মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

এদিকে, যশোদানন্দন, শ্রীশ্রীমুচিরাম শর্ম্মা-ঈশানমন্দিরে সুবিরাজমান-সম্পূর্ণরূপে মাতৃবিস্মৃত। যদি কখন মাকে মনে পড়িত, তবে সে আহারের সময়-ঈশানবাবুর ঘরের প্রফুল্ল-মল্লিকাসন্নিভ সিদ্ধান্ন, দানাদার গব্য ঘৃত, সুগন্ধি ঝোলে নিমগ্ন রোহিতমৎস্য, পৃথিবীর ন্যায় নিটোল গোলাকার সদ্যভর্জ্জিত লুচির রাশি-এই সকল পাতে পাইলে মুচিরাম মনে করিতেন, “মা বেটী কি ছাই-ই আমাকে খাওয়াইত!” সে সময়ে মাকে মনে পড়িত-অন্য সময়ে নহে।
মুচিরামের পাঠশালার লেখা পড়া সমাপ্ত হইল-অর্থাৎ গুরু মহাশয় বলিল, সমাপ্ত হইয়াছে। মুচিরামের কোন গুণ ছিল না, এমত বলি না; তাহা হইলে এ ইতিহাস লিখিতে আমি প্রবৃত্ত হইতাম না। মুচিরামের কণ্ঠস্বর ভাল ছিল বলিয়াছি-গুণ নম্বর এক। গুণ নম্বর দুই, তাহার হস্তাক্ষর অতি সুন্দর হইল। আর কিছু হইল না। ঈশানবাবু মুচিরামকে ইংরেজি স্কুলে পাঠাইলেন।
মুচিরাম ধেড়ে ছেলে, স্কুলে ঢুকিয়া বড় বিপদ্‌গ্রস্ত হইল। মাষ্টারেরা তামাসা করে, ছোট ছোট ছেলেরা খিল্‌‌খিল্ করিয়া হাসে। মুচিরাম রাগ করে, কিন্তু পড়ে না। সুতরাং মাষ্টারেরা হারাণ অধিকারীর পথে গেলেন। আবার কাণমলায় কাণমলায় মুচিরামের কাণ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। প্রথমে কাণমলা, তার পর বেত্রাঘাত, মুষ্ট্যাঘাত, চপেটাঘাত, কীলাঘাত, এবং ঘুসাঘাত। ঈশানবাবুর ঘরের তপ্ত লুচির জোরে মুচিরাম নির্ব্বিবাদে সব হজম করিল।
এইরূপে মুচিরাম, তপ্ত লুচি ও বেত খাইয়া, স্কুলে পাঁচ-সাত বৎসর কাটাইল। কিছু হইল না। ঈশানবাবু তাহাকে স্কুল হইতে ছাড়াইয়া লইলেন। ঈশানবাবুর দয়ার শেষ নাই-মাজিষ্ট্রেট সাহেবের কাছে তাঁহার বিশেষ প্রতিপত্তি-মুচিরামের হাতের লেখাও ভাল-ঈশানবাবু মুচিরামের একটি দশ টাকার মুহুরিগিরি করিয়া দিলেন। বলিয়া দিলেন, “ঘুস ঘাস লইও না বাপু, তা হলে তাড়াইয়া দিব।” মুচিরাম শর্ম্মা প্রথম দিনেই একটা হুকুমের চোরাও নকল দিয়া আট গণ্ডা পয়সা হাত করিলেন, এবং সন্ধ্যার অল্পকাল পরেই তাহা প্রতিবাসিনীবিশেষের পাদপদ্মে উৎসর্গ করিলেন।
এদিকে ঈশানবাবুও প্রাচীন হইয়া আসিয়াছিলেন। তিনি ইহার পরেই পেন্সন লইয়া স্বকর্ম্ম হইতে অবসৃত হইলেন এবং মুচিরামকে পৃথক্ বাসা করিয়া দিয়া, সপরিবারে স্বদেশে প্রস্থান করিলেন। মুচিরাম ঈশানবাবুকে একটু ভয় করিত-এক্ষণে তাহার পোয়া বারো পড়িয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *