মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত – ৬

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

পোয়া বারো-মুচিরাম জেলা লুঠিতে লাগিল। প্রথম লোকের কাছে চাহিয়া চিন্তিয়া দুই চারি আনা লইত। তার পর দাঁও শিথিল। ফেলু সেখের ধানগুলি জমীদার জোর করিয়া কাটিয়া লইতে উদ্যত, সাহেব দয়া করিয়া পুলিশকে হুকুম দিলেন, ফেলুর সম্পত্তি রক্ষা করিবে। সাহেব হুকুম দিলেন, কিন্তু পুলিশের নামে পরওয়ানাখানি লেখা আর হয় না। পরওয়ানা লেখা মুচিরামের হাত। পরওয়ানা যাইতে যাইতে ধান থাকে না; ফেলু মুচিরামকে এক টাকা, দুই টাকা, তিন টাকা, ক্রমে পাঁচ টাকা স্বীকার করিল-তৎক্ষণাৎ পরওয়ানা বাহির হইল। তখন মাজিষ্ট্রেটেরা স্বহস্তে জোবানবন্দী লইতেন না-এক কোণে বসিয়া এক একজন মুহুরি ফিস্‌ফিস্ করিয়া জিজ্ঞাসা করিত, আর যাহা ইচ্ছা তাহা লিখিত। সাক্ষীরা এক রকম বলিত, মুচিরাম আর এক রকম জোবানবন্দী লিখিতেন, মোকদ্দমা বুঝিয়া ফি সাক্ষ্য-প্রতি চারি আনা, আট আনা, এক টাকা পাইতেন। মোকদ্দমা বুঝিয়া মুচি দাঁও মারিতেন; অধিক টাকা পাইলে সব উল্টা লিখিতেন। এইরূপে নানাপ্রকার ফিকির ফন্দীতে মুচিরাম অনেক টাকা উপার্জ্জন করিতে লাগিলেন-তিনি একা নহেন, সকলেই করিত-তবে মুচি কিছু অধিক নির্লজ্জ-কখন কখন লোকের টেঁক হইতে টাকা কাড়িয়া লইত।
যাই হৌক, মুচি শীঘ্রই বড়মানুষ হইয়া উঠিল-কোন্ মুচি না হয়?-অচিরাৎ সেই অকৃতনাম্নী প্রতিবাসিনী স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা হইল। মদ, গাঁজা, গুলি, চরস, আফিঙ্গ-যাহার নাম করতে আছে এবং যাহার নাম করিতে নাই-সকলই মুচিবাবুর গৃহকে অহর্নিশি আলোক ও ধূমময় করিতে লাগিল। মুচিরামেরও চেহারা ফিরিতে লাগিল-গালে মাস লাগিল-হাড় ঢাকিয়া আসিল-বর্ণ জাপান লেদার ছাড়িয়া দিল্লীর নাগরায় পৌঁছিল। পরিচ্ছদের বৈচিত্র্য জন্মিতে লাগিল-শাদা, কালো, নীল, জরদা, রাঙ্গা, গোলাপী প্রভৃতি নানা বর্ণের বস্ত্রে মুচিরাম সর্ব্বদা রঞ্জিত। রাত্রি দিন মাথায় তেড়ি কাটা, অধরে তাম্বূলের রাগ এবং কণ্ঠে নিধুর টপ্পা। সুতরাং মুচিরামের পোয়া বারো।
দোষের মধ্যে সাহেব বড় খিট্‌খিট্ করে। মুচিরাম একে ঘোরতর বোকা, কোন কর্ম্মই ভাল করিয়া করিতে পারিত না, তাহাতে আবার দুর্জ্জয় লোভ,-সকল-তাতে মুচিরাম গালি খাইত। সাহেবটাও বড় বদরাগী-অনেক সময়ে মুচিরামকে কাগজপত্র ছুঁড়িয়া মারিত। সাহেবের ভিতরে ভিতরে হৃদয়ে দয়া ছিল-নচেৎ মুচিরামের চাকরী অধিক কাল টিকিত না।
সৌভাগ্যক্রমে সে সাহেব বদলি হইয়া গেল-আর একজন আসিল।
এই নূতন সাহেবটির নাম (Grongerham) লিখিবার সময়ে লোকে লিখিত গ্রঙ্গারহ্যাম-বলিবার সময়ে বলিত গঙ্গারাম সাহেব। গঙ্গরাম সাহেব অতি ভদ্রলোক, দয়ার সাগর, কাহারও কোন অনিষ্ট করিতেন না, মোকদ্দমা করিতে গিয়া, কেবল ডিষমিস করিতেন। তবে সাহেব কিছু অলস, কাজ কর্ম্মে বড় মন দিতেন না, এবং নিজে সরল বলিয়া তাঁবেদারদিগের উপর বড় বিশ্বাস ছিল। সকল কর্ম্মের ভার সেরেস্তাদার এবং হেড কেরাণীর উপর ছিল। যত দিন সাহেব ঐ জেলায় ছিলেন, একদিনের জন্য একখানি চিঠি স্বহস্তে মুশাবিদা করেন নাই-হেড কেরাণী সব করিত।
সাহেব প্রথম আসিয়া, মুচিরামের কালোকালো নধর সুচিক্কণ শরীরটি দেখিয়া, এবং তাহার আভূমিপ্রণত ডবল সেলাম দেখিয়া নিজের সরলচিত্তে একেবারে সিদ্ধান্ত করিলেন যে, আপিসের মধ্যে এই সর্ব্বাপেক্ষা উপযুক্ত লোক। সে বিশ্বাস তাঁহার কিছুতেই গেল না। যাইবারও কোন কারণ ছিল না–কেন না, কাজকর্ম্মের তিনি খবর রাখিতেন না। একদিন আপিসের মীর মুন্সী মিরজা গোলাম সর্ফদর খাঁ সাহেব, দুনিয়াদারি নামাফিক মনে করিয়া ফৌত করিলেন। সাহেব পরদিনেই মুচিরামকে ডাকিয়া তৎপদে অভিষিক্ত করিলেন। মীর মুন্সীর বেতন কুড়ি টাকা-কিন্তু বেতনে কি করে? পদটি রুধিরে পরিপ্লুত। অজরামরবৎপ্রাজ্ঞ মুচিরাম শর্ম্মা রুধিরসঞ্চয় করিতে লাগিলেন।
দোষ কি? অজরামরবৎপ্রাজ্ঞ বিদ্যামর্থঞ্চ চিন্তয়েৎ। দুইটা একজনে পারে না-মুচিরাম বিদ্যাচিন্তা করিতে সক্ষম নহেন; কোষ্ঠীতে তাহা লেখে নাই-অতএব
বিষ্ণুশর্ম্মার উপদেশানুসারে মৃত্যুভয় রহিত হইয়া তিনি অর্থচিন্তায় প্রবৃত্ত। যদি সেই “হিতোপদেশ”গুলি অধীত হইবার যোগ্য হয়-যদি সে গ্রন্থ এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও পূজার যোগ্য হয়-তবে মুচিরামও প্রাজ্ঞ-আর এ দেশের সকল মুচিই প্রাজ্ঞ।
বিষ্ণুশর্ম্মা ভারতবর্ষের মাকিয়াবেল্লি-চাণক্য ভারতের রোশফুকল। যাহার এইরূপ গ্রন্থ বিদ্যালয়ের বালকদিগকে পড়াইবার নিয়ম করিয়াছে, তাহাদিগের উচিত, আবার বিদ্যালয়ের প্রবেশ করা। তাহাদের শিক্ষা হয় নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *