১১. BRANSONISM

BRANSONISM7

জন ডিক্‌সন সাহেবকে ফৌজদারী আদালতে ধরিয়া আনিয়াছে। সাহেব বড় কালো, তা হলে হয় কি, সাহেব ত বটে-পাড়াগেঁয়ে কাছারিতে বিচার দেখিতে অনেক রঙ্গদার লোক ছুটিয়া গেল। বিচার একটা দেশী ডিপুটির কাছে হইবে। তাহাতে সাহেবের কিছু কষ্ট; তবে মনে মনে ভরসা আছে যে, বাঙ্গালিটা ভয়ে আমাকে ছাড়িয়া দিবে। ডিপুটি মহাশয়ের রকম দেখিয়াও তাই বোধ হয়, একটা তেকেলে বুড়ো-নিরীহ রকম ভাল মানুষ; জড়সড় হইয়া বসিয়া আছে।
এদিকে কনষ্টেবল মহাশয়েরা কতকটা ভয়ে ভয়ে সাহেব মহাশয়কে ডকস্থ করিলেন। সাহেব ডকস্থ হইয়াই একটু গরম হইয়া হাকিমের পানে চাহিয়া চোখ ঘুরাইয়া একটু বাঁকা বাঁকা বুলিতে বলিলেন, “সে হামাকে টোমরা হেখানে কেন আনিলো?”
হাকিম বলিল, “কি জানি সাহেব! কেন আনিলো-তুমি কি করেছ?”
সাহেব। যা করে না কেন, টোমার সাতে হামার কোন বাট হোবে না। হাকিম । কেন সাহেব?
সাহেব। টুমি কালা বাঙ্গালি আছে।
হাকিম । তার পর?
সাহেব। হামি সাহেব আছে।
হাকিম । তা ত দেখ্‌ছি-তাতে কি হলো?
সাহেব। তোমার-কি বলে? সেটা লেই।
হাকিম । তবু ভাল-মাতৃভাষা ধরেছ, এতক্ষণ বাঁকা বাঁকা বুলি ধরেছিলে কেন? কি নেই?
সাহেব। সেই ঝাতে মোকদ্দমা করে-সে তুমি জানে না?
হাকিম । সাহেব, আমি ভাল মানুষ-তোমায় এখনও কিছু বলি নাই-কিন্তু আর “তুমি” “তুমি” করিও না-জরিমানা করিব।
সাহেব। টুমি মোর জরিমানা করিতে পারে না-হামি সাহেব আছে-তোমার সেই সেটা-কি বলে-সেটা লেই।
হাকিম । কি নেই সাহেব?
সাহেব। সেই যে-জুষ্টিকেশন।
হাকিম । ওহো-Jurisdiction? বটে। তুমি কি বিলাতী সাহেব?
সাহেব। হামি সাহেব আছে।
হাকিম । রংটা এত কাল কেন?
সাহেব। মুই কোয়লার কাম করেছিল।
হাকিম । তোমার বাপের নাম কি?
সাহেব। বাপের নামে কোটের কি কাম আছে?
হাকিম । বলি সেটা জানা আছে কি?
সাহেব। হামার বাপ বড় আদমি ছেলো-লেকেন লামটা এখন মনে পড়্‌ছে না।
হাকিম । মনে কর না হয়। তোমার নামটা কি?
সাহেব। আমার নাম জান সাহেব-জান ডিক্‌সন্।
হাকিম । বাপের নাম ডিক্‌সন্ নয়?
সাহেব। হোবে-ডিক্‌সন্ হোতে পারে-লেকেন-
বাদীর মোক্তার এই সময়ে বলিল, “হুঁজুর, ওর বাপের নাম গোবর্দ্ধ্বন সাহেব |”
সাহেব রাগ করিয়া বলিল, “গোবর্দ্ধ্বন হইলো ত কি হইলো-তোমার বাপের নাম যে রামকান্ত-তোমার বাপ চূড়া বেচিত-আমার বাপ বড় আদমি ছেলো |”
হাকিম । তোমার বাপ কি করিত?
সাহেব। বড় লোকের সাদি দিত।
হাকিম । সে আবার কি? ঘটকালি করিত না কি?
মোক্তার। আজ্ঞে না-বিবাহের বাজনার জয়ঢাক ঘাড়ে করিত।
অনেকে হাসিল। হাকিম জুরিস্‌ডিক্‌সনের আপত্তি নামঞ্জুর করিয়া বিচারে প্রবৃত্ত হইলেন। ফরিয়াদীকে তলব করায় রূপার পৈছা হাতে নধর কালো কোলো একজন স্ত্রীলোক উপস্থিত হইল। তাহাকে যেরূপ জিজ্ঞাসাবাদ করা হইল, আর সে যেরূপ উত্তর দিল, নিম্নে লিখিতেছি;-
প্রশ্ন-তোমার নাম কি?
উত্তর-রঙ্গিণী জেলেনী।
প্রশ্ন। তুমি কি কর?
উত্তর। বিল খালে মাছ ধরে বেচি।
আসামী সাহেব কহিল, “ঝুটা বাত! ও সুঁটকি মাছ বেচে |”
জেলেনী বলিল, “তাও বেচি। তাহাতেই ত তুমি মরেছ |”
প্রশ্ন। তোমার কিসের নালিশ?
উত্তর। চুরির নালিশ।
প্রশ্ন। কে চুরি করেছে?
উত্তর। (সাহেবকে দেখাইয়া) এই বাগদীর ছেলে।
সাহেব। মুই সাহেব আছে-মুই বাগদী লই।
প্রশ্ন। কি চুরি করেছ?
উত্তর। এই ত বলিলাম-এক মুঠা সুঁটকি মাছ।
প্রশ্ন। কি রকমে চুরি করিল?
উত্তর। আমি ডালা পাতিয়া তাতে সুঁটকি মাছ সাজাইয়া বেচিতেছিলাম- একজন খদ্দের এলো-তা তার পানে ফিরে কথা কইতেছিলাম-এমন সময়ে সাহেব ডালা হইতে এক মুঠা মাছ তুলে নিয়ে পাকেটে পুরিল।
প্রশ্ন। তার পর, তুমি টের পেলে কেমন ক’রে?
উত্তর। পাকেটের যে আধখানা বই ছিল না-তা সাহেবের মনে ছিল না। সুঁটকি মাছ সব ফুটো দিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।
এই কথা শুনিয়া সাহেব রাগ করিয়া বলিল, “না বাবুজি‌! ওর চুপড়িটাই ফুটো, তাই মাছ বেরইয়ে পড়েছিল |”
জেলেনী বলিল, “ওর পাকেটে দুই চারিটা মাছ পাওয়া গিয়াছিল |”
সাহেব বলিল, “সে মুই দাম দেবে ব’লে নিয়েছিলো |”
সাক্ষীর দ্বারা প্রমাণ হইল যে, ডিক্‌সন্ সাহেব সুঁটকি মাছ চুরি করিয়াছেন। তখন হাকিম, সাহেবের জবাব লিখিতে বসিলেন। সাহেব জবাবে কেবল এই কথা বলিলেন যে, কালা বাঙ্গালির আমার উপর “জুষ্টিকেশন লেই |” সে আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়া হাকিম তাহাকে এক হপ্তা কয়েদের হুকুম দিলেন। দুই চারি দিন পরে এই কথাটা কলিকাতার একখানা ইংরেজি দৈনিক পত্রের সম্পাদকের কাণে গেল। পর দিন প্রভাতে সেই পত্রের সম্পাদকীয় উক্তিমধ্যে নিম্নোদ্ধৃত লীডর দেখা গেল।
“THE WISDOM OF A NATIVE MAGISTRATE.-A story of lamentable failure of justice and race antipathy has reached us from the Mofussil. John Dickson, an English gentleman of good birth though at present rather in straightened circumstances had fallen under the displeasure of a clique of designing natives headed by one Rungini Jeliani, a person, as we are assured on good authority, of great wealth, and considerable influence in native society. He was hauled up before a native Magistrate on a charge of some petty larceny which, if the trial had taken place before a European Magistrate, would have been at once thrown out as preposterous, when preferred against a European of Mr. Dickson’s position and character. But Baboo Jaladhar Gangooly, the ebony-coloured Daniel before whose awful tribunal, Mr. Dickson had the misfortune to be dragged, was incapable of understanding that petty larencies, however, congenial to sharp intellects of his own country, have never been known to be perpetrated by men born and bred on English soil, and the poor man was convicted on evidence the trumpery character of which was probably as well known to the magistrate as to the prospecutors themselves. The poor man pleaded his birth, and his rights as a European British subject, to be tried by a magistrate of his own race, but the plea was nagatived for reasons we neither know nor are able to conjecture. Possibly the Babu was under the impression that Lord Ripon’s cruel and nefarious Government had already passed into Law the Bill which is to authorize every man with a dark skin lawfully to murder and hang every man with a white one. May that day be distant yet! Meanwhile we leave our readers to conjecture from a study of the names Jaladhar and Jaliani whether the tie of kindred which obviously exists between prosecutor and magistrate has had no influence in producing this extraordinary decision.”
এই লীডর বাহির হইলে পর উহা পড়িয়া জেলার মাজিষ্ট্রেট সাহেব জলধরবাবুকে চাপরাশি পাঠাইয়া তলব করিয়া আনিলেন। গরিব ব্রাহ্মণ নবমীর পাঁঠার মত কাঁপিতে কাঁপিতে হুজুরের কাছে গিয়া উপস্থিত হইল। তিনি সেলাম করিতে না করিতে সাহেব গরম হইয়া বলিলেন, “What do you mean, Babu, by convicting a European British subject?”
ডিপুটি। What European British subject, Sir?
ম্যাজিষ্ট্রেট। Read here, I suppose you can do that. I am going to report you to the Government for this piece of folly.
এই বলিয়া সাহেব কাগজখানা বাবুর কাছে ফেলিয়া দিলেন, বাবু কুড়াইয়া লইয়া পড়িলেন। সাহেব বলিলেন,“Do you now understand?”
Deputy. Yes, Sir, but this man was not a European British subject.
Magistrate. How do you know that?
Deputy. He was very dark.
Magistrate. Do you find it laid down in the law that a fair skin is the only evidence by which a man shall be adjudged to be a European subject?
Deputy. No, Sir.
Magistrate. Well, what other evidence did you take?
এখন ডিপুটিবাবুটি বহুকালের ডিপুটি-জানিতেন যে, তর্কে তাঁহার জিত নিশ্চিত, কিন্তু তর্কে জিতিলেই বিপদ্। অতএব সুচতুর দেশী চাকুরের যাহা কর্ত্তব্য,-তাহা করিলেন, তর্ক ছাড়িয়া দিলেন। বলিলেন,“I, do not presume to discuss the matter with you, Sir, I see I was wrong, and I am very sorry for it.”
এখন ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব নিতান্ত বোকা নহেন, ভিতরে ভিতরে একটু রঙ্গদার। এই কথা শুনিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন,“Very sorry for what?”
Deputy. For convicting a European British subject.
Magistrate. Why so?
Deputy. Because it is very wrong for a native to convict a European British subject.
Magistrate. Why very wrong?
ডিপুটিটি সাহেবকে এক হাটে কিনিতে আর হাটে বেচিতে পারে। অমনি উত্তর দিল,“Very wrong, because a European British subject cannot commit a crime and a native cannot judge honestly.”
Magistrate. Do you admit that?
Deputy. I do not see why I should not. I try to do my duty to the best of my ability, but I speak of my countrymen generally.
Magistrate. You don’t think countrymen ought to try Europeans?
Deputy. Most certainly they should not. The glorious British Empire will come to an end if they do.
Magistrate. Well, Babu, I am glad to see you are so sensible. I wish all your countrymen were equally so; at least that all native magistrates were like you.
Deputy. Oh Sir! how can you expect it, when there are men at the top of our service who think differently.
Magistrate. Are you not yourself near the top? You must have served long.
Deputy. Unfortunately my claims to promotion have always been overlooked. I thought of speaking to you, Sir, on the subject.
Magistrate. You certainly deserve promotion. I will write to the Commissioner and see what can be done for you.
ডিপুটি তখন দুই হাতে সেলাম করিয়া উঠিয়া গেলেন। এই সময় জয়েন্ট সাহেব, বড় সাহেবের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ডিপুটি বাহির হইয়া গেল জয়েন্ট দেখিলেন। জয়েন্ট, বড় সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “What could you have been saying to this fellow?”
Magistrate. Oh! He is very amusing.
Joint. How so?
Magistrate. He is both fool and knave. He thinks of pleasing me by traducing his own countrymen.
Joint. And did you tell him your mind?
Magistrate. O no! I promised him promotion, which I will try to get for him. He has at least the merit of not being conceited. A conceited native is perfectly useless as a subordinate, and I prefer encouraging men to make a moderate estimate of their own merits.
এ দিকে, ডিপুটি ফিরিয়া আসিলে পর, আর এক ডিপুটি বাবুর সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। দোশরা ডিপুটি জলধরকে বলিলেন, “সাহেবের কাছে গিয়াছিলেন না কি?”
জলধর। হাঁ। কি পাপে পড়েছি!
২রা ডিপুটি। কেন?
জ। সে দিনকার সেই বাগদী বেটাকে কয়েদ দিয়াছিলাম বলিয়া, সাহেব বলে, গবর্ণমেণ্টে আমার নামে রিপোর্ট করিবে।
২রা ডিপুটি। তার পর?
জ। তার পর আর কি? প্রমোশ্যনের রিপোর্ট করিয়ে এলেম।
২রা ডিপুটি। সে কি? কি মন্ত্রে?
জ। মন্ত্র আর কি? দুটো মন রাখা কথা।

———————
7 llbert বিল সম্বন্ধীয় বিবাদকালে ইহা লিখিত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *