সিথিরায় যাত্রা

উড্ডীন পাখির মতো, মুক্তছন্দে উৎফুল্ল উত্তাল,
দড়িদড়া ছিন্ন করে হৃদয় আমার ছুটেচলে,
দোলে নৌকা ক্ষণে- ক্ষণে রিক্তমেঘ আকাশের তলে,
যেন এক দেবদূত, রৌদ্রময় দিগন্তে মাতাল ।
দেখা যায় কোন দ্বীপ-কালো, আর বিষাদে মলিন ?
-জানো না, সিথেরা ঐ, সেকালের শৌখিন প্রিয়,
মামুলি এলদোরদো, গানে-গানে অবিস্মরনীয় ।
কিন্তু যাই বলো, এই দেশ বড় ধূসর, শ্রীহীন ।
-রহস্যে মধুর দ্বীপ,হৃদয়ের উজ্জলউৎসব !
তার তটরেখা থেকে, যেন এক গন্ধের উচ্ছ্বাস,
ভেসে আসে সনাতন ভেনাসের দৃপ্ত প্রতিভাস,
ব্যাপ্ত করে আত্মায় আলস্য আর প্রেমের বৈভব ।
সুন্দর, শ্যামল দ্বীপ পরিপূর্ন পুষ্পিত বিতানে,
চিরকাল সর্বজাতি যার কাছে অর্ঘ্য নিয়ে যায়,
হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস কেপে ওঠে তন্ময় পূজায়,
যেমন গন্ধের দোলা গোলাপের বিলোল বাগানে,
কিংবা যেন বনতলে কপোতের শাশ্বত কূজন !
কিন্তু তা তো নয় ! এ যে রুগ্ন এক বিশীর্ণ বিস্তার,
শিলাময় মরু, যাকে দীর্ণ করে কর্কশ চীৎকার ।
অথচ অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখি ! নয় সেমোহন
ছায়াময় মরু কুঞ্জবনে পরিবৃত মন্দির, যেথায়
তন্বী এক পূজারিনী প্রেম দেয় ফুলের বিলাসে,
এবং গোপন তাপে দগ্ধতনু, ভ্রমে অনায়সে
অর্ধেক উন্মুক্ত করে বেশবাস চঞ্চল হাওয়ায় ;
যখন আসন্ন তীর, উপকুলে তরী প্রতিহত,
ধবল পালের পটে নাড়ে ডানা ব্যাকুলপাখিরা,
দেখি এক ফাসিকাষ্ঠ, কৃঞ্চকায়, সুদীর্ঘ, ত্রিশিরা,
আকাশেরে দীর্ণ করে উদাসীন সাইপ্রেসের মতো ।
ঝুলে আছে শব, তাতে শকুনেরা পঙক্তিভোজে বসে
হিংস্র বেগে ছিড়ে নেয় পক্ক মাংস, রক্তমেদে মাখা,
শটিত পুঞ্জের মধ্যে, যেন তীক্ষ্ন, কদর্য শলাকা,
হানে চঞ্চু অবিরাম, প্রত্যেকেই, নিষ্ঠুর আক্রোশে ;
চক্ষু দুই ছিদ্র তার, বিধ্বস্ত উদর থেকে খসে
পরিপুষ্ট অন্ত্রতন্ত্র ঊরুপ্রান্তে গড়ায় সচ্ছল,
এ- জঘন্য নিমন্ত্রণে পরিতৃপ্ত ঘাতকের দল
চঞ্চুর আঘাতে তাকে নপুংসক করেছে নি:শেষে ।
এদিকে, মঞ্চের তলে, ঊর্ধ্বমুখ, ক্ষুধায় উন্মাদ,
হিংসুক জন্তুর পাল শান্তিহীন ফেরে পাকে-পাকে,
সে-বিক্ষুব্ধ জনতার সবচেয়ে বড়ো যে, সেটাকে
মনে হয় অনুচরে পরিবৃত ভীষন জল্লাদ ।
সিথেরার পুত্র, যার জন্ম এই স্বচ্ছ নীলিমায়,
পুরাতন অনাচারে যুগান্তের সঞ্চিত দুর্নাম
এবং নিষিদ্ধ পাপ-তুমি তার দিয়ে গেলে দাম
মরণের পরপারে বাক্যহীন অবমাননায়।
অপহত হাস্যকর, তোর কষ্টে আমি যে তন্ময় !
জেনেছি, বিছিন্ন তোর প্রত্যঙ্গের দেখে নিপাতন-
আদন্তবিস্তৃত যেন ন্যক্কারের পুনরারোহণ –
অনাদি দু:খের ধারা, দীর্ঘায়িত, পিত্তবিষময় ।
স্মরণের বরণীয় রে পাতকী, তোর কাছে এসে
মনে জাগে অনেক চঞ্চুর বেগ, কঠিন চোয়াল –
যে-সব সুতীক্ষ্ণ শ্যেন, আর কালো শ্বাপদের পাল
একদা আমার মাংস চূর্ণ করেছিল ভালবেসে ।
মনোরোম নভোতর, নির্বিকার সিন্ধুর নীলিমা ;
কিন্তু সব অন্ধকার, রক্তমাখা আমার নয়নে,
হায় ! যেন ঢেকে দেয় কাফনের ঘন আচ্ছাদনে
আমার চিত্তেরে এই রূপকের নিবিড় কালিমা ।
ভেনাস, তোমার দ্বীপে শুধু এই প্রতীক প্রোথিত,
ফাসিকাষ্ঠে পচা মড়া- চিত্রকল্প ঝোলে সে আমারই ।
ভগবান, দাও সেই শক্তি ও সাহস, যাতে পারি
দেখে নিতে আমার শরীর – মন বিতৃষ্ণাব্যতীত ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *