1 of 2

রাজসিংহ – ১.৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : চিত্রবিচারণ
পরদিন চঞ্চলকুমারী ক্রীত চিত্রগুলি একা বসিয়া মনোযোগের সহিত দেখিতেছিলেন। নির্‍মলকুমারী আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া চঞ্চল বলিল, “নির্‍মল ! ইহার মধ্যে কাহাকেও তোমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে?”
নির্‍মল বলিল, “যাহাকে আমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, তাহার চিত্র ত তুমি পা দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ |”
চ। ঔরঙ্গজেবকে!
নি । আশ্চর্‍য হইলে যে?
চ। বদ্জাতের ধাড়ি যে? অমন পাষণ্ড যে আর পৃথিবীতে জন্মে নাই?
নি । বদ্জাতকে বশ করিতেই আমার আনন্দ। তোমার মনে নাই, আমি বাঘ
পুষিতাম? আমি একদিন না একদিন ঔরঙ্গজেবকে বিবাহ করিব ইচ্ছা আছে।
চ। মুসলমান যে?
নি । আমার হাতে পড়িলে ঔরঙ্গজেবও হিন্দু হবে।
চ। তুমি মর।
নি । কিছুমাত্র আপত্তি নাই–কিন্তু ঐ একখানা কার ছবি তুমি পাঁচ বার করিয়া দেখিতেছ, সে খবরটা লইয়া তবে মরিব।
চঞ্চলকুমারী তখন আর পাঁচখানা চিত্রের মধ্যে ক্ষিপ্রহস্তে করস্থ চিত্রখানি মিশাইয়া দিয়া বলিল, “কোন্ ছবি আবার পাঁচ বার করিয়া দেখিতেছিলাম? মানুষে মানুষের একটা কলঙ্ক দিতে পারিলেই কি হয়? কোন্ ছবিখানা পাঁচ বার করিয়া দেখিতেছিলাম?” নির্‍মল হাসিয়া বলিল, “একখানা তসবির দেখিতেছিলে, তার আর কলঙ্ক কি? রাজকুমারী, তুমি রাগ করিলে বলিয়া আমার কাছে ধরা পড়িলে। কার এমন কপাল প্রসন্ন, তসবিরগুলা দেখিলে আমি খুঁজিয়া বাহির করিতে পারি |”
চ। আকব্বর শাহের।
নি । আকব্বরের নামে রাজপুতনী ঝাড়ু মারে। তা ত নহেই।
এই বলিয়া নির্‍মলকুমারী তসবিরের গোছা হাতে লইয়া খুঁজিতে লাগিল। বলিল, “তুমি যেখানি দেখিতেছিলে, তাহার উল্‍টা পিঠে একটা কালো দাগ আছে দেখিয়াছি |” সেই চিহ্ন ধরিয়া, নির্‍মলকুমারী একখানা ছবি বাহির করিয়া চঞ্চলকুমারীর হাতে দিল, বলিল, “এইখানি |”
চঞ্চলকুমারী রাগ করিয়া ছবিখানি ফেলিয়া দিল। বলিল, “তোর আর কিছু কাজ নেই, তাই তুই লোককে জ্বালাতন করিতে আরম্ভ করেছিস। তুই দূর হ |”
নি । দূর হব না। তা, রাজকুঙার! এ বুড়ার ছবিতে দেখিবার তুমি এত কি পেয়েছ?
চ। বুড়ো! তোর কি চোখ গিয়েছে না কি?
নির্‍মল চঞ্চলকে জ্বালাইতেছিল, চঞ্চলের রাগ দেখিয়া টিপি টিপি হাসিতে লাগিল। নির্‍মল বড় সুন্দরী, মধুর সরস হাসিতে তাহার সৌন্দর্‍য বড় খুলিল। নির্‍মল হাসিয়া বলিল, “তা ছবিতে বুড়া না দেখাক–লোকে বলে, মহারাণা রাজসিংহের বয়স অনেক হয়েছে। তাঁর দুই পুত্র উপযুক্ত হইয়াছে |”
চ। ও কি রাজসিংহের ছবি? তা অত কে জানে সখি?
নি । কাল কিনেছ–আজ কিছু জান না সখি? তা মানুষটার বয়সও হয়েছে, এমন যে খুব সুপুরুষ, তাও নয়। তবে দেখিতেছিলে কি?
চ।
গৌরী সম্ ঝে ভসমভার
পিয়ারী সম্ ঝে কালা।
শচী সম্ ঝে সহস্রলোচন,
বীর সম্ ঝে বীরবালা ||
 
গঙ্গাগর্‍জন শম্ভুজটপর,
ধরণী বৈঠত বাসুকীফণ্‌‌মে ।
পবন হোয়ত আগুন-সখা,
বীর ভজত যুবতী ম‍ন্‍‌মে ||
নি । এখন, তুমি দেখিতেছি, আপনি মরিবার জন্য ফাঁদ পাতিলে। রাজসিংহকে
ভজিলে, রাজসিংহকে কি কখন পাইতে পারিবে?
চ। পাইবার জন্য কি ভজে? তুমি কি পাইবার জন্য ঔরঙ্গজেব বাদশাহকে
ভজিয়াছ?
নি। আমি ঔরঙ্গজেবকে ভজিয়াছি, যেমন বেড়াল ইন্দুর ভজে। আমি যদি
ঔরঙ্গজেবকে না পাই, তা নয় আমার বেড়ালখেলাটা এ জন্মের মত রহিয়া গেল।
তোমারও কি তাই?
চ। আমারও না হয়, সংসারের খেলাটা এ জন্মের মত রহিয়া গেল।
নি । কিসে কি হয়, তা তুমি আমি কি জানি? কি হইয়াছে, তাই কি জানি?
আমরাও তাই বলি। চঞ্চলকুমারীর কি হইয়াছে, তা ত বলিতে পারি না। শুধু ছবি দেখিয়া কি হয়, তা ত জানি না। অনুরাগ ত মানুষে মানুষে–ছবিতে মানুষে হইতে পারে কি? পারে, যদি তুমি ছবিছাড়াটুকু আপনি ধ্যান করিয়া লইতে পার। পারে, যদি আগে হইতে মনে মনে তুমি কিছু গড়িয়া রাখিয়া থাক, তার পর ছবিখানাকে (বা স্বপ্নটাকে) সেই মনগড়া জিনিসের ছবি বা স্বপ্ন মনে কর। চঞ্চলকুমারীর কি তাই কিছু হইয়াছিল? তা আঠার বছরের মেয়ের মন আমি কেমন করিয়া বুঝিব বা বুঝাইব?
চঞ্চলকুমারীর মন যাই হোক, মনের আগুনে এখন ফুঁ দিয়া সে ভাল করে নাই। কেন না, সম্মুখে বড় বিপদ। কিন্তু সে সকল বিপদের কথা বলিতে আমাদের এখনও অনেক বিলম্ব আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *