রাজমোহনের স্ত্রী

প্রথম পরিচ্ছেদ

মধুমতী নদীতীরে রাধাগঞ্জ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। প্রভূত ধনসম্পন্ন ভূস্বামীদিগের বসতি-স্থান বলিয়া এই গ্রাম গণ্ডগ্রামস্বরূপ গণ্য হইয়া থাকে। একদা চৈত্রের অপরাহ্নে দিনমণির তীক্ষ্ণ কিরণমালা ম্লান হইয়া আসিলে দুঃসহ নৈদাঘ উত্তাপ ক্রমে শীতল হইতেছিল; মন্দ সমীরণ বাহিত হইতে লাগিল; তাহার মৃদু হিল্লোল ক্ষেত্রমধ্যে কৃষকের ঘর্ম্মাক্ত ললাটে স্বেদবিন্দু বিশুষ্ক করিতে লাগিল, এবং সদ্যশয্যোত্থিতা গ্রাম্য রমণীদিগের স্বেদবিজড়িত অলকপাশ বিধূত করিতে লাগিল।
ত্রিংশৎবর্ষবয়স্কা একটা রমণী একটি সামান্য পর্ণকুটীর অভ্যন্তরে মাধ্যাহ্নিক নিদ্রা সমাপনান্তে গাত্রোত্থান করিয়া বেশভূষায় ব্যাপৃতা হইলেন। স্ত্রীজাতির এই বৃহৎ ব্যাপারসম্পাদনে রমণীর কালবিলম্ব হইল না; একটু জল, একখানি টিনে-মোড়া চারি আঙ্গুল বিস্তার দর্পণ, সেইরূপ দীর্ঘকায় একখানি চিরুণির দ্বারা এ ব্যাপার সুসম্পন্ন হইল। এতদ্ব্যতিরেকে কিছু সিন্দূরের গুঁড়ায় ললাট বিশোভিত হইল। পরিশেষে একটি তাম্বুলের রাগে অধর রঞ্জিত হইল। এইরূপে জগদ্বিজয়িনী রমণী জাতির একজন মহারথী সশস্ত্র হইয়া কলসীকক্ষে যাত্রা করিলেন, এবং কোনও প্রতিবাসীর বংশ-রচিত দ্বার সবলে উদ্ঘাটিত করিয়া গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্টা হইলেন।র্য্য
যে গৃহমধ্যে ইনি প্রবেশ করিলেন, তাহার মধ্যে চারিখানি চালা ঘর-মাটির পোতা-ঝাঁপের বেড়া। কুটীরমধ্যে কোথাও দারিদ্র্যলক্ষণ দৃষ্ট হইতেছিল না-সর্ব্বত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চতুষ্কোণ উঠানের চারিদিকে চারিখানি ঘর। তিনখানির দ্বার উঠানের দিকে-একখানির দ্বার বাহিরের দিকে। এই ঘরখানি বৈঠকখানা-অপর তিনখানি চতুষ্পার্শ্বে আবরণ বিশিষ্ট হইয়া অন্তঃপুরত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিল। সদর বাটীর মণ্ডপ সম্মুখে সুকর্ষিত ভূমিখণ্ডে কিছু বার্ত্তাকু শাকাদি জন্মিয়াছিল। চারিপার্শ্বে নলের বেড়া; দ্বারে ঝাঁপের আগড়; সুতরাং অবলা অনায়াসে গৃহে প্রবেশ করিল।
বলা বাহুল্য যে, লব্ধপ্রবেশা প্রথমেই অন্তঃপুরাভিমুখে চলিলেন। পুরবাসী বা পুরবাসিনী বর্গ মাধ্যাহ্নিক নিদ্রা সমাপনান্তে স্ব স্ব কার্য্যে কে কোথায় গিয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। কেবলমাত্র তথায় দুই ব্যক্তি ছিল; একটি অষ্টাদশবর্ষীয়া তরুণী বস্ত্রোপরে কারুকার্য্যে ব্যাপৃতা ছিলেন, আর একটি চারি বৎসরের শিশু খেলায় মগ্নচিত্ত ছিল। তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পাঠশালায় যাইবার সময় জানিয়া শুনিয়া মস্যাধার ভুলিয়া গিয়াছিল। শিশু সেই মসীপাত্র দেখিতে পাইয়া অপর্য্যাপ্ত আনন্দ সহকারে সেই কালি মুখে মাখিতেছিল; পাছে দাদা আসিয়া দোয়াত কাড়িয়া লয়, বাছা যেন এই ভয়ে সকল কালিটুকু একেবারে মাখিয়া ফেলিতেছিল। অভাগ্যতা, কারুকার্য্যকারিণীর নিকট ধরাসনে উপবেশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি করিতেছিস্ লো?”
সম্বোধিতা রমণী হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আজ যে দিদি, বড় অনুগ্রহ; না জানি আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম।”
অভ্যাগতা হাসিয়া কহিল, “আর কার মুখ দেখে উঠ্‌বে? রোজ যার মুখ দেখে উঠ আজও তার মুখ দেখে উঠেছ।”
এই কথা শুনিয়া তরুণীর মুখমণ্ডল ক্ষণেকের জন্য মেঘাচ্ছন্ন হইল; অপরা নারীর অধরমূলে হাস্য অর্দ্ধপ্রকটিত রহিল। এই স্থলে উভয়ের বর্ণনা করি।

অভ্যাগতা যে ত্রিংশৎবর্ষবয়স্কা এ কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। সে শ্যামবর্ণা-কাল নয়-কিন্তু তত শ্যামও নয়। মুখকান্তি নিতান্ত সুন্দর নয়, অথচ কোন অংশ চক্ষুর অপ্রিয়কর নয়; তন্মধ্যে ঈষৎ চঞ্চল মাধুরী ছিল, এবং নয়নের ‘হাসি হাসি’-ভাবে সেই মাধুরী আরও মধুর হইয়াছিল। দেহময় যে অলঙ্কারসকল ছিল, তাহা সংখ্যায় বড় অধিক না হইবে, কিন্তু একটি মুটের বোঝা বটে। যে শঙ্খবণিক সেই বিশাল শঙ্খ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তিনি বিশ্বকর্ম্মার অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্র সন্দেহ নাই। আভরণময়ীর স্থূলাঙ্গে একখানি মোটা শাটী ছিল; শাটীখানি বুঝি রজকের উপর রাগ করিয়াছিল, তাই সে পথে অনেক কাল গতিবিধি করে নাই।
অষ্টাদশবর্ষীয়ার কোমল অঙ্গে এতাদৃশ অলঙ্কার বেশী ছিল না। বস্তুতঃ তাহার বাক্যালাপে পূর্ব্ব বঙ্গীয় কোনরূপ কণ্ঠবিকৃতি সংলক্ষিত হইত না; ইহাতে স্পষ্ট অনুভূত হইতে পারে যে, এই সর্ব্বঙ্গসুন্দর রমণীকুসুম মধুমতী-তীরজ নহে-ভাগীরথী-কূলে রাজধানী সন্নিহিত কোনও স্থানে জাতা ও প্রতিপালিতা হইয়া থাকিবেক। তরুণীর আরক্ত গৌরবর্ণছটা মনোদুঃখ বা প্রগাঢ় চিন্তাপ্রভাবে কিঞ্চিৎ মলিন হইয়াছিল; তথাচ যেমন মধ্যাহ্ন রবির কিরণে স্থলপদ্মিনী অর্দ্ধ প্রোজ্জ্বল, অর্দ্ধশুষ্ক হয়, রূপসীর বর্ণজ্যোতি সেইরূপ কমনীয় ছিল। অতিবর্দ্ধিতকেশজাল অযত্নশিথিল গ্রন্থিতে স্কন্ধদেশে বদ্ধ ছিল; তথাপি অলককুন্তল সকল বন্ধন দশায় থাকিতে অসম্মত হইয়া ললাট কপোলাদি ঘিরিয়া বসিয়াছিল। প্রশস্ত পূর্ণায়ত ললাটতলে নির্দ্দোষ বঙ্কিম ভ্রূযুগল ব্রীড়াবিকম্পিত; নয়নপল্লবাবরণে লোচনযুগল সচরাচর অর্দ্ধাং শমাত্র দেখা যাইত; কিন্তু যখন সে পল্লব ঊর্দ্ধোত্থিত হইয়া কটাক্ষ স্ফুরণ করিত, তখন বোধ হইত যেন নৈদাঘ মেঘমধ্যে সৌদামিনী-প্রভা প্রকটিত হইল। কিন্তু সে যৌবনমদমত্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিক্ষেপে চিন্তাকুলতা প্রতীত হইত; এবং তথায় ক্ষুদ্র ওষ্ঠাধর দেখিলেই বুঝা যাইত, সে হৃদয়তলে কত সুখ দুঃখ বিরাজ করিতেছে। তাহার অঙ্গসৌষ্ঠ ও নির্ম্মাণ-পারিপাট্য, শারীরিক বা মানসিক ক্লেশে অনেক নষ্ট হইয়াছিল; তথাচ পরিধেয় পরিষ্কার শাটীখণ্ডমধ্যে যাহা অর্দ্ধ দৃষ্ট হইতেছিল, তাহার অনুরূপ শিল্পকর কখনও গড়ে নাই। সেই সুঠাম অঙ্গ প্রায় নিরাভরণ, কেবলমাত্র প্রকোষ্ঠে ‘চুড়ি’ ও বাহুতে ‘মুড়কিমাদুলি’ ইহাও বড় সুগঠন।
তরুণী হস্তস্থিত সুচ্যাদি একপার্শ্বে রাখিয়া অভ্যাগতার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইলেন। অভ্যাগতা কথোপকথনকালে নিজ গৃহযন্ত্রণা-বর্ণনে বিস্তর সদ্বক্তৃত্ব প্রকাশ করিলেন; দোষের মধ্যে এই, যে যন্ত্রণাগুলিন বর্ণনা করিলেন, তাহা প্রায় কাল্পনিক। বক্ত্রী নিজ কর্দ্দমময় বস্ত্রাঞ্চলের অগ্রভাগ লইয়া পুনঃ পুনঃ চক্ষে দিতে লাগিলেন; বিধাতা তাঁহাকে যে চক্ষুযুগল দিয়াছিলেন সে কিছু এমত অবস্থার যোগ্য নয়; কিন্তু কি হবে?-অবস্থাবিশেষে শালগ্রামেরও মৃত্যু ঘটে। চক্ষুর ঘটে নাই, যতবার কাপড়খানা এসে ঠেকে ততবার চক্ষু দুইটি কামধেনুর মত অজস্র অশ্রু বর্ষণ করে। বক্ত্রী-চূড়ামণি অনেকবার অশ্রুবৃষ্টি করিয়া একবার জাঁকাইয়া কাঁদিবার উদ্যোগে ছিলেন; কিন্তু ভাগ্যক্রমে কথিত চক্ষু দুইটি সেই সময় সেই শিশুটির কালিময় মুখের উপর পড়িল; শিশুটি মসীপাত্র শূন্য করিয়া অন্ধকারময় মূর্ত্তি লইয়া দণ্ডায়মান ছিল, বালকের এই অপরূপ অঙ্গরাগ দেখিয়া গৃহযন্ত্রণাবাদিনী কাঁদিতে গিয়া হাসিয়া ফেলিলেন; রসের সাগর উথলিয়া যন্ত্রণাদি ভাসাইয়া দিল।
রোদনাদির ব্যাপার সমাপ্ত হইলে, সূর্য্যদেবকে সত্য সত্যই অস্তাচলে যাইবার উদ্যোগী দেখিয়া বক্ত্রী তরুণীকে জল আনিতে যাইবার আমন্ত্রণ করিলেন। বস্তুতঃ এই আমন্ত্রণের জন্যই এত দূর আসা। নবীনা বারি-বাহনার্থ যাইতে অস্বীকৃতা হইলেন; কিন্তু তাঁহার সঙ্গিনী বিশেষ উত্তেজনা করিতে লাগিলেন। নবীনা কহিলেন, “মধুমতীতে বড় কুমীর, গেলে কুমীরে খাবে।”

ইহা শুনিয়া সঙ্গিনী যে ঘোর হাস্য করিল, নবীনা তাহাতেই বুঝিলেন,-তাঁহার আপত্তি গ্রাহ্য হইল না। তিনি পুনরায় কহিলেন, “যাবি কখন লা কনক, আর কি বেলা আছে?” “এখনও দুপুর বেলা” বলিয়া কনক অঙ্গুলী নির্দ্দেশে দেখাইলেন যে, এ পর্য্যন্ত সূর্য্যকর বৃক্ষোপরে দীপ্তিমান্ রহিয়াছে।
নবীনা তখন কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্য্য সহকারে বলিলেন, “তুই জানিস্ ত কনক দিদি, আমি কখন জল আনিতে যাই না।”
কনক কহিল, “সেই জন্যই ত যাইতে কহি, তুই কেন সারাদিন পিঁজরেতে কয়েদ থাক্‌বি? আর বাড়ীর বউমানুষে জল আনে না?”
নবীনা গর্ব্বিত বচনে কহিলেন, “জল আনা দাসীর কর্ম্ম।”
“কেন, কে জল এনে দেয় লো? দাসী চাকর কোথা?”
“ঠাকুরঝি জল আনে।”
“ঠাকুরঝি যদি দাসীর কর্ম্ম করিতে পারে, তবে বৌ পারে না?”
তখন তরুণী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বরে কহিল, “কথায় কাজ নাই কনক! তুমি জান আমার স্বামী আমাকে জল আনিতে বারণ করিয়াছেন। তুমি তাঁহাকে চেন ত?”
কনকময়ী কোনও উত্তর না করিয়া সচকিত কটাক্ষে চতুর্দ্দিকে নিরীক্ষণ করিলেন, যেন কেহ আসিতেছে কি না দেখিলেন। কোথাও কেহ নাই দেখিয়া সমভিব্যাহারিণীর মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন, যেন কিছু বলিতে বাসনা আছে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আশঙ্কাপ্রযুক্ত কথনেচ্ছা দমন করিয়া অধোদৃষ্টি করতঃ চিন্তা করিতে লাগিলেন। তরুণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবিতেছিস্?”
কনক কহিল-“যদি-যদি তোর চোখ্ থাকত্___”
নবীনা আর না শুনিয়া ইঙ্গিতের দ্বারা নিষেধ করিয়া কহিল, “চুপ্ কর্, চুপ্ কর্-বুঝিয়াছি।”
কনক বলিল, “বুঝিয়া থাক ত কি করিবে এখন?”
তরুণী কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, ঈষৎ অধরকম্পে এবং অল্প ললাট-রক্তিমায় প্রকাশ পাইতে লাগিল যে, যুবতীর মনোমধ্যে কোন্ চিন্তা প্রবল। তাদৃশ ঈষৎ দেহকম্পনে আরও দেখা গেল যে, সে চিন্তায় হৃদয় অতি চঞ্চল হইতেছে। ক্ষণেক পরে কহিলেন, “চল যাই, কিন্তু ইহাতে কি পাপ আছে?”
কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, “পাপ আছে! আমি ভুঁড়ে ভট্টাচার্য্যনহি, শাস্ত্রের খবরও রাখি না; কিন্তু আমার আড়াই কুড়ি মিন্‌সে থাকিলেও যাইতাম।”
“বড় বুকের পাটা” বলিয়া হাসিতে হাসিতে যুবতী কলসী আনিতে উঠিল; “পঞ্চাশটা! হাঁলো, এতগুলো কি তোর সাধ?”
কনক দুঃখের হাসি হাসিয়া কহিল, “মুখে আনিতে পাপ; কিন্তু বিধাতা যে একটা দিয়াছেন, পঞ্চাশটাও যদি তেমনি হয়, তবে কোটীখানেকেই বা কি ক্ষতি? কাহারও সঙ্গে যদি দেখা সাক্ষাৎ না হইল তবে আমি কোটী পুরুষের স্ত্রী হইয়াও সতী সাধ্বী পতিব্রতা।”
“কুলীনে কপাল” বলিয়া তরুণী চঞ্চল পদে পাকশালা হইতে একটি ক্ষুদ্র কলসী আনয়ন করিলেন। যেমন বারিবাহিনী তেমনই কলসী। তখন উভয়ে প্রবাহিণী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, “এখন এস দেখি মোর গৌরবিণী, হাঁ-করাগুলোকে একবার রূপের ছটাটা দেখাইয়া আনি।”
“মর্ পোড়ার বাঁদর” বলিয়া কনকের সমভিব্যাহারিণী অবগুণ্ঠনে সলজ্জ বদন আচ্ছন্ন করিলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

অপনীত সূর্য্যকর নারিকেলাদি বৃক্ষাগ্রভাগ হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে; কিন্তু এখনও পর্য্যন্ত নিশা ধরাবাসিনী হয় নাই। এমন সময় কনক ও তাহার সমভিব্যাহারিণী কলসীকক্ষে গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিল। পথিপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র উদ্যান ছিল; পূর্ব্ববঙ্গ মধ্যে তদ্রূপ উদ্যান বড় বিরল। সুশোভন লৌহ রেইলের পরিধি মধ্য হইতে অসংখ্য গোলাপ ও মল্লিকার কলি পথিকার নেত্রমোদন করিতেছিল। পূর্ব্বতন পদ্ধতিমত চতুষ্কোণ ও অণ্ডাকার বহুতর চান্‌কার মধ্যে পরিষ্কার ইষ্টকচূর্ণ পথ সুরচিত ছিল। উদ্যানমধ্যে একটি পুষ্করিণী। তাহার তীর কোমল তৃণাবলিতে সুসজ্জিত; একদিকে ইষ্টকনির্ম্মিত সোপানাবলী। ঘাটের সম্মুখে বৈঠকখানা। বৈঠকখানার বারাণ্ডায় দাঁড়াইয়া দুই ব্যক্তি কথোকথন করিতেছিল।
বয়োধিক যে ব্যক্তি, তাহার বয়স ত্রিশ বৎসরের ঊর্দ্ধ হইবে; দীর্ঘ শরীর, স্থূলাকার পুরুষ। অতি স্থূলকায় বলিয়াই সুগঠন বলা যাইতে পারিল না। বর্ণ কঠোর শ্যাম; কান্তি কোনও অংশে এমত নহে যে, সে ব্যক্তিকে সুপুরুষ বলা যাইতে পারে; বরং মুখে কিছু অমধুরতা ব্যক্ত ছিল। বস্তুতঃ সে মুখাবয়ব অপর সাধারনের নহে; কিন্তু তাহার বিশেষত্ব কি যে, তাহাও হঠাৎ নিশ্চয় করা দুর্ঘট। কটিদেশে ঢাকাই ধুতি; লম্বা লম্বা পাকান ঢাকাই চাদরে পাগড়ি বাঁধা। পাগড়িটার দৌরাত্ম্যে, যে দুই এক গাছি চুল মাথায় ছিল, তাহাও দেখিতে পাওয়া ভার। ঢাকাই মলমলের পিরহাণ গাত্রে;-সুতরাং তদভ্যন্তরে অন্ধকারময় অসীম দেহখানি বেশ দেখা যাইতেছিল; আর সঙ্গে সঙ্গে সোনার কবচখানিও উঁকিঝুঁকি মারিতেছিল। কিন্তু গলদেশে যে হেলেহার মন্দর পর্ব্বতে বাসুকির ন্যায় বিরাজ করিতেছিল, সে একেবারে পিরহাণের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। পিরহাণের সোনার বোতাম, তাহাতে চেন্ লাগান; প্রায় সকল আঙ্গুলেই অঙ্গুরীয়; হস্তে যমদণ্ডতুল্য পিচের লাঠি। বামনদেবের পাদপদ্মতুল্য দুইখানি পায়ে ইংরাজি জুতা।
ইহার সমভিব্যাহারী পরম সুন্দর, বয়স অনুমান বাইশ বৎসর। তাঁহার সুবিমল স্নিগ্ধ বর্ণ, শারীরিক ব্যায়ামের অসদ্ভাবেই হউক, বা ঐহিক সুখ সম্ভোগেই হউক, ঈষৎ বিবর্ণ হইয়াছিল। তাঁহার পরিচ্ছদ অনতিমূল্যবান্,-একখানি ধুতি, অতি পরিপাটী একখানি চাদর, একটি কেমব্রিকের পিরাণ; আর গোরার বাটীর জুতা পায়। একটি আঙ্গুলে একটি আংটি; কবচ নাই, হারও নাই।
বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি অপরকে কহিল, “তবে মাধব, তুমি আবার কলিকাতা ধরিয়াছ! আবার এ রোগ কেন?”
মাধব উত্তর করিলেন, “রোগ কিসে? মথুর দাদা, আমার কলিকাতার উপর টান যদি রোগ হয়, তবে তোমার রাধাগঞ্জের উপর টানও রোগ।”
মথুর জিজ্ঞাসা করিল, “কিসে?”
মাধব। নয় কিসে? তুমি রাধাগঞ্জের আমবাগানের ছায়ায় বয়স কাটাইয়াছ, তাই তুমি রাধাগঞ্জ ভালবাসে; আমি কলিকাতার দুর্গন্ধে কাল কাটাইয়াছি, আমিও তাই কলিকাতা ভালবাসি।
মথুর। শুধু দুর্গন্ধ! ডেরেনের শুকো দুই; তাতে দুটো একটা পচা ইঁদুর, পচা বেরাল উপকরণ-দেবদুর্ল্লভ।
মাধব হাসিয়া কহিল, “শুধু এ সকল সুখের জন্য কলিকাতায় যাইতেছি না, আমার কাজও আছে।”
মথুর। কাজ ত সব জানি।-কাজের মধ্যে নূতন ঘোড়া নূতন গাড়ি-ঠক্ বেটাদের দোকানে টো টো করা-টাকা উড়ান-তেল পুড়ান-ইংরাজিনবিশ ইয়ার বক্‌শিকে মদ খাওয়ান-আর হয়ত রসের তরঙ্গে ঢলাঢল্। হাঁ করিয়া ওদিক কি দেখিতেছ? তুমি কি কখন কন্‌কিকে দেখ নাই? না ওর সঙ্গের ছুঁড়িটা আস্‌মান থেকে পড়েছে?-তাই ত বটে! ওর সঙ্গে ওটি কে?
মাধব কিঞ্চিৎ রক্তিমকান্তি হইলেন; কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভাবান্তর প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “কনকের কি স্বভাব দেখেছ? কপালে বিধাতা এত দুঃখ লিখেছেন, তবু হেসে হেসে মরে।”
মথুর। তা হউক-সঙ্গে কে?
মাধব। তা আমি কেমন করিয়া বলিব, আমার কি কাপড় ফুঁড়ে চোখ চলে? ঘোমটা দেখিতেছ না?
বস্তুতঃ কনক ও তাহার সঙ্গিনী কলসীকক্ষে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিল। কনককে সকলেই চিনিত; কিন্তু দ্বিতীয় কুলকামিনীর প্রতি পদসঞ্চারে যে অনির্ব্বচনীয় লাবণ্য বিকাশ হইতেছিল, তাঁহার বস্ত্র ভেদ করিয়া যে অপূর্ব্ব অঙ্গসৌষ্ঠব দেদীপ্যমান হইতেছিল, তাহাতে প্রথমে মাধবের, পশ্চাৎ মথুরের দৃষ্টি মুগ্ধ হইল; এবং উভয়ে সঙ্গীতধ্বনিদত্তচিত্ত কুরঙ্গের ন্যায় অবহিত মনে তৎপ্রতি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।
শেষ লিখিত কয়েকটি কথা যে সময়ে মাধবের মুখ হইতে নির্গত হইল, সেই সময় একবার মন্দ সমীরণ-হিল্লোল রমণীদিগের শিরোপরে বাহিত হইল; এই সময় তরুণী স্বীয় কক্ষস্থিত কলসী অনভ্যস্ত কক্ষে উত্তমরূপে বসাইবার জন্য অবগুণ্ঠন হইতে হস্ত লইবার সময়, দুষ্ট সমীরণ অবগুণ্ঠনদি উড়াইয়া ফেলিল। মুখ দেখিয়া মাধব বিস্মিতের ন্যায় ললাট আকুঞ্চিত করিলেন। মথুর কহিল, “ওই দেখ-তুমি ওকে চেন?”
“চিনি।”
“চেন? তুমি চেন, আমি চিনি না; অথচ আমি এইখানে জন্ম কাটাইলাম, আর তুমি কয়দিন! চেন যদি, তবে কে এটি?”
“আমার শ্যালী।”
“তোমার শ্যালী? রাজমোহনের স্ত্রী?”
“হাঁ।”
“রাজমোহনের স্ত্রী, অথচ আমি কখন দেখি নাই?”
“দেখিবে কিরূপে? উনি কখন বাটীর বাহির হয়েন না।”
মথুর কহিল, “হয়েন না, তবে আজ হইয়াছেন কেন?”
মাধব। কি জানি।
মথুর। মানুষ কেমন?
মাধব। দেখিতেই পাইতেছ-বেশ সুন্দর।
মথুর। ভবিষ্যদ্বক্তা গণকঠাকুর এলেন আর কি? তা বলিতেছি না-বলি, মানুষ ভাল?
মাধব। ভাল মানুষ কাহাকে বলে?
মথুর। আঃ কালেজে পড়িয়া একেবারে অধঃপাতে গিয়াছ। একবার যে সেখানে গিয়া রাঙ্গামুখোর শ্রাদ্ধর মন্ত্র পড়িয়া আসে, তাহার সঙ্গে দুটো কথা চলা ভার। বলি ওর কি-?
মাধবের বিকট ভ্রূভঙ্গ দৃষ্টে মথুর যে অশ্লীল উক্তি করিতে চাহিতেছিলেন তাহা হইতে ক্ষান্ত হইলেন।
মাধব গর্ব্বিত বচনে কহিলেন, “আপনার এত স্পষ্টতার প্রয়োজন নাই; ভদ্রলোকের স্ত্রী পথে যাইতেছে, তাহার সম্বন্ধে আপনার এত বক্তৃতার আবশ্যক কি?”
মথুর কহিল, “বলিয়াছি ত দু’ পাত ইংরেজি উল্‌টাইলে ভায়ারা সব অগ্নি-অবতার হইয়া বসেন। আর ভাই, শ্যালীর কথা কব না ত কাহার কথা কব? বসিয়া বসিয়া কি পিতামহীর যৌবন বর্ণনা করিব? যাক্ চুলায় যাক্; মুখখানা ভাই, সোজা কর-নইলে এখনই কাকের পাল পিছনে লাগিবে। রাজমুহুনে গোবর্দ্ধন এমন পদ্মের মধু খায়?”
মাধব কহিল, “বিবাহকে বলিয়া থাকে সুরতি খেলা।”
এইরূপ আর কিঞ্চিৎ কথোপকথন পরে উভয়ে স্ব স্ব স্থানে গমন করিলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

কনকময়ী এবং তৎসঙ্গিনী নীরবে গৃহাভিমুখে চলিলেন। লোকের সম্মুখে কথা কহিতে কনকের সহচরী অতি লজ্জাকর বোধ করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে নীরব দেখিয়া কনকও নীরব। কিন্তু এমন লোকালয়মধ্যে রসনারূপিণী প্রচণ্ডা অশ্বিনী যে নিজ প্রাখর্য্যাদি গুণ দেদীপ্যমান করিতে পারিল না, কনকের ইহাতে বড় মনোদুঃখ রহিল। তাঁহারা আপনাপন গৃহ-সান্নিধ্যে আসিলেন; তথায় লোকের গতিবিধি অধিক না থাকায় কনীয়সী কথোপকথন আরম্ভ করিলেন; বলিলেন, “কি পোড়া কপালে বাতাস দিদি, আমাকে কি নাস্তানাবুদই করিল।”
কনক হাসিয়া কহিল, “কেন, তোমার ভগ্নীপতি কি কখন তোমার মুখ দেখে নাই?”
কনীয়সী। আমি ত তাহার জন্য বলিতেছি না-অন্য একজন যে কে ছিল।
কনক। কেন, সে যে, মথুরবাবু; তাহাকে কি কখন দেখ নাই?
কনীয়সী। কবে দেখিলাম-আমার ভগ্নীপতির জ্যেঠাত ভাই মথুরবাবু?
কনক। সে না ত কে?
কনীয়সী। কি লজ্জা বোন্ কাহারও সাক্ষাতে বলিস্ না।
কনক। মরণ আর কি! আমি লোকের কাছে গল্প করিতে যাইতেছি যে, তুমি জল আনিতে ঘোমটা খুলে মুখ দেখাইয়াছিলে।
এই বলিয়া কনক মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল। তরুণী সরোষে কহিল, “তুমি ভাগাড়ে পড় না কেন? কথার রকম দেখ। এমত জানিলে কি আমি তোমার সঙ্গে আসিতাম?”
কনক পুনরায় হাস্য করিতে লাগিল; যুবতী কহিলেন, “তোর ও হাসি আমার ভাল লাগে না-সর্ব্বনাশ! দুর্গা যা করেন।”
এই বলিয়া নবীনা গৃহাভিমুখে নিরীক্ষণ করিয়া কম্পিতকলেবরা হইল। কনকময়ীও সেই দিকে নিরীক্ষণ করিয়া এই আকস্মিক ভীতির হেতু অনুভূত করিলেন, তাঁহারা প্রায় গৃহ-সান্নিধ্যে উপনীতা হইয়াছিলেন। কনক দেখিতে পাইল যে, দ্বারে অগ্নিবিচ্ছুরিত নয়নে কালমূর্ত্তির ন্যায় রাজমোহন দণ্ডায়মান রহিয়াছে। সঙ্গিনীর কর্ণে কর্ণে সে কহিল,-“আজ দেখিতেছি মহাপ্রলয়; আমি তোর সঙ্গে যাই, যদি অকূলে কাণ্ডারী হইতে পারি।”
রাজমোহনের স্ত্রী তদ্রূপ মৃদুস্বরে কহিল, “না, না, আমারও সহ্য আছে-তুমি থাকিলে হয়ত হিতে বিপরীত হবে তুমি বাড়ী যাও।”
ইহা শুনিয়া কনক পথান্তরে নিজ গৃহে গমন করিল। তাঁহার সহচরী যখন নিজ গৃহে প্রবেশ করিলেন, তখন রাজমোহন কিছুই বলিল না। তাহার স্ত্রী জলকলসী লইয়া পাকশালায় রাখিলেন। রাজমোহন নিঃশব্দে সঙ্গে সঙ্গে পাকশালায় যাইলেন। স্ত্রী কলসীটি রাখিলে রাজমোহন কহিল, “একটু দাঁড়াও।” এই বলিয়া জলের কলসী লইয়া আঁস্তাকুড়ে জল ঢালিয়া ফেলিলেন। রাজমোহনের একটি প্রাচীনা পিসী ছিল। পাকের ভার তাঁরই প্রতি; তিনি এইরূপ জলের অপচয় দেখিয়া রাজমোহনকে ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, “আবার জলটা অপচয় করিতেছিস্ কেন রে? তোর ক’গণ্ডা দাসী আছে যে, আবার জল আনিয়া দিবে?”
“চুপ কর্ মাগী হারামজাদী” বলিয়া রাজমোহন বারিশূন্য কলসীটা বেগে দূরে নিক্ষেপ করিল; এবং স্ত্রীর দিকে ফিরিয়া অপেক্ষাকৃত মৃদু অথচ অন্তর্জ্বালাকর স্বরে কহিল, “তবে রাজরাণী, কোথায় যাওয়া হইয়াছিল?”
রমণী অতি মৃদুস্বরে দার্ঢ্য সহকারে কহিল, “জল আনিতে গিয়াছিলাম।”
যথায় স্বামী তাঁহাকে দাঁড়াইতে বলিয়াছিল তিনি তথায় চিত্রার্পিত পুত্তলিকার ন্যায় অস্পন্দিতকায় দাঁড়াইয়া ছিলেন।
রাজমোহন ব্যঙ্গ করিয়া কহিল, “জল আনিতে গিয়াছিলে? কাকে ব’লে গিছ্‌লে ঠাকুরাণি?”
“কাহারেও বলে যাই নাই।”
রাজমোহন আর ক্রোধপ্রবাহ সম্বরণ করিতে পারিল না, চিৎকার স্বরে কহিল, “কারেও বলে যাও নাই-আমি দশ হাজার বার বারণ করেছি না?”
অবলা পূর্ব্বমত মৃদুস্বরে কহিল, “করেছ।”
“তবে গেলি কেন হারামজাদি?”
রমণী অতি গর্ব্বিত বচনে কহিল, “আমি তোমার স্ত্রী।” তাঁহার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, কণ্ঠস্বর বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল।
“গেলে কোন দোষ নাই বলিয়া গিয়াছিলাম।”
অসমসাহসের কথা শুনিয়া রাজমোহন একেবারে অগ্নিসম হইয়া উঠিলেন; বজ্রনাদবৎ চিৎকারে কহিলেন, “আমি তোকে হাজার বার বারণ করেছি কি না? এবং ব্যাঘ্রবৎ লম্ফ দিয়া চিত্রপুত্তলিসম স্থিররূপিণী সাধ্বীর কোমল কর বজ্রমুষ্টে এ হস্তে ধরিয়া প্রহারার্থ দ্বিতীয় হস্ত উত্তোলন করিলেন।”
অবলাবালা কিছু বুঝিলেন না; প্রহারোদ্যত হস্ত হইতে একপদও সরিয়া গেলেন না, কেবল এমন কাতর চক্ষে স্ত্রী-ঘাতকের প্রতি চাহিয়া রহিলেন যে, প্রহারকের হস্ত যেন মন্ত্রমুগ্ধ রহিল। ক্ষণেক নীরব হইয়া রহিয়া রাজমোহন পত্নীর হস্ত ত্যাগ করিল; কিন্তু তৎক্ষণাৎ পূর্ব্বমত বজ্রনিনাদে কহিল, “তোরে লাথিয়ে খুন করব।”
তথাপি তিরস্কৃতা কোন উত্তর করিল না, কেবল চক্ষে অবিরল জলধারা বিগলিত হইতেছিল। ঈদৃশী মানসিক যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করিতে দেখিয়া নিষ্ঠুর কিঞ্চিৎ আর্দ্র হইল। সহধর্ম্মিণীর অচলা সহিষ্ণুতা দৃষ্টে প্রহারোদ্যমে বিতথপ্রযত্ন হইলেন বটে, কিন্তু রসনাগ্রে অবাধে বজ্রতাড়ন হইতে লাগিল। সে মধুমাখা শব্দাবলী এ স্থলে উদ্ধৃত করিয়া পাঠকের কর্ণ পীড়ন করা অবিধেয়। ধীরা সকলই নীরবে সহ্য করিল। ক্রমে রাজমোহনের প্রচণ্ডতা খর্ব্ব হইয়া আসিল; তখন প্রাচীনা পিসীর একটু সাহস হইল। তিনি ধীরে ধীরে ভ্রাতুষ্পুত্র-বধূর কর ধারণপূর্ব্বক তাঁহার গৃহাভ্যন্তরে লইয়া গেলেন; এবং যাইতে যাইতে ভ্রাতুষ্পুত্রকে দুই এক কথা শুনাইয়া দিলেন; কিন্ত তাহাও সাবধানে, সাবধানে-সাবধানের মার নাই। যখন দেখিলেন যে, রাজমোহনের ক্রোধ, মন্দীভূত হইয়া আসিয়াছে, তখন বর্ষীয়সী একেবারে স্বীয় কণ্ঠকূপ হইতে প্রচণ্ড তিরস্কারপ্রবাহ ছাড়িয়া দিলেন, ভ্রাতুষ্পুত্র যতগুলিন কুকথা মুখনির্গত করিয়াছিল, প্রায় সকলগুলিরই উপযুক্ত মূল্যে প্রতিশোধ দিলেন। রাজমোহন তখন ক্রোধ লইয়া ব্যস্ত, পিসীর মুখনিঃসৃত ভাষালালিত্যের বড় রসাস্বাদন করিতে পারিলেন না; আর পূর্ব্বে সে রস অনেক আস্বাদন করা হইয়াছিল, সুতরাং তিনি এক্ষণে তাহা অপূর্ব্ব বলিয়া বোধ করিলেন না। দুই জনে দুই দিকে গেলেন; পিসী বধূকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। রাজমোহন কাহার মাথা ভাঙ্গিবেন ভাবিতে ভাবিতে চলিলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এক্ষণে পাঠক মহাশয়ের সহিত যাঁহাদিগের পরিচয় হইল, তাঁহাদিগের পূর্ব্ব বিবরণ কথনে প্রবৃত্ত হই।
পূর্ব্বাঞ্চলে কোন ধনাঢ্য ভূস্বামীর আলয়ে বংশীবদন ঘোষ নামে এক ভৃত্য ছিল। এই ভূস্বামীর বংশ ও নাম এক্ষণে লোপ হইয়াছে, কিন্তু পূর্ব্বে তাঁহার যথেষ্ট খ্যাতি প্রতিপত্তি ছিল। বৃদ্ধকাল পর্য্যন্ত সন্তানের মুখাবলোকন না করিয়া শেষ বয়সে তিনি দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করিলেন। কিন্তু বিধির নির্ব্বন্ধ কে খণ্ডাইতে পারে? দ্বিতীয় পত্নীও সন্তানরত্নপ্রসবিনী হইলেন না। না হউন, বার্দ্ধক্যের তরুণী স্ত্রী একাই এক সহস্র। সত্য বটে মধ্যে মধ্যে দুই সপত্নীতে কিছু গোলযোগ উপস্থিত করিতেন; কখন কখন কর্ত্তার নিকট আসিয়া উভয়ে চীৎকারের মহলা দিতেন; কখন বা কনিষ্ঠা জ্যেষ্ঠার কাপড় টানিয়া ছিঁড়িতেন; জ্যেষ্ঠা কনিষ্ঠার চুল টানিয়া ছিঁড়িতেন। এখনও কখন হইয়াছে যে, ছেঁড়া ছিঁড়ি নাক কাণ পর্য্যন্ত উঠিয়াছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হইলেই প্রায় উলু খাক্‌ড়ার প্রাণ বধ হইয়া থাকে,-বৃদ্ধ, সহধর্ম্মিণীদিগের সময়ে সময়ে নিকটে থাকিলেই লাথিটা গুঁতাটায় বঞ্চিত হইতেন না; কনিষ্ঠার পদাঘাত পাইলেই মনে করিতেন,-এইবার পূর্ব্বপুরুষেরা স্বর্গে উঠিলেন; এমনই লাথির জোর। জ্যেষ্ঠা সর্ব্বদা বলিতেন, “বড়র বড়, ছোটর ছোট।” শেষে করাল কাল মধ্যস্থ হইয়া “বড়র বড়, ছোটর ছোট” বলিয়া বড়কে আগে অন্তর্হিত করিল।
বয়োধিকা পত্নীর মৃত্যু দেখিয়া প্রাচীন মনে করিলেন, “ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে; আমাকেও কোন্ দিন ডাক পড়ে এই। মরি তাতে ক্ষতি নাই, বার ভূতে বিষয়টা খাবে।”
প্রেয়সী যুবতীর সাক্ষাতে মনের কথা বলিলে প্রেয়সী বলিলেন, “কেন আমি আছি, আমি কি তোমার বার ভূত?” বৃদ্ধ কর্ত্তা কহিলেন, তুমি যেখানে এক বিঘা জমি স্বহস্তে দান বিক্রয় করিতে পারিবে না, সেখানে তুমি আর বিষয় ভোগ করিলে কি?” চতুরা কহিল, “তুমি মনে করিলে সব পার; বিষয় বিক্রয় করিয়া আমায় নগদ টাকাটা দাও না।” তথাস্তু বলিয়া ভূস্বামী ভূমি বিক্রয় করিয়া অর্থসঞ্চয়ে মন দিলেন। স্ত্রীর আজ্ঞা এমনই ফলবতী যে, যখন বৃদ্ধ লোকান্তরে গমন করিল, তখন তাহার বিপুল সম্পত্তি প্রায় স্বর্ণরৌপ্যরাশিতেই ছিল-ভূমি অতি অল্প ভাগ। করুণাময়ী বড় বুদ্ধিমতী; তিনি মনে মনে ভাবিলেন, “এখন ত সকলই আমার; ধন আছে, জন আছে, যৌবনও আছে। ধন জন যৌবন সকলই বৃথা; যত দিন থাকে তত দিন ভোগ করিতে হয়।”
ভগবান্ শ্রীরামচন্দ্র অবতারে যখন জানকী বিচ্ছেদে কাতর হন, তখন কি করেন, সীতার একটি সুবর্ণ প্রতিমূর্ত্তি গঠন করিয়া মনকে আশ্বাস দিয়াছিলেন। করুণাময়ীও সেইরূপ স্বামীর কোনও প্রতিমূর্ত্তির মুখ নিরীক্ষণ করিয়া এ দুঃসহ বিরহ যন্ত্রণা নিবারণ না করেন কেন? আরও ভাবিলেন, রামচন্দ্র ধাতুময় প্রতিমূর্ত্তিতে হৃদয় স্নিগ্ধ করিতেন; নির্জ্জীব ধাতুতে যদি মনোদুঃখ নিবারণ হয়, তবে যদি একটা সজীব পতিপ্রতিনিধি করি তাহ’লে আরও সুখদ হইবে সন্দেহ কি? কেন না, সজীব প্রতিনিধিতে কেবল যে চক্ষুর তৃপ্তি হইবে এমত নহে, সময়ে সময়ে কার্য্যোদ্ধারও সম্ভাবনা। অতএব একটা উপ-স্বামী স্থির করা আবশ্যক। পতি এমন পরম পদার্থ যে, একেবারে পতিহীন হওয়া অপেক্ষা একটা উপপতি রাখাও ভাল; বিশেষ শ্রীরামচন্দ্র যাহা করিয়াছেন তাহাতে কি আর কিন্তু আছে?
