছে দাঁড়ালে ধরা প’ড়ে যে সে আমাকে মাথায় ছাড়িয়ে গেছে, আমি একটু দূরে দূরে থাকলাম, হিতাংশু ছুটোছুটি ক’রে বরফ লেমনেড কিনতে লাগল, আর অসিত কুলিকে ঠেলে দিয়ে বড়-বড় বাক্স-বিছানা হাই-হাই ক’রে তুলতে লাগল গাড়িতে।
মাসিমা বললেন, ‘তোমরা এ-গাড়িতেই এসো।’
‘না, না, সে কী কথা, আমরা-আমরা এই পাশের গাড়িতেই—’
‘আরে এসো না’—ব’লে দে-সাহেব অসিতের পিঠের উপর হাত রাখলেন।
নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা : মনে হ’লো আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়টি এতকাল এই পঁয়তাল্লিশটি মিনিটের জন্যই অপেক্ষা ক’রে ছিলো। ফার্স্ট ক্লাসের গদিকে অবজ্ঞা ক’রে আমরা বসলাম বাঙ্-বিছানার উপর; তাতে একটা সুবিধে এই হ’লো যে একসঙ্গে সকলকেই দেখতে পেলাম—দেখলাম মোনালিসা খুশী, ওর মা খুশী। বাবা খুশী, দেখতে-দেখতে আমরাও খুশীতে ভ’রে গেলাম; এতদিন যা বাধো-বাধো ছিলো তা সহজ হ’লো, এতদিন যা ইচ্ছে ছিলো তা মূর্ত হ’লো—রীতিমতো কলরব করতে-করতে চললাম আমরা; এতবড় রেলগাড়িটা যেন আমাদের খুশীর বেগেই চলেছে। মোনালিসা নাম ধ’রে-ধ’রে ডাকতে লাগল আমাদের—কত তার কথা, কত গল্প—আর গাড়ি যখন ঢাকা স্টেশনের কাছাকাছি, কোনো-এক ঝর্নার বর্ণনা দিচ্ছে সে, হঠাৎ আমি ব’লে উঠলাম, ‘আমাদের চিঠি পেয়েছিলে?’
‘তোমাদের চিঠি, না তোমার চিঠি?’
আমি একটু লাল হ’য়ে বললাম, ‘জবাব দাও নি যে?’
‘এতক্ষণ ধ’রে তো সেই জবাবই দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে আরও দেবো।’
মিথ্যো বলে নি মোনালিসা। স্বর্গের দরজা হঠাৎ খুলে গেলো আমাদের, আমরা তিনজন আমরা চারজন হ’য়ে উঠলাম।
তারপর একদিন মাসিমা আমাদের ডেকে বললেন, ‘একবার তোমরা তরুর জন্য খেটেছ, আর একবার খাটতে হবে। ঊনতিরিশে অঘ্রাণ ওর বিয়ে।’
ঊনতিরিশে! আর দশ দিন পরে!
ছুটে গেলাম ওর কাছে, বললাম, ‘মোনালিসা, এ কী শুনছি!’
ভুরু কুঁচকে বললো, ‘কী? কী বললে?’
গোপন নামটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় আমি একটু থমকে গেলাম, কিন্তু একবার যখন বেরিয়েই গেছে তখন আর ভয় কী! মরিয়া হলে মানুষের যে সাহস হয়, সেই সাহসের বশে আমি সোজা তাকালাম ওর চোখের দিকে, চোখের ভিতরে—যা যা আগে আমি কখনো করি নি—বেগুনি-বেগুনি কালো রঙের ওর চোখ, একফোঁটা হীরের মতো চোখের মণি—তাকিয়ে থেকে আবার বললাম, ‘মোনালিসা।’
‘মোনালিসা’ সে আবার কে?’
‘মোনালিসা তোমারই নাম’, বললো অসিত, ‘জানো না?’
‘সে কী?’
হিতাংশু বললো, ‘আর কোনো নামে আমরা ভাবতেই পারি না তোমাকে।’
‘মজা-তো—’ কৌতুকের রং লাগল ওর মুখে, মিলিয়ে গেলো, পলকের জন্য ছায়া পড়লো সেখানে, যেন একটি ক্ষণিক বিষাদের মেঘ আস্তে ভেসে গেল মুখের উপর দিয়ে। একটু তাকিয়ে রইল, চোখের পাতা দুটি চোখের উপর নামল একবার।
হঠাৎ, মুহূর্তের জন্য—কী কারণে বুঝলাম না—আমাদের একটু যেন মন-খারাপ হ’লো, কিন্তু তখনই তা উড়িয়ে দিল হাসির হাওয়া, আমাদের কথায় লাগল ঠাট্টার বুড়বুড়ি।
‘কী শুনছি? মোনালিসা, কী শুনছি?’
‘কী শুনছ বলো তো?’ ব’লে আঁচলে মুখ চেপে খিলখিল ক’রে হেসে পালিয়ে গেলো।
বর এলো বিয়ের দু’দিন আগে কলকাতা থেকে। ধবধবে ফর্সা, ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবি পরনে, কাছে দাঁড়ালে সূক্ষ্ম একটি সুগন্ধে মন যেন পাখি হ’য়ে উড়ে যায়। দেখে আমরা মুগ্ধ। হিতাংশু বারবার বলতে লাগল—’হীরেন বাবু কী সুন্দর দেখতে।’
অসিত জুড়ল—‘ধুতির পাড়টা!’
‘পা দুটো!’ বলে উঠলো হিতাংশু। ‘অমন ফর্সা পা না-হলে কি আর ও-রকম ধুতি মানায়!’
আমি ফস্ করে বললাম, ‘যা-ই বলো, ঠোঁটের কাছটা একটু বোকা-বোকা।’
‘কী! বোকা-বোকা!’ অসিত চেঁচিয়ে উঠলো, কিন্তু চিৎকার বেরোল না, কারণ লোকজন নিয়ে চ্যাঁচামেচি ক’রে-ক’রে বিয়ের অনেক আগেই সে-গলা ভেঙে ব’সে আছে। রেগে যাওয়া বেড়ালের মতো ফ্যাঁশ ফ্যাঁশ ক’রে বললো, ‘এমন সুন্দর দেখেছ কখনো!’
‘মোনালিসার মতো তো নয়!’ আমি আমার গোঁ ছাড়লাম না।
‘একজন কি আর-একজনের মতো হয় কখনো! খুব মানিয়েছে দু’জনে। চমৎকার!’ ব’লে অসিত লাফিয়ে সাইকেলে উঠে বোঁ ক’রে কোথায় যেন চলে গেলো। বিয়ের সমস্ত ভারই তার উপর, তর্ক করার সময় কোথায়।
বিয়ের দিন শানাইয়ের শব্দে রাত থাকতেই আমার ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই মনে পড়লো সেই আর-একটি শেষ-রাত্রি, যখন মৃত্যুর হাত থেকে—তা-ই মনে হয়েছিলো তখন—মোনালিসাকে আমি ফিরিয়ে এনেছিলাম। সেদিন অন্ধকারের ভিতর থেকে একটু একটু ক’রে আলো বেরিয়ে আসা দেখতে-দেখতে যে আনন্দে আমি ভেসে গিয়েছিলাম, সেই আনন্দ ফিরে এলো আমার বুকে, গা কাঁটা দিয়ে উঠলো, শানাইয়ের সুরে চোখ ভ’রে উঠলো জলে। আর শুয়ে থাকতে পারলাম না, তারা-ভরা আকাশের তলায় দাঁড়ালাম এসে। শুনতে পেলাম বিয়েবাড়ির সাড়াশব্দ, শাঁখের ফুঁ—কাছে গেলাম। মনে হ’লো আর একবার যদি দেখতে পাই, এই ভোর হবার আগের মুহূর্তে, যখন আকাশ ঘোষণা করছে মধ্যরাত্রি আর হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ভোর—এই আশ্চর্য অপার্থিব সময়ে একটু দেখতে পাই যদি। কিন্তু না—গায়ে-হলুদ হচ্ছে, কত-কত অচেনা মেয়ে ঘিরে আছে তাকে, কত কাজ, কত সাজ—এর মধ্যে আমি তো তাকে দেখতে পাব না। বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরকার চলাফেরা, কথাবার্তা শুনতে লাগলাম, আর সব ছাপিয়ে, সব ছাড়িয়ে শানাইয়ের সুর ঝরল, আমার চোখের সামনে কাঁপতে-কাঁপতে তারার ঝাঁক মিলিয়ে গেলো, ফুটে উঠলো মাঠে মাঠে গাছপালার চেহারা, মাটির অবয়ব, পৃথিবীতে আর একবার ভোর হলো।
সেদিনে অসিতের গলা একেবারেই ভেঙে গিয়ে নববধূর মতো ফিসফিসে হ’লো। এত ব্যস্ত সে, আমাকে যেন চেনেই না। হিতাংশুও ব্যস্ত, ব্যস্ত এবং একটু গর্বিত, কেননা বর সদলে বাসা নিয়েছেন তাদেরই বাড়ির দুটো ঘরে, একতলা দোতলায় দূতের কাজ করতে-করতে সে স্যান্ডেল ক্ষইয়ে ফেলল। আমি একবার হিতাংশুকে, একবার অসিতকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম সারাদিন ভ’রে, কিন্তু আমার নিজের মনে হ’লো না বিশেষ-কোনো কাজে লাগছি, আর শেষ পর্যন্ত যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে কনেকে সাতপাক ঘোরাবার সময় এলো, তখনও আমি এগিয়ে গেলাম, কিন্তু আমাকে ঠেলে দিয়ে অসিত আর হিতাংশুই পিঁড়ি তুলল, দু’হাতে দু’জনের গলা জড়িয়ে ধ’রে ও সাত পাক ঘুরল, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম।
বিয়ের পরদিন থেকেই আমরা তিনজন হীরেন বাবুর চাকর বনে গেলাম। তাঁর মতো সুন্দর কেউ না, তাঁর মতো বিদ্যেবুদ্ধি কারো নেই, তাঁর মতো ঠাট্টা কেউ করতে পারে না। অন্য পুরুষদের বাঁদর মনে হ’লো তুলনায়—আমারও আর মনে হ’লো না যে তাঁর ঠোঁটের কাছটা একটু বোকা-বোকা। এমনকি, আমি চেষ্টা করতে লাগলাম তাঁর মতো ক’রে বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে, হাসতে, কথা বলতে; ওরা দু’জনও তা-ই করলো, আবার তা দেখে হাসি পেলো আমার, হয়তো প্রত্যেকেই আমরা অন্য দু’জনের চেষ্টা দেখে হেসেছি মনে-মনে, যদিও মুখে কেউ কিছু বলি নি।
একদিন দুপুরবেলা হীরেনবাবুর কাছে খুব একটা মজার গল্প শুনছি, তিনি একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘দ্যাখো তো ভাই, তরু গেলো কোথায়।’
‘ডেকে আনব?’ ব’লে আমি ছুটে বেরিয়ে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *