নিশীথ রাক্ষসীর কাহিনী

প্রথম পরিচ্ছেদ

“ভাল, সারি, সত্য বল দেখি, তোমার বিশ্বাস কি? ভূত আছে?”
বরদা, ছোট ভাই সারদাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিল। সন্ধ্যার পর, টেবিলে দুই ভাই খাইতেছিল-একটু রোষ্ট মটন প্লেটে করিয়া, ছুরি কাঁটা দিয়া তৎসহিত খেলা করিতে করিতে জ্যেষ্ঠ বরদা এই কথা কনিষ্ঠকে জিজ্ঞাসা করিল।
সারদা প্রথমে উত্তর না করিয়া এক টুকরো রোষ্টে উত্তম করিয়া মাষ্টার্ড মাখাইয়া, বদনমধ্যে প্রেরণপূর্ব্বক, আধখানা আলুকে তৎসহবাসে প্রেরণ করিয়া, একটি রুটি ভাঙ্গিয়া বাম হস্তে রক্ষাপূর্ব্বক, অগ্রজের মুখ পানে চাহিতে চাহিতে চর্ব্বর্ণ কার্য্য সমাপন করিল। পরে, এতটুকু সেরি দিয়া, গলাটা ভিজাইয়া লইয়া বলিল, “ভূত? না।”
এই বলিয়া সারদাকৃষ্ণ সেন পরলোকগত এবং সুসিদ্ধ মেষশাবকের অবশিষ্টাংশকে আক্রমণ করিবার উদ্যোগ করিলেন।
বরদাকৃষ্ণ কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হইয়া বলিল, “Rather laconic.”
সারদাকৃষ্ণের রসনার সহিত রসাল মেষমাংসের পুনরালাপ হইতেছিল, অতএব সহসা উত্তর করিল না। যথাবিহিত সময়ে অবসর প্রাপণান্তর তিনি বলিলেন, “Laconic? বরং একটা কথা বেশী বলিয়াছি। তুমি জিজ্ঞাসা করিলে ‘ভূত আছে’-আমার বলিলেই হইত ‘না।’ আমি বলিয়াছি, ‘ভূত? না।’ ‘ভূত?’ কথাটা বেশী বলিয়াছি। কেবল তোমার খাতিরে।”
“অতএব তোমার ভ্রাতৃভক্তির পুরস্কারস্বরূপ, এই স্বর্গপ্রাপ্ত চতুষ্পদের খণ্ডান্তর প্রসাদ দেওয়া গেল।” এই বলিয়া বরদা, আর কিছু মটন কাটিয়া ভ্রাতার প্লেটে ফেলিয়া দিলেন। সারদা অবিচলিতচিত্তে, তৎপ্রতি মনোভিনিবেশ করিল!
তখন বরদা বলিল, Seriously সারি, ভূত আছে বিশ্বাস কর না?”
সারি। না।
বরদা। কেন বিশ্বাস কর না?
সারদা। সেই প্রাচীন ঋষির কথা-প্রমাণাভাবাৎ। কপিল প্রমাণ-অভাবে ঈশ্বর মানিলেন না-আর আমি প্রমাণ-অভাবে ভূত মানিব?
এই বলিয়া সারদা এক গেলাস সেরি মেষের সৎকারার্থ আপনার উদরমধ্যে প্রেরণ করিল।
বরদাকৃষ্ণ চটিয়া উঠিল-বলিল, “কোথাকার বাঁদর। ভূত নাই!- ঈশ্বর নাই! তবে তুমিও নেই, আমিও নেই?”
সারি। তাই বটে। তোমার মটন রোষ্ট ফুরাইল, দেখিয়া, আমি নেই। আর আমার আহারের ঘটা দেখিয়া, বোধ হয় তুমিও নেই।
বরদা, “কই, খেলি কই?” এই বলিয়া অবশিষ্ট মাংসটুকু কাটিয়া ভাইয়ের প্লেটে সংস্থাপিত করিয়া, গ্লাসে সেরি ঢালিয়া দিলেন। সারদা যতক্ষণ মাংসের ছেদন, বিন্ধন, মুখে উত্তোলন এবং চর্ব্বণ ইত্যাদি কার্য্যে নিযুক্ত ততক্ষণ বরদা চুপ করিয়া রহিল, পরে অবসর পাইলে, সারদা জ্যেষ্ঠকে বলিল, “তুমি নাই, আর আমি নাই-ইহা প্রায় philosophically true -কেন না, আমরা “mere permanent possibilities of sensation.” আর এই যে আহার করিলাম, ইহাও না করার মধ্যে জানিবে,-কেবল সেই possible sensation গুলার মধ্যে কতকগুলা sensation হইল মাত্র।
বরদা। সেই কথাই জিজ্ঞাসা করিতেছি, ভূত দেখা, ভূতের শব্দ শুনা, এ সব possible sensation নহে?
সারদা। ভূত থাকিলে possible.
বর। ভূত নাই?
সার। তা ঠিক বলিতেছি না-তবে প্রমাণ নাই বলিয়া ভূতে বিশ্বাস নাই, ইহাই বলিয়াছি।
বর। প্রত্যক্ষ কি প্রমাণ নহে?
সার। আমি কখন ভূত প্রত্যক্ষ করি নাই।
বর। টেমস্ নদী প্রত্যক্ষ করিয়াছ?
সার। না।
বর। টেমস্ নদী আছে মান?
সার। যাহাদের কথায় বিশ্বাস করা যায়, এমন লোক প্রত্যক্ষ করিয়াছে।
বর। ভূতও এমন লোক প্রত্যক্ষ করিয়াছে।
সার। বিশ্বাসযোগ্য এমন কে? এক জনের নাম কর দেখি?
বর। মনে কর, আমি।
এই কথা বলিতে বরদার মুখ কালো হইয়া গেল-শরীর রোমাঞ্চিত হইল।
সার। তুমি?
বর। তা হইলে বিশ্বাস কর।
সার। তুমি একটু imaginative, একটু sentimental-রজ্জুকে সর্প ভ্রম হইতে পারে।
বর। তুমি দেখিবে?
সার। দেখিব না কেন?
বর। আচ্ছা তবে আহার সমাপ্ত করা যাউক।
-‘নারায়ণ’, বৈশাখ ১৩২২, পরিশিষ্ট।