০৫. চাঁদের পাহাড় – পঞ্চম পরিচ্ছেদ

শঙ্করের সেবা-শুশ্রূষার গুণে ডিয়েগো আলভারেজ সে যাত্রা সেরে উঠল এবং দিন পনেরো শঙ্কর তাকে নিজের কাছেই রাখলে। কিন্তু চিরকাল যে পথে পথে বেড়িয়ে এসেছে, ঘরে তার মন বসে না। একদিন সে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শঙ্কর নিজের কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছিল। বললে— চল, তোমার অসুখের সময় যেসব কথা বলেছিলে, মনে আছে? সেই হলদে হীরের খনি?
অসুখের ঝোঁকে আলভারেজ যে সব কথা বলেছিল, এখন সে সম্বন্ধে বৃদ্ধ আর কোনো কথাটি বলে না। বেশির ভাগ সময় চুপ করে কী যেন ভাবে। শঙ্করের কথার উত্তরে বৃদ্ধ বললে— আমিও কথাটা যে না ভেবে দেখেছি, তা মনে কোরো না। কিন্তু আলেয়ার পিছনে ছুটবার সাহস আছে তোমার?
শঙ্কর বললে— আছে কিনা তা দেখতে দোষ কি? আজই বল তো মাভো স্টেশনে তার করে আমার বদলে অন্য লোক পাঠাতে বলি।
আলভারেজ কিছুক্ষণ ভেবে বললে— কর তার। কিন্তু আগে বুঝে দেখ। যারা সোনা বা হীরে খুঁজে বেড়ায় তারা সব সময় তা পায় না। আমি আশি বছরের এক বুড়ো লোককে জানতাম, সে কখনো কিছু পায়নি। তবে প্রতিবারই বলতো— এইবার ঠিক সন্ধান পেয়েছি, এইবার পাব! আজীবন অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে আর আফ্রিকার ভেল্ডে প্রসপেকটিং করে বেড়িয়েছে।
আরও দিন দশেক পরে দু’জনে কিসুমু গিয়ে ভিক্টোরিয়া নায়ানজা হ্রদে স্টীমার চড়ে দক্ষিণ মুখে মোয়ানজার দিকে যাবে ঠিক করলে।
পথে এক জায়গায় বিস্তীর্ণ প্রান্তরে হাজার হাজার জেব্রা, জিরাফ, হরিণ চরতে দেখে শঙ্কর তো অবাক। এমন দৃশ্য সে আর কখনো দেখেনি। জিরাফগুলো মানুষকে আদৌ ভয় করে না, পঞ্চাশ গজ তফাতে দাঁড়িয়ে ওদের চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল।
আলভারেজ বললে— আফ্রিকার জিরাফ মারবার জন্যে গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে বিশেষ লাইসেন্স নিতে হয়। যে সে মারতে পারে না। সেইজন্যে মানুষকে ওদের তত ভয় নেই।
হরিণের দল কিন্তু বড় ভীরু, এক এক দলে দু-তিনশো হরিণ চরছে। ওদের দেখে ঘাস খাওয়া ফেলে মুখ তুলে একবার চাইলে, পরক্ষণেই মাঠের দূর প্রান্তের দিকে সবাই চার পা তুলে দৌড়।
কিসুমু থেকে স্টীমার ছাড়ল— এটা ব্রিটিশ স্টীমার, ওদের পয়সা কম বলে ডেকে যাচ্ছে। নিগ্রো মেয়েরা পিঠে ছেলেমেয়ে বেঁধে মুরগি নিয়ে স্টীমারে উঠেছে। মাসাই কুলিরা ছুটি নিয়ে দেশে যাচ্ছে, সঙ্গে নাইরোবি শহর থেকে কাঁচের পুঁতি, কম দামের খেলো আয়না, ছুরি প্রভৃতি নানা জিনিস।
স্টীমার থেকে নেমে আবার ওরা পথ চলে। ভিক্টোরিয়া হ্রদের যে বন্দরে ওরা নামলে— তার নাম মোয়ানজা। এখান থেকে তিনশো মাইল দূরে ট্যাবোরা, সেখানে পৌঁছে কয়েক দিন বিশ্রাম করে ওরা যাবে টাঙ্গানিয়াকা হ্রদের তীরবর্তী উজিজি বন্দরে।
এই পথে যাবার সময় আলভারেজ বললে টাঙ্গানিয়াকার মধ্য দিয়ে যাওয়া বড় বিপজ্জনক ব্যাপার। এখানে একরকম মাছি আছে তা কামড়ালে স্লিপিং সিকনেস হয়। স্লিপিং সিকনেসের মড়কে টাঙ্গানিয়াকা জনশূন্য হয়ে পড়েছে। মোয়ানজা থেকে ট্যাবোরার পথে সিংহের ভয়ও বেশি। প্রকৃত পক্ষে আফ্রিকার এই অঞ্চলও ‘সিংহের রাজ্য’ বলা চলে।
শহর থেকে দশ মাইল দূরে পথের ধারে একটা ছোট খড়ের বাংলো। সেখানে এক ইউরোপীয় শিকারী আশ্রয় নিয়েছে। আলভারেজকে সে খুব খাতির করলে। শঙ্করকে দেখে বললে— একে পেলে কোথায়? এ তো হিন্দু! তোমার কুলি?
আলভারেজ বললে— আমার ছেলে।
সাহেব আশ্চর্য হয়ে বললে— কি রকম?
আলভারেজ আনুপূর্বিক সব বর্ণনা করলে, তার রোগের কথা, শঙ্করের সেবা-শুশ্রূষার কথা। কেবল বললে না কোথায় যাচ্ছে ও কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।
সাহেব হেসে বললে— বেশ ভালো। ওর মুখ দেখে মনে হয় ওর মনে সাহস ও দয়া দুই-ই আছে। ইস্ট ইন্ডিজের হিন্দুরা লোক হিসেবে ভালোই বটে। একবার ইউগান্ডাতে একজন শিখ আমার প্রতি এমন সুন্দর আতিথ্য দেখিয়েছিল, তা কখনও ভুলতে পারবো না। আজ তোমরা এস, রাত সামনে, আমার এখানেই রাত্রি যাপন কর। এটা গভর্ণমেন্টের ডাকবাংলো, আমিও তোমাদের মতো সারাদিন পথ চলে বিকেলের দিকে এসে উঠেছি।
সাহেবের একটি ছোট গ্রামোফোন ছিল, সন্ধ্যার পরে টিনবন্দী বিলিতী টোম্যাটোর ঝোল ও সার্ডিন মাছ সহযোগে সান্ধ্যভোজন সমাপ্ত করবার পরে সবাই বাংলোর বাইরে ক্যাম্প চেয়ারে শুয়ে রেকর্ডের পর রেকর্ড শুনে যাচ্ছে, এমন সময় অল্প দূরে সিংহের গর্জন শোনা গেল। বোধ হল মাটির কাছে মুখ নামিয়ে সিংহ গর্জন করছে— কারণ মাটি যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সাহেব বললে— টাঙ্গানিয়াকায় বেজায় সিংহের উপদ্রব আর বড় হিংস্র এরা। প্রায় অধিকাংশই মানুষখেকো। মানুষের রক্তের আস্বাদ একবার পেয়েছে, এখন মানুষ ছাড়া আর কিছু চায় না।
শঙ্কর ভাবলে খুব সুসংবাদ বটে। ইউগান্ডা রেলওয়ে তৈরি হবার সময় সে সিংহের উপদ্রব কাকে বলে খুব ভালো করেই দেখেছে।
পরদিন সকালে ওরা আবার রওনা হল। সাহেব বলে দিলে সূর্য উঠে গেলে খুব সাবধানে থাকবে। স্লিপিং সিকনেসের মাছি রোদ উঠলেই জাগে, গায়ে যেন না বসে।
দীর্ঘ দীর্ঘ ঘাসের বনের মধ্যে দিয়ে সুঁড়িপথ। আলভারেজ বললে— খুব সাবধান, এই সব ঘাসের বনেই সিংহের আড্ডা; বেশি পেছনে থেক না।
আলভারেজের বন্দুক আছে, এই একটা ভরসা। আর একটা ভরসা এই যে আলভারেজ, যাকে বলে ‘ক্র্যাকশট’ তাই। অর্থাত্‍ তার গুলি বড় একটা ফসকায় না। কিন্তু অত বড় অব্যর্থ লক্ষ্য শিকারীর সঙ্গে থেকেও শঙ্কর বিশেষ ভরসা পেলে না, কারণ ইউগান্ডার অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, সিংহ যখন যাকে নেবে এমন সম্পূর্ণ অতর্কিতেই নেবে যে, পিঠের রাইফেলের চামড়ার স্ট্র্যাপ খুলবার অবকাশ পর্যন্ত দেবে না।
সেদিন সন্ধ্যা হবার ঘন্টাখানেক আগে দূর বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে রাত্রে বিশ্রামের জন্যে স্থান নির্বাচন করে নিতে হল। আলভারেজ বললে— সামনে কোনো গ্রাম নেই। অন্ধকারের পর এখানে পথ চলা ঠিক নয়।
একটা সুবৃহৎ বাওবাব গাছের তলায় দু-টুকরো কেম্বিস ঝুলিয়ে ছোট্ট একটা তাঁবু খাটানো হল। কাঠকুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাত্রের খাবার তৈরি করতে বসল শঙ্কর। তারপর সমস্ত দিন পরিশ্রমের পরে দু’জনেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
অনেক রাত্রে আলভারেজ ডাকলে— শঙ্কর, ওঠ।
শঙ্কর ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল।
আলভারেজ বললে— কি একটা জানোয়ার তাঁবুর চারপাশে ঘুরছে, বন্দুক বাগিয়ে রাখ।
সত্যিই একটা কোনো অজ্ঞাত বৃহৎ জন্তুর নিঃশ্বাসের শব্দ তাঁবুর পাতলা কেম্বিসের পর্দার বাইরে শোনা যাচ্ছে বটে। তাঁবুর সামনে সন্ধ্যায় যে আগুন করা হয়েছিল, তার স্বল্পাবশিষ্ট আলোকে সুবৃহৎ বাওবাব গাছটা একটা ভীষণদর্শন দৈত্যের মতো দেখাচ্ছে। শঙ্কর বন্দুক নিয়ে বিছানা থেকে নামবার চেষ্টা করতে বৃদ্ধ বারণ করলে।
পরক্ষণেই জানোয়ারটা হুড়মুড় করে তাঁবুটা ঠেলে তাঁবুর মধ্যে ঢুকবার চেষ্টা করবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর পর্দার ভিতর থেকেই আলভারেজ পর পর দু’বার রাইফেল ছুঁড়লে। শব্দটা লক্ষ্য করে শঙ্করও সেই মুহূর্তে বন্দুক ওঠালে। কিন্তু শঙ্কর ঘোড়া টিপবার আগে আলভারেজের রাইফেল আর একবার আওয়াজ করে উঠল।
তারপরেই সব চুপ।
ওরা টর্চ ফেলে সন্তর্পণে তাঁবুর বাইরে এসে দেখল তাঁবুর পুবদিকে বাইরের পর্দাটা খানিকটা ঠেলে ভিতরে ঢুকেছে এক প্রকান্ড সিংহ।
সেটা তখনো মরেনি, কিন্তু সাংঘাতিক আহত হয়েছে। আরও দু’বার গুলি খেয়ে সেটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে।
আলভারেজ আকাশের নক্ষত্রের দিকে চেয়ে বললে— রাত এখনো অনেক। ওটা এখানে পড়ে থাক। চলো আমরা আমাদের ঘুম শেষ করি।
দু’জনেই এসে শুয়ে পড়ল— একটু পরে শঙ্কর বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলে আলভারেজের নাসিকা গর্জন শুরু হয়েছে। শঙ্করের চোখে ঘুম এল না।
আধঘন্টা পরে শঙ্করের মনে হল, আলভারেজের নাসিকা গর্জনের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্যে টাঙ্গানিয়াকা অঞ্চলের সমস্ত সিংহ যেন এক যোগে ডেকে উঠল। সে কি ভয়ানক সিংহের ডাক! …আগেও শঙ্কর অনেকবার সিংহগর্জন শুনেছে, কিন্তু এ রাত্রের সে ভীষণ বিরাট গর্জন তার চিরকাল মনে ছিল। তাছাড়া ডাক তাঁবু থেকে বিশ হাতের মধ্যে।
আলভারেজ আবার জেগে উঠল। বললে— নাঃ, রাত্রে দেখছি একটু ঘুমুতে দিলে না। আগের সিংহটার জোড়া। সাবধানে থাক। বড় পাজি জানোয়ার।
কি দুর্যোগের রাত্রি! তাঁবুর আগুনও তখন নিভু-নিভু। তার বাইরে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাতলা কেম্বিসের চটের মাত্র ব্যবধান— তার ওদিকে সাথীহারা পশু। বিরাট গর্জন করতে করতে সেটা একবার তাঁবু থেকে দূরে যায়, আবার কাছে আসে, কখনো তাঁবু প্রদক্ষিণ করে।
ভোর হবার কিছু আগে সিংহটা সরে পড়লো। ওরাও তাঁবু তুলে আবার যাত্রা শুরু করলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *