মৃণালিনী – ০২

দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ : গৌড়েশ্বর

অতি বিস্তীর্ণ সভমণ্ডপে নবদ্বীপোজ্জ্বলকারী রাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর বিরাজ করিতেছেন। উচ্চ শ্বেত প্রস্তরের বেদির উপরে রত্নপ্রবালবিভূষিত সিংহাসনে, রত্নপ্রবালমণ্ডিত ছত্রতলে বর্ষীয়ান রাজা বসিয়া আছেন। শিরোপরি কনককিঙ্কিণী সংবেষ্টিত বিচিত্র কারুকার্যখচিত শুভ্র চন্দ্রাতপ শোভা পাইতেছে। এক দিকে পৃথগাসনে হোমাবশেষবিভূষিত, অনিন্দ্যমূর্তি ব্রাহ্মণমণ্ডলী সভাপণ্ডিতকে পরিবেষ্টন করিয়া বসিয়া আছেন। যে আসনে, এক দিন হলায়ুধ উপবেশন করিয়াছিলেন, সে আসনে এক্ষণে এক অপরিণামদর্শী চাটুকার অধিষ্ঠান করিতেছিলেন। অন্য দিকে মহামাত্য ধর্মাধিকারকে অগ্রবর্তী করিয়া প্রধান রাজপুরুষেরা উপবেশন করিয়াছিলেন। মহাসামন্ত, মহাকুমারামাত্য, প্রমাতা, ঔপরিক, দাসাপরাধিক, চৌরোদ্ধরণিক, শৌল্কিক, গৌল্মিকগণ ক্যত্রপ, প্রান্তপালেরা, কোষ্ঠপালেরা, কাণ্ডরিক্যা, তদাযুক্তক, বিনিযুক্তক প্রভৃতি সকলে উপবেশন করিতেছেন। মহাপ্রতীহার সশস্ত্রে সভার অসাধারণতা রক্ষা করিতেছেন। স্তাবকেরা উভয় পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। সর্বজন হইতে পৃথগাসনে কুশাসনমাত্র গ্রহণ করিয়া পণ্ডিতবর মাধবাচার্য উপবেশন করিয়া আছেন।
রাজসভার নিয়মিত কার্যসকল সমাপ্ত হইলে, সভাভঙ্গের উদ্যোগ হইল। তখন মাধবাচার্য রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! ব্রাহ্মণের বাচালতা মার্জনা করিবেন। আপনি রাজনীতিবিশারদ, এক্ষণে ভূমণ্ডলে যত রাজগণ আছেন সর্বাপেক্ষা বহুদর্শী; প্রজাপালক; আপনিই আজন্ম রাজা। আপনার অবিদিত নাই যে, শত্রুদমন রাজার প্রধান কর্ম। আপনি প্রবল শত্রুদমনের কি উপায় করিয়াছেন?”
রাজা কহিলেন, “কি আজ্ঞা করিতেছেন?” সকল কথা বর্ষীয়মান রাজার শ্রুতিসুলভ হয় নাই।
মাধবাচার্যের পুনরুক্তির প্রতীক্ষা না করিয়া ধর্মাধিকার পশুপতি কহিলেন, “মহারাজাধিরাজ! মাধবাচার্য রাজসমীপে জিজ্ঞাসু হইয়াছেন যে, রাজশত্রুদমনের কি উপায় হইয়াছে। বঙ্গেশ্বরের কোন্ শত্রু এ পর্যন্ত দমিত হয় নাই, তাহা এখনও আচার্য ব্যক্ত করেন নাই। তিনি সবিশেষ বাচন করুন |”
মাধবাচার্য অল্প হাস্য করিয়া এবার অত্যুচ্চস্বরে কহিলেন, “মহারাজ, তুরকীয়েরা আর্যাবর্ত প্রায় সমুদয় হস্তগত করিয়াছে। আপাতত: তাহারা মগধ জয় করিয়া গৌড়রাজ্য আক্রমণের উদ্যোগে আছে |”
এবার কথা রাজার কর্ণে প্রবেশলাভ করিল। তিনি কহিলেন, “তুরকীদিগের কথা বলিতেছেন? তুরকীয়েরা কি আসিয়াছে?”
মাধবাচার্য কহিলেন, “ঈশ্বর রক্ষা করিতেছেন; এখনও তাহারা এখানে আসে নাই। কিন্তু আসিলে আপনি কি প্রকারে তাহাদিগের নিবারণ করিবেন?”
রাজা কহিলেন- “আমি কি করিব-আমি কি করিব? আমার এই প্রাচীন শরীর, আমার যুদ্ধের উদ্যোগ সম্ভবে না। আমার এক্ষণে গঙ্গালাভ হইলেই হয়। তুরকীয়েরা আসে আসুক |”
এবম্ভূত রাজবাক্য সমাপ্ত হইলে সভাস্থ সকলেই নীরব হইল। কেবল মহাসামন্তের কোষমধ্যস্থ অসি অকারণ ঈষৎ ঝনৎকার শব্দ করিল। অধিকাংশ শ্রোতৃবর্গের মুখে কোন ভাবই ব্যক্ত হইল না। মাধবাচার্যের চক্ষু হইতে একবিন্দু অশ্রুপাত হইল।
সভাপণ্ডিত দামোদর প্রথমে কথা বলিলেন, “আচার্য, আপনি কি ক্ষুব্ধ হইলেন? যেরূপ রাজাজ্ঞা হইল, ইহা শাস্ত্রসঙ্গত। শাস্ত্রে ঋষিবাক্য প্রযুক্ত আছে যে, তুরকীয়েরা এ দেশ অধিকার করিবে। শাস্ত্রে আছে অবশ্য ঘটিবে -কাহার সাধ্য নিবারণ করে? তবে যুদ্ধোদ্যমে প্রয়োজন কি?”
মাধবাচার্য কহিলেন, “ভাল সভাপণ্ডিত মহাশয়, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আপনি এতদুক্তি কোন্ শাস্ত্রে দেখিয়াছেন?”
দামোদর কহিলেন, “বিষ্ণুপুরাণে আছে, যথা___”
মা। ‘যথা’ থাকুক-বিষ্ণুপুরাণ আনিতে অনুমতি করুন; দেখান এরূপ উক্তি কোথায় আছে?
দা। আমি কি এতই ভ্রান্ত হইলাম? ভাল, স্মরণ করিয়া দেখুন দেখি, মনুতে এ কথা আছে কি না?
মা। গৌড়েশ্বরের সভাপণ্ডিত মানবধর্মশাস্ত্রেরও কি পারদর্শী নহেন?
দা। কি জ্বালা! আপনি আমাকে বিহ্বল করিয়া তুলিলেন। আপনার সম্মুখে সরস্বতী বিমনা হয়েন, আমি কোন্ ছার? আপনার সম্মুখে গ্রন্থের নাম স্মরণ হইবে না; কিন্তু কবিতাটা শ্রবণ করুন।
মা। গৌড়েশ্বরের সভাপণ্ডিত যে অনুষ্টুপ্চ্ছ ন্দে একটি কবিতা রচনা করিয়া থাকিবেন, ইহা কিছুই অসম্ভব নহে। কিন্তু আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি- তুরকজাতীয় কর্তৃক গৌড়বিজয়বিষয়িণী কথা কোন শাস্ত্রে কোথাও নাই।
পশুপতি কহিলেন, “আপনি কি সর্বশাস্ত্রবিৎ?”
মাধবাচার্য কহিলেন, “আপনি যদি পারেন, তবে আমাকে অশাস্ত্রজ্ঞ বলিয়া প্রতিপন্ন করুন?”
সভাপণ্ডিতের এক জন পারিষদ কহিলেন, “আমি করিব। আত্মশ্লাঘা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। যে আত্মশ্লাঘাপরবশ, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?”
মাধবাচার্য কহিলেন, “মূর্খ তিনজন। যে আত্মরক্ষায় যত্নহীন, যে সেই যত্নহীনতার প্রতিপোষাক, আর যে আত্মবুদ্ধির অতীত বিষয়ে বাক্যব্যয় করে, ইহারাই মূর্খ। আপনি ত্রিবিধ মূর্খ |”
সভাপণ্ডিতের পারিষদ অধোবদনে উপবেশন করিলেন।
পশুপতি কহিলেন, “যবন আইসে, আমরা যুদ্ধ করিব |”
মাধবাচার্য কহিলেন, “সাধু! সাধু! আপনার যেরূপ যশ:, সেইরূপ প্রস্তাব করিলেন। জগদীশ্বর আপনাকে কুশলী করুন! আমার কেবল এই জিজ্ঞাসা যে, যদি যুদ্ধই অভিপ্রায়, তবে তাহার কি উদ্যোগ হইয়াছে!”
পশুপতি কহিলেন, “মন্ত্রণা গোপনেই বক্তব্য। এ সভাতলে প্রকাশ্য নহে। কিন্তু যে অশ্ব, পদাতি এবং নাবিকসেনা সংগৃহীত হইতেছে, কিছু দিন এই নগরী পর্যটন করিলে তাহা জানিতে পারিবেন।”
মা। কতক কতক জানিয়াছি।
প। তবে এ প্রস্তাব করিতেছেন কেন?
মা। প্রস্তাবের তাৎপর্য এই যে, এক বীরপুরুষ এক্ষণে এখানে সমাগত হইয়াছেন। মগধের যুবরাজ হেমচন্দ্রের বীর্যের খ্যাতি শুনিয়া থাকিবেন।
প। বিশেষ শুনিয়াছি। ইহাও শ্রুত আছি যে, তিনি মহাশয়ের শিষ্য। আপনি বলিতে পারিবেন যে, ঈদৃশ বীরপুরুষের বাহুরক্ষিত মগধরাজ্য শত্রুহস্তগত হইল কি প্রকারে।
মা। যবনবিপ্লবের কালে যুবরাজ প্রবাসে ছিলেন। এই মাত্র কারণ।
প। তিনি কি এক্ষণে নবদ্বীপে আগমন করিয়াছেন?
মা। আসিয়াছেন। রাজ্যাপহারক যবন এই দেশে আগমন করিতেছে শুনিয়া এই দেশে তাহাদিগের সহিত সংগ্রাম করিয়া দস্যুর দণ্ডবিধান করিবেন। গৌড়রাজ তাঁহার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করিয়া উভয়ে শত্রু বিনাশের চেষ্টা করিলে উভয়ের মঙ্গল।
প। রাজবল্লভেরা অদ্যই তাঁহার পরিচর্যায় নিযুক্ত হইবে। তাঁহার নিবাসার্থ যথাযোগ্য বাসগৃহ নির্দিষ্ট হইবে। সন্ধিনিবন্ধনের মন্ত্রণা যথাযোগ্য সময়ে স্থির হইবে।
পরে রাজাজ্ঞায় সভাভঙ্গ হইল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : কুসুমনির্মিতা

উপনগর প্রান্তে গঙ্গাতীরবর্তী এক অট্টালিকা হেমচন্দ্রের বাসার্থে রাজপুরুষেরা নির্দিষ্ট করিলেন। হেমচন্দ্র মাধবাচার্যের পরামর্শনুসারে সুরম্য অট্টালিকায় আবাস সংস্থাপিত করিলেন।
নবদ্বীপে জনার্দন নামে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। তিনি বয়োবাহুল্যপ্রযুক্ত এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ের হানিপ্রযুক্ত সর্বতোভাবে অসমর্থ। অথচ নি:সহায়। তাঁহার সহধর্মিণীও প্রাচীনা এবং শক্তিহীনা। কিছু দিন হইল, ইঁহাদিগের পর্ণকুটীর প্রবল বাত্যায় বিনাশপ্রাপ্ত হইয়াছিল। সেই অবধি ইঁহারা আশ্রয়াভাবে এই বৃহৎ পুরীর এক পার্শ্বে রাজপুরুষদিগের অনুমতি লইয়া বাস করিতেছিলেন। এক্ষণে কোন রাজপুত্র আসিয়া তথায় বাস করিবেন শুনিয়া তাঁহারা পরাধিকার ত্যাগ করিয়া বাসান্তরের অন্বেষণে যাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন।
হেমচন্দ্র উহা শুনিয়া দু:খিত হইলেন। বিবেচনা করিলেন যে, এই বৃহৎ ভবনে আমাদিগের উভয়েরই স্থান হইতে পারে। ব্রাহ্মণ কেন নিরাশ্রয় হইবেন? হেমচন্দ্র দিগ্বিজয়কে আজ্ঞা করিলেন, “ব্রাহ্মণকে গৃহত্যাগ করিতে নিবারণ কর |” ভৃত্য ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিল, “এ কার্য ভৃত্য দ্বারা সম্ভবে না। ব্রাহ্মণঠাকুর আমার কথা কাণে তুলেন না |”
ব্রাহ্মণ বস্তুত: অনেকেরই কথা কাণে তুলেন না-কেন না, তিনি বধির। হেমচন্দ্র ভাবিলেন, ব্রাহ্মণ অভিমানপ্রযুক্ত ভৃত্যের আলাপ গ্রহণ করেন না। এজন্য স্বয়ং তৎসম্ভাষণে গেলেন। ব্রাহ্মণকে প্রণাম করিলেন।
জনার্দন আশীর্বাদ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”
হে। আমি আপনার ভৃত্য।
জ। কি বলিলে-তোমার নাম রামকৃষ্ণ?
হেমচন্দ্র অনুভব করিলেন, ব্রাহ্মণের শ্রবণশক্তি বড় প্রবল নহে। অতএব উচ্চতরস্বরে কহিলেন, “আমার নাম হেমচন্দ্র। আমি ব্রাহ্মণের দাস |”
জ। ভাল ভাল; প্রথমে ভাল শুনিতে পাই নাই, তোমার নাম হনুমান দাস।
হেমচন্দ্র মনে করিলেন, “নামের কথা দূর হউক। কার্যসাধন হইলেই হইল |” বলিলেন, “নবদ্বীপাধিপতির এই অট্টালিকা, তিনি ইহা আমার বাসের জন্য নিযুক্ত করিয়াছেন। শুনিলাম আমার আসায় আপনি স্থান ত্যাগ করিতেছেন |”
জ। না, এখনও গঙ্গাস্নানে যাই নাই; এই স্নানের উদ্যোগ করিতেছি।
হে। (অত্যুচ্চৈ:স্বরে) স্নান যথাসময়ে করিবেন। এক্ষণে আমি এই অনুরোধ করিতে আসিয়াছি যে, আপনি এ গৃহ ছাড়িয়া যাইবেন না।
জ। গৃহে আহার করিব না? তোমার বাটীতে কি? আদ্য শ্রাদ্ধ?
হে। ভাল: আহারাদির অভিলাষ করেন, তাহারও উদ্যোগ হইবে। এক্ষণে যেরূপ এ বাড়ীতে অবস্থিতি করিতেছেন, সেইরূপই করুন।
জ। ভাল ভাল; ব্রাহ্মণভোজন করাইলে দক্ষিণা ত আছেই। তা বলিতে হইবে না। তোমার বাড়ী কোথা?
হেমচন্দ্র হতাশ্বাস হইয়া প্রত্যাবর্তন করিতেছিলেন, এমন সময়ে পশ্চাৎ হইতে কে তাঁহার উত্তরীয় ধরিয়া টানিল। হেমচন্দ্র ফিরিয়া দেখিলেন। দেখিয়া প্রথম মুহূর্তে তাঁহার বোধ হইল, সম্মুখে একখানি কুসুমনির্মিতা দেবীপ্রতিমা। দ্বিতীয় মুহূর্তে দেখিলেন, প্রতিমা সজীব; তৃতীয় মুহূর্তে দেখিলেন, প্রতিমা নহে, বিধাতার নির্মাণকৌশলসীমা-রূপিণী বালিকা অথবা পূর্ণযৌবনা তরুণী।
বালিকা না তরুণী? ইহা হেমচন্দ্র তাহাকে দেখিয়া নিশ্চিত করিতে পারিলেন না।
বীণানিন্দিতস্বরে সুন্দরী কহিলেন, “তুমি পিতামহকে কি বলিতেছিলে? তোমার কথা উনি শুনিতে পাইবেন কেন?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তাহা ত পাইলেন না দেখিলাম। তুমি কে?”
বালিকা বলিল, “আমি মনোরমা |”
হে। ইনি তোমার পিতামহ?
ম। তুমি পিতামহকে কি বলিতেছিলে?
হে। শুনিলাম ইনি এ গৃহ ত্যাগ করিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন। আমি তাই নিবারণ করিতে আসিয়াছি।
ম। এ গৃহে এক রাজপুত্র আসিয়াছেন। তিনি আমাদিগকে থাকিতে দিবেন কেন?
হে। আমিই সেই রাজপুত্র। আমি তোমাদিগকে অনুরোধ করিতেছি, তোমরা এখানে থাক।
ম। কেন?
এ ‘কেন’র উত্তর নাই। হেমচন্দ্র অন্য উত্তর না পাইয়া কহিলেন, “কেন? মনে কর, যদি তোমার ভাই আসিয়া এই গৃহে বাস করিত, সে কি তোমাদিগকে তাড়াইয়া দিত?”
ম। তুমি কি আমার ভাই?
হে। আজি হইতে তোমার ভাই হইলাম। এখন বুঝিলে?
ম। বুঝিয়াছি। কিন্তু ভগিনী বলিয়া আমাকে কখন তিরস্কার করিবে না ত?
হেমচন্দ্র মনোরমার কথার প্রণালীতে চমৎকৃত হইতে লাগিলেন। ভাবিলেন, “এ কি অলৌকিক সরলা বালিকা? না উন্মাদিনী?” কহিলেন, “কেন তিরস্কার করিব?”
ম। যদি আমি দোষ করি?
হে। দোষ দেখিলে কে না তিরস্কার করে?
মনোরমা ক্ষুণ্ণভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন, বলিলেন, “আমি কখন ভাই দেখি নাই; ভাইকে কি লজ্জা করিতে হয়?”
হে। না।
ম। তবে আমি তোমাকে লজ্জা করি না-তুমি আমাকে লজ্জা করিবে?
হেমচন্দ্র হাসিলেন-কহিলেন, “আমার বক্তব্য তোমার পিতামহকে জানাইতে পারিলাম না,-তাহার উপায় কি?”
ম। আমি বলিতেছি।
এই বলিয়া মৃদু মৃদু স্বরে জনার্দনের নিকট হেমচন্দ্রের অভিপ্রায় জানাইলেন।
হেমচন্দ্র দেখিয়া বিস্মিত হইলেন যে, মনোরমার সেই মৃদু কথা বধিরের বোধগম্য হইল।
ব্রাহ্মণ আনন্দিত হইয়া রাজপুত্রকে আশীর্বাদ করিলেন। এবং কহিলেন, “মনোরমা, ব্রাহ্মণীকে বল, রাজপুত্র তাঁহার নাতি হইলেন-আশীর্বাদ করুন |” এই বলিয়া ব্রাহ্মণ স্বয়ং “ব্রাহ্মণি! ব্রাহ্মণি!” বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণী তখন স্থানান্তরে গৃহকার্য ব্যাপৃতা ছিলেন-ডাক শুনিতে পাইলেন না। ব্রাহ্মণ অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “ব্রাহ্মণীর ঐ বড় দোষ কাণে কম শোনেন।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : নৌকাযানে

হেমচন্দ্র ত উপবনগৃহে সংস্থাপিত হইলেন। আর মৃণালিনী? নির্বাসিতা, পরপীড়িতা, সহায়হীনা মৃণালিনী কোথায়?
সান্ধ্য গগনে রক্তিম মেঘমালা কাঞ্চনবর্ণ ত্যাগ করিয়া ক্রমে ক্রমে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিল। রজনীদত্ত তিমিরাবরণে গঙ্গার বিশাল হৃদয় অস্পষ্টীকৃত হইল। সভামণ্ডলে পরিচারকহস্তজ্বালিত দীপমালার ন্যায়, অথবা প্রভাতে উদ্যানকুসুমসমূহের ন্যায়, আকাশে নক্ষত্রগণ ফুটিতে লাগিল। প্রায়ান্ধাকার নদীহৃদয়ে নৈশ সমীরণ কিঞ্চিৎ খরতরবেগে বহিতে লাগিল। তাহাতে রমণীহৃদয়ে নায়কসংস্পর্শজনিত প্রকম্পের ন্যায়, নদীবক্ষে তরঙ্গ উত্থিত হইতে লাগিল। কূলে তরঙ্গাভিঘাতজনিত ফেনপুঞ্জে শ্বেতপুষ্পমালা গ্রথিত হইতে লাগিল। বহু লোকের কোলাহলের ন্যায় বীচিরব উত্থিত হইল। নাবিকেরা নৌকাসকল তীরলগ্ন করিয়া রাত্রির জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করিতে লাগিল। তন্মধ্যে একখানি ছোট ডিঙ্গি অন্য নৌকা হইতে পৃথক এক খালের মুখে লাগিল। নাবিকেরা আহারাদির ব্যবস্থা করিতে লাগিল।
ক্ষুদ্র তরণীতে দুইটিমাত্র আরোহী। দুইটিই স্ত্রীলোক। পাঠককে বলিতে হইবে না, ইহারা মৃণালিনী আর গিরিজায়া।
গিরিজায়া মৃণালিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “আজিকার দিন কাটিল |”
মৃণালিনী কোন উত্তর করিল না।
গিরিজায়া পুনরপি কহিল, “কালিকার দিনও কাটিবে-পরদিনও কাটিবে-কেন কাটিবে না?”
মৃণালিনী তথাপি কোন উত্তর করিলেন না; কেবলমাত্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
গিরিজায়া কহিল, “ঠাকুরাণি! এ কি এ? দিবানিশি চিন্তা করিয়া কি হইবে? যদি আমাদিগের নদীয়া আসা কাজ ভাল না হইয়া থাকে, চল, এখনও ফিরিয়া যাই |”
মৃণালিনী এবার উত্তর করিলেন। বলিলেন, “কোথায় যাইবে?”
গি। চল, হৃষীকেশের বাড়ী যাই।
মৃ। বরং এই গঙ্গাজলে ডুবিয়া মরিব।
গি। চল, তবে মথুরায় যাই।
মৃ। আমি ত বলিয়াছি, তথায় আমার স্থান নাই। কুলটার ন্যায় রাত্রিকালে যে বাপের ঘর ছাড়িয়া আসিয়াছি, কি বলিয়া সে বাপের ঘরে আর মুখ দেখাইব?
গি। কিন্তু তুমি ত আপন ইচ্ছায় আইস নাই, মন্দ ভাবিয়াও আইস নাই। যাইতে ক্ষতি কি?
মৃ। সে কথা কে বিশ্বাস করিবে? যে বাপের ঘরে আদরের প্রতিমা ছিলাম, সে বাপের ঘরে ঘৃণিত হইয়াই বা কি প্রকারে থাকিব?
গিরিজায়া অন্ধকারে দেখিতে পাইল না যে, মৃণালিনীর চক্ষু হইতে বারিবিন্দুর পর বারিবিন্দু পড়িতে লাগিল। গিরিজায়া কহিল, “তবে কোথায় যাইবে?”
মৃ। যেখানে যাইতেছি।
গি। সে ত সুখের যাত্রা। তবে অন্যমন কেন? যাহাকে দেখিতে ভালবাসি, তাহাকে দেখিতে যাইতেছি, ইহার অপেক্ষা সুখ আর কি আছে?
মৃ। নদীয়ায় আমার সহিত হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না।
গি। কেন? তিনি কি সেখানে নাই?
মৃ। সেইখানেই আছেন। কিন্তু তুমি ত জান যে, আমার সহিত এক বৎসর অসাক্ষাৎ তাঁহার ব্রত। আমি কি সে ব্রত ভঙ্গ করাইব?
গিরিজায়া নীরব হইয়া রহিল। মৃণালিনী আবার কহিলেন, “আর কি বলিয়াই বা তাঁহার নিকট দাঁড়াইব। আমি কি বলিব যে, হৃষীকেশের উপর রাগ করিয়া আসিয়াছি, না, বলিব যে, হৃষীকেশ আমাকে কুলটা বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছে?”
গিরিজায়া ক্ষণেক নীবর থাকিয়া কহিল, “তবে কি নদীয়ায় তোমার সঙ্গে হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না?”
মৃ। না।
গি। তবে যাইতেছ কেন?
মৃ। তিনি আমাকে দেখিতে পাইবেন না। কিন্তু আমি তাঁহাকে দেখিব। তাঁহাকে দেখিতেই যাইতেছি।
গিরিজায়ার মুখে হাসি ধরিল না। বলিল, “তবে আমি গীত গাই,
চরণতলে দিনু হে শ্যাম পরাণ রতন।
দিব না তোমারে নাথ মিছার যৌবন ||
এ রতন সমতুল,     ইহা তুমি দিবে মূল,
দিবানিশি মোরে নাথ দিবে দরশন ||
ঠাকুরাণি, তুমি তাঁহাকে দেখিয়া ত জীবধারণ করিবে। আমি তোমার দাসী হইয়াছি, আমার ত তাহাতে পেট ভরিবে না, আমি কি খেয়ে বাঁচিব?”
মৃ। আমি দুই একটি শিল্পকর্ম জানি। মালা গাঁথিতে জানি, চিত্র করিতে জানি, কাপড়ের ফুল তুলিতে জানি। তুমি বাজারে আমার শিল্পকর্ম বিক্রয় করিয়া দিবে।
গিরি। আর আমি ঘরে ঘরে গীত গায়িব। “মৃণাল অধমে” গাইব কি?
মৃণালিনী অর্ধহাস্য, অর্ধ সকোপ দৃষ্টিতে গিরিজায়ার প্রতি কটাক্ষ করিলেন।
গিরিজায়া কহিল, “অমন করিয়া চাহিলে আমি গীত গায়িব |” এই বলিয়া গায়িল,
“সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে।
কে আছে কাণ্ডারী হেন কে যাইবে সঙ্গে ||”
মৃণালিনী কহিল, “যদি এত ভয়, তবে একা এলে কেন?”
গিরিজায়া কহিল, “আগে কি জানি |” বলিয়া গায়িতে লাগিল,
“ভাস্‌ল তরী সকাল বেলা,       ভাবিলাম এ জলখেলা,
      মধুর বহিবে বায়ু ভেসে যাব রঙ্গে।
এখন – গগনে গরজে ঘন,       বহে খর সমীরণ,
   কূল ত্যজি এলাম কেন, মরিতে আতঙ্গে ||”
মৃণালিনী কহিল, “কূলে ফিরিয়া যাও না কেন?”
গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,
“মনে করি কূলে ফিরি,       বাহি তরী ধীরি ধীরি
      কূলেতে কণ্টক-তরু বেষ্টিত ভুজঙ্গে |”
মৃণালিনী কহিলেন, “তবে ডুবিয়া মর না কেন?”
গিরিজায়া কহিল, “মরি তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু” বলিয়া আবার গায়িল,
“যাহারে কাণ্ডারী করি,       সাজাইয়া দিনু তরী,
      সে কভু না দিল পদ তরণীর অঙ্গে ||”
মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া, এ কোন অপ্রেমিকের গান |”
গি। কেন?
মৃ। আমি হইলে তরী ডুবাই।
গি। সাধ করিয়া?
মৃ। সাধ করিয়া।
গি। তবে তুমি জলের ভিতর রত্ন দেখিয়াছ।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ : বাতায়নে

হেমচন্দ্র কিছু দিন উপবনগৃহে বাস করিলেন। জনার্দনের সহিত প্রত্যহ সাক্ষাৎ হইত; কিন্তু ব্রাহ্মণের বধিরতাপ্রযুক্ত ইঙ্গিতে আলাপ হইত মাত্র। মনোরমার সহিতও সর্বদা সাক্ষাৎ হইত, মনোরমা কখন তাঁহার সহিত উপযাচিকা হইয়া কথা কহিতেন, কখন বা বাক্যব্যয় না করিয়া স্থানান্তরে চলিয়া যাইতেন। বস্তুত: মনোরমার প্রকৃতি তাঁহার পক্ষে অধিকতর বিস্ময়জনক বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। প্রথমত: তাঁহার বয়ক্রম: দুরনুমেয়, সহজে তাঁহাকে বালিকা বলিয়া বোধ হইত, কিন্তু কখন কখন মনোরমাকে অতিশয় গাম্ভীর্যশালিনী দেখিতেন। মনোরমা কি অদ্যাপি কুমারী? হেমচন্দ্র একদিন কথোপকথনচ্ছলে মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মনোরমা, তোমার শ্বশুরবাড়ী কোথা?” মনোরমা কহিল, “বলিতে পারি না |” আর এক দিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মনোরমা, তুমি কয় বৎসরের হইয়াছ?” মনোরমা তাহাতেও উত্তর দিয়াছিলেন, “বলিতে পারি না |”
মাধবাচার্য হেমচন্দ্রকে উপবনে স্থাপিত করিয়া দেশপর্যটনে যাত্রা করিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় এই যে, এ সময় গৌড়দেশীয় অধীন রাজগণ যাহাতে নবদ্বীপে সসৈন্য সমবেত হইয়া গৌড়েশ্বরের আনুকূল্য করেন, তদ্বিষয়ে তাঁহাদিগকে প্রবৃত্তি দেন। হেমচন্দ্র নবদ্বীপে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু নিষ্কর্মে দিনযাপন ক্লেশকর হইয়া উঠিল। হেমচন্দ্র বিরক্ত হইলেন। এক একবার মনে হইতে লাগিল যে, দিগ্বিজয়কে গৃহরক্ষায় রাখিয়া অশ্ব লইয়া একবার গৌড়ে গমন করেন। কিন্তু তথায় মৃণালিনীর সাক্ষাৎ লাভ করিলে তাঁহার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হইবে, বিনা সাক্ষাতে গৌড়যাত্রায় কি ফলোদয় হইবে? এই সকল আলোচনায় যদিও গৌড়যাত্রায় হেমচন্দ্র নিরস্ত হইলেন, তথাপি অনুদিন মৃণালিনীচিন্তায় হৃদয় নিযুক্ত থাকিত। একদা প্রদোষকালে তিনি শয়নকক্ষে, পর্যঙ্কোপরি শয়ন করিয়া মৃণালিনীর চিন্তা করিতেছিলেন। চিন্তাতেও হৃদয় সুখলাভ করিতেছিল। মুক্ত বাতায়নপথে হেমচন্দ্র প্রকৃতির শোভা নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। নবীন শরদুদয়। রজনী চন্দ্রিকাশালিনী, আকাশ নির্মল, বিস্তৃত নক্ষত্রখচিত, ক্কচিৎ স্তরপরম্পরাবিন্যস্ত স্বেতাম্বুদমালায় বিভূষিত। বাতায়নপথে অদূরবর্তিনী ভাগীরথীও দেখা যাইতেছিল; ভাগীরথী বিশালোরসী, বহুদূরবিসর্পিণী, চন্দ্রকর-প্রতিঘাতে উজ্জ্বলতরঙ্গিণী, দূরপ্রান্তে ধূমময়ী, নববারি-সমাগম-প্রহ্লাদিনী। নববারি-সমাগমজনিত কল্লোল হেমচন্দ্র শুনিতে পাইতেছিলেন। বাতায়নপথে বায়ু প্রবেশ করিতেছিল। বায়ু গঙ্গাতরঙ্গে নিক্ষিপ্ত জলকণা-সংস্পর্শে শীতল, নিশাসমাগমে প্রফুল্ল বন্যকুসুমসংস্পর্শে সুগন্ধি; চন্দ্রকরপ্রতিঘাতী-শ্যামোজ্জ্বল বৃক্ষপত্র বিধূত করিয়া, নদীতীরবিরাজিত কাশকুসুম আন্দোলিত করিয়া, বায়ু বাতায়নপথে প্রবেশ করিতেছিল। হেমচন্দ্র বিশেষ প্রীতিলাভ করিলেন।
অকস্মাৎ বাতায়নপথ অন্ধকার হইল-চন্দ্রালোকের গতি রোধ হইল। হেমচন্দ্র বাতায়নসন্নিধি একটি মনুষ্যমুণ্ড দেখিতে পাইলেন। বাতায়ন, ভূমি হইতে কিছু উচ্চ-এজন্য কাহারও হস্তপদাদি কিছু দেখিতে পাইলেন না-কেবল একখানি মুখ দেখিলেন। মুখখানি অতি বিশালশ্মশ্রুসংযুক্ত, তাহার মস্তকে উষ্ণীষ। সেই উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে, বাতায়নের নিকটে, সম্মুখে শ্মশ্রুসংযুক্ত উষ্ণীষধারী মনুষ্যমুণ্ড দেখিয়া, হেমচন্দ্র শয্যা হইতে লম্ফ দিয়া নিজ শাণিত অসি গ্রহণ করিলেন।
অসি গ্রহণ করিয়া হেমচন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন যে, বাতায়নে আর মনুষ্যমুণ্ড নাই।
হেমচন্দ্র অসিহস্তে দ্বারোদ্ঘাটন করিয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। বাতায়নতলে আসিলেন। তথায় কেহ নাই।
গৃহের চতু:পার্শ্বে, গঙ্গাতীরে, বনমধ্যে হেমচন্দ্র ইতস্তত: অন্বেষণ করিলেন। কোথাও কাহাকে দেখিলেন না।
হেমচন্দ্র গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। তখন রাজপুত্র পিতৃদত্ত যোদ্ধৃবেশে আপাদমস্তক আত্মশরীর মণ্ডিত করিলেন। অকালজলদোদয়বিমর্ষিত গগনমণ্ডলবৎ তাঁহার সুন্দর মুখকান্তি অন্ধকারময় হইল। তিনি একাকী সেই গম্ভীর নিশাতে শস্ত্রময় হইয়া যাত্রা করিলেন। বাতায়নপথে মনুষ্যমুণ্ড দেখিয়া তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন যে, বঙ্গে তুরক আসিয়াছে।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাপীকূলে

অকালজলদোদয়স্বরূপ ভীমমূর্তি রাজপুত্র হেমচন্দ্র তুরকের অন্বেষণে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। ব্যাঘ্র যেমন আহার্য দেখিবামাত্র বেগে ধাবিত হয়, হেমচন্দ্র তুরক দেখিবামাত্র সেইরূপ ধাবিত হইলেন। কিন্তু কোথায় তুরকের সাক্ষাৎ পাইবেন, তাহার স্থিরতা ছিল না।
হেমচন্দ্র একটিমাত্র তুরক দেখিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি এই সিদ্ধান্ত করিলেন যে, হয় তুরকসেনা নগরসন্নিধানে উপস্থিত হইয়া লুক্কায়িত আছে, নতুবা এই ব্যক্তি তুরকসেনার পূর্বচর। যদি তুরকসেনাই আসিয়া থাকে, তবে উৎসঙ্গে একাকী সংগ্রাম সম্ভবে না। কিন্তু যাহাই হউক, প্রকৃত অবস্থা কি, তাহার অনুসন্ধান না করিয়া হেমচন্দ্র কদাচ স্থির থাকিতে পারেন না। যে মহৎকার্য জন্য মৃণালিনীকে ত্যাগ করিয়াছেন, অদ্য রাত্রিতে নিদ্রাভিভূত হইয়া সে কর্মে উপেক্ষা করিতে পারেন না। বিশেষ যবনবধে হেমচন্দ্রের আন্তরিক আনন্দ। উষ্ণীষধারী মুণ্ড দেখিয়া অবধি তাঁহার জিঘাংসা ভয়ানক প্রবল হইয়াছে, সুতরাং তাঁহার স্থির হইবার সম্ভাবনা কি? অতএব দ্রুতপদবিক্ষেপে হেমচন্দ্র রাজপথাভিমুখে চলিলেন।
উপবনগৃহ হইতে রাজপথ কিছু দূর। যে পথ বাহিত করিয়া উপবনগৃহ হইতে রাজপথে যাইতে হয়, সে বিরল-লোক-প্রবাহ গ্রাম্য পথ মাত্র। হেমচন্দ্র সেই পথে চলিলেন। সেই পথপার্শ্বে অতি বিস্তারিত, সুরম্য সোপানাবলিশোভিত এক দীর্ঘিকা ছিল। দীর্ঘিকাপার্শ্বে অনেক বকুল, শাল, অশোক, চম্পক, কদম্ব, অশ্বত্থ, বট, আম্র, তিন্তিড়ী প্রভৃতি বৃক্ষ ছিল। বৃক্ষগুলি যে সুশৃঙ্খলরূপে শ্রেণীবিন্যস্ত ছিল, এমত নহে, বহুতর বৃক্ষ পরস্পর শাখায় শাখায় সম্বদ্ধ হইয়া বাপীতীরে ঘনান্ধকার করিয়া রহিত। দিবসেও তথায় অন্ধকার। কিম্বদন্তী ছিল যে, সেই সরোবরে ভূতযোনি বিহার করিত। এই সংস্কার প্রতিবাসীদিগের মনে এরূপ দৃঢ় হইয়া উঠিয়াছিল যে, সচরাচর তথায় কেহ যাইত না। যদি যাইত, তবে একাকী কেহ যাইত না। নিশাকালে কদাপি কেহ যাইত না।
পৌরাণিক ধর্মের একাধিপত্যকালে হেমচন্দ্রও ভূতযোনির অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রত্যয়শালী হইবেন, তাহার আর বিচিত্র কি? কিন্তু প্রেতসম্বন্ধে প্রত্যয়শালী বলিয়া তিনি গন্তব্য পথে যাইতে সঙ্কোচ করেন, এরূপ ভীরুস্বভাব নহেন। অতএব তিনি নি:সঙ্কোচ হইয়া বাপীপার্শ্ব দিয়া চলিলেন। নি:সঙ্কোচ বটে, কিন্তু কৌতূহলশূন্য নহেন। বাপীর পার্শ্বে সর্বত্র এবং তত্তীরপ্রতি অনিমেষলোচন নিক্ষিপ্ত করিতে করিতে চলিলেন। সোপানমার্গের নিকটবর্তী হইলেন। সহসা চমকিত হইলেন। জনশ্রুতির প্রতি তাঁহার বিশ্বাস দৃঢ়ীকৃত হইল। দেখিলেন, চন্দ্রালোকে সর্বাধ:স্থ সোপানে, জলে চরণ রক্ষা করিয়া শ্বেতবসনপরিধানা কে বসিয়া আছে। স্ত্রীমূর্তি বলিয়া তাঁহার বোধ হইল। শ্বেতবসনা অবেণীসম্বদ্ধকুন্তলা; কেশজাল স্কন্ধ, পৃষ্ঠদেশ, বাহুযগল, মুখমণ্ডল, হৃদয় সর্বত্র আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে। প্রেত বিবেচনা করিয়া হেমচন্দ্র নি:শব্দে নি:শব্দে চলিয়া যাইতেছিলেন। কিন্তু মনে ভাবিলেন, যদি মনুষ্য হয়? এত রাত্রে কে এ স্থানে? সে ত তুরককে দেখিলে দেখিয়া থাকিতে পারে? এই সন্দেহে হেমচন্দ্র ফিরিলেন। নির্ভয়ে বাপীতীরারোহণ করিলেন, সোপানমার্গে ধীরে ধীরে অবতরণ করিতে লাগিলেন। প্রেতিনী তাঁহার আগমন জানিতে পারিয়াও সরিল না, পূর্বমত রহিল। হেমচন্দ্র তাঁহার নিকটে আসিলেন। তখন সে উঠিয়া দাঁড়াইল। হেমচন্দ্রের দিকে ফিরিল; হস্তদ্বারা মুখাবরণকারী কেশদাম অপসৃত করিল। হেমচন্দ্র তাহার মুখ দেখাইলেন। সে প্রেতিনী নহে, কিন্তু প্রেতিনী হইলে হেমচন্দ্র অধিকতর বিস্ময়াপন্ন হইতেন না। কহিলেন, “কে, মনোরমা! তুমি এখানে?”
মনোরমা কহিল, “আমি এখানে অনেকবার আসি-কিন্তু তুমি এখানে কেন?”
হে। আমার কর্ম আছে।
ম। এ রাত্রে কি কর্ম?
হে। পশ্চাৎ বলিব; এ রাত্রে এখানে কেন?
ম। তোমার এ বেশ কেন? হাতে শূল; কাঁকালে তরবারি; তরবারে এ কি জ্বলিতেছে? এ কি হীরা? মাথায় এ কি? ইহাতে ঝকমক করিয়া জ্বলিতেছে, এই বা কি? এও কি হীরা? এত হীরা পেলে কোথা?
হে। আমার ছিল।
ম। এ রাত্রে এত হীরা পরিয়া কোথায় যাইতেছ? চোরে যে কাড়িয়া লইবে?
হে। আমার নিকট হইতে চোরে কাড়িতে পারে না।
ম। তা এত রাত্রে এত অলঙ্কারে প্রয়োজন কি? তুমি কি বিবাহ করিতে যাইতেছ?
হে। তোমার কি বোধ হয়, মনোরমা?
ম। মানুষ মারিবার অস্ত্র লইয়া কেহ বিবাহ করিতে যায় না। তুমি যুদ্ধে যাইতেছ।
হে। কাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিব? তুমিই বা এখানে কি করিতেছিলে?
ম। স্নান করিতেছিলাম। স্নান করিয়া বাতাসে চুল শুকাইতেছিলাম। এই দেখ, চুল এখনও ভিজা রহিয়াছে।
এই বলিয়া মনোরমা আর্দ্র কেশ হেমচন্দ্রের হস্তে স্পর্শ করাইলেন।
হে। রাত্রে স্নান কেন?
ম। আমার গা জ্বালা করে।
হে। গঙ্গাস্নান না করিয়া এখানে কেন?
ম। এখানকার জল বড় শীতল।
হে। তুমি সর্বদা এখানে আইস?
ম। আসি।
হে। আমি তোমার সম্বন্ধ করিতেছি-তোমার বিবাহ হইবে। বিবাহ হইলে এরূপ কি প্রকারে আসিবে?
ম। আগে বিবাহ হউক।
হেমচন্দ্র হাসিয়া কহিলেন, “তোমার লজ্জা নাই-তুমি কালামুখী |”
ম। তিরস্কার কর কেন? তুমি যে বলিয়াছিলে, তিরস্কার করিবে না।
হে। সে অপরাধ লইও না। এখান দিয়া কাহাকেও যাইতে দেখিয়াছ?
ম। দেখিয়াছি।
হে। তাহার কি বেশ?
ম। তুরকের বেশ।
হেমচন্দ্র অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “সে কি? তুমি তুরক চিনিলে কি প্রকারে?”
ম। আমি পূর্বে তুরক দেখিয়াছি।
হে। সে কি? কোথায় দেখিলে?
ম। যেখানে দেখি না-তুমি কি সেই তুরকের অনুসরণ করিবে?
হে। করিব-সে কোন্ পথে গেল?
ম। কেন?
হে। তাহাকে বধ করিব।
ম। মানুষ মেরে কি হবে?
হে। তুরক আমার পরম শত্রু।
ম। তবে একটি মারিয়া কি তৃপ্তি লাভ করিবে?
হে। আমি যত তুরক দেখিতে পাইব, তত মারিব।
ম। পারিবে?
হে। পারিব।
মনোরমা বলিল, “তবে সাবধানে আমার সঙ্গে আইস |”
হেমচন্দ্র ইতস্তত: করিতে লাগিলেন। যবনযুদ্ধে এই বালিকা পথপ্রদর্শিনী!
মনোরমা তাঁহার মানসিক ভাব বুঝিলেন; বলিলেন, “আমাকে বালিকা ভাবিয়া অবিশ্বাস করিতেছ?”
হেমচন্দ্র মনোরমার প্রতি চাহিয়া দেখিলেন। বিস্ময়াপন্ন হইয়া ভাবিলেন-মনোরমা কি মানুষী?

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : পশুপতি

গৌড়দেশের ধর্মাধিকার পশুপতি অসাধরণ ব্যক্তি; তিনি দ্বিতীয় গৌড়েশ্বর। রাজা বৃদ্ধ, বার্ধক্যের ধর্ম্মানুসারে পরমতাবলম্বী এবং রাজকার্যে অযত্নবান হইয়াছিলেন, সুতরাং প্রধানামাত্য ধর্মাধিকারের হস্তেই গৌড়রাজ্যের প্রকৃত ভার অর্পিত হইয়াছিল। এবং সম্পদে অথবা ঐশ্বর্যে পশুপতি গৌড়েশ্বরের সমকক্ষ ব্যক্তি হইয়া উঠিয়াছিলেন।
পশুপতির বয়:ক্রম পঞ্চত্রিংশং বৎসর হইবে। তিনি দেখিতে অতি সুপুরুষ। তাঁহার শরীর দীর্ঘ, বক্ষ বিশাল, সর্বাঙ্গ অস্থিমাংসের উপযুক্ত সংযোগে সুন্দর। তাঁহার বর্ণ তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ; ললাট অতি বিস্তৃত, মানসিক শক্তির মন্দিরস্বরূপ। নাসিকা দীর্ঘ এবং উন্নত, চক্ষু ক্ষুদ্র, কিন্তু অসাধারণ ঔজ্জ্বল্য-সম্পন্ন। মুখকান্তি জ্ঞানগাম্ভীর্যব্যঞ্জক এবং অনুদিন বিষয়ানুষ্ঠানজনিত চিন্তার গুণে কিছু পুরুষভাবপ্রকাশক। তাহা হইলে কি হয়, রাজসভাতলে তাঁহার ন্যায় সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ আর কেহই ছিল না। লোকে বলিত, গৌড়দেশে তাদৃশ পণ্ডিত এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিও কেহ ছিল না।
পশুপতি জাতিতে ব্রাহ্মণ, কিন্তু তাঁহার জন্মভূমি কোথা, তাহা কেহ বিশেষ জ্ঞাত ছিল না। কথিত ছিল যে, তাঁহার পিতা শাস্ত্রব্যবসায়ী দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন।
পশুপতি কেবল আপন বুদ্ধিবিদ্যার প্রভাবে গৌড়রাজ্যের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন।
পশুপতি যৌবনকালে কাশীধামে পিতার নিকট থাকিয়া শাস্ত্রাধ্যয়ন করিতেন। তথায় কেশব নামে এক বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। হৈমবতী নামে কেশবের এক অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা ছিল। তাহার সহিত পশুপতির পরিণত হয়। কিন্তু অদৃষ্টবশত: বিবাহের রাত্রেই কেশব, সম্প্রদানের পর কন্যা লইয়া অদৃশ্য হইল। আর তাহার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। সেই পর্যন্ত পশুপতি পত্নীসহবাসে বঞ্চিত ছিলেন। কারণবশত: একাল পর্যন্ত দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ করেন নাই। তিনি এক্ষণে রাজপ্রাসাদতুল্য উচ্চ অট্টালিকায় বাস করিতেন, কিন্তু বামানয়ননি:সৃত জ্যোতির অভাবে সেই উচ্চ অট্টালিকা আজি অন্ধকারময়।
আজি রাত্রে সেই উচ্চ অট্টালিকার এক নিভৃত কক্ষে পশুপতি একাকী দীপালোকে বসিয়া আছেন। এই কক্ষের পশ্চাতেই আম্রকানন। আম্রকাননে নিষ্ক্রান্ত হইবার জন্য একটি গুপ্তদ্বার আছে। সেই দ্বারে আসিয়া নিশীথকালে, মৃদু মৃদু কে আঘাত করিল। গৃহাভ্যন্তর হইতে পশুপতি দ্বার উদ্ঘাটিত করিলেন। এক ব্যক্তি গৃহে প্রবেশ করিল। সে মুসলমান। হেমচন্দ্র তাহাকেই বাতায়নপথে দেখিয়াছিলেন। পশুপতি, তখন তাহাকে পৃথগাসনে উপবেশন করিতে বলিয়া বিশ্বাসজনক অভিজ্ঞান দেখিতে চাহিলেন। মুসলমান অভিজ্ঞান দৃষ্ট করাইলেন।
পশুপতি সংস্কৃতে কহিলেন, “বুঝিলাম আপনি তুরকসেনাপতির বিশ্বাসপাত্র। সুতরাং আমারও বিশ্বাসপাত্র। আপনারই নাম মহম্মদ আলি? এক্ষণে সেনাপতির অভিপ্রায় প্রকাশ করুন |”
যবন সংস্কৃতে উত্তর দিলেন, কিন্তু তাঁহার সংস্কৃতে তিন ভাগ ফরাসী, আর অবশিষ্ট চতুর্থ ভাগ যেরূপ সংস্কৃত, তাহা ভারতবর্ষে কখন ব্যবহৃত হয় নাই। তাহা মহম্মদ আলিরই সৃষ্ট সংস্কৃত। পশুপতি বহুকষ্টে তাহার অর্থবোধ করিলেন। পাঠক মহাশয়ের সে কষ্টভোগের প্রয়োজন নাই, আমরা তাঁহার সুবোধার্থ সে নূতন সংস্কৃত অনুবাদ করিয়া দিতেছি।
যবন কহিল, “খিলিজি সাহেবের অভিপ্রায় আপনি অবগত আছেন। বিনা যুদ্ধে গৌড়বিজয় করিবেন তাঁহার ইচ্ছা হইয়াছে। কি হইলে আপনি এ রাজ্য তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিবেন?”
পশুপতি কহিলেন, “আমি এ রাজ্য তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিব কি না, তাহা অনিশ্চিত। স্বদেশবৈরিতা মহাপাপ। আমি এ কর্ম কেন করিব?”
য। উত্তম। আমি চলিলাম। কিন্তু আপনি তবে কেন খিলিজির নিকট দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন?
প। তাঁহার যুদ্ধের সাধ কতদূর পর্যন্ত, তাহা জানিবার জন্য।
য। তাহা আমি আপনাকে জানাইয়া দিই। যুদ্ধেই তাঁহার আনন্দ।
প। মনুষ্যযুদ্ধে, পশুযুদ্ধে চ? হস্তিযুদ্ধে কেমন আনন্দ?
মহম্মদ আলি সকোপে কহিলেন, “গৌড়ের যুদ্ধের অভিপ্রায়ে আসা পশুযুদ্ধেই আসা। বুঝিলাম, ব্যঙ্গ করিবার জন্যই আপনি সেনাপতিকে লোক পাঠাইতে বলিয়াছিলেন। আমরা যুদ্ধ জানি, ব্যঙ্গ জানি না। যাহা জানি, তাহা করিব |”
এই বলিয়া মহম্মদ আলি গমনোদ্যোগী হইল। পশুপতি কহিলেন, “ক্ষণেক অপেক্ষা করুন, আর কিছু শুনিয়া যান। আমি যবনহস্তে এ রাজ্য সমর্পণ করিতে অসম্মত নহি; অক্ষমও নহি। আমিই গৌড়ের রাজা, সেনরাজা নামমাত্র। কিন্তু সমুচিত মূল্য না পাইলে আপন রাজ্য কেন আপনাদিগকে দিব?”
মহম্মদ আলি কহিলেন, “আপনি কি চাহেন?”
প। খিলিজি কি দিবেন?
য। আপনার যাহা আছে, তাহা সকলই থাকিবে-আপনার জীবন, ঐশ্বর্য পদ সকলই থাকিবে। এই মাত্র।
প। তবে আমি পাইলাম কি? এ সকলই ত আমার আছে-কি লোভে আমি এ গুরুতর পাপানুষ্ঠান করিব?
য। আমাদের আনুকূল্য না করিলে কিছুই থাকিবে না; যুদ্ধ করিলে, আপনার ঐশ্বর্য পদ, জীবন পর্যন্ত অপহৃত হইবে।
প। তাহা যুদ্ধ শেষ না হইলে বলা যায় না। আমরা যুদ্ধ করিতে একেবারে অনিচ্ছুক বিবেচনা করিবেন না। বিশেষ মগধে বিদ্রোহের উদ্যোগ হইতেছে, তাহাও অবগত আছি। তাহার নিবারণ জন্য এক্ষণে খিলিজি ব্যস্ত, গৌড়জয় চেষ্টা আপাতত: কিছু দিন তাঁহাকে ত্যাগ করিতে হইবে, তাহাও অবগত আছি। আমার প্রার্থিত পুরস্কার না দেন না দিবেন; কিন্তু যুদ্ধ যদি স্থির হয়, তবে আমাদিগের এই উত্তম সময়। যখন বিহারে বিদ্রোহিসেনা সজ্জিত হইবে, গৌড়েশ্বরের সেনাও সাজিবে।
ম। ক্ষতি কি? পিঁপড়ের কামড়ের উপর মশা কামড়াইলে হাতী মরে না। কিন্তু আপনার প্রার্থিত পুরস্কার কি, তাহা শুনিয়া যাইতে বাসনা করি।
প। শুনুন। আমিই এক্ষণে প্রকৃত গৌড়ের ঈশ্বর, কিন্তু লোকে আমাকে গৌড়েশ্বর বলে না। আমি স্বনামে রাজা হইতে বাসনা করি। সেনবংশ লোপ হইয়া পশুপতি গৌড়াধিপতি হউক।
ম। তাহাতে আমাদিগের কি উপকার করিলেন? আমাদিগকে কি দিবেন?
প। রাজকর মাত্র। মুসলমানের অধীনে করপ্রদ মাত্র রাজা হইব।
ম। ভাল; আপনি যদি প্রকৃত গৌড়েশ্বর, রাজা যদি আপনার এরূপ করতলস্থ, তবে আমাদিগের সহিত আপনার কথাবার্তার আবশ্যক কি? আমাদিগের সাহায্যের প্রয়োজন কি? আমাদিগকে কর দিবেন কেন?
প। তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিব। ইহাতে কপটতা করিব না। প্রথমত: সেনরাজ আমার প্রভু; বয়সে বৃদ্ধ, আমাকে স্নেহ করেন। স্ববলে যদি আমি তাঁহাকে রাজ্যচ্যুত করি-তবে অত্যন্ত লোকনিন্দা। আপনারা কিছুমাত্র যুদ্ধোদ্যম দেখাইয়া, আনুকূল্যে বিনা যুদ্ধে রাজধানী প্রবেশপূর্বক তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া আমাকে তদুপরি স্থাপিত করিলে সে নিন্দা হইবে না। দ্বিতীয়ত: রাজ্য অনধিকারীর অধিকারগত হইলেই বিদ্রোহের সম্ভাবনা, আপনাদিগের সাহায্যে সে বিদ্রোহ সহজেই নিবারণ করিতে পারিব। তৃতীয়ত: আমি স্বয়ং রাজা হইলে এক্ষণে সেনরাজার সহিত আপনাদিগের যে সম্বন্ধ, আমার সঙ্গেও সেই সম্বন্ধ থাকিবে। আমাদিগের সহিত যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকিবে। যুদ্ধে আমি প্রস্তুত আছি- কিন্তু জয় পরাজয় উভয়েরই সম্ভাবনা। জয় হইলে আমার নূতন কিছু লাভ হইবে না। কিন্তু পরাজয়ে সর্বস্বহানি। কিন্তু আপনাদিগের সহিত সন্ধি করিয়া রাজ্য গ্রহণ করিলে সে আশঙ্কা থাকিবে না। বিশেষত: সর্বদা যুদ্ধোদ্যত থাকিতে হইলে নূতন রাজ্য সুশাসিত হয় না।
ম। আপনি রাজনীতিজ্ঞের ন্যায় বিবেচনা করিয়াছেন। আপনার কথায় আমার সম্পূর্ণ প্রত্যয় জন্মিল। আমিও এইরূপ স্পষ্ট করিয়া খিলিজি সাহেবের অভিপ্রায় ব্যক্ত করি। তিনি এক্ষণে অনেক চিন্তায় ব্যস্ত আছেন যথার্থ, কিন্তু হিন্দুস্থানে যবনরাজ একেশ্বর হইবেন, অন্য রাজার নামমাত্র আমরা রাখিব না। কিন্তু আপনাকে গৌড়ে শাসনকর্তা করিব। যেমন দিল্লীতে মহম্মদ ঘোরির প্রতিনিধি কুতবউদ্দীন, যেমন পূর্বদেশে কুতবউদ্দীনের প্রতিনিধি বখ্ঘ‍তিয়ার খিলিজি, তেমনই গৌড়ে আপনি বখ্ব‍তিয়ারের প্রতিনিধি হইবেন। আপনি ইহাতে স্বীকৃত আছেন কি না?
পশুপতি কহিলেন, “আমি ইহাতে সম্মত হইলাম |”
ম। ভাল; কিন্তু আমার আর এক কথা জিজ্ঞাস্য আছে। আপনি যাহা অঙ্গীকার করিতেছেন, তাহা সাধন করিতে আপনার ক্ষমতা কি?
প। আমার অনুমতি ব্যতীত একটি পদাতিকও যুদ্ধ করিবে না। রাজকোষ আমার অনুচরের হস্তে। আমার আদেশ ব্যতীত যুদ্ধের উদ্যোগে একটি কড়াও খরচ হইবে না। পাঁচজন অনুচর লইয়া খিলিজিকে রাজপুরে প্রবেশ করিতে বলিও; কেহ জিজ্ঞাসা করিবে না, “কে তোমরা?”
ম। আরও এক কথা বাকি আছে। এই দেশে যবনের পরম শত্রু হেমচন্দ্র বাস করিতেছে। আজ রাত্রেই তাহার মুণ্ড যবন-শিবিরে প্রেরণ করিতে হইবে।
প। আপনারা আসিয়াই তাহা ছেদন করিবেন-আমি শরণাগত-হত্যা-পাপ কেন স্বীকার করিব?
ম। আমাদিগের হইতে হইবে না। যবন-সমাগম শুনিবামাত্র সে ব্যক্তি নগর ত্যাগ করিয়া পলাইবে। আজি সে নিশ্চিন্ত আছে। আজি লোক পাঠাইয়া তাহাকে বধ করুন।
প। ভাল, ইহাও স্বীকার করিলাম।
ম। আমরা সন্তুষ্ট হইলাম। আমি আপনার উত্তর লইয়া চলিলাম।
প। যে আজ্ঞা। আর একটি কথা জিজ্ঞাস্য আছে।
ম। কি, আজ্ঞা করুন।
প। আমি ত রাজ্য আপনাদিগের হাতে দিব। পরে যদি আপনারা আমাকে বহিষ্কৃত করেন?
ম। আমরা আপনার কথায় নির্ভর করিয়া অল্পমাত্র সেনা লইয়া দূত পরিচয়ে পুরপ্রবেশ করিব। তাহাতে যদি আমরা স্বীকার মত কর্ম না করি, আপনি সহজেই আমাদিগকে বহিষ্কৃত করিয়া দিবেন।
প। আর যদি আপনারা অল্প সেনা লইয়া না আইসেন?
ম। তবে যুদ্ধ করিবেন।
এই বলিয়া মহম্মদ আলি বিদায় হইল।

সপ্তম পরিচ্ছেদ : চৌরোদ্ধরণিক

মহম্মদ আলি বাহির হইয়া দৃষ্টিপথাতীত হইলে, অন্য এক জন গুপ্তদ্বার-নিকটে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “প্রবেশ করিব?”
পশুপতি কহিলেন, “কর |”
একজন চৌরোদ্ধরণিক প্রবেশ করিল। সে প্রণত হইলে পশুপতি আশীর্বাদ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন শান্তশীল! মঙ্গল সংবাদ ত?”
চৌরোদ্ধরণিক কহিল, “আপনি একে একে প্রশ্ন করুন-আমি ক্রমে সকল সংবাদ নিবেদন করিতেছি |”
প। যবনদিগের অবস্থিতি স্থানে গিয়াছিলে?
শা। সেখানে কেহ যাইতে পারে না।
প। কেন?
শা। অতি নিবিড় বন, দুর্ভেদ্য।
প। কুঠারহস্তে বৃক্ষচ্ছেদন করিতে করিতে গেলে না কেন?
শা। ব্যাঘ্র ভল্লুকের দৌরাত্ম্য।
প। সশস্ত্রে গেলে না কেন?
শা। যে সকল কাঠুরিয়ারা ব্যাঘ্র ভল্লুক বধ করিয়া বনমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা সকলেই যবন-হস্তে প্রাণত্যাগ করিয়াছে-কেহই ফিরিয়া আইসে নাই।
প। তুমিও না হয় না আসিতে?
শা। তাহা হইলে কে আসিয়া আপনাকে সংবাদ দিত?
পশুপতি হাসিয়া কহিলেন, “তুমিই আসিতে |”
শান্তশীল প্রণাম করিয়া কহিল, “আমিই সংবাদ দিতে আসিয়াছি |”
শান্তশীল আনন্দিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি প্রকারে গেলে?”
শা। প্রথমে উষ্ণীষ অস্ত্র ও তুরকী বেশ সংগ্রহ করিলাম। তাহা বাঁধিয়া পৃষ্ঠে সংস্থাপিত করিলাম। তার উপর কাঠুরিয়াদিগের সঙ্গে বন-পথে প্রবেশ করিলাম। পরে যখন যবনেরা কাঠুরিয়াদিগকে দেখিতে পাইয়া তাহাদিগকে দেখিতে পাইয়া তাহাদিগকে মারিতে প্রবৃত্ত হইল- তখন আমি অপসৃত হইয়া বৃক্ষান্তরালে বেশ পরিবর্তন করিলাম। পরে মুসলমান হইয়া যবনশিবিরে সর্বত্র বেড়াইলাম।
প। প্রশসংনীয় বটে। যবন-সৈন্য কত দেখিলে?
শা। সে বৃহৎ অরণ্যে যত ধরে। বোধ হয়, পঁচিশ