এইরূপ বিবেচনা করিয়া করুণাময়ী স্বামীর সজীব প্রতিমূর্ত্তিত্বে কাহাকে বরণ করিবে ভাবিতে ভাবিতে বংশীবদন ঘোষ খানসামার উপর নজর পড়িল; বংশীবদনকে আর কে পায়? ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ লইয়া সংসার, তাহার মধ্যে ধর্ম্ম আদৌ, কাম মোক্ষ-পশ্চাৎ। এই তিনকে যদি করুণাময়ী ভৃত্যের শ্রীচরণে সমর্পণ করিতে পারিল, রহিল অর্থ। অর্থ আর কয়দিন বাকি থাকে? খানসামা বাবু অতি শীঘ্র সদর নায়েব হইয়া বসিলেন। কালে সকলের লয়,-কালে প্রণয়ের লয়-কালে প্রণয়ীর লয়,-প্রণয়ময়ী অতি শীঘ্রই খানসামাকে ত্যাগ করিয়া প্রেমাপদ মৃত স্বামীর অনুবর্ত্তিনী হইলেন।
প্রথমে করুণাময়ীর অতি সামান্য জ্বর হয়; জ্বরটা অকস্মাৎ বৃদ্ধি পায়। লোকে বংশীবদনের নানামত নিন্দা করিতে লাগিল; কেহ কেহ এমনও কহিল যে, সে ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করণাশায় করুণাময়ীকে বিষপান করাইয়াছিল। যাহাই হউক, করুণাময়ী প্রাণত্যাগ করিলেন।
বংশীবদন প্রণয়িনী বিয়োগের মনোদুঃখেই হউক, অথবা “যঃ পলায়তি স জীবতি” বলিয়াই হউক, তৎক্ষণাৎ চাকরি স্থান পরিত্যাগ করিয়া বাটী আসিলেন।
করুণাময়ীর বিপুল অর্থরাশি যে তাহার সঙ্গে আসিল, তাহা বলা বাহুল্য। অপর্য্যাপ্ত ধনের অধিপতি হইয়াও বংশীবদন, পাছে অসম্ভব ব্যয় ভূষণ করিলে বিপদ্‌গ্রস্ত হইতে হয় এই আশঙ্কায় অতি সাবধানে কালযাপন করিতে লাগিলেন। তিনি পরলোক গমন করিলে তাঁহার পুত্রেরা তাদৃশ সাবধানতা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন না; এবং দীর্ঘকাল গতে নিশ্চিন্ত হইয়া ভূসম্পত্তি ক্রয় করিলেন, অট্টালিকা ও ক্রীড়া-হর্ম্ম্যাদি নির্ম্মাণ করিলেন, এবং পৈতৃক ধনরাশির উপর উপযুক্ত ঐশ্বর্য্য বিস্তার করিয়া কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
জ্যেষ্ঠ রামকান্ত অতি বিষয়কার্য্যদক্ষ ছিলেন। তাঁহার দক্ষতার ফলে তাঁহার অংশ দ্বিগুণাধিক সম্বর্দ্ধিত হইল।-রামকান্ত এই সম্বর্দ্ধিত সম্পত্তি নিজ দক্ষতর পুত্র মথুরামোহনের হস্তে সমর্পণ করিয়া পরলোক গমন করেন।
রামকান্তের দৃঢ় সংস্কার ছিল যে, ইংরাজি স্কুল ইত্যাদি যে সকল স্থান বিদ্যাভ্যাস জন্য অধুনা সংস্থাপন হইতেছিল তৎসমুদায়ই কেবল খ্রীষ্টান ধর্ম্ম প্রচারের জন্য জাল বিস্তার মাত্র;-সুতরাং মথুরমোহনের কখন ইংরাজি বিদ্যালয় দর্শন করা হয় নাই। বাল্যাবধি বিষয়কার্য্য সম্পাদনে পিতৃসহযোগী হইয়া তদ্বিষয়ে তাঁহার বিশেষ পারদর্শিতা জন্মিয়াছিল; প্রজাপীড়ন, তঞ্চকতা ও অর্থ সংগ্রহ প্রভৃতি বিদ্যাতে বিশেষ নিপুণতা অর্জ্জিত হইয়াছিল।
বংশীবদনের দ্বিতীয় পুত্র রামকানাই অন্যপন্থাবলম্বী হইল। তিনি স্বভাবতঃ সাতিশয় ব্যয়শীল ছিলেন; এজন্য অল্পকালেই অতুল্য ঐশ্বর্য্য বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিল। মধ্যম বাবুর যেমন বাটী, মধ্যম বাবুর যেমন বাগান, মধ্যম বাবুর যেমন আসবাব, এমন কোন বাবুরই নয়। কিন্তু মধ্যম বাবুর জমিদারীও সর্ব্বাপেক্ষা লাভশূন্য; এবং মধ্যম বাবুর ধনাগারও তদ্রূপ অপদার্থ। শেষে কতিপয় শঠ চাটুকার তাঁহাকে কোন বাণিজ্যাদি ব্যাপারে সংলিপ্ত করিল। কলিকাতায় থাকিয়া ব্যবসায় ঈদৃশ অপরিসীম অর্থলাভের সঙ্কল্প করিতে লাগিল যে, সরলচিত্ত ভূস্বামীপুত্র দুরাশাগ্রস্ত হইয়া কলিকাতায় গেলেন; এবং বাণিজ্যোপলক্ষে ধূর্ত্ত চাটুকারদিগের করে পতিত হইয়া হৃতসর্ব্বস্ব হইলেন। পরিশেষে ঋণ পরিশোধার্থ তাবৎ ভূসম্পত্তি বিক্রীত হইয়া গেল।
রামকানাই বাণিজ্য উপলক্ষে কলিকাতায় আসায় এক উপকার হইয়াছিল,-রাজধানীবাসীদিগের পদ্ধতি অনুসারে নিজ পুত্র মাধবকে দেশীয় ও বিদেশীয় বিদ্যায় শিক্ষিত করিয়াছিলেন। আরও মনুষ্যজন্মের সাধ মিটাইয়া উপযুক্ত পাত্রীর সহিত মাধবের পরিণয় ঘটাইয়াছিলেন। -কলিকাতার নিকটবর্ত্তী কোনও গ্রামে এক দরিদ্র কায়স্থ বাস করিত। জগদীশ্বর যেমন কাহাকে সর্ব্বাংশে সুখী করেন না, তেমনই কাহাকেও সর্ব্বাংশে দুঃখী করেন না। কায়স্থের দুস্তর দুঃখসাগরতলে অমূল্য দুই রত্ন জন্মিয়াছিল-তাঁহার দুই কন্যাতুল্য অনিন্দিত সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী অথবা অকুলষিতচরিত্রা আর কোন কামিনী তৎপ্রদেশে ছিল না। কিন্তু রূপেই বা কি করে, চরিত্রেই বা কি করে,-ললাটলিপিদোষে হউক বা যে কারণেই হউক সচরাচর দেখা যায় বঙ্গদেশসম্ভূত কত রমণীরত্ন শূকরদন্তে দলিত হয়,-কায়স্থের জ্যেষ্ঠা কন্যা মাতঙ্গিনীর অদৃষ্টের তদ্রূপ হইল-নীচস্বভাব রাজমোহন তাঁহার স্বামী হইল।
রাজমোহন কর্ম্মঠ, কোনও উপায়ে সংসার প্রতিপালন করিয়া থাকে; তাহার বাটীও নিকটে। এজন্য কন্যাকর্ত্তার ও কন্যাকর্ত্রীর পাত্র মনোনীত হইল,-রাজসিংহাসনের যোগ্য কন্যা মাতঙ্গিনী দুষ্টের দাসী হইলেন। কনিষ্ঠা হেমাঙ্গিনীর প্রতি বিধাতা প্রসন্ন,-মাধবের সহিত তাঁহার পরিণয় হইল।
মাধবের অধ্যয়ন সমাপ্ত হইবার কিছু পূর্ব্বে রামকানাই লোকান্তরে গমন করিলেন। মাধব পিতৃপরলোকের পর প্রায় দারিদ্র্যগ্রস্ত হইতেন, কিন্তু অদৃষ্ট প্রসন্ন। বংশীবদন ঘোষের কনিষ্ট পুত্র রামগোপাল, জ্যেষ্ঠের ন্যায় ধনসম্পত্তিশালী না হইলেও দ্বিতীয়ের ন্যায় হতভাগ্য ছিলেন না। রামগোপাল, রামকানাইয়ের পরই পীড়াক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তাঁহার সন্তানসন্ততি ছিল না। তিনি এই মর্ম্মে উইল করিলেন যে, মাধব তাঁহার তাবৎ সম্পত্তির অধিকারী হইবেক, বিধবা স্ত্রী যত দিন মাধবের ঘরে বাস করিবেন তত দিন তাঁহার নিকট গ্রাসাচ্ছাদন পাইবেন মাত্র।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পিতৃবিয়োগের পরেও মাধব বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন-শেষ পর্য্যন্ত রহিলেন। তাঁহার অনুপস্থিতিকালে তাঁহার কার্য্যকারকেরা বিষয় রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। পাঠ সমাপ্ত হইলে হেমাঙ্গিনীকে সঙ্গে লইয়া রাধাগঞ্জে গমনোদ্যত হইয়া শ্বশুরালয়ে আগমন করিলেন।
মাতঙ্গিনী তৎকালে পিত্রালয়ে ছিলেন, এবং রাজমোহনও তথায় উপস্থিত ছিলেন। রাজমোহন সময়ের সুযোগ বুঝিয়া মাধবের নিকট নিজের দুঃখকাহিনী প্রকাশ করিলেন; বলিলেন, “পূর্ব্বে কোনরূপ দিন যাপন করিয়াছি, কিন্তু এক্ষণে কাজকর্ম্ম প্রায় রহিত হইয়াছে; আমাদের সহায় মুরুব্বি মহাশয় ব্যতীত আর কেহ নাই। মহাশয় কুবেরতুল্য ব্যক্তি, অনুগ্রহ করিলে অনেকের কাছে বলিয়া দিতে পারেন।”
মাধব জানিতেন যে, রাজমোহন অতি দুর্নীতস্বভাব, কিন্তু সরলা মাতঙ্গিনী তাহার গৃহিণী হইয়া যে গ্রাসাচ্ছদনের ক্লেশ পাইতেছিলেন ইহাতে মাধবের অন্তঃকরণে রাজমোহনের উপর মমতা জন্মাইল। তিনি বলিলেন, “আমার পূর্ব্বাবধি মানস যে, কোন বিশ্বস্ত আত্মীয়ব্যক্তি হস্তে বিষয়কর্ম্মের কিয়দংশ ভার ন্যস্ত করিয়া আপনি কতকটা ঝঞ্ঝাট এড়াই, তা মহাশয় যদি এ ভার গ্রহন করেন তবে ত উত্তমই হয়।”
রাজমোহন মনে মনে বিবেচনা করিল যে, মাধব যে প্রস্তাব করিতেছিলেন তাহাতে রাজমোহনের আশার অতিরিক্ত ফল হইতেছে; কেন না, সে যদি মাধবের জমিদারীর একজন প্রধান কর্ম্মকারক হইতে পারে, তাহা হইলে তাহার উপার্জ্জনের সীমা থাকিবে না। কিন্তু এক দোষ যে, দেশ ছাড়িয়া যাইতে হইবে। রাজমোহন উত্তর করিলেন, “আমার প্রতি মহাশয়ের দয়া যথেষ্ট; কিন্তু যদি মহাশয়ের সহিত যাইতে হয়, তা’হলে পরিবার কাহার কাছে রাখিয়া যাই?”
মাধব বলিলেন, “সে চিন্তার প্রয়োজন কি? একই সংসারে দুই ভগিনী একত্র থাকিবেন, মহাশয়ও আমার বাটীতে যেমন ভাবে ইচ্ছা তেমনই ভাবে থাকিবেন।”
এই শুনিয়া রাজমোহন ভ্রূভঙ্গ করিয়া মাধবের প্রতি চাহিয়া সক্রোধে বলিল,-“না মহাশয়, প্রাণ থাকিতে এমন কখনও পারিব না।”
এই বলিয়া রাজমোহন তদ্দণ্ডেই শ্বশুরালয় হইতে প্রস্থান করিল।
পরদিন প্রাতে রাজমোহন প্রত্যাগমন করিল, এবং মাধবকে পুনরায় কহিল, “মহাশয়, সপরিবারে দূরদেশে যাওয়া আমি পারৎপক্ষে স্বীকার নাহি, কিন্তু কি করি, আমার নিতান্ত দুর্দ্দশা উপস্থিত, সুতরাং আমাকে যাইতেই হইতেছে; কিন্তু একটা পৃথক্ ঘর-দ্বারের বন্দোবস্ত না হইলে যাওয়া যায় না।”
যাচকের যাঞ্ছার ভঙ্গী পৃথক্, নিয়মকর্ত্তার ভঙ্গী পৃথক্। মাধব দেখিলেন, রাজমোহন যাচক হইয়া নিয়মকর্ত্তার ন্যায় কথাবার্ত্তা কহিতেছেন; কিন্তু মাধব তাহাতে রুষ্ট না হইয়া বলিলেন, “তাহার আশ্চর্য্য কি? মহাশয় যাইবার পর পক্ষমধ্যে প্রস্তুত বাটী পাইবেন।”
রাজমোহন সম্মত হইল; এবং মাতঙ্গিনীর সহিত মাধবের পশ্চাতে রাধাগঞ্জে যাত্রা করিল।
রাজমোহনের এইরূপ অভিপ্রায় পরিবর্ত্তনের তাৎপর্য্য কি, তাহা প্রকাশ নাই। ফলতঃ এমত অনেকের বোধ হইয়াছিল যে, রাজমোহন এক্ষণে বাটী থাকিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক হইয়াছিল; অনিচ্ছার কারণ কি, তাহাও প্রকাশ নাই।
রাধাগঞ্জে উপস্থিত হইয়া মাধব রাজমোহনকে কার্য্যের নামমাত্র ভার দিয়া অতি সুন্দর বেতন নির্দ্ধারণ করিয়া দিলেন; গৃহ নির্ম্মাণ করিতে নিষ্কর ভূমি প্রদান করিলেন; এবং নির্ম্মণ প্রয়োজনীয় তাবৎ সামগ্রী আহরণ করিয়া দিলেন।
রাজমোহন বিনা নিজ ব্যয়ে নিজোপযুক্ত পরিপাটী গৃহ স্বল্পকাল মধ্যে নির্ম্মাণ করিলেন। সেই গৃহের মধ্যেই এই আখ্যায়িকার সূত্রপাত।
রাজমোহন যদিও উচ্চ বেতন-ভোগী হইলেন, কিন্তু মাধব সন্দেহ করিয়া কোনও গুরুতর কার্য্যের ভার দিলেন না।-প্রতিপালনার্থ বেতন দিলেন মাত্র। রাজমোহনের কালক্ষেপনের উপায়াভাব প্রযুক্ত মাধব তাহাকে কৃষকের দ্বারা কর্ষণার্থ বহু ভূমি দান করিলেন; রাজমোহন প্রায় এই কার্য্যেই ব্যাপৃত থাকিতেন।
এইরূপে মাধবের নিকট শোধনাতীত উপকার প্রাপ্ত হইয়া রাজমোহন কোন অংশে কখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেন না। রাধাগঞ্জে আসা অবধি রাজমোহন, মাধবের প্রতি অপ্রীতিসূচক এবং অপ্রীতিজনক ব্যবহার করিতে লাগিলেন; উভয়ের সাক্ষাৎ সম্ভাবনাদি অতি কদাচিৎ সংঘটন হইত। এইরূপ আচরণে মাধব কখন দৃকপাত করিতেন না-দৃকপাত করিলেও তদ্ধেতু বিরক্তি বা বদান্যতার লাঘব জন্মাইত না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, মাতঙ্গিনী ও হেমাঙ্গিনী পরস্পর প্রাণতুল্য ভালবাসিতেন, তথাপি তাঁহাদের প্রায় সাক্ষাৎ হইত না। হেমাঙ্গিনী কখন কখন স্বামীকে অনুরোধ করিয়া অগ্রজা সন্নিধানে শিবিকা প্রেরণ করিতেন; কিন্তু রাজমোহন প্রায় মাতঙ্গিনীকে ভগিনীগৃহে গমন করিতে দিতেন না। হেমাঙ্গিনী মাধবের স্ত্রী হইয়াই বা কিরূপে রাজমোহনের বাটীতে আসেন?

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

এক্ষণে আখ্যায়িকার সূত্র পুনঃগ্রহণ করা যাইতেছে। পুষ্পোদ্যান হইতে মাধব বাটীতে প্রত্যাগমন করিলে একজন পত্র-বাহক তাঁহার হস্তে একখানি লিপি প্রদান করিল। লিপির শিরোনামার স্থলে “জরুরি” এই শব্দ দৃষ্টে মাধব ব্যস্ত হইয়া পত্রপাঠে নিযুক্ত হইলেন। সদর মোকামে যে ব্যক্তি তাঁহার মোক্তার নিযুক্ত ছিল, সেই ব্যক্তি এই পত্র প্রেরণ করিয়াছিল। পত্রের মর্ম্ম নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ-
“মহিমার্ণবেষু-
অধীন এ মোকামে থাকিয়া হুজুরের মোকদ্দমা জাতের তদ্বিরে নিযুক্ত আছে, এবং তাহাতে যেমত যেমত আবশ্যক তাহা সাধ্যমত আমলে আনিতেছে। ভরসা করি সর্ব্বত্র মঙ্গল ঘটনা হইবেক। সম্প্রতি অকস্মাৎ যে এক গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে তাহা হুজুরের গোচরে নিবেদন করিতে অধীনের সাহসাভাব। হুজুরের শ্রীমতী খুড়ী ঠাকুরাণীর উকিল হুজুরের নামে অদ্য এ মোকামের প্রধান সদর আপিল আদালতে এই দাবিতে মোকদ্দমা রুজু করিয়াছেন যে, রামগোপাল ঘোষ মহাশয়ের উইলনামা সম্পূর্ণ মিথ্যা তঞ্চক-হুজুর কর্ত্তৃক জাল উইল প্রস্তুত হইয়া বিষয়াদি হইতে তেঁহ বেদস্ত হইয়াছেন। অতএব সমেৎ ওয়াশিলাত তাবৎ বিষয়ে দখল পাওয়ার ও উইল রদের দাবি ইত্যাদি।”
পত্রী মাধবের হস্তলিখিত হইয়া ভূপতিত হইল। মনে যে তাঁহার কিরূপ ক্রোধাবির্ভাব হইল তাহা বর্ণনা করা দুষ্কর। বহুক্ষণ চিন্তার পর পত্রী মৃত্তিকা হইতে উত্তোলন করিলেন, এবং ললাটের স্বেদস্রুতি করদ্বারা বিলুপ্ত করিয়া পুনঃপাঠে প্রবৃত্ত হইলেন। যথা-
“ইঁহার ছলাদার কে, তাহা অধীন এ পর্য্যন্ত জানিতে পারে নাই; কিন্তু অধীন অনেক অনুসন্ধান করিতেছে ও করিবেক। ফলে এমত বোধ হয় না যে, বিনা ছলা স্ত্রীলোক এরূপ নালিশ উত্থাপন করিবেন। অধীন অদ্য পরম্পরায় শ্রুত হইল যে, কোনও অতি প্রধান ব্যক্তির কুপরামর্শমতে এ ঘটনা উপস্থিত হইয়াছে।”
মাধব মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন যে, এমত ব্যক্তি কে, যে কুপরামর্শ দিয়াছে? মাধব অনেক ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কখন একজন প্রতিযোগী প্রতিবাসীর প্রতি সন্দেহ, কখনও বা অপরের প্রতি সন্দেহ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনও সন্দেহ সমূলক বলিয়া বোধ হইল না।
পত্রপাঠে পুনঃপ্রবৃত্ত হইলেনঃ-
“অধীনের বিবেচনায় হুজুরের কোনও শঙ্কা নাই, কেন না, ‘যতো ধর্ম্মঃ ততো জয়’, কিন্তু যেরূপ বিপক্ষের সহায় দেখা যাইতেছে, তাহাতে সতর্কতার আবশ্যক।-বাবুদিগের এক্ষণে ওকালতনামা দেওয়া আবশ্যক-পশ্চাৎ সময়ে সময়ে সদর হইতে উকীল কৌন্সিলী আনান কর্ত্তব্য হইবেক। তৎপক্ষে হুজুরের যেমন মর্জি। আজ্ঞাধিন প্রাণপণে হুজুরের কার্য্যে নিযুক্ত রহিল-সাধ্যানুসারে ত্রুটি করিবেক না। ইতি তারিখ-
আজ্ঞানুবর্ত্তী শ্রীহরিদাস রায়”।
“পুনশ্চ নিং-
আপাততঃ মোকদ্দমায় খরচ প্রায় হাজার টাকার আবশ্যক হইবেক। যেরূপ হুজুর বুঝিবেন সেইরূপ করিবেন।”
পত্রপাঠ সমাপন মাত্র মাধব, খুল্লতাত-পত্নীর অনুসন্ধানে পুরমধ্যে চলিলেন। ক্রোধে কলেবর কম্পিত হইতেছিল, অতি তরল পদবিক্ষেপে গমন করিতে লাগিলেন;-তাঁহাকে খুল্লতাত-পত্নী কোন্ মুখে জাল সাজ বলিয়া বিচারাগারে ব্যক্ত করিয়াছেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, এবং তৎক্ষণাৎ খুড়ীকে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিবেন স্থির করিলেন।
পুরমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে, সন্ধ্যাকাল পাইয়া অন্তঃপুরবাসিনীরা যে হট্টগোল উপস্থিত করিয়াছেন, তাহাতে কর্ণপাত করাই কষ্ট, কথার উত্তর পাওয়া দূরে থাকুক। কোথাও কোন রূপসী-একে স্থূলাকার তাহাতে মেঘের বর্ণ-নানা মত চিৎকার করিয়া এটা ওটা সেটা চাহিতেছে, এবং নানামত মুখভঙ্গী অঙ্গভঙ্গী করিতেছে,-যেন একটা ক্ষুদ্র হস্তিনী কেলি করিতেছে। কোথাও একটি পরিচারিকা তদ্রূপ বিশাল দেহপর্ব্বত লইয়া ব্যস্ত-প্রায় বিবসনা-গৃহ মার্জ্জন করিতেছে; এবং যেমন ত্রিশূলহস্তে অসুরবিজয়িনী প্রমথেশ্বরী প্রতিবার শূলাঘাতে অসুরদল দলিত করিয়াছিলেন, পরিচারিকাও করাল সম্মার্জ্জনী হস্তে রাশি রাশি জঞ্জাল, ওজলা, তরকারির খোসা প্রভৃতি দলিত করিতেছিল, এবং যে আঁটকুড়ীরা এত জঞ্জাল করিয়াছিল তাহাদিগের পতিপুত্রের মাথা মহাসুখে খাইতেছিল। কোথাও অপরা কিঙ্করী আঁস্তাকুড়ে বসিয়া ঘোররবে বাসন মাজিতেছিল,-পাচিকার অপরাধ, সে কেন কড়া বগুনায় পাক করিয়াছিল?-তাই কিঙ্করীর এ গুরুতর কর্ম্মভোগ; যেমন মার্জ্জনা-কার্য্যে তাহার বিপুল করযুগল ঘর্ ঘর্ শব্দে চলিতেছিল, রসনাখানিও তদ্রূপ দ্রুতবেগে পাচিকার চতুর্দ্দশ পুরুষকে বিষ্ঠাদি ভোজন করাইতেছিল। পাচিকা স্বয়ং তখন স্থানান্তরে, গৃহিণীর সহিত ঘৃত লইয়া মহা গোলযোগ করিতেছিলেন, আঁস্তাকুড়ে যে তাঁহার পূর্ব্ব-পুরুষের আহারাদির পক্ষে এমন অন্যায় ব্যবস্থা হইতেছিল, তাহা কিছুমাত্র জানিলেন না-ঘৃতের বিষয়ে একেবারে উন্মত্তা। গৃহিণী পাকার্থ যতটুকু ঘৃত প্রয়োজন ততটুকু দিয়াছেন, কিন্তু পাচিকা তাহাতে সন্তুষ্টা নহেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, যতটুকু পাকার্থ আবশ্যক তাহার দ্বিগুণ ঘৃত কোন সুযোগে লওয়াই যুক্তি; কারণ, অর্দ্ধেক পাক হইবে, অর্দ্ধেক আত্মসেবার জন্য থাকিবে।
কোথাও বা দারুণ বঁটীর আঘাতে মৎস্যকুল ছিন্নশীর্ষ হইয়া ভূমিতে লুটাইতেছিল, কোথাও বা বালক-বালিকার দল মহানন্দে ক্রীড়া করিতেছিল। পুরসুন্দরীরা কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে প্রদীপ-হস্তে যাতায়াত করিতেছিলেন; মলের শব্দ কোথাও ঝণাৎ ঝণাৎ, কোথাও রুণ্ রুণ্, কোথাও বা ঠুণু, ঠুণু; আর যেমন বয়স তার মলও তেমনই বাজিতেছিল। কখন বা বামাসুরে রামী বামী শ্যামীর ডাক পড়িতেছিল। পাড়ার গোটা দুই অধঃপেতে ছেলে নিজ নিজ পৌরুষ প্রকাশের উপযুক্ত সময় পাইয়া মল্লযুদ্ধ উপলক্ষে উঠানে চুল ছেঁড়াছিঁড়ি করিতেছিল। কতকগুলিন বালিকা কলরব করিয়া আগডুম বাগডুম খেলিতেছিল।
মাধব এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া হতাশ হইলেন; এ ঘোর কলরবের মধ্যে যে কেহ তাহার কথা শুনিতে পাইবে, এমত ভরসা রহিল না। তিনি অষ্টমে উঠিয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন, “বলি, মাগীরা একটু থাম্‌বি।” এই বলিয়া উঠানে গিয়া মল্লযোদ্ধা-বালকদ্বয়ের মধ্যে একজনকে কেশাকর্ষণ করিয়া দুই-চারি চপেটাঘাত করিলেন।
একেবারে আগুনে জল পড়িল;- ঘোরতর কোলাহল পলকমধ্যে আর নাই, যেন ভোজবাজিতে সকলই তিরোহিত হইল। যে স্থূলাঙ্গিনী আকাশকে সম্বোধন করিয়া বিবিধ চীৎকার ও মুখভঙ্গি করিতেছিলেন, তাঁহার কণ্ঠ হইতে অর্দ্ধনির্গত চীৎকার অমনি কণ্ঠেই রহিয়া গেল, হস্তিনীর ন্যায় আকারখানি কোথায় যে লুক্কায়িত হইল তাহা আর দেখিতে পাওয়া গেল না; সমার্জ্জনীহস্তে যিনি বিবসনে বিষম ব্যাপার করিতেছিলেন, তিনি অমনি করস্থ ভীম প্রহরণ দূরে নিক্ষেপ করতঃ রণক্ষেত্র হইতে পলায়ন আরম্ভ করিলেন, কিন্তু প্রায়-বসনহীন, মাংসরাশি কোথায় লুকাইবেন স্থান না পাওয়ায় এ কোণ ও কোণ করিতে লাগিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে মেঝেতে কে জল ফেলিয়াছিল-পরিচারিকা দ্রুতপদে বিবসন শরীর লইয়া যেমন পলাইবেন, অমনি পা পিছলাইয়া চীৎপাত হইয়া ভূ-শায়িনী হইলেন; যিনি পাত্রাদি মার্জ্জনে হাত মুখ দুই ঘুরাইতে ঘুরাইতে পাচিকার পিতৃপুরুষের পিণ্ডাদির ব্যবস্থা করিতেছিলেন, তাঁহার একটা লম্বা গালির ছড়া আধখানা বই বলা হইল না-হাত ঘুরিতে ঘুরিতে যেমন উঁচু হইয়াছিল তেমনই উঁচু রহিয়া গেল; মৎস্যদল-দলনী বারেক নিস্তব্ধ হইলেন, পশ্চাৎ কার্য্যারম্ভ করিলেন বটে, কিন্তু আর তাদৃশ ঘটা রহিল না; রন্ধনশালার কর্ত্রী যে ঘৃতের কারণ বক্তৃতা আরম্ভ করিয়াছিলেন, অকস্মাৎ তাহা হইতে নিবৃত্ত হইয়া পলায়নতৎপরা হইলেন–অন্যমনস্কপ্রযুক্তই হউক, আর তাড়াতাড়িতে বিবেচনার অভাববশতঃই হউক, পাচিকা পলায়নকালে পূর্ণভাণ্ড ঘৃত হইয়া চলিয়া গেল-পাচিকা ইতিপূর্ব্বে কেবল অর্দ্ধভাণ্ড মাত্র ঘৃতের প্রার্থিতা ছিলেন; যে পুর-সুন্দরীরা প্রদীপহস্তে কক্ষে কক্ষে গমনাগমন করিতেছিলেন, তাঁহারা সকলে ত্রস্তে পলাইয়া লুক্কায়িত হইলেন, পলায়নকালে মলগুলি একেবারে ঝন্ ঝন্ করিয়া বাজিয়া উঠিল-হস্তের দীপসকল নিবিয়া গেল।
যে শিশু মল্লযোদ্ধাটি মাধবের চপেটাঘাত খাইয়াছিলেন, তিনি বীরত্বের এমত নূতনতর পুরস্কার প্রাপ্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ রণস্থলী হইতে বেগে প্রস্থান করিয়াছিলেন-দ্বিতীয় যোদ্ধাও সময়ের গতিক তাদৃশ সুবিধাজনক নয় বুঝিয়া রণে ভঙ্গ দিলেন, কিন্তু যেমন ঘটৎকচ মৃত্যুকালেও পিতৃবৈরী নষ্ট করিয়াছিলেন, ইনিও তেমনই পলায়নকালে বিপক্ষের ঊরুদেশে একটি পদাঘাত করিয়া গেলেন, যে বালিকাগণ কলরব-সহকারে খেলিতেছিল, তাহারা খেলা ত্যাগ করিয়া পলায়নতৎপর বীরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল-ভয় হইয়াছে, কিন্তু হাসিটা একেবারে থামিল না। যে অন্তঃপুর এতক্ষণ অতি ঘোর কোলাহলপরিপূর্ণ ছিল, তাহা এক্ষণে একেবারে নীরব। কেবল মাত্র গৃহিণী-অবিকৃত কান্তিমতী হইয়া-বাবুর সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলেন।
মাধব তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “কি মাসী, আমার বাড়ীতে বাজার!”
মাসী মৃদুহাস্য করিয়া কহিলেন, “বাছা, মেয়ে মানুষের স্বভাব বকা।”
মাধব কহিলেন, “খুড়ী কোথা, মাসী?”
উত্তর-“আমিও তাই ভাবিতেছিলাম, আজ সকাল বেলা হ’তে কেহই তাঁহাকে দেখে নাই।”
মাধব বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, “সকাল অবধি নাই! তবে সকলই সত্য!”
মাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি সত্য বাপু?”
মাধব। কিছু না-পশ্চাৎ বলিব। খুড়ী তবে কোথায়? কাহারও সঙ্গে কি তাঁহার আজও দেখা হয় নাই?
গৃহিণী ডাকিয়া কহিলেন, “অম্বিকা, শ্রীমতী! তোরা কেহ দেখেছিস?”
তাহারা সকলে সমস্বরে উত্তর করিল “না।”
মাধব কহিলেন, “বড়ই আশ্চর্য্যের কথা।”
পরে অন্তরাল হইতে একজন স্ত্রীলোক মৃদুস্বরে কহিল, “আমি নাবার বেলা বড় বাড়ীতে তাঁকে দেখেছিলাম।”
মাধব অধিকতর বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিলেন, “বড় বাড়ীতে? মথুর দাদার ওখানে!”
তাঁহার মনোমধ্যে এক নূতন সিদ্ধান্ত উপস্থিত হইল। ভাবিলেন, “তবে কি মথুর দাদার কর্ম্ম? না না, তা হ’তে পারে না-আমি অন্যায় দোষ দিতেছি”। পরে প্রকাশ্যে কহিলেন, “করুণা তুই বড় বাড়ীতে যা,-খুড়ীকে ডেকে আন্; যদি না আসেন, তবে কেন আস্‌বেন না, জিজ্ঞাসা করিস্।”

সপ্তম পরিচ্ছেদ

এদিকে মাতঙ্গিনী স্বামীকৃত তিরস্কারের পর শ্বশ্রূস্বসা কর্ত্তৃক নিজ শয়নকক্ষে আনীত হইলে কক্ষের দ্বার অর্গলবব্ধ করিয়া মনের দুঃখে শয্যাবলম্বন করিলেন। রাত্রে পাকাদি সমাপন হইলে শ্বশ্রূস্বসা তাঁহাকে আহারার্থে ডাকিলেন, কিন্তু মাতঙ্গিনী শয্যাত্যাগ করিলেন না। ননন্দা কিশোরী আসিয়া পিতৃষ্বসার সংযোগে অনেক অনুনয় সাধনাদি করিলেন; কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। অবশেষে তাঁহারা নিরস্ত হইলেন-মাতঙ্গিনী অনশনা রহিলেন।
মাতঙ্গিনী শয্যায় শুইয়া আপন অদৃষ্টের বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। মাতঙ্গিনীর প্রতি রুষ্ট হইলে রাজমোহন প্রায় শয়নাগারে আসিত না, সুতরাং অদ্য রাত্রে যে আসিবে না, ইহা মাতঙ্গিনী উত্তমরূপে জানিতেন না।
ক্রমে রজনী গভীরা হইল। একে একে গৃহস্থ সকলে নিদ্রামগ্ন হইলেন। সর্ব্বত্র নীরব হইল। মাতঙ্গিনীর শয়নকক্ষে প্রদীপ ছিল না। গবাক্ষরন্ধ্রের আচ্ছাদনীয় পার্শ্ব হইতে চন্দ্রালোক আসিয়া কক্ষতলে পড়িয়াছিল; তদ্ধেতু কক্ষের অংশবিশেষ ঈষৎ আলোকিত হইয়াছিল। তদ্ব্যতীত সর্ব্বত্র অন্ধকার।
প্রকৃত অপরাধে অপমানের যন্ত্রণা সততই এত তীক্ষ্ণ যে, যতক্ষণ না তৎসম্বন্ধীয় বিষময়ী স্মৃতি বিলোপিত হয়, ততক্ষণ মানবদেহে নিদ্রা অনুভূত হইতে পারে না। গ্রীষ্মাতিশয্যপ্রযুক্ত বক্ষঃস্থল হইতে অঞ্চল পদতলে প্রক্ষিপ্ত করিয়া উপাধান-ন্যস্ত বাম ভুজোপরে শিরঃ সংস্থাপন করিয়া মাতঙ্গিনী অশ্রুপূর্ণ লোচনে গৃহতলশোভিনী চন্দ্রপদরেখা প্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন। কেন? সে অমৃত শীতল কিরণ দৃষ্টে কত যে পূর্ব্বসুখ স্মৃতিপথগামী হইল, তাহা কে বর্ণনা করিতে পারে? কৈশোরে কত দিন প্রদোষকালে হেমাঙ্গিনীর সহিত গৃহ-প্রাঙ্গনে এক-শয্যায় শায়িনী হইয়া শিশু-মনোরঞ্জিনী উপকথা কখন বা শ্রবন করিতে করিতে নীলাম্বরবিহারী এই নিশানাথ প্রতি চাহিয়া থাকিতেন, তাহা মনে পড়িল। নীলাম্বর হইতে এই মৃদুল জ্যোতিঃ বর্ষিত হইয়া কত যে হৃদয়-তৃপ্তি জন্মাইত, এ বৃন্তোৎপন্ন কুসুমযুগলবৎ কণ্ঠলগ্না দুই সহোদরা তখন কত যে আন্তরিক সুখে উচ্চহাস্য হাসিতেন, তাহা স্মরণপথে লাগিল।
সেই এক দশা আর এই এক দশা। সে উচ্চহাস্য আর কাহার কণ্ঠে? সেই সকল প্রিয়জনই বা কোথায়? আর কি তাঁহাদের মুখ দেখিতে পাইবেন? আর কি তাঁহাদের সেই স্নেহপূর্ণ সম্বোধন কর্ণকুহরে সুধাবর্ষণ করিবে? মনঃপীড়াপ্রদান-পটু স্বামীর হস্তজ্বালিত কালাগ্নি অন্তর্দাহ ব্যতীত আর কিছু কি অদৃষ্টে আছে?
এই সকল দুঃখ চিন্তার মধ্যে একটি গূঢ় বৃত্তান্ত জাগিতেছিল। সে চিন্তা অনুতাপময়ী হইয়াও পরম সুখকরী। মাতঙ্গিনী এ চিন্তাকে হৃদয়-বহিষ্কৃত করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু পারিলেন না। এই গূঢ় ব্যাপার কি তাহা কনক ব্যতীত আর কেহ জানিত না।
দুঃখ-সাগর মনোমধ্যে মন্থন করিয়া তৎস্মৃতিলাভে মাতঙ্গিনী কখন মনে করিতেন, রত্ন পাইলাম; কখন বা ভাবিতেন, হলাহল উঠিল। রত্নই হউক, আর গরলই হউক, মাতঙ্গিনী ভাবিয়া দেখিলেন, তাঁহার কপালে কোন সুখই ঘটিতে পারে না। চক্ষুর্দ্বয় বারিপ্লাবিত হইল।
ক্রমে গ্রীষ্মাতিশয্য দুঃসহ হইয়া উঠিল; মাতঙ্গিনী গবাক্ষ-রন্ধ্র মুক্ত করিবার অভিপ্রায়ে শয্যা ত্যাগ করিয়া তদভিমুখে গমন করিলেন। মুক্ত করেন, এমত সময়ে যেন কেহ শনৈঃ পদসঞ্চারে সেই দিকে অতি সাবধানে আসিতেছিল-এমত লঘু শব্দ তাঁহার কর্ণপ্রবিষ্ট হইল।
‍জানেলাটি যেমন সচরাচর এরূপ গৃহে ক্ষুদ্র হয়, তদ্রূপই ছিল,-দুই হস্ত মাত্র দৈর্ঘ্য, সার্দ্ধেএক হস্ত মাত্র বিস্তার। এ প্রদেশে চালাঘরে মৃত্তিকার প্রাচীর থাকে না, দরমার বেষ্টনীই সর্ব্বত্র প্রথা। রাজমোহনের গৃহেও সেইরূপ ছিল; এবং জানালার ঝাঁপ ব্যতীত কাষ্ঠের আবরণী ছিল ন।
পার্শ্বে যে ছিদ্র দিয়া গৃহমধ্যে জ্যোৎস্না প্রবেশ করিয়াছিল, পদসঞ্চার শ্রবণে ভীতা হইয়া মাতঙ্গিনী সেই ছিদ্র বহির্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু নীলাম্বরস্পর্শী বৃক্ষশ্রেণীর শিরোভাগ ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না।
মাতঙ্গিনী জানিতেন, যে দিক্ হইতে পদসঞ্চার শব্দ তাঁহার কর্ণাগত হইল, সে দিক্ দিয়া মনুষ্য যাতায়াতের কোন পথ নাই; সুতরাং আশঙ্কা জন্মান বিচিত্র কি? মাতঙ্গিনী নিস্পন্দ শরীরে কর্ণোত্তলন করিয়া তথায় দণ্ডায়মান রহিলেন।
ক্রমশঃ পদক্ষেপণ শব্দ আরও নিকটাগত হইল; পরক্ষণেই দুই জন কর্ণে কর্ণে কথোপকথন করিতেছে শুনিতে পাইলেন। দুই-চারি কথায় মাতঙ্গিনী নিজ স্বামীর কণ্ঠস্বর চিনিতে পারিলেন। তাঁহার ত্রাস ও কৌতূহল দুই-ই সম্বর্দ্ধিত হইল। যথায় মাতঙ্গিনী গৃহমধ্যে দণ্ডায়মানা ছিলেন, আর যথায় আগন্তুক ব্যক্তিরা বিরলে কথোপকথন করিতেছিল, তন্মধ্যে দরমার বেষ্টনীমাত্র ব্যবধান ছিল। সুতরাং মাতঙ্গিনী তৎকথোপকথনের অনেক শুনিতে পাইলেন; আর যাহা শুনিতে পাইলেন না, তাহার মর্ম্মার্থ অনুভবে বুঝিতে পারিলেন।
এক ব্যক্তি কহিতেছিল, “অত বড় বড় করিয়া কথা কহ কেন? তোমার বাড়ীর লোকে যে শুনিতে পাইবে।”
দ্বিতীয় ব্যক্তি উত্তর করিল, “এত রাত্রে কে জাগিয়া থাকিবে?”
মাতঙ্গিনী কণ্ঠস্বরে বুঝিলেন, এ কথা রাজমোহন কহিল।
প্রথম বক্তা কহিল, “কি জানি যদি কেহ জাগিয়া থাকে, আমাদের একটু সরিয়া দাঁড়াইলে ভাল হয়।”
রাজমোহন উত্তর করিল, “বেশ আছি; যদি কেহ জাগিয়াই থাকে, তবে এ ছেঁচের ছায়ার মধ্যে কেহ আমাদিগকে ঠাওর পাইবে না, বরং সরিয়া দাঁড়াইলে দেখিতে পাবে।”
প্রথম বক্তা জিজ্ঞাসা করিল, “এ ঘরে কে থাকে?”
দ্বিতীয় বক্তা রাজমোহন উত্তর করিল, “সে কথায় দরকার কি?”
প্র ব। বলিতেই বা ক্ষতি কি?
দ্বি ব। এ আমার ঘর, আমার স্ত্রী ভিন্ন আর কেহ থাকেন না।
প্র ব। তুমি ঠিক জান ত, তোমার স্ত্রী ঘুমাইয়াছে?
দ্বি ব। বোধ করি ঘুমাইয়াছে, কিন্তু সেটা ভাল করিয়া জানিয়া আসিতেছি, তুমি এখানে ক্ষণেক দাঁড়াও।
মাতঙ্গিনী পুনরায় পদক্ষেপণ শব্দ শুনিতে পাইলেন; বুঝিলেন, রাজমোহন বাটীর ভিতর আসিতেছে। মাতঙ্গিনী নিঃশব্দে গবাক্ষ সন্নিধান হইতে সরিয়া শয্যায় আসিলেন; এবং এমত সাবধানে তদুপরি আরোহণ করিলেন যে, কিঞ্চিন্মাত্র পদশব্দ হইল না। তথায় নিমীলিত নেত্রে শয়ন করিয়া একান্ত নিদ্রাভিভূতার ন্যায় রহিলেন।
রাজমোহন আসিয়া দ্বারে মৃদু মৃদু করাঘাত করিল। পত্নী আসিয়া দারোদ্ঘাটন করিল না। তখন রাজমোহন মৃদুস্বরে মাতঙ্গিনীকে ডাকিতে লাগিল; তথাপি দ্বারোন্মোচিত হইল না। রাজমোহন বিবেচনা করিল, মাতঙ্গিনী নিদ্রিতা। তথাপি কি জানি এমনই হয় যে, মাতঙ্গিনী সন্ধ্যাকালে ব্যাপারে অভিমানিনী হইয়া নীরব আছেন, এই সন্দেহে রাজমোহন কৌশলে কক্ষাভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে যত্ন করিল। পাকাশালায় গমন করিয়া তথাকার প্রদীপ জ্বালিয়া আনিল; দ্বারের নিকটে প্রদীপ রাখিয়া এক হস্তে একখানা কপাট টানিয়া রাখিয়া এক পদে দ্বিতীয় কবাট ঠেলিয়া ধরিল,-এইরূপে দুই কবাটমধ্যে অঙ্গুলিপ্রবেশের সম্ভাবনা হইলে, দ্বিতীয় হস্তের অঙ্গুলি দ্বারা পরীক্ষা করিয়া দেখিল যে, মাতঙ্গিনী, রাজমোহন স্বেচ্ছাকৃত শয়নাগারে প্রবেশ করিতে পারে, এই অভিপ্রায় কেবলমাত্র কাষ্ঠের “খিল” দিয়া দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন। রাজমোহন অনায়াসে “খিল” বাহির হইতে উদ্ঘাটিত করিল, এবং প্রদীপহস্তে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল।
রাজমোহন দেখিল যে, মাতঙ্গিনীর মুখকান্তি যথার্থ সুষুপ্তি-সুস্থিরের ন্যায় রহিয়াছে। বার কয়েক তাঁহাকে ডাকিল; কোন উত্তর পাইল না। যদি পত্নী অভিমানে নিরুত্তরা থাকে তবে অভিমান ভঞ্জনার্থ দুই চারিটা মিষ্ট কথা কহিল; তথাপি মাতঙ্গিনী নিঃশব্দ রহিয়াছেন, ও ঘন ঘন গভীর শ্বাস বহিতেছে দেখিয়া মনে নিশ্চিত বিবেচনা করিল, মাতঙ্গিনী নিদ্রিতা। সে নিদ্রার ছল করিবে কেন? অতঃপর নিঃসন্দিগ্ধমনে পূর্ব্ব কৌশলে দ্বার বন্ধ করিয়া অন্য কক্ষদ্বারে গমন করিলে দ্বারে দ্বারে সকলকে মৃদুস্বরে ডাকিল, কেহই উত্তর দিল না; সুতরাং সকলেই নিদ্রামগ্ন বিবেচনায় রাজমোহন প্রদীপ নির্ব্বাপিত করিয়া আগন্তুক ব্যক্তির নিকট গমন করিল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

মাতঙ্গিনী পুনর্ব্বার নিঃশব্দে পদসঞ্চারে শয্যা ত্যাগ করিয়া গবাক্ষসান্নিধ্যে গমন করিলেন; এবং নিম্নোদ্ধৃত মত কথোপকথন শ্রবণ করিলেন।
সকলেই নিদ্রিত, এ সংবাদ রাজমোহন প্রমুখাৎ শ্রবণ করিয়া আগন্তুক কহিল, “তুমি আমাদের এ উপকার করিতে তবে স্বীকার আছ?”
রাজমোহন কহিল, “বড় নহি-আমি কিন্তু তা বলিয়া ভালমানুষির বড়াই করিতেছি না; তবু নেমকহারামি; আমি লোকটাকে দু’চক্ষে দেখিতে পারি না বটে, কিন্তু আমার উপকার অনেক করিয়াছে।”
অপরিচিত ব্যক্তি কহিল, “উপকার করিয়াছে, তবে দেখিতে পার না কেন?”
রাজ। উপকার করেছে, কিন্তু মন্দও করেছে। আমার ভাল কর, কর, না কর-সে তোমার ইচ্ছা; কিন্তু আমায় যে দুঃখ দেয়, সে শত উপকার করিলেও তার মাপ নাই।
অপরিচিত। তবে আর নেমকহারামি কি? আমাদের কাজে লাগিবে?
রাজ। লাগি, যদি যা চাই, দাও। আমার ইচ্ছা এখানকার বাস উঠাই-ওর কাছে না থাকিতে হয়। কিন্তু যাই কি নিয়ে-হাত খালি; দেশে গেলে বাঁচি কি মরি। তাই আমি এমন এক হাত মারিতে চাই যে, সেই টাকায় অন্যত্র আমার কিছুকাল গুজরাণ হয়। যদি তোমাদের এ কর্ম্মে এমন হাত মারিতে পারি, তা হলে লাগিব না কেন? লাগিব।
অপ। আচ্ছা, কি নেবে বল?
রাজ। তুমি আগে বল দেখি আমায় কি করিতে হইবে?
অপ। যাহা বরাবর করেছ তাহাই করিবে; মাল বই করিয়া দিবে। এইবার মনে করিতেছি যে, নগদ ছাড়া যা কিছু পাইব তা তোমার কাছে রেখে যাব।
রাজ। বুঝেছি, আমি নইলে তোমার কাজ চলিবে না। তোমরা বেশ বুঝেছ যে, এত বড় বাড়ীতে একটা কর্ম্ম হইলে এ দিকেও বড় গোলযোগ হইয়া উঠিবে; রাঁড়ী বালতির বাড়ী নয় যে, দারোগা বাবু কিছু প্রণামী লইয়া স্বচ্ছন্দে দেখনহাসির বাড়ীতে বসিয়া ইয়ারকি মারিবে। একটা তল্লাস তাগাদার বড় রকম সকমই হইয়া উঠিবে; তাহা হইলে সোণা কোলে করিয়া বসিয়া থাকিলে ত হইবে না। তাই তোমরা চাও যে, যত দিন না লেঠাটা মিটে তত দিন আমার কাছে সব থাকে। তা বড় মন্দ মতলব নয়; আর আমারও এমত যুত বরাত আছে যে, কোন শালা খড়্‌কে গাছটিও টের পাবে না। বিশেষ আমি ভায়রা ভাই, আমাকে কোন্ শালা শেষ করবে? অতএব আমার দ্বারা যে কাজ হবে, আর কাহারও দ্বারা তেমনটি হবে না। কিন্তু আমার সঙ্গে বনিয়া উঠা ভার।
অপ। যদি ভাই এতই বুঝিতেছ, তবে কেন বনাইয়া লও না।
রাজ। আমি দশ কথা পাঁচ কথার মানুষ নই; প্রাণ চায় দাও-না হয়, আপনার কর্ম্ম আপনি কর,-সিকিভাগ চাই।
দস্যু। ভালরূপ জানিত যে, রাজমোহনের এ বিষয়ে কাজে কথায় এক, অপহৃত দ্রব্যের চতুর্থাংশের ন্যূন সে সহায়তা করিতে স্বীকার হইবে না; অতএব বাক্যব্যয় বৃথা। কিয়ৎক্ষণচিন্তা করিয়া কহিল, “আমি সম্মত হইলাম। তাদের একবার জিজ্ঞাসার আবশ্যক, তা তারা কিছু আমার মত ছাড়া হবে না।”
রাজমোহন উত্তর করিল, “তাতে সন্দেহ কি? কিন্তু আর একটা কথা আছে। যা আমার কাছে থাকিবে, তার আমরা একটা মোটামুটি দাম ধরিব; ইহারই সিকি তোমরা আমাকে নগদ দিয়া যাবে; তার পর মহাজনে কম দেয় আমি কম্‌তির সিকি ফেরত দিব, আর বেশী দেয় তোমরা আমাকে বেশীটা দেবে।”
দস্যু। তাই হবে; কিন্তু আমারও আর একটি কথা আছে। তোমাকে আর একটি কাজ করিতে হইবে।
রাজ। আর এক মুঠো টাকা।
দস্যু। তা ত বটেই। আমরা মাধব ঘোষের যথাসর্ব্বস্ব লুঠিব, সে কেবল আমাদের আপনাদেরই জন্য; কিন্তু পরের একটা কাজ আছে।
রাজমোহন কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি কাজ?”
দস্যু। তাহার খুড়ার উইলখানা চাই।
রাজমোহন কিছু চমকিয়া কহিল, “হুঁ।”
দস্যু। কহিল, “হুঁ, কিন্তু উইলখানা কোথায় আছে আমরা তা জানি না। আমরা ত সমস্ত রাত্রি কেবল কাগজ উটকাইয়া বেড়াইতে পারব না। কোথায় আছে সে খবরটা তুমি অবশ্য জান।”
রাজ। জানি; কিন্তু কাহার জন্য উইল চাই?
দস্যু। তাহা কেন বলিব?
রাজ। কেন, আমাকেও বলিবে না?-আমার কাছে লুকাইবার আবশ্যক?
দস্যু। তোমাকেও বলিতে বারণ।
রাজ। মথুর ঘোষ?
দস্যু। যেই হউক-আমাদের বাদশার মুখ নিয়ে কাজ। যেই হউক, কিছু মজুরি দেবে, আমরা কাজ তুলে দেব।
রাজ। আমারও ঐ কথা।
দস্যু। উইল পাব কোথায়?
রাজ। আমায় কি দিবে বল?
দস্যু। তুমি বল না।
রাজ। পাঁচ শত খানি দিও; তোমরা পাবে ঢের, দিলেই বা।
দস্যু। এটা বড় জিয়াদা হইতেছে; আমরা মোটে দুই হাজার দক্ষিণা পাইব, তার মধ্যে সিকি দিই কেমন করে।
রাজ। তোমাদের ইচ্ছা।
দস্যু। পুনর্ব্বার চিন্তা করিয়া কহিল, “আচ্ছা, তাই সই; আমার ঢের কাজ আছে, আমি কাগজ হাঁটকাইয়া বেড়াইলে চলিবে না। নয়ত কোনও ছোঁড়া ফোঁড়ার হাতে পড়িবে, আর পুড়াইয়া ফেলিবে-পাঁচ শতই দেব।”
রাজ। মাধবের শুইবার খাটের শিয়রে একটা নতুন দেরাজ-আলমারি আছে; তাহার সব নীচের দেরাজের ভিতর একটা বিলিতী টিনের ছোট বাক্‌সতে উইল, কবালা, খত ইত্যাদি রাখিয়া থাকে; আমার গোপন খবর জানা আছে।
দস্যু। ভাল কথা; যদি এ লেঠা চুকিল, তবে চল জুটি গিয়া। কর্ম্ম হইয়া গেলে যেখানে আসিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করিব, তাহা সকলে থেকে স্থির করা যাইবে। এস, আর দেরি করে কাজ নেই; চাঁদনি ডুবিলে কর্ম্ম হবে-এখনকার রাত ছোট।
এই কহিয়া উভয়ে ধীরে ধীরে গৃহের ছায়াবরণ হইতে বনের দিকে প্রস্থান করিল। মাতঙ্গিনী বিস্মিত ও ভীতি-বিহ্বলা হইয়া ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।

নবম পরিচ্ছেদ

মাতঙ্গিনী অন্তরালে থাকিয়া তাবৎ শুনিয়াছিলেন। এই বিষম কু-সঙ্কল্পকারিদিগের মুখনির্গত যতগুলি শব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, ততগুলি বজ্রাঘাত তাঁহার বোধ হইয়াছে। যতক্ষণ না কথোপকথন সমাপ্ত হইয়াছিল, ততক্ষণ বসন্ত-বাতাহত অশ্বত্থ পত্রের ন্যায় তাঁহার ভীতি-কম্পিত তনু কোন মতে দণ্ডামান ছিল; কিন্তু কথা সমাপ্তি হইবামাত্র মাতঙ্গিনী আত্ম-বিবশা হইয়া ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।
প্রথমতঃ কিয়ৎক্ষণ ত্রাস ও উৎকট মানসিক যন্ত্রণার আধিক্য প্রযুক্ত বিমূঢ়া হইয়া রহিলেন; ক্রমে মনঃস্থির হইলে দৈব-প্রকাশিত এই বিষম ব্যাপার মনোমধ্যে পরিচালনা করিতে লাগিলেন। এ পর্য্যন্ত তিনি নিজ ভর্ত্তাকে সম্পূর্ণরূপে চিনিতেন না; আজ তাঁহার চক্ষুরুন্মীলিত হইল। চক্ষুরুন্মীলনে যে করাল মূর্ত্তি দেখিলেন, তাহাতে মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। এ পর্য্যন্ত মনে ভাবিতেন যে, বিধাতা তাঁহাকে ক্রোধ-পরবশ দুর্নীত ব্যক্তির পাণিগৃহিতী করিয়াছেন; আজ জানিলেন যে, তিনি দস্যুপত্নী-দস্যু তাঁহার হৃদয়-বিহারী।
জানিয়াই বা কি? দস্যু-স্পর্শ হইতে পলাইবার উপায় আছে কি? স্ত্রী-জাতি-পতিসেবাপরায়ণা দাসী-পতিত্যাগের শক্তি কোথায়? চিরদিন দস্যুপদে দেহ-রত্ন অর্পিত হইবে-গরলোদ্গীর্ণমান বিষধর হৃদয়-পথে আসীন থাকিবে, পাছে সে আন্দোলনে আসনচ্যুত হয় বলিয়া কখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতে পারিবে না। ইহা অপেক্ষা আর কি ভয়ঙ্কর ললাট-লিপি বিধাতার লেখনী হইতে নির্গত হইতে পারে?
মাতঙ্গিনী ক্ষণেককাল এইরূপ চিন্তা করিলেন; পরক্ষণেই যে দস্যুদল-সঙ্কলিত দারুণপ্রমাদ ঘটনা হইবে তাহাই মনোমধ্যে প্রখর তেজে প্রদীপ্ত হইতে লাগিল। আর কাহারই বা এই সর্ব্বনাশ ঘটনা হইবে? হেমাঙ্গিনীর সর্ব্বনাশ, মাধবের সর্ব্বনাশ! মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চ কণ্টকিত,-শোণিত শীতল হইতে লাগিল, মস্তক বিঘূর্ণিত হইতে লাগিল। যখন ভাবিলেন যে প্রিয় সহোদরা এক্ষণে এই নির্জ্জন নিশীথে হৃদয়বল্লভের কণ্ঠলগ্না হইয়া নিশ্চিন্ত মনে সুষুপ্তি সুখানুভব করিতেছে, সে মনেও জানে না যে, দারিদ্র্যরাক্ষসী তাহার পশ্চাতে মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে, এখনই গ্রাস করিবে; হয়ত ধনহানির সঙ্গে মানহানি, প্রাণহানি পর্য্যন্ত হইবে তখনই মাতঙ্গিনীর নিজ সম্বন্ধীয় মর্ম্মব্যথক ভূত ভবিষ্যত চিন্তা অন্তর্হিত হইল। মনে মনে স্থির বুঝিলেন যে, আমি না বাঁচাইলে হেমাঙ্গিনী ও মাধবের রক্ষা নাই, যদি প্রাণ পর্য্যন্ত পণ করিয়া তাহাদের রক্ষা করিতে পারি, তবে তাহাও করিব।
মাতঙ্গিনী প্রথমোদ্যমে মনে করিলেন, গৃহস্থ সকলকে জাগরিত করিয়া সকল ঘটনা বিবৃত করেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে ভাব অন্তর্হিত হইল; ভাবিলেন, তাহাতে কোন উপকার হইবে না। কেন না, রাজমোহনের আত্মপরিবার এমত অশ্রুতপূর্ব্ব সংবাদ বিশ্বাস হইবেক না; বিশ্বাস করিলেও মাধবের উপকারার্থ রাজমোহনের বিরুদ্ধাচারী হইবেক না। বরং লাভের মধ্যে তাহারা রাজমোহনের নিকট মাতঙ্গিনীকে এতদ্বিষয়ে সংবাদ-দাত্রী বলিয়া পরিচিত করিলে মাতঙ্গিনীর মহাবিপদ্ সম্ভাবনা।
পশ্চাৎ বিবেচনা করিলেন যে, কেবল কনককে জাগ্রত করিয়া তাহাকে সকল সংবাদ অবগত করান; এবং যাহা উচিত হয় পরামর্শ করেন। তদভিপ্রায়ে মাতঙ্গিনী শয্যাত্যাগ করিয়া বাটীর বাহিরে আসিলেন। কনকের গৃহ সন্নিকট। মাতঙ্গিনী ধীরে ধীরে কনকের গৃহাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন।
চন্দ্রালোকে পৃথিবী প্রফুল্লিতা। মাতঙ্গিনী কনকের গৃহ দ্বারে উপনীত হইয়া ধীরে ধীরে করাঘাত করিলেন, কনকের নিদ্রাভঙ্গ হইতে না হইতে কনকের মাতা কহিল, “কে রে?”
সর্ব্বনাশ! কনকের মাতা অতিশয় মুখরা, মাতঙ্গিনীর এ কথা স্মরণই ছিল না। মাতঙ্গিনী ভয়ে নিঃশব্দ রহিলেন। কনকের মাতা পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে রে?” “কে রে?”
মাতঙ্গিনী সাহস করিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিল, “আমি গো।”
কনকের মাতা কোপযুক্ত স্বরে কহিল, “কে?-রাজুর বৌ বুঝি, এত রাত্রে তুমি এখানে কেন গা?”
মাতঙ্গিনী মৃদুস্বরে বলিলেন, “কনককে একটা কথা বলিব।”
কনকের মাতা বলিল, “রাত্রে কথা কি আবার একটা? সারাদিন কথা কয়ে কি আশ মেটে না? ভালমানুষের মেয়েছেলে রাত্রে এ-বাড়ী ও-বাড়ী কি গা? বউ-মানুষ, এখনই এ সব ধরেছ?-চল দেখি তোমার পিশেসের কাছে।”
মাতার তর্জ্জনে গর্জ্জনে কনকের নিদ্রাভঙ্গ হইল; বৃত্তান্ত বুঝিয়া কনক কহিল, “মা, দুয়ারটা খুলে দাও, শুনিই না কি বলে।”
কনকের মাতা গর্জ্জন করিয়া বলিল, “দেখ্ কন্‌কি, এমন মুড়ো ঝাঁটা তোর কপালে আছে।”
কনক নিস্পন্দ ও নির্ব্বাক্ হইল। মাতঙ্গিনী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন, এবং পুনরায় গভীর চিন্তায় অভিভূত হইলেন। ভাবিলেন, “কি করি? কেমন করে তাদের রক্ষা হয়? কে সংবাদ দিবে?-কে এ রাত্রে যাইবে? আমি আপনিই যাই, এ ছাড়া অন্য উপায় নাই।” পরক্ষণে ভাবিলেন-“কেমন করিয়া যাইব? লোকে কি বলিবে? মাধব কি মনে করিবে? শুধু তাহাই নহে, স্বামী জানিতে পারিলে প্রমাদ ঘটিবে। তাহা হউক-লোকে যাই বলুক-মাধব যাহা হয় মনে করুক-স্বামী যাহা করে করুক, তজ্জন্য মাতঙ্গিনী ভীতা নহে।”
কিন্তু মাতঙ্গিনী যাইতে সাহস করিলেন না। এ গভীর নিশীথকালে, এই নিস্তব্ধ বনান্ত পথ, তাহাতে আবার একাকিনী অবলা, নবীন বয়সী, বাল্যকালাবধি ভৌতিক উপন্যাস শ্রবণে হৃদয়মধ্যে ভৌতিক-ভীতি বিষম প্রবলা। পথ অতি দুর্গম। তাহাতে আবার দস্যুদল কোথায় জটলা করিয়া আছে; যদি তাহাদের করকবলিত হয়েন? এই কথা স্মৃতিমাত্র ভয়ে মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। যদি দস্যুদলমধ্যে মাতঙ্গিনী স্বামীর দৃষ্টিপথে পতিতা হয়েন? এই ভয়ে মাতঙ্গিনী পুনঃ পুনঃ রোমাঞ্চিত হইতে লাগিলেন।
স্বভাবতঃ মাতঙ্গিনীর হৃদয় সাহস-সম্পন্ন। যে অন্তঃকরণে স্নেহ আছে, প্রায় সে অন্তঃকরণে সাহস বিরাজ করে। প্রিয়তমা সহোদরা ও তৎপ্রতির মঙ্গলার্থ মাতঙ্গিনী প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে উদ্যত হইলেন। যেমন উপস্থিত বিপত্তির বিকট মূর্ত্তি পুনঃ পুনঃ মনোমধ্যে প্রকটিত হইতে লাগিল, অমনি মাতঙ্গিনীও হৃদয়গ্রন্থি দৃঢ়বদ্ধ হইতে লাগিল-তখন অগাধ প্রনয়-সলিলে ভাসমান হইয়া বলিলেন, “এ ছার জীবন কার আর কি জন্য? যদি এ সঙ্কল্পে প্রাণ রক্ষা না হয়, তাতেই বা ক্ষতি কি? এ গুরুভার বহন করা আমার পক্ষে কষ্টকর হইয়াছে। কাজেই এ দেহ ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করে। যাহারা প্রাণাধিক্ তাহাদের মঙ্গল সাধনে এ প্রাণ ত্যাগ না করি কেন? আমার ভয় কি? প্রাণনাশাধিক বিপদও ঘটিতে পারে; জগদীশ্বর রক্ষাকর্ত্তা।”
কিন্তু মাধবের বাটীতে এ নিশীথে একাকিনী কি প্রকারেই যান? মাতঙ্গিনীর চিন্তাকুলতা সহনানীত হইল।
কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া মাতঙ্গিনী দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া চিন্তাসম্বর্দ্ধিত গ্রীষ্মাতিশয্যের প্রতিকার হেতু জালরন্ধ্র সন্নিধানে গিয়া জালাবরণী উত্তোলন করিলেন। দেখিলেন যে, বিটপী শ্রেণীর ছায়া এক্ষণে দীর্ঘাকৃত হইয়াছে-অস্তাচলাভিমুখী নিশাললাটরত্ন প্রায়-দিগন্তব্যাপী বৃক্ষশিরোরাজির উপরে আসিয়া নির্ব্বাণোন্মুখ আলোক বর্ষণ করিতেছেন। আর দুই চারি দণ্ড পরে সে আলোক একেবারে নির্ব্বাপিত হইবে; তখন আর হেমাঙ্গিনীকে রক্ষা করিবার সময় থাকিবে না। বিপদ্ একেবারে সম্মুখে দেখিয়া মাতঙ্গিনী আর বিলম্ব করিলেন না।
মাতঙ্গিনী ঝটিতি এক খণ্ড শয্যোত্তরচ্ছদে আপাদমস্তক দেহ আবরিত করিলেন, এবং কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্তা হইয়া যে কৌশলপ্রভাবে ক্ষণপূর্ব্বে রাজমোহন বাহির হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়াছিলেন, মাতঙ্গিনীও তদ্রূপ করিলেন।
গৃহের বাহিরে দণ্ডায়মানা হইয়া যখন মাতঙ্গিনী ঊর্দ্ধে অসীম নীলাম্বর, চতুর্দ্দিকে বিজন বন-বৃক্ষের নিঃশব্দ নিস্পন্ত্র শিরঃশ্রেণীর নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, তখন পুনর্ব্বার সাহস দ্রবীভূত হইয়া গেল-হৃদয় শঙ্কাকম্পিত হইল-চরন অচল হইল। মাতঙ্গিনী অঞ্জলিবদ্ধ করে ইষ্টদেবের স্তব করিলেন। হৃদয়ে আবার সাহস আসিল; তিনি দ্রুতপাদবিক্ষেপে পথ বহিয়া চলিলেন।
বনময় পথ দিয়া যাইতে প্রভাতবাতাহত পদ্মের ন্যায় মাতঙ্গিনীর শরীর কম্পিত হইতে লাগিল। সর্ব্বত্র নিঃশব্দ; মাতঙ্গিনীর পাদবিক্ষেপশব্দ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল; স্থানে স্থানে নিবিড় ছায়ান্ধকারে অন্তঃকরণ শিহরিতে লাগিল। যত বৃক্ষের গুঁড়ি ছিল প্রত্যেককে করালবদন পৈশাচ মূর্ত্তি বলিয়া ভ্রম হইতে লাগিল, বৃক্ষে বৃক্ষে, শাখায় শাখায়, পত্রে পত্রে, নরঘ্ন প্রেত লুক্কায়িতভাবে মাতঙ্গিনীকে লক্ষ্য করিতেছে তাহা তাঁহার প্রতীতি হইতে লাগিল। যে যে স্থলে তমসা নিবিড়তর, সেই সেই স্থানে দুরন্ত ভূতযোনী বা দস্যুর প্রচ্ছন্ন শরীরের ছায়া মাতঙ্গিনীর চক্ষুর্জ্বালা উৎপাদন করিতে লাগিল। বাল্যকালে যত ভৌতিক উপন্যাস শ্রুত হইয়াছিল, নিশীথ পান্থের গহনমধ্যে বিকট পৈশাচ দংষ্ট্র ভঙ্গী সন্দর্শনে ভীতি-বিহ্বল হইয়া প্রাণত্যাগ করার যে সকল উপকথা শ্রবণ করিয়াছিলেন, সে সকলই একেবারে তাঁহার স্মরণপথে আসিতে লাগিল।
যদি কোথাও শাখাচ্যুত শুষ্কপত্র-পতন শব্দ হইল, যদি কোনও শাখারূঢ় নৈশ বিহঙ্গ পক্ষস্পন্দন করিল, যদি কোথাও শুষ্কপত্রমধ্যে কোন কীট দেহ সঞ্চালন করিল, অমনি মাতঙ্গিনী ভয়ে চমকিয়া উঠিতে লাগিলেন; তথাপি দৃঢ় সঙ্কল্প-বিবদ্ধা সাহসিকা তরুণী, কখন বা ইষ্টদেব নামজপ কখন বা প্রিয়জনগনের বিপত্তি চিন্তা করিতে করিতে চঞ্চলপদে উদ্দিষ্ট স্থানাভিমুখে চলিলেন।
ভয়সঙ্কুল নিবিড় তমসাচ্ছন্ন পথের এক পার্শ্বে বৃহৎ আম্র-কানন অপর পার্শ্বে এক দীর্ঘিকার পাহাড়। বন্য উচ্চভূমিখণ্ডমধ্যে পথ অতি সঙ্কীর্ণ; তদুপরি দীর্ঘিকার উপর প্রকাণ্ডাকার কতিপয় বটবৃক্ষের ছায়ায় চন্দ্রালোকের গতি নিরুদ্ধ হইয়াছিল, সুতরাং এই স্থানে পথান্ধকার নিবিড়তর। দীর্ঘিকার পাহাড়ের বটবৃক্ষতল বহুতর লতাগুল্ম কণ্টক বৃক্ষাদিতে সমাচ্ছন্ন।
মাতঙ্গিনী ভীতি-চকিতনেত্রে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আম্র-কাননের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আলোক প্রদীপ্ত হইতেছিল, এবং অস্ফুটস্বরে বহু ব্যক্তির কথোপকথনের শব্দও মাতঙ্গিনীর কর্ণগোচর হইল।
মাতঙ্গিনী বুঝিলেন, যাহা ভর করিয়াছিলেন, তাহাই ঘটিল। এই আম্র-কাননের মধ্যে দস্যুদল জটলা করিতেছে। দুঃসময়ে বিপদ্ এক প্রকারে কেবল উপস্থিত হয় না;-পথিমধ্যে একটা কুকুর শয়ন করিয়াছিল, নিশাকালে পথিক দেখিয়া উচ্চরব করিতে লাগিল। আম্র-কাননের কথোপকথন তৎক্ষণাৎ বন্ধ হইল। মাতঙ্গিনী বুঝিতে পারিলেন যে, কুকুর-শব্দে দুরাত্মারা লোকসমাগত অনুভূত করিয়াছে; অতএব শীঘ্রই তাহারা কাছে আসিবে। আসন্নকালে মাতঙ্গিনী নিঃশব্দ গমনে দীর্ঘিকার জলের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন। আম্র-কানন বা পথ হইতে তাঁহাকে কেহ দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা রহিল না। কিন্তু যদি দস্যুরা দীর্ঘিকার তটারোহণ করিয়া পথিকের অণ্বেষণ করে, তাহা হইলে মাতঙ্গিনী তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিপথে পতিত হইবেন। নিকটে এমত কোন ক্ষুদ্র বৃক্ষলতাদি ছিল না যে, তদন্তরালে লুক্কায়িত হইতে পারেন। কিন্তু আসন্ন বিপদে মাতঙ্গিনীর ধৈর্য্য ও কর্ত্তব্যতৎপরতা বিশেষ স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়া উঠিল।
ক্ষণমধ্যে মাতঙ্গিনী জলতীরস্থ এক খণ্ড গুরুভার আর্দ্র মৃৎখণ্ড উত্তোলন করিয়া অঙ্গস্থ শয্যোত্তরচ্ছদের মধ্যে রাখিয়া গ্রন্থিবন্ধন করিলেন। অনায়াস-গোপনযোগ্য পরিধেয় শাটীমাত্র অঙ্গে রাখিয়া কৃতপ্রতিজ্ঞ হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। এক্ষণে পুষ্করিণীর পাহাড়ের অপর দিকে মনুষ্যকণ্ঠস্বর স্পষ্ট শ্রুতিগোচর হইল, এবং মনুষ্যসঞ্চালনশব্দও নিঃসন্দেহে শ্রুত হইল। মাতঙ্গিনী ঈদৃশ সাবধানতার সহিত শয্যোত্তরচ্ছদ জলমগ্ন করিলেন যে, জলশব্দ না হয়। বস্ত্রখণ্ড মৃৎখণ্ডের গুরুভারে তলস্পর্শ করিয়া অদৃশ্য হইল। মাতঙ্গিনী এক্ষণে ধীরে ধীরে জলমধ্যে অবতরণ করিয়া অন্ধকারবর্ণ স্বচ্ছ সরোবর-বক্ষে যথায় কথিত বটবিটপীর ছায়ায় প্রগাঢ়তর অন্ধকার হইয়াছিল, তথায় অধর পর্য্যন্ত জলমগ্ন হইয়া রহিলেন। তাঁহার মুখমণ্ডল ব্যতীত আর কিছু জলের উপর জাগিতেছিল না। তথাপি কি জানি, যদি সেই মুখমণ্ডলের উজ্জ্বলবর্ণ সে নিবিড় অন্ধকার মধ্যে কেহ লক্ষ্য করে, এই আশঙ্কায় মাতঙ্গিনী নিজ কবরীবন্ধনী উন্মোচন করিয়া কোমলকুঞ্চিত কুন্তলজাল মুখের উপর লম্বিত করিয়া দিলেন। অতঃপর সেই ঘনান্ধকারবর্ণ সরসীজলের উপরে, ঘনতর বৃক্ষ-ছায়াভ্যন্তরে যে নিবিড় কেশদাম ভাসিতেছিল তাহা মনুষ্য কর্ত্তৃক আবিষ্কৃত হওয়া অসম্ভব। পরক্ষণেই কথোপকথনকারীরা দীর্ঘিকা-তট অবতরণ করিয়া অর্দ্ধপথ আসিল। মাতঙ্গিনী তাহাদের কেবলমাত্র কণ্ঠস্বর ও পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। তাহাদের পানে যে চাহিয়া দেখিবেন, এমত সাহস হইল না।
আগন্তুকদের মধ্যে একজন অর্দ্ধস্ফুট বাক্যে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কহিল, “এ ত বড় তাজ্জব! আমি সঠিক বলিতেছি, আমি বেশ দেখিয়াছিলাম, এই পথের উপর একটা মানুষ চাদর মুড়ি দিয়া যাইতেছিল; বাগানের বেড়ার ফাঁক দিয়া আমি দেখিয়াছিলাম।”
দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিল, “গাছপালা দেখে তোর ধাঁধা লেগে থাক্‌বে; অপদেবতা টেবতাই বা দেখে থাক্‌বি। এত গর্‌মিতে মানুষে কাপড় মুড়ি দিয়া বেড়াবে কেন?”
“হবে” বলিয়া পুনশ্চ উভয়ে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল ; আশঙ্কার মূল কারণ যে ভীতিবিহ্বলা অবলা তাঁহাকে তাহারা দেখিতে পাইল না।
দস্যুরা কিছু দেখিতে না পাইয়া চলিয়া গেল। যতক্ষণ তাহাদের প্রত্যাবর্ত্তন-শব্দ কর্ণগোচর হইতে লাগিল ততক্ষণ মাতঙ্গিনী জলমধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করিয়া স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিলেন। যখন বিবেচনা হইল যে, আর তাহাদের দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা নাই, তখন জল হইতে উঠিয়া গমনোদ্যোগিনী হইলেন।
মাতঙ্গিনী যে পথে গমনকালীন এরূপ বিপদ্‌গ্রস্ত হইয়াছিলেন, শঙ্কাক্রমে এবার সে পথ ত্যাগ করিলেন। পুষ্করিণীর তীর পরিবেষ্টন করিয়া অপর দিকে এক পথে উঠিলেন। মধুমতী যাইতে মাতঙ্গিনীর নিষেধ ছিল বটে, কিন্তু পুষ্করিণী নিষিদ্ধ ছিল না, এবং মধ্যে মধ্যে আহ্নিক স্নানাদি ক্রিয়ার্থ এই জলে আসিতেন। সুতরাং এ স্থানের সকল পথ উত্তমরূপে চিনিতেন। পুষ্করিণীর অন্য এক পাহাড়ে উঠিয়া অন্য এক পথ অবলম্বন করিলে যে পূর্ব্বাবলম্বিত পথে পড়িতে হয়, অথচ আম্র-কাননের ধারে যাইতে হয় না, ইহা এই সময়ে মাতঙ্গিনীর স্মরণ হইল। বৃক্ষলতাকণ্টকাদির প্রাচুর্য্য বশতঃ এই পথ অতি দুর্গম, কিন্তু মাতঙ্গিনীর পক্ষে কণ্টকাদির বিঘ্ন, তুচ্ছ বিঘ্ন অলক্তক পরিবর্ত্তে কণ্টক-বেধবাহিত রক্তধারা চরণদ্বয় রঞ্জিত করিতে লাগিল। এক দিকে গুরুতর সঙ্কল্প সিদ্ধির জন্য উৎকণ্ঠা, অপর দিকে দস্যু-হস্ত হইতে পরিত্রাণের জন্য ব্যগ্রতা; এই উভয় কারণে মাতঙ্গিনী তিলার্দ্ধ বিলম্ব না করিয়া কণ্টকলতাদি পদদলিত করিয়া চলিলেন। কিন্তু এক নূতন ব্যাঘাত উপস্থিত হইবার উপক্রম হইল;-মাতঙ্গিনী রাধাগঞ্জে আসিয়া অবধি দুই তিনবার মাত্র সহোদরাবল্লভ মাধবের আলয়ে আগমন করিয়াছিলেন, কিন্তু পদব্রজে একবারও গমন করেন নাই। সুতরাং এদিকের পথ তাঁহার তেমন জানা ছিল না। এক্ষণে মাতঙ্গিনী চতুর্দ্দিকবাহী পথ-সন্নিধানে উপনীতা হইয়া কোন্ পথে যাইবেন, তাহা অবধারণে অক্ষম হইলেন। মাতঙ্গিনী পাগলিনীর ন্যায় ইতস্ততঃ চাহিতে লাগিলেন। ভাগ্যক্রমে মাধবের অট্টালিকার সম্মুখ-রোপিত দেবদারু-শ্রেণীর শিরোমালা নয়নগোচর হইল। দৃষ্টিমাত্র হর্ষিতচিত্তে তদভিমুখে চলিলেন; এবং সত্বর অট্টালিকার সমীপবর্ত্তিনী হইয়া খিড়কির দ্বারে উপস্থিত হইলেন। তথাপি মাতঙ্গিনীর ক্লেশের চূড়ান্ত হইল না। এ নিশীথে বাটীর সকলেই নিদ্রিত, কে দ্বার খুলিয়া দিবে? অনেকবার করাঘাত করিয়া মাতঙ্গিনী পুরকিঙ্করী করুণাকে নিদ্রোত্থিতা করিলেন। নিদ্রাভঙ্গে করুণা অপ্রসন্ন হইয়া ভীষণ গর্জ্জন করিয়া কহিল, “এত রেতে কে রে দোর ঠেঙ্গায়?”
মাতঙ্গিনী উৎকণ্ঠা-তীব্র স্বরে কহিলেন, “শীঘ্র-শীঘ্র করুণা, দ্বার খোল।” নিদ্রাভঙ্গকরণ-অপরাধ অতি গুরুতর ; এমন সহজে ক্ষমা সম্ভাবনা কি? করুণার ক্রোধোপণম হইল না, পূর্ব্ববৎ পুরুষ বচনে কহিল, “তুই কে যে তোকে আমি তিন পর রেতে দোর খুলে দেব?”
মাতঙ্গিনী স্পষ্টে আপন নাম ডাকিয়া কহিতে পারেন না, অথচ শীঘ্র গৃহ-প্রবেশ জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন; অতএব পুনরায় সবিনয়ে কহিলেন, “তুমি এস শীঘ্র এসো গো, এলেই দেখ্‌তে পাবে।”
করুণা সম্বর্দ্ধত রোষে কহিল, “তুই কে বল্ না, আ মরণ‌!”
মাতঙ্গিনী কহিলেন, “ওগো বাছা, আমি চোর ছ্যাঁচড় নই, মেয়ে মানুষ।”
তখন করুণার স্থূল বুদ্ধিতেও একটু একটু আভাস হইল যে, চোর ছ্যাঁচড়ের কণ্ঠস্বর এত সুমধুর প্রায় দেখা যায় না। অতএব আর গণ্ডগোল না করিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। এবং মাতঙ্গিনীকে দেখিবামাত্র সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, “এ কি! তুমি! তুমি ঠাকুরাণী!”
মাতঙ্গিনী কহিলেন, “আমি একবার হেমের সঙ্গে দেখা করিব-বড় দরকার; শীঘ্র আমাকে হেমের কাছে লইয়া চল।”