ঋগ্বেদ ০৬।৪৭

ঋগ্বেদ ০৬।৪৭
ঋগ্বেদ সংহিতা । ৬ষ্ঠ মণ্ডল । সূক্ত ৪৭
এই সূক্তের দেবতা নানাবিধ। প্রথম ৫টী ঋকের দেবতা সোমরস। বিংশ ঋকের প্রথম পদের দেবতা দেবগণ, দ্বিতীয় পাদের পৃথিনী, তৃতীয় পদের বৃহস্পতি এবং চতুর্থপদের ইন্দ্র। দ্বাবিংশ হইতে ৪টী ঋকের দেবতা সৃঞ্জয়পুত্র প্রস্তোক, কারণ ওই ৪টী ঋকে তাঁহার দানের প্রশংসা করা হইয়াছে। ষড়বংশ হইতে ৩টী ঋকের অর্থাৎ ত্রিচের দেবতা রথ। পরবর্তী ত্রিচের অর্থাৎ ঊনত্রিংশৎ ত্রিশৎ ও একত্রিশৎ ঋকের দেবতা দুন্দুভি। অবশিষ্ট ঋকের দেবতা ইন্দ্র। ভরদ্বাজের অপতা গৰ্গ ঋষি।

১। এই অভিযুত সোম স্বস্বাছ, মধুর, তীব্র ও সারবান। ইন্দ্র এই সোমরস পান করিলে কেহই রণস্থলে তাঁহাকে সহ্য করিতে সমর্থ হয় না।

২। এই যজ্ঞে ঈদৃশ সোমরস পীত হইয়া নিরতিশয় হর্ষ বিধান করিয়াছিল। ইন্দ্র ইহ৷ পান করিয়া বৃত্ৰ সংহারকালে হৃষ্ট হইয়াছিলেন। ইহা শম্ববরের অসংখ্য সৈন্য এবং একোণাশত পুরী নাশ করিয়াছিল।

৩। এই সোম পীত হইয়া আমার বাক্যের স্বমূৰ্ত্তি বিধান করিতেছে। ইহা অভিলষিত বুদ্ধি প্রদান করিতেছে। এই সুবুদ্ধি সোম ছয়টা অবস্থাপ স্বষ্টি করিয়াছে (১)। ভূতজাত কেহই তাছা হইতে দূরে অবস্থান করিতে সমর্থ হয় না।

৪। ফলতঃ এই সোমরসই পৃথিবীর বিস্তার ও স্বর্গের দৃঢ়তা বিধান করিয়াছে। এই সোমরসহ এই তিন উৎকৃষ্ট আধারে রস স্থাপন করিয়াছে(২) এবং বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষকে ধারণ করিয়া রহিয়াছে।

৫। নিৰ্ম্মল অন্তরিক্ষস্থিত উষার প্রারম্ভে এই সোমরসই বিচিত্র দর্শন সৌর জ্যোতি প্রকাশ করে। বারিবর্ষক, বলশালী এই সোমরসই মরুৎগণের সহিত সুদৃঢ় স্তম্ভদ্বার স্বৰ্গলোক ধারণ করিয়া রহিয়াছে।

৬। হে বীর ইন্দ্ৰ! তুমি ধন লাভার্থ আরব্ধ সংগ্রামে শত্রুনিধনকারী। সাহসপূর্বক কলসস্থিত সোমরস পান কর। মাধ্যান্ত্রিক যাগে ভূমি প্রচুর পরিমাণে সোম পান কর। হে ধনম্পদ! তুমি আমাদিগকে ধন প্রদান কর।

৭। হে ইন্দ্ৰ! তুমি মার্গ রক্ষকের ন্যায় অগ্রগামী হইয়া আমাদিগের প্রতি দৃষ্টি রাখিও এবং আমাদিগের অভিমুখে শ্রেষ্ঠ ধন আনয়ন কর। তুমি সম্যকরূপে আমাদিগকে দুঃখ হইতে ও শক্র হইতে পরিত্রাণ কর এবং উৎকৃষ্ট নায়ক হইয়া অfমাদিগকে অভিলষিত ধনে লইয়া যাও।

৮। হে ইন্দ্ৰ! তুমি জ্ঞানবান, তুমি আমাদিগকে বিস্তীর্ণ লোকে এবং সুখময়, ভয়শূন্ত আলোকে নিৰ্ব্বিন্ধে লইয়া যাও (৩), তুমি প্রাচীন, আমরা যেন তোমার মনোজ্ঞ ও বৃহৎ বাহুদ্বয়ের উপর রক্ষার নিমিত্ত নির্ভর করি।

৯। হে ধনাঢ্য ইন্দ্ৰ! তুমি আমাদিগকে নিজ পরাক্রমশালী অশ্বদ্বয়ের পশ্চাৎ স্ববিস্তীর্ণ রপের উপর স্থাপন কর। বিবিধ অন্নের মধ্য হইতে তুমি আমাদিগের জন্য প্রকৃষ্টতম অন্ন আনয়ন কর। হে মঘবা! অন্য কোন ধনশালী ব্যক্তি যেন ধন বিষয়ে আমাদিগকে অতিক্রম না করে।

১০। হে ইন্দ্ৰ! তুমি আমাকে সুখী কর। মদীয় জীবন বৃদ্ধি করিতে প্রসন্ন হও। লৌহময় খঙগ ধারার ন্যায় (৪) মদীয় বুদ্ধি সুতীক্ষ্ণ কর। তোমাকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত সম্প্রতি আমি যাহা কিছু উচ্চারণ করিতেছি তৎসমুদয় গ্রহণ কর। দেবগণ যেন আমাকে রক্ষা করেন।

১১। যিনি শক্ৰ হইতে রক্ষা করেন ও অভীষ্ট পূরণ করেন; যিনি অনায়াসে আহ্বানযোগ্য, শৌর্য্যশালী ও সৰ্ব্বকার্য্যে সমর্থ, আমি বহু লোকের বন্দনীর সেই ইন্দ্রকে প্রত্যেক যাগে আহ্বান করি। ধনবান সেই ইন্দ্ৰ যেন আমাদিগকে সমৃদ্ধি বিধান করেন।

১২। শোভন রক্ষণবিধানকারী, ধনশালী ইন্দ্ৰ যেন রক্ষাদ্বারা আমাদিগের সুখবিধান করেন। সৰ্ব্বজ্ঞ সেই ইন্দ্ৰ যেন আমাদিগের শক্রদিগকে বধ করিয়া আমাদিগন্থে, নির্ভয় করেন। আমরা যেন তাহার প্রসাদে নিরতিশয় বীৰ্য্য সম্পন্ন হই।

১৩। আমরা যেন সেই যাগার্হ ইন্দ্রের অনুগ্রহ, বুদ্ধি ও কল্যাণকর প্রীতির পাত্র হই। সুরক্ষক ও ধনসম্পন্ন সেই ইন্দ্ৰ যেন বিদ্বেষকারীগণকে আমাদিগ হইতে বহুদূরে অন্তর্হিত করেন।

১৪। হে ইন্দ্ৰ! স্তবকারীর স্তোত্র ও উপাসনা ও বিপুল ধন এবং প্রচুর অভিযুত সোমরস নিম্নদেশ প্রবণ জলরাশির ন্যায় ত্বদভিমুখে প্রধাবিত হয়। হে বজধর! তুমি জল, দুগ্ধ ও সোমরস সম্যকরূপে মিশ্রিত কর।

১৫। কোন ব্যক্তি প্রকৃতরূপে ইন্দ্রের স্তব, প্রীতিসাধন ও যাগ করিতে সমর্থ? কারণ ধনশালী ইন্দ্র প্রতিদিন নিজ উগ্ৰশক্তি বিদিত হয়েন, কারণ মাৰ্গগামী ব্যক্তি যেরূপ নিজ পাদদ্বয়কে ক্রমান্বয়ে অগ্রবর্তী ও পশ্চাদ্বর্ত্তী করে তদ্রূপ তিনি নিজ প্রজ্ঞাবলে প্রথম স্তোতাকে পরবর্তী ও পরবর্তী স্তোতাকে প্রথমে করেন।

১৬। প্রবল শক্রর দমন করিয়া এবং নিরন্তর স্তোতৃবর্গের স্থান পরিবর্তন করিয়া এই ইন্দ্র নিজ বীরত্বের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন। উদ্ধত ব্যক্তিগণের দ্বেষকারী, স্বৰ্গীয় ও পার্থিব উভয়বিধ ধনের অধিপতি এই ইন্দ্র নিজ পরিচারকবর্গকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত পুনঃ পুনঃ আহ্বান করেন।

১৭। এই ইন্দ্ৰ পূৰ্ব্বতন প্রশস্ত কৰ্ম্মের অনুষ্ঠানকারীগণের সহিত মিত্রত পরিত্যাগ করেন এবং তাহাদিগের প্রতি দ্বেষ করিয়া তদপেক্ষ নিকৃষ্ট ব্যক্তি গণের সহিত বন্ধুতা করেন। অথবা ত্বদীয় উপাসনা বর্জিত ব্যক্তিগণকে পরিত্যাগপূর্বক পরিচর্য্যাকারীগণের সহিত বহুবৎসর যাবৎ একত্র অবস্থিতি করেন।

১৮। সমস্ত দেবগণের প্রতিনিধিভূত এই ইন্দ্র বিবিধ মূৰ্ত্তি ধারণ করেন এবং সেই সেই রূপ পরিগ্রহ করিয়া তিনি পৃথকভাবে প্রকাশিত হয়েন। তিনি মায়াদ্বারা বিবিধরুপ ধারণ করিয়া যজমানগণের নিকট উপস্থিত হয়েন। কারণ র্তাহার রথে সহস্ৰ অশ্ব যোজিত আছে।

১৯। ত্বষ্টা(৫) রথে অশ্বদ্বয় যোজিত করিয়া ত্রিভুবনের বহুস্থানে প্রকাশিত হয়েন। অন্য কোন ব্যক্তি প্রত্যহ উপস্থিত স্তোতৃবর্গের মধ্যে গমনপূর্বক শক্ৰগণ হইতে তাহাদিগকে রক্ষা করে?

২০। হে দেবগণ! আমরা ভ্রমণ করিতে করিতে গোসঞ্চার রহিত দেশে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। সুবিস্তীর্ণ ধরিত্রী দস্যুগণের আশ্রয় প্রদান করিতেছে। হে বৃহস্পতি! তুমি ধেনুগণের অনুসন্ধান বিষয়ে আমাদিগকে পরিচালিত কর। হে ইন্দ্ৰ! এইরূপে পথভ্রষ্ট ত্বদীয় উপাসককে তুমি পথপ্রদর্শন কর (৬)।

২১। ইন্দ্র অন্তরিক্ষস্থিত গৃহ হইতে সূর্য্যরূপে আবিভূত হইয়া দিবসের অপরার্দ্ধ প্রকাশিত করিবার নিমিত্ত প্রত্যহ তুল্যরূপে কৃষ্ণবর্ণ রাত্ৰিসকল দূর করেন। বর্ষণকারী সেই ইন্দ্র উদব্রজ নামক দেশে বট ও শম্বর নামক দুই ধনার্থী দাসকে সংহার করিয়াছেন (৭)।

২২। হে ইন্দ্র! প্রস্তোক ত্বদীয় স্তবকারী আমাকে স্বর্ণপূর্ণ দশটা কোশ ও দশটা অশ্ব প্রদান করিয়াছেন এবং অতিথিশ্ব শংবরকে জয় করিয়া যে ধন লাভ করিয়াছেন, আমরা দিবোদাসের নিকট হইতে সেই ধন গ্রহণ করিয়াছি।

২৩। আমি দিবোদাসের নিকট হইতে দশটা অশ্ব, দশটা সুবর্ণ কোশ পরিচ্ছদ, প্রচুর অল্প এবং দশটা হিরণ্যপিও লাভ করিয়াছি।

২৪। অশ্বথ মদীয় ভ্রাতা পায়ুকে অশ্বগণের সহিত দশখানি রথ এবং অথৰ্ব্ব গোত্র ঋষিগণকে একশত গে। প্রদান করিয়াছেন।

২৫। সকল লোকের হিতের জন্য যে ভরদ্বাজপুত্র সকল ঈদৃশ অতুল ঐশ্বৰ্য্য গ্রহণ করিয়াছিলেন স্বঞ্জয়পুত্র তাহাদিগকে পূজা করিয়াছিলেন।

২৬। হে বনস্পতি নিৰ্ম্মিত রথ! তোমার অবয়ব সকল দৃঢ় হউক, তুমি আমাদিগের বন্ধু ও রক্ষক হও, তুমি প্রকৃষ্টবীরগণ কর্তৃক যুক্ত হও। ভূমি গোদ্বারা সন্নদ্ধ(৮) তুমি আমাদিগকে মুদৃঢ় কর, তোমার উপর আরূঢ় রথী যেন অনায়াসে শত্রু জয় করিতে সমর্থ হয়।

২৭। হে ঋত্বিগগণ! তোমরা হব্যদ্বারা রথের যজ্ঞ কর, কারণ এই রথ স্বর্গ ও পৃথিবীর সারাংশদ্বারা স্বঃ, বনস্পতির স্থিরাংশদ্বারা ঘটিত, জলের বেগের ন্যায় বেগযুক্ত, গোদ্বারা আবৃত এবং বজ্রভূত।

২৮। হে দিব্যরথ! তুমি আমাদিগের যাগে প্রসন্ন হইয়া হব্য গ্রহণ কর, কারণ তুমি ইন্দ্রের বজ্রস্বরূপ, মরুৎগণের পুরোবন্তী, মিত্রের গর্ভভূত, ও বরুণের নাভিস্বরূপ।

২৯। হে দুন্দুভি(৯)! তুমি নিজ শব্দদ্বার স্বর্গ ও পৃথিবী পরিপূর্ণ কর, স্থাবর ও জঙ্গম উভয়বিধ প্রাণিজাত ইহা অবগত হউক। তুমি ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণের সহিত সমবেত হইয়৷ অস্মদীয় শক্রগণকে সুদূরে প্রেরণ কর।

৩০। হে দুন্দুভি! তুমি আমাদিগের শক্রগণকে রোদন করাও। তুমি আমাদিগের বল প্রদান কর। তুমি দুৰ্দ্ধব শক্রগণের পীড়াবিধানপূর্বক উচ্চরব কর। হে দুন্দুভি! আমাদিগের অনিষ্ট করিয়া যাহারা আমন্দিত হয় তুমি তাহাদিগকে দূরীভূত কর। তুমি ইন্দ্রের মুষ্টিস্বরূপ অতএব আমাদিগকে দৃঢ়তা প্রদান কর।

৩১। হে ইন্দ্ৰ! আমাদিগের এই সমস্ত ধেনুকে প্রতিনিবৃত্ত করিয়া আমাদিগের নিকট প্রত্যানয়ন কর। ছন্দুভি সকল ব্যক্তির নিকট ঘোষণা করিবার নিমিত্ত নিয়ত উচ্চরব করিতেছে। আমাদ্বিগের নায়কগণ অশ্বারোহণ-পূর্বক সমবেত হইয়াছে। হে ইন্দ্র! আমাদিগের রথারূঢ় সৈন্যগণ যেন যুদ্ধে জয়লাভ করে(১৭)।

————-

(১) স্বর্গ, পৃথিবী, দিব, রাত্রি, জল ও ওষধি। সায়ণ।

(২) ওষধি, জল ও ধেনু। সায়ণ।

(৩) অর্থাৎ স্বর্গ। সায়ণ। “A blessed state of happiness, light and safety.”—Wilson.

(৪) মূলে “অয়সঃ ন ধারাং” আছে।

(৫) অর্থাৎ ইন্দ্র। সায়ণ।

(৬) আর্য্যগণ নিজ গো-সঙ্কুল কর্ষিত প্রদেশের সীমা অতিক্রম করিয়া অনার্য্য, আদিবাসীগণের অরণ্য প্রদেশে প্রবেশ করিয়াছেন, তাহাই ঋকের অর্থ।

(৭) এই উদব্রজদেশ কোথায় তাহার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় না।

(৮) ইহার অর্থ রথ গোদ্বারা আকৃষ্ট–এইরূপ হইতে পারে। কিন্তু সায়ণ এই ঋকে ও পরের ঋকে গো অর্থে গোচর্ম্ম করিয়াছেন। অর্থাৎ রথ গোচর্ম্ম দ্বারা আবৃত।

(৯) শেষ তিনটী ঋকে যুদ্ধ রথের স্তুতি হইল, এক্ষণে তিনটী ঋকে যুদ্ধ দুন্দুভির স্তুতি হইতেছে।

(১০) যুদ্ধের আয়োজন সমস্ত প্রস্তুত; যুদ্ধের প্রাককালে ইন্দ্রের সাহায্য প্রার্থনা করা হইতেছে।