মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মুচিরাম অল্পদিনেই জানিল যে, যাত্রাওয়ালার জীবন সুখের নয়। যাত্রাওয়ালা কেবল কোকিলের মত গান করিয়া ডালে ডালে মুকুল ভোজন করিয়া বেড়ায় না। অল্পদিনে মুচিরামের শরীর শীর্ণ হইল। এ গ্রাম ও গ্রাম ছুটাছুটি করিতে সকল দিন আহার হয় না; রাত্রি জাগিয়া প্রাণ ওষ্ঠাগত; চুলের ভারে মাথায় উকুনে ঘা করিল; গায়ে খড়ি উড়িতে লাগিল; অধিকারীর কাণমলায় কাণমলায় দুই কাণে ঘা হইল। শুধু তাই নয়; অধিকারী মহাশয়ের পা টিপিতে হয়, তাঁকে বাতাস করিতে হয়, তামাক সাজিতে হয়, আরও অনেক রকম দাসত্ব করিতে হয়। অল্পদিনেই মুচিরামের সোণার মেঘ বাষ্পরাশিতে পরিণত হইল।
মুচিরামের আরও দুর্ভাগ্য এই যে, বুদ্ধিটা বড় তীক্ষ্ণ নহে। গীতের তাল যে, পুষ্করিণীতীরস্থ দীর্ঘ বৃক্ষে ফলে না, ইহা বুঝিতে তাহার বহুকাল গেল। ফলে তালিমের সময়ে তালের কথা পড়িলে, মুচিরাম অন্যমনস্ক হইত-মনে পড়িত, মা কেমন তালের বড়া করে!-মুচিরামের চক্ষু দিয়া এবং রসনা দিয়া জল বহিয়া যাইত।
আবার গান মুখস্থ করা আরও দায়-কিছুতেই মুখস্থ হইত না-কাণমলায় কাণমলায় কাণ রাঙ্গা হইয়া গেল। সুতরাং আসরে গায়িবার সময়ে পিছন হইতে তাহাকে বলিয়া দিতে হইত। তাহাতে মধ্যে মধ্যে বড় গোল বাঁধিত-সকল সময়ে ঠিক শুনিতে বা বুঝিতে পারিত না। একদিন পিছন হইতে বলিয়া দিতেছে-
“নীরদকুন্তলা-লোচনচঞ্চলা
দধতি সুন্দররূপং”
মুচিরাম গায়িল-“নীরদ কুন্তলা__” থামিল-আবার পিছন হইতে বলিল, “লোচনচঞ্চলা”-মুচিরাম ভাবিয়া চিন্তিয়া গায়িল, “লুচি চিনি ছোলা”। পিছন হইতে বলিয়া দিল, “দধতি সুন্দররূপং”-মুচিরাম না বুঝিয়া গায়িল, “দধিতে সন্দেশ রূপং”। সেদিন আর গায়িতে পাইল না।
মুচিরামকে কৃষ্ণ সাজিতে হইত-কিন্তু কৃষ্ণের বক্তব্য সকল তাহাকে পিছন হইতে বলিয়া দিতে হইত-“আ-বা-আ-বা ধবলী”টি মুখস্থ ছিল। একদিন মানভঞ্জন যাত্রা হইতেছে-পিছন হইতে মুচিরামকে বক্তৃতা শিখাইয়া দিতেছে। কৃষ্ণকে বলিতে হইবে, “মানময়ি রাধে! একবার বদন তুলে কথা কও |” সেই সময়ে বেহালাওয়ালা মৃদঙ্গীর হাতে তামাকের কল্কে দিয়া বলিতেছিল, “গুড়ুক খাও___” শুনিয়া মুচিরাম বলিল, “রাধে-একবার বদন তুলে-গুড়ক খাও |” হাসির চোটে যাত্রা ভাঙ্গিয়া গেল।
মুচিরাম প্রথমে বুঝিতে পারিল না-হাসি কিসের-যাত্রা ভাঙ্গিল কেন? কিন্তু যখন দেখিল, অধিকারী সাজঘরে আসিয়া একগাছা বাঁক সাপটিয়া ধরিয়া, তাহার দিকে ধাবমান হইলেন, তখন মুচিরাম হঠাৎ বুঝিল যে, এই বাঁক তাহার পৃষ্ঠদেশে অবতীর্ণ হইবার কিছু গুরুতর সম্ভাবনা-অতএব কথিত পৃষ্ঠদেশ স্থানান্তরে লইয়া যাওয়া আশু প্রয়োজন। এই ভাবিয়া মুচিরাম অকস্মাৎ নিষ্ক্রান্ত হইয়া নৈশ অন্ধকারে অন্তর্হিত হইল।
অধিকারী মহাশয় বাঁকহস্তে তৎপশ্চাৎ নিষ্ক্রান্ত হইয়া, তাহাকে না দেখিতে পাইয়া, তাহার ও তাহার পিতৃপিতামহ, মাতা ও ভগিনীর নানাবিধ অযশ কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন। মুচিরামও এক বৃক্ষান্তরালে থাকিয়া অস্ফুটস্বরে অধিকারী মহাশয়ের পিতৃমাতৃ সম্বন্ধে তদ্রূপ অপবাদ রটনা করিতে লাগিল। অধিকারী মুচিরামের সন্ধান না পাইয়া, সাজঘরে গিয়া বেশ ত্যাগ করিয়া, দ্বার রুদ্ধ করিয়া শয়ন করিয়া রহিলেন। দেখিয়া মুচিরাম বৃক্ষচ্ছায়া ত্যাগ করিয়া, রুদ্ধদ্বারসমীপে দাঁড়াইয়া অধিকারীকে নানাবিধ অবক্তব্য কদর্য্য ভাষায় মনে মনে সম্বোধন করিতে লাগিল; এবং উভয় হস্তের অঙ্গুষ্ঠ উত্থিত করিয়া তাহাকে কদলীভোজনের অনুমতি করিল। তৎপরে রুদ্ধ কবাটকে বা কবাটের অন্তরালস্থিত অধিকারীর বদনচন্দ্রকে একটি লাথি দেখাইয়া, মুচিরাম ঠাকুরবাড়ীর মন্দিরের রোয়াকে গিয়া শয়ন করিয়া রহিল।
প্রভাতে উঠিয়া অধিকারী মহাশয় গ্রামান্তরে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। শুনিলেন, মুচিরাম আইসে নাই-কেহ কেহ বলিল, তাহাকে খুঁজিয়া আনিব? অধিকারী মহাশয় গালি দিয়া বলিলেন, “জুট্‌তে হয়, আপনি জুট্‌বে, এখন আমি খুঁজে বেড়াতে পারি নে |” দয়ালুচিত্ত বেহালাওয়ালা বলিল, “ছেলেমানুষ-যদি নাই জুট্‌তে পারে-আমি খুঁজে আনিব।” অধিকারী ধমকাইলে-মনে মনে ইচ্ছা, মুচিরামের হাত হইতে উদ্ধার পান, এবং সেই সঙ্গে তাহার পাওনা টাকাগুলি ফাঁকি দেন। বেহালাওয়ালা ভাবিল-মুচিরাম কোনরূপে জুটিবে। আর কিছু বলিল না।
যাত্রার দল চলিয়া গেল-মুচিরাম জুটিল না। রাত্রিজাগরণ-দেবালয়বরণ্ডে সে অকাতরে নিদ্রা যাইতেছিল। উঠিয়া দল চলিয়া গিয়াছে শুনিয়া, কাঁদিতে আরম্ভ করিল। এমন বুদ্ধি নাই যে, অধিকারী কোন্ পথে গিয়াছে, সন্ধান করিয়া সেই পথে যায়। কেবল কাঁদিতে লাগিল। পূজারি বামন অনুগ্রহ করিয়া বেলা তিন প্রহরে দুইটি ঠাকুরের প্রসাদ খাইতে দিল। খাইয়া, মুচিরাম কান্নার দ্বিতীয় অধ্যায় আরম্ভ করিল। যত রাত্রি নিকট হইতে লাগিল, তত ভাবিতে লাগিল-আমি কেন পালাইলাম! আমি কেন দাঁড়াইয়া মার খাইলাম না!
গ্রন্থকার ভনে, এবার যখন বাঁক উঠিতে দেখিবে, পিঠ পাতিয়া দিও। তোমার গোষ্ঠীর বাপচৌদ্দপুরুষ বুড়া সেনরাজার আমল হইতে কেবল পিঠ পাতিয়া দিয়াই আসিতেছে। তুমি পলাইবে কোথায়? এ সুসভ্য জগতের অধিকারীরা মুচিরাম দেখিলে বাঁকপেটাই করিয়া থাকে-মুচিরামেরা পিঠ পাতিয়াই দেয়। কেহ পালায় না-রাখাল ছাড়া কি গোরু থাকিতে পারে হে বাপু? ঘাস জলের প্রয়োজন হইলেই, তোমাদের যখন রাখাল ভিন্ন উপায় নাই, তখন পাঁচনবাড়িকে প্রাতঃপ্রণাম করিয়া গোজন্ম সার্থক কর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *