০১.দুঃখ কি?

গুরু। বাচস্পতি মহাশয়ের সম্বাদ কি? তাঁর পীড়া কি সারিয়াছে?
শিষ্য। তিনি ত কাশী গেলেন।
গুরু। কবে আসিবেন?
শিষ্য। আর আসিবেন না। একবারে দেশত্যাগী হইলেন।
গুরু। কেন?
শিষ্য। কি সুখে আর থাকিবেন?
গুরু। দুঃখ কি?
শিষ্য। সবই দুঃখ-দুঃখের বাকি কি? আপনাকে বলিতে শুনিয়াছি ধর্ম্মেই সুখ। কিন্তু বাচস্পতি মহাশয় পরম ধার্ম্মিক ব্যক্তি, ইহা সর্ব্ববাদিসম্মত। অথচ তাঁহার মত দুঃখীও আর কেহ নাই, ইহাও সর্ব্ববাদিসম্মত।
গুরু। হয় তাঁর কোন দুঃখ নাই, নয় তিনি ধার্ম্মিক নন।
শিষ্য। তাঁর কোন দুঃখ নাই? সে কি কথা? তিনি চিরদরিদ্র, অন্ন চলে না। তার পর এই কঠিন রোগে ক্লিষ্ট, আবার গৃহদাহ হইয়া গেল। আবার দুঃখ কাহাকে বলে?
গুরু। তিনি ধার্ম্মিক নহেন।
শিষ্য। সে কি? আপনি কি বলেন যে, এই দারিদ্র্য, গৃহদাহ, রোগ, এ সকলই অধর্ম্মের ফল?
গুরু। তা বলি।
শিষ্য। পূর্ব্বজন্মের?
গুরু। পূর্ব্বজন্মের কাজ কি? ইহজন্মের অধর্ম্মের ফল।
শিষ্য। আপনি কি ইহাও মানেন যে, এ জন্মে আমি অধর্ম্ম করিয়াছি, বলিয়া আমার রোগ হয়?
গুরু। আমিও মানি, তুমিও মান। তুমি কি মান না যে, হিম লাগাইলে সর্দ্দি হয়, কি গুরুভোজন করিলে অজীর্ণ হয়?
শিষ্য। হিম লাগান কি অধর্ম্ম?
গুরু। অন্য ধর্ম্মের মত একটা শারীরিক ধর্ম্ম আছে। হিম লাগান তাহার বিরোধী। এই জন্য হিম লাগান অধর্ম্ম।
শিষ্য। এখানে অধর্ম্ম মানে hygiene?
গুরু। যাহা শারীরিক নিয়মবিরুদ্ধ, তাহা শারীরিক অধর্ম্ম।
শিষ্য। ধর্ম্মাধর্ম্ম কি স্বাভাবিক নিয়মানুবর্ত্তিতা আর নিয়মাতিক্রম?
গুরু। ধর্ম্মাধর্ম্ম অত সহজে বুঝিবার কথা নহে। তাহা হইলে ধর্ম্মতত্ত্ব বৈজ্ঞানিকের হাতে রাখিলেই চলিত। তবে হিম লাগান সম্বন্ধে অতটুকু বলিলেই চলিতে পারে।
শিষ্য। তাই না হয় হইল। বাচস্পতির দারিদ্র্য দুঃখ কোন্ পাপের ফল?
গুরু। দারিদ্র্য দুঃখটা আগে ভাল করিয়া বুঝা যাউক। দুঃখটা কি?
শিষ্য। খাইতে পায় না।
গুরু। বাচস্পতির সে দুঃখ হয় নাই, ইহা নিশ্চিত। কেন না, বাচস্পতি খাইতে না পাইলে এত দিন মরিয়া যাইত।
শিষ্য। মনে করুন, সপরিবারে বুকড়ি চালের ভাত আর কাঁচকলা ভাতে খায়।
গুরু। তাহা যদি শরীর পোষণ ও রক্ষার পক্ষে যথেষ্ট না হয়, তবে দুঃখ বটে। কিন্তু যদি শরীর রক্ষা ও পুষ্টির পক্ষে উহা যথেষ্ট হয়, তবে তাহার অধিক না হইলে দুঃখ বোধ করা, ধার্ম্মিকের লক্ষণ নহে, পেটুকের লক্ষণ। পেটুক অধার্ম্মিক।
শিষ্য। ছেঁড়া কাপড় পরে।
গুরু। বস্ত্রে লজ্জা নিবারণ হইলেই ধার্ম্মিকের পক্ষে যথেষ্ট। শীতকালে শীত নিবারণও চাই। তাহা মোটা কম্বলেও হয়। তাহা বাচস্পতির জুটে না কি?
শিষ্য। জুটিতে পারে। কিন্তু তাহারা আপনারা জল তুলে, বাসন মাজে, ঘর ঝাঁট দেয়।
গুরু। শারীরিক পরিশ্রম ঈশ্বরের নিয়ম। যে তাহাতে অনিচ্ছুক, সে অধার্ম্মিক। আমি এমন বলিতেছি না যে, ধনে কোন প্রয়োজন নাই। অথবা যে ধনোপার্জ্জনে যত্নবান্, সে অধার্ম্মিক। বরং যে সমাজে থাকিয়া ধনোপার্জ্জনে যথাবিহিত যত্ন না করে, তাহাকে অধার্ম্মিক বলি। আমার বলিবার উদ্দেশ্য এই যে, সচরাচর যাহারা আপনাদিগকে দারিদ্র্যপীড়িত মনে করে, তাহাদিগের নিজের কুশিক্ষা এবং কুবাসনা-অর্থাৎ অধর্ম্মে সংস্কার, তাহাদিগের কষ্টের কারণ। অনুচিত ভোগলালসা অনেকের দুঃখের কারণ।
শিষ্য। পৃথিবীতে কি এমন কেহ নাই, যাহাদের পক্ষে দারি‍দ্র্য যথার্থ দুঃখ?
গুরু। অনেক কোটি কোটি। যাহারা শরীর রক্ষার উপযোগী অন্নবস্ত্র পায় না-আশ্রয় পায় না-তাহারা যথার্থ দরিদ্র। তাহাদের দারিদ্র্য দুঃখ বটে!
শিষ্য। এ দারিদ্র্যও কি তাহাদের ইহজন্মকৃত অধর্ম্মের ভোগ?
গুরু। অবশ্য।
শিষ্য। কোন্ অধর্ম্মের ভোগ দারিদ্র্য?
গুরু। ধনোপার্জ্জনের উপযোগী গ্রাসাচ্ছাদন আশ্রয়াদির প্রয়োজনীয় যাহা, তাহার সংগ্রহের উপযোগী আমাদের কতকগুলি শারীরিক ও মানসিক শক্তি আছে। যাহারা তাহার সম্যক্ অনুশীলন করে নাই বা সম্যক্ পরিচালনা করে না, তাহারাই দরিদ্র।
শিষ্য। তবে, বুঝিতেছি আপনার মতে আমাদিগের সমস্ত শারীরিক ও মানসিক শক্তি অনুশীলন ও পরিচালনাই ধর্ম্ম, ও তাহার অভাবই অধর্ম্ম।
গুরু। ধর্ম্মতত্ত্ব সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর তত্ত্ব, তাহা অল্প কথায় সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু মনে করি যদি তাই বলা যায়?
শিষ্য। এ যে বিলাতী Doctrine of Culture!
গুরু। Culture বিলাতী জিনিস নহে। ইহা হিন্দুধর্ম্মের সারাংশ।
শিষ্য। সে কি কথা? Culture শব্দের একটা প্রতিশব্দও আমাদের দেশীয় কোন ভাষায় নাই।
গুরু। আমরা কথা খুঁজিয়া মরি, আসল জিনিষটা খুঁজি না, তাই আমাদের এমন দশা। দ্বিজবর্ণের চতুরাশ্রম কি মনে কর?
শিষ্য। System of Culture?
গুরু। এমন, তোমার Matthew Arnold প্রভৃতি বিলাতী অনুশীলনবাদীদের বুঝিবার সাধ্য আছে কি না সন্দেহ। সধবার পতিদেবতার উপাসনায়, বিধবার ব্রহ্মচর্য্যে, সমস্ত ব্রতনিয়মে, তান্ত্রিক অনুষ্ঠনে, যোগে, এই অনুশীলনতত্ত্ব অন্তর্নিহিত। যদি এই তত্ত্ব কখন তোমাকে বুঝাইতে পারি, তবে তুমি দেখিবে যে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যে পরম পবিত্র অমৃতময় ধর্ম্ম কথিত হইয়াছে, তাহা এই অনুশীলনতত্ত্বের উপর গঠিত।
শিষ্য। আপনার কথা শুনিয়া আপনার নিকট অনুশীলনতত্ত্ব কিছু শুনিতে ইচ্ছা করিতেছি। কিন্তু আমি যত দূর বুঝি, পাশ্চাত্ত্য অনুশীলনতত্ত্ব ত নাস্তিকের মত। এমন কি, নিরীশ্বর কোমৎ-ধর্ম্ম অনুশীলনের অনুষ্ঠান পদ্ধতি মাত্র বলিয়াই বোধ হয়।
গুরু। এ কথা অতি যথার্থ। বিলাতী অনুশীলনতত্ত্ব নিরীশ্বর, এই জন্য উহা অসম্পূর্ণ ও অপরিণত অথবা উহা অসম্পূর্ণ বা অপরিণত বলিয়াই নিরীশ্বর,-ঠিক সেটা বুঝি না। কিন্তু হিন্দুরা পরম ভক্ত, তাহাদিগের অনুশীলনতত্ত্ব জগদীশ্বর-পাদপদ্মেই সমর্পিত।
শিষ্য। কেন না, উদ্দেশ্য মুক্তি। বিলাতী অনুশীলনতত্ত্বের উদ্দেশ্য সুখ। এই কথা কি ঠিক?
গুরু। সুখ ও মুক্তি, পৃথক্ বলিয়া বিবেচনা করা উচিত কি না? মুক্তি কি সুখ নয়?
শিষ্য। প্রথমতঃ, মুক্তি সুখ নয়-সুখ দুঃখ মাত্রেরই অভাব। দ্বিতীয়তঃ, মুক্তি যদিও সুখবিশেষ বলেন, তথাপি সুখমাত্র মুক্তি নয়। আমি দুইটা মিঠাই খাইলে সুখী হই, আমার কি তাহাতে মুক্তি লাভ হয়?
গুরু। তুমি বড় গোলযোগের কথা আনিয়া ফেলিলে। সুখ এবং মুক্তি, এই দুইটা কথা আগে বুঝিতে হইবে, নহিলে অনুশীলনতত্ত্ব বুঝা যাইবে না। আজ আর সময় নাই-আইস, একটু ফুলগাছে জল দিই, সন্ধ্যা হইল। কাল সে প্রসঙ্গ আরম্ভ করা যাইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *