পত্রাবলী

পত্রাবালী

[কালীপ্রসন্ন ঘোষকে লিখিত]

সুহৃদ্বরেষু—
আপনার পত্রগুলির যে উত্তর দিতে পারি না, তাহার অন্যান্য কারণের মধ্যে একটি কারণ এই যে, তাহার উত্তর অদেয়। আপনি যাহা লেখেন তাহা এত মধুর, যে উত্তর যাহাই দিই না কেন তাহা কর্কশ হইবে। আপনার পত্রের উত্তর দেওয়া, আর অমৃত পান করিয়া ধন্বন্তরিকে মূল্য দেওয়া সমান বলিয়া বোধ হয়। আপনার পত্রের উত্তর না দেওয়াই ভাল–কোকিলকে Thanks দিয়া কি হইবে? আপনার নববর্ষ প্রভৃতি দিবসের সম্ভাষণ সম্বন্ধে এই কথা বিশেষ খাটে। আপনি নিজে পীড়িত ; চক্ষের যন্ত্রণায় লিখিতে অসমর্থ, তথাপি আমাদের মঙ্গল আন্তরিক কামনা করিয়া পত্র লিখিয়াছেন। আপনার তুল্য মনুষ্য অতি দুর্লভ। আপনাকে কায়মনোবাক্যে আশীর্বাদ করিতেছি, আপনি অচিরাৎ সুস্থ হইয়া স্বদেশের উন্নতি সাধন করিতে থাকুন।
স্যার আশলি ইডেনের স্বদেশ গমন উপলক্ষে কলিকাতায় হুলুস্থূল পড়িয়া গিয়াছে। কেহ বলে, গোবর জল ছড়া দাও। কেহ বলে, “অরে নিদারুণ প্রাণ! কোন পথে…যান, আগে যা রে পথ দেখাইয়া” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের লাভের মধ্যে দুই একটা সমারোহ দেখিতে যাইব।
আমার দৌহিত্রটি এ পর্যন্ত আরোগ্য লাভ করিতে পারে নাই, তবে পূর্বাপেক্ষা ভাল আছে। আর ইন্দ্র, চন্দ্র, বায়ু বরুণ, যম, কুবের প্রভৃতি দিক্‌পালগণ পূর্বমত দিক্‌পালন করিতেছেনচন্দ্রের মধ্যে মধ্যে, পূর্ণোদয় হয়, মধ্যে মধ্যে অমাবস্যা। এখন কালী প্রসন্ন হইলেই আনন্দমঠ বজায় হয়। ইতি তাং ৪ বৈশাখ [১২৮৯ সাল] [১৬ এপ্রিল, ১৮৮২]
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন’]

[কালীপ্রসন্ন ঘোষকে লিখিত]

সুহৃদ্বরেষু—
আপনার অনুগ্রহ পত্র পাইয়া আনন্দ লাভ করিলাম।
আমি যখন প্রথম এখানে আসি, তখন দুই এক মাসের জন্য আসিতেছি এরূপ কর্তৃপক্ষের নিকট শুনিয়াছিলাম। এজন্য একাই আসিয়াছি। বিশেষ পরিবার আনিবার স্থান এ নহে। এক্ষণে জানিলাম ইহার ভিতর অনেক চক্র আছে।*** সেই মন্থরার দল আমাদের স্বদেশী স্বজাতি, আমার তুল্য পদস্থ ; আমার ও আপনার বন্ধুবর্গের মধ্যে গণ্য। আমিই বা আনন্দমঠ লিখিয়া কি করিব, আপনিই বা তাহার মূলমন্ত্র বুঝাইয়া কি করিবেন? এ ঈর্ষ্যাপরবশ, আত্মোদরপরায়ণ জাতির উন্নতি নাই। বল, “বন্দেউদরং”।
বৈশাখের “বান্ধব” পাইয়াছি। এবং “মূলমন্ত্র” “জাতীয় সঙ্গীত” এবং অন্যান্য প্রবন্ধ পড়িয়া অতিশয় প্রীত হইয়াছি।
আপনিও “শাপেনাস্তং গমিতমহিমা”, শুনিয়া দুঃখিত হইলাম। তবে আপনি মহৎ কর্তব্যানুরোধেই এ দশা প্রাপ্ত, কাজেই তাহা সহ্য হয়, কিন্তু আমি যে কি জন্য বৈতরণীসৈকতে পড়িয়া ঘোড়ার ঘাস কাটি তাহা বুঝিতে পারি না। যে ব্যক্তি লিখিয়াছিল “যমদ্বারে মহাঘোরে তপ্তা বৈতরণী নদী” সে ব্যক্তি নিশ্চিত জানিত উড়িষ্যার বৈতরণীপারেই যমদ্বার বটে।
দশমহাবিদ্যার কিয়দংশ হস্তলিপি হইতে হেম বাবুর মুখেই শুনিয়াছিলাম। সেটুকু আমার বড় ভাল লাগিয়াছিল। বোধ হয় সেটুকু আপনিও গ্রন্থকারের মুখে শুনিয়া থাকিবেন। অবশিষ্টাংশ এখনও ভাল করিয়া পড়ি নাই। যেটুকু পড়িলাম তাহাতে বুঝিলাম যে গ্রন্থকারের মুখে না শুনিলে গ্রন্থের সকল রসটুকু পাওয়া যায় না। বিশেষ তাঁহার ছন্দ নূতনআমার আবৃত্তির সম্পূর্ণ আয়ত্ত নহে। এ জন্য স্থির করিয়াছি, যদি কখন রজনী প্রভাত হয়, তবে তাঁহারই মুখে অবশিষ্টাংশ শুনিয়া হৃদয়ঙ্গম করিব।
আনন্দমঠে বিস্তর ছাপার ভুল দেখিলাম। অনুগ্রহ করিয়া মার্জনা করিবেন। ইতি ২৩শে পৌষ [১২৮৯] [৬ জানুয়ারি ১৮৮৩]
অনুগ্রহকাঙ্ক্ষী
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
‘ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন’]

[সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত]

শ্রীচরণেষু
অঘোর বরাটকে একটু পত্র লিখিবেন, যে, মাঘ মাসের বঙ্গদর্শন বাহির করার পক্ষে আপত্তি নাই, ভবিষ্যৎ সংখ্যার প্রতি আপত্তি আছে। অর্থাৎ মাঘ সংখ্যা ভিন্ন আর বাহির করিতে দিবেন না। ইহা লিখিবেন।
পত্র পাঠ মাত্র ইহা লিখিবেন। চন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া অনেক কাকুতি মিনতি করিতেছে। কিন্তু এটুকু লইলে বিবাদ সম্পূর্ণ মিটিবে না। ইতি তাং ২৩ ফেব্রুয়ারি [১৮৮৪]1
“শ্রীশচন্দ্র মজুমদার” সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা—পৃষ্ঠা ৩৫]
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

[শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখিত]

প্রিয়তমেষু,
আমি হাঁপানির পীড়ায় অত্যন্ত অসুস্থ থাকায় তোমার পত্রের উত্তর দিতে বিলম্ব হইয়াছে।
গেজেটে তোমার appointment দেখিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলাম। ভরসা করি শীঘ্রই চাকরী চিরস্থায়ী হইবে।
“পদরত্নাবলী” পাইয়াছি। কিন্তু সুখ্যাতি কাহার করিব? কবিদিগের না সংগ্রহকারদিগের? যদি কবিদিগের প্রশংসা করিতে বল, বিস্তর প্রশংসা করিতে পারি। আর যদি সংগ্রহকারদিগের প্রশংসা করিতে বল, তবে কি কি বলিব আমায় লিখিবে, আমি সেইরূপ লিখিব। তুমি বরং রবীন্দ্রনাথ, যখন সংগ্রহকারক, তখন সংগ্রহ যে উৎকৃষ্ট হইয়াছে তাহা কেহই সন্দেহ করিবে না এবং আমার সার্টিফিকেট নিষ্প্রোয়োজন। তথাপি তোমরা যাহা লিখিতে বলিবে, লিখিব।
কৃষ্ণ সম্বন্ধে যে প্রশ্ন করিয়াছ, পত্রে তাহার উত্তর সংক্ষেপে দিলেই চলিবে। আমি যাহা লিখিয়াছি (নবজীবনে ও প্রচারে) ও যাহা লিখিব, তাহাতে এই দুইটি তত্ত্ব প্রমাণিত হইবে।
১। শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছাক্রমে কদাপি যুদ্ধে প্রবৃত্ত নহেন।
২। ধর্মযুদ্ধ আছে। ধর্মার্থেই মনুষ্যকে অনেক সময় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হয় (যথা William the Silent) ধর্মযুদ্ধে অপ্রবৃত্তি অধর্ম। সে সকল স্থানে ভিন্ন শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধে কখনও প্রবৃত্ত হয়েন।
৩। অন্যে যাহাতে ধর্মযুদ্ধ ভিন্ন কোন যুদ্ধে কখন প্রবৃত্ত না হয়, এ চেষ্টা তিনি সাধ্যানুসারে করিয়াছিলেন।
মনুষ্যে ইহার বেশী পারে না। কৃষ্ণচরিত্র মনুষ্যচরিত্র। ঈশ্বর লোকহিতার্থে মনুষ্যচরিত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন।
কৃষ্ণনগরে কবে যাইবে? ইনি তাং ২৫শে আশ্বিন [১২৯২] [১০ অক্টোবর ১৮৮৫]
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘প্রদীপ’]

——————
1 অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যা ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রকাশিত চন্দ্রনাথ বসুর “পশুপতি সম্বাদ” বঙ্কিমচন্দ্রকে ক্ষুণ্ণ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রকে উক্ত পত্রখানি লেখেন।
——————

[গিরিজাপ্রসন্ন রায়কে লিখিত]

সাদর সম্ভাষণম্
আপনার পত্র পাইয়া প্রীত হইয়াছি। আপনি যে সঙ্কল্প করিয়াছেন, তাহাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি হইতে পারে না। কেবল এই কথা যে, আমার প্রণীত নরনারীচরিত্রগুলি আপনাদিগের এতদূর পরিশ্রমের যোগ্য কিনা সন্দেহ।
তবে, আপনি সুলেখক এবং উৎকৃষ্ট বোদ্ধা, তাহার পরিচয় পূর্বে পাইয়াছি। আপনার যত্নে আমার রচনা আশার অতীত সফলতা লাভ করিতে পারিবে, এমন ভরসা করি।
আমার পুস্তক হইতে যেখানে যতদূর উদ্ধৃত করা আবশ্যক বোধ করিবেন, তাহা করিবেন। তাহাতে আমার কোন ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই।
পুস্তকের নাম যাহা নির্বাচিত করিয়াছেন, তাহাতেও আমার কোন আপত্তি হইতে পারে না।
আমি চন্দ্র বাবুর মতের অপেক্ষা না করিয়াই আপনার পত্রের উত্তর দিলাম, কেননা আপনার বিচার-শক্তি পরিচয় পূর্বেই পাইয়াছি।
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ সম্বন্ধে একটা কথা বলিয়া রাখা ভাল। প্রথম সংস্করণে কয়েকটা গুরুতর দোষ ছিল, দ্বিতীয় সংস্করণে তাহা কতক কতক সংশোধন করা হইয়াছে। পুস্তকের অর্ধেক মাত্র সংশোধিত হইয়া মুদ্রিত হইলে, আমাকে কিছু দিনের জন্য কলিকাতা হইতে অতিদূরে যাইতে হইয়াছিল। অতএব অবশিষ্ট অংশ সংশোধিত না হইয়াই ছাপা হইয়াছিল। তাহাতে প্রথমাংশে ও শেষাংশে কোথাও কিছু অসঙ্গতি থাকিতে পারে।
চন্দ্র বাবু ও অক্ষয় বাবু আপনার সহায়তা করিবেন, আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। *** ইতি ১১ই জৈষ্ঠ্য [১২৯৩] [২৪ মে ১৮৮৬]
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র শর্মণঃ।
‘বঙ্কিমচন্দ্র’]

[জ্যোতিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত]

[১৮৮৭ সনে সঞ্জীবচন্দ্রের একমাত্র পুত্র জ্যোতিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মেহেরপুরে পুলিস-ইন্‌স্পেক্টরের পদে নিয়োগের পর চাকরিতে পাকা হইয়া পুলিসের চাকরি কিভাবে নির্বাহ করিবেন, তাহার উপদেশ চাহিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে এক পত্র দিয়াছিলেন। ইহার উত্তরে নিম্নলিখিত উপদেশ সম্বলিত পত্র বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাকে লেখেন।] প্রিয়তমেষু
বোধ করি পূজার সময় বাড়ী গিয়াছিলে, এতদিনে ফিরিয়া আসিয়া থাকিবে।
আমার নিকট উপদেশ চাহিয়াছিলে, আমি এই পত্রের মধ্যে সাতটি উপদেশ লিখিয়া পাঠাইলাম। ঐ সাতটি Golden rule বিবেচনা করিবে। বিশেষ প্রথম পাঁচটি। উহার অনুবর্তী হইলে সর্বত্র মঙ্গল ঘটিবে। এখানকার সমস্ত মঙ্গল। ভরসা করি এই মাস হইতে তুমি সংসারের ভার লইতে পারিবে। ইতি ১৩ আশ্বিন।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিশেষ উপদেশ
I. প্রথম প্রয়োজনীয় কথা। সত্য ভিন্ন কখন মিথ্যা পথে যাইবে না। কলমের মুখে কখন মিথ্যা নির্গত না হয়। তাহা হইলে চাকরি থাকে না। নিতান্ত পক্ষে কর্তৃপক্ষের অবিশ্বাস জন্মে। অবিশ্বাস জন্মিলে আর উন্নতি হয় না।
II. দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় কথা। পরিশ্রম। বিনা পরিশ্রমে কখন উন্নতি হয় না। কখন কোন কাজ পড়িয়া না থাকে।
III. উপরওয়ালাদের আজ্ঞাকারী তাঁহাদিগের নিকট বিনীতভাব। চাকরি রাখার পক্ষে এবং উন্নতির পক্ষে ইহা নিতান্ত প্রয়োজনীয়। তর্ক করিও না।
IV. আপনার কাজের Rules & Laws বিশেষরূপে অবগত হইবে।
V. কাহারও উপর অত্যাচার করিবে না। পুলিসের লোকে আসামীর উপর বড় অত্যাচার করে। অনেকের বিশ্বাস যে তা নহিলে কাজ চলে না। তাহা ভ্রান্তি। না চলে সেও ভাল। ইহা নিজে কখন করিবে না, বা অধীনস্থ কাহাকে করিতে দিবে না। ইহার কারাদণ্ড আছে।
VI. সকলের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করিবে। অধীনস্থ ব্যক্তিদিগকে ব্যবহার দ্বারায় বশীভূত করিবে। কেহ শত্রু না হয়। কর্তব্য কর্মের অনুরোধে অনেকের অনিষ্ট করিতে হয়। তাহার উপায় নাই। দোষীর অবশ্য দণ্ড চাই।
VII. নিষ্কারণে ভীত হইবে না।

‘প্রবাসী’, শ্রাবণ ১৩৫৮]

[ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে লিখিত]

শ্রদ্ধাস্পদেষু
তিনকড়ি বাবুর নিকট এক সেট পুস্তক দিয়াছি। তন্মধ্যে আর একটি নূতন পুস্তক ধর্মতত্ত্ব আছে। ঐ গ্রন্থ পাঠকালে আপনার যাহা কিছু মনে উদয় হয় অথবা গ্রন্থকারকে বলিবার প্রয়োজন হয়, তাহা যদি অনুগ্রহ করিয়া মার্জিনে নোট করিয়া রাখেন, তবে ভবিষ্যতে উপকৃত হইতে পারিবে।

‘ভূদেব-চরিত’]

[ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে লিখিত]

৫ নং প্রতাপ চাটুয্যার গলি
কলিকাতা—-১৩ জুন [১৮৮৮]
[৩২ জৈষ্ঠ্য ১২৯৫]
শ্রদ্ধাস্পদেষু—
আপনার অনুগ্রহপত্র পাইয়াছি। আমার পুস্তকগুলি আপনি নিজে স্টেশনে আসিয়া লইয়া গিয়াছেন, এবং অনুরুদ্ধ না হইয়াও পাড়িয়া থাকেন, ইহার অপেক্ষা পুস্তকের আদর আর কি বেশী হইতে পারে? ইহাই আমার আশার অতীত ফল।
পুস্তকগুলি যেরূপ বাজারে বিক্রয় হয়, সেইরূপ বাঁধানই আপনাকে পাঠান হইয়াছে, ভাল করিয়া বাঁধান হয় নাই। সকলগুলি, এক রকম বাঁধান, এবং বাঁধান ইহার অপেক্ষা ভাল হয়, এইরূপ করিয়া বাঁধাইয়া পাঠাইবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাঁধান পুস্তক আবার বাঁধাইতে গেলে, ছোট মার্জিন আরও ছাঁটা পড়িয়া যাইবে, এবং আবাঁধা পুস্তক এক সেট পুরা হয় না, এজন্য যেমন ছিল তেমনি পাঠাইতে বাধ্য হইয়াছি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালা গ্রন্থেরও একটু বাহ্য সৌষ্ঠব চাই, এজন্য পুস্তকগুলি সোণার জলে এবং কাপড়ে বাঁধাইয়া বিক্রয় করিয়া থাকি।
গীতা পুনশ্চ প্রচারে প্রকাশিত হইতেছে। যদি আপনার দেখিবার ইচ্ছা হয়, তবে পাঠাইতে পারি। উহাতে আপনার দেখিবার যোগ্য কিছু নাই, ইহা বলা বাহুল্য। তবে, আমরা কি ভাবি, কি করি, ইহা বোধ হয় দেখিতে আপনার ইচ্ছা হইতে পারে। ইতি
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

[কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেবকে লিখিত]

অশেষ গুণসম্পন্ন শ্রীযুক্ত কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেব
আশীর্বাদ ভাজনেষু
আপনি আমাকে যে কয়েক প্রশ্ন করিয়াছেন, ধর্মশাস্ত্রব্যবসায়ীরাই তাহার উপযুক্ত উত্তর দিতে সক্ষম। আমি ধর্মশাস্ত্রব্যবসায়ী নহি, এবং ধর্মশাস্ত্রবেত্তার আসন গ্রহণ করিতেও প্রস্তুত নহি। তবে সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে যে আন্দোলন উপস্থিত, তৎসম্বন্ধে দুই একটা কথা বলিবার আমার আপত্তি নাই।
প্রথমতঃ—শাস্ত্রের দোহাই দিয়া কোন প্রকার সমাজ সংস্কার যে সম্পন্ন হইতে পারে, অথবা সম্পন্ন করা উচিত, আমি এমন বিশ্বাস করি না। যখন মৃত মহাত্মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুবিবাহ নিবারণ জন্য শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করিয়া আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তখনও আমি এই আপত্তি করিয়াছিলাম, এবং এখনও পর্যন্ত সে মত পরিবর্তন করার কোন কারণ আমি দেখি নাই। আমার এরূপ বিবেচনা করিবার দুইটী কারণ আছে। প্রথম এই যে, বাঙ্গালী সমাজ শাস্ত্রে বশীভূত নহে,—দেশাচার বা লোকাচারের বশীভূত। সত্য বটে যে, অনেক সময়ে লোকাচার শাস্ত্রানুযায়ী, কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায় যে, লোকাচার শাস্ত্রবিরুদ্ধ। যেখানে লোকাচার এবং শাস্ত্রে বিরোধ, সেখানে লোকাচারই প্রবল।
উপরিউক্ত বিশ্বাসের দ্বিতীয় কারণ এই যে, সমাজ সর্বত্র শাস্ত্রের বিধানানুসারে চলিলে, সামাজিক মঙ্গল ঘটিবে কি না সন্দেহ। আপনারা সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে শাস্ত্রেয় বিধান সকল অনুসন্ধান দ্বারা বাহির করিয়া, সমাজকে তদনুসারে চলিতে পরামর্শ দিতে ইচ্ছা করিতেছেন; কিন্তু সকল বিষয়েই কি সমাজ শাস্ত্রের বিধানানুসারে চলিতে বলিতে সাহস করিবেন? ধর্মশাস্ত্রের একটি বিধি এই, ব্রাহ্মণাদি শ্রেষ্ঠ বর্ণের পরিচর্যাই শূদ্রের ধর্ম। বাঙ্গালার শূদ্রেরা কি সেই ধর্মাবলম্বী? শাস্ত্রের ব্যবস্থা এখানে চলে না। আপনারা কেহ চালাইতে সাহসী হয়েন কি? চেষ্টা করিলেও এ ব্যবসা চালান যায় কি? হাইকোর্টের শূদ্র জজ জজিয়তি ছাড়িয়া, বা সৌভাগ্যশালী শূদ্র জমিদার জমিদারের আসন ছাড়িয়া, ধর্মশাস্ত্রের গৌরবার্থ লুচিভাজা ব্রাহ্মণের পদ সেবায় নিযুক্ত হইবেন কি? কোন মতেই না। বাঙ্গালী সমাজ, প্রয়োজন মতে ধর্মশাস্ত্রের কিয়দংশ মানে ; প্রয়োজন মতে অবশিষ্টাংশ অনেককাল বিসর্জন দিয়াছে। এবং সেইরূপ প্রয়োজন বুঝিলে, অবশিষ্টাংশ বিসর্জন দিবে। এমন স্থলে ধর্মশাস্ত্রের ব্যবস্থা খুঁজিয়া কি ফল? আমার নিজের বিশ্বাস যে, ধর্ম সম্বন্ধে এবং নীতি সম্বন্ধে সামাজিক উন্নতি (Religious and moral regeneration) না ঘটিলে, কেবল শাস্ত্রের বা গ্রন্থ বিশেষের দোহাই দিয়া, সামাজিক প্রথা বিশেষ পরিবর্তন করা যায় না। আমার প্রণীত কৃষ্ণ-চরিত্র বিষয়ক গ্রন্থে, ইহা আমি সবিস্তারে বুঝাইয়াছি। আমি উপরে বলিয়াছি যে, সমাজ দেশাচারের অধীন,—শাস্ত্রের অধীন নহে। এই দেশাচার পরিবর্তন জন্য ধর্ম সম্বন্ধীয় এবং নীতি সম্বন্ধীয় সাধারণ উন্নতি ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। এই সাধারণ উন্নতি কিয়ৎ পরিমাণে ঘটিয়াছে বলিয়াই এই আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে। এই উন্নতি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইলে, সমুদ্রযাত্রায় সমাজের কাহারও কোন আপত্তি থাকিবে না, কাহারও আপত্তি থাকিলেও সে আপত্তির কোন বল থাকিবে না। কিন্তু যতদিন না সেই উন্নতির উপযুক্ত মাত্রা পরিপূর্ণ হয়, ততদিন কেহই সমুদ্রযাত্রা সাধারণে প্রচলিত করিতে পারিবেন না।
তবে ইহাও বক্তব্য যে, সমুদ্রযাত্রার পক্ষে বাঙ্গালী সমাজ বর্তমান সময়ে কতদূর বিরোধী, তাহা এখন আমাদের কাহারও ঠিক জানা নাই। দেখিতে পাই যে, যাঁহার অর্থ ও অবস্থা সমুদ্রযাত্রার অনুকূলে, তিনিই ইচ্ছা করিলে ইউরোপ যাইতেছেন। সমুদ্রযাত্রা শাস্ত্রনিষিদ্ধ বলিয়া কেহ কেহ যে যান নাই, ইহা আমার দৃষ্টিগোচরে কখনও আসে নাই। তবে ইহা স্বীকার করিতে আমি বাধ্য যে, যাঁহারা ইউরোপ হইতে ফিরিয়া আসেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই এক প্রকার সমাজ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া আছেন, কিন্তু তাঁহাদের দোষে কি আমাদের দোষে, তাহা ঠিক বলা যায় না। তাঁহারা এ দেশে আসিয়াই সাহেব সাজিয়া ইচ্ছাপূর্বক বাঙ্গালী সমাজের বাহিরে অবস্থিতি করেন। বিদেশীয় পরিচ্ছদ, বিদেশীয় ভোজন প্রথা এবং বিদেশীয় ব্যবহার দ্বারা আপনাদিগকে পৃথক্ রাখেন। যাঁহারা ইউরোপ হইতে আসিয়া সেরূপ আচরণ না করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ অনায়াসে হিন্দুসমাজে পুনর্মিলিত হইয়াছেন। ইউরোপ হইতে প্রত্যাগত মহাশয়েরা সকলেই দেশে ফিরিয়া আসিয়া হিন্দুসমাজসম্মত ব্যবহার করিলে, সাধারণতঃ তাঁহারা যে পরিত্যক্ত হইবেন, একথা নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না।
পরিশেষে আমার এই বক্তব্য, সমুদ্রযাত্রা হিন্দুদিগের ধর্মশাস্ত্রানুমোদিত কি না, তাহা বিচার করিবার আগে দেখিতে হয় যে, ইহা ধর্মানুমোদিত কি না? যাহা ধর্মানুমোদিত, কিন্তু ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ, তাহা কি ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া পরিহার্য? অনেকে বলিবেন যে, যাহা ধর্মশাস্ত্রসম্মত, তাহাই ধর্ম, যাহা হিন্দুদিগের ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ, তাহাই অধর্ম? এ কথা আমি স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহি। হিন্দুদিগের প্রাচীন গ্রন্থে এরূপ কথা পাই না। মহাভারতে কৃষ্ণোক্তি এইরূপ আছে।
ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহুর্ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।
যৎ স্যাদ্ধারণ প্রযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।
কর্ণপর্ব একোনসপ্ততিতমোহধ্যায়, ৫৯ শ্লোক।
ধর্ম লোক সকলকে ধারণ (রক্ষা) করেন, এই জন্য ধর্ম বলে। যাহা হইতে লোকের রক্ষা হয়, ইহাই ধর্ম নিশ্চিত জানিবে।
যদি মহাভারতকার মিথ্যা না লিখিয়া থাকেন, যদি হিন্দুদের আরাধ্য ঈশ্বরাবতার বলিয়া সমাজে পূজিত কৃষ্ণ মিথ্যাবাদী না হন, তবে যাহা লোকহিতকর তাহাই ধর্ম। এই সমুদ্রযাত্রা পদ্ধতি লোকহিতকর কি না? যদি লোকহিতকর হয়, তবে ইহা স্মৃতিশাস্ত্রবিরুদ্ধ হইলেও কেন পরিত্যাগ করিব?
আমি এইরূপ বুঝি ধর্মশাস্ত্রে যাহাই আছে, তাহাই হিন্দুধর্ম নহে। হিন্দুধর্ম অতিশয় উদার। স্মার্ত ঋষিদিগের হাতে—বিশেষতঃ আধুনিক স্মার্ত রঘুনন্দনাদির হাতে—ইহা অতিশয় সঙ্কীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। স্মার্ত ঋষিগণ হিন্দুধর্মের স্রষ্টা নহেন,হিন্দুধর্ম সনাতনতাঁহাদিগের পূর্ব হইতেই আছে। অতএব সনাতন ধর্মে এবং এই ধর্ম্মশাস্ত্রে বিরোধ অসম্ভব নহে। যেখানে এরূপ বিরোধ দেখিব, সেখানে সনাতন ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করাই উচিত। ধর্মে এবং হিন্দুধর্মের কোন বিরোধ আমি স্বীকার করিতে পারি না। ধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মে যদি কোন বিরোধ থাকে, তবে হিন্দুধর্মের গৌরব কি? উহাকে সনাতন ধর্ম বলিব কেন? এরূপ বিরোধ নাই। সমুদ্রযাত্রা লোকহিতকর বলিয়া ধর্মানুমোদিত। সুতরাং ধর্মশাস্ত্রে যাহাই থাকুক, সমুদ্রযাত্রা হিন্দুধর্মানুমোদিত।
আপনার একান্ত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী,
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
২৩ জুলাই, ১৮৯২
কলিকাতা,
‘হিতবাদী’]

[গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়কে লিখিত]

নমস্কার পূর্বক নিবেদন
আপনার যাহা বক্তব্য তাহা কাল বৈকালে মুখে মুখেই বলিতে পারিতেন, তথাপি পত্রখানি যে নিজে হাতে করিয়া আনিয়াছিলেন, ইহা আমার বিশেষ সৌভাগ্য কারণ, মুখের কথা তখনই অন্তর্হিত হইত, কিন্তু পত্রখানি যত্ন করিয়া রাখিলে শত বৎসর থাকিতে পারে। আমি উহা যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিব এবং আমার মৃত্যুর পর ঐরূপ যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিবার জন্য আমার দৌহিত্রদিগকে বলিয়া যাইব। কারণ উহাতে আপনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে “আপনার সম্মানে বঙ্গবাসী মাত্রেরই সম্মান করা হইয়াছে ও সম্মানও সম্মানিত হইয়াছে”। অন্যে এ কথা বলিলে, তাহার মূল্য যাহাই হউক, আপনি সত্যবাদী ও সমাজের শিরোভূষণ স্বরূপ অতএব আপনার এই উক্তি আমার বংশে চিরস্মরণীয় ও চিররক্ষণীয়।
যদি বিষবৃক্ষ অনুবাদিত হইয়া প্রথম পরিচিত হয় তখন একখানি ইংরেজি সংবাদপত্র (Scotsman) বলিয়াছেন যে, ঐ গ্রন্থ সংস্কৃত Epic কাব্যের Episode গুলির সহিত তুলনীয়, এবং একজন বলিয়াছেন যে Sophocles প্রণীত Antigone চরিত্রের পর আর ইহার তুল্য স্ত্রী চরিত্র কোন সাহিত্যে সৃষ্ট হয় নাই। এই সকল কথা আমি বড় গৌরবের কথা মনে করিয়াছিলাম। কিন্তু আপনার উক্তি আমার পক্ষে তদপেক্ষা অধিকতর গৌরবের হইয়াছে। ইতি ১৯ পৌষ ১৩০০ [২ জানুয়ারি ১৮৯৪]
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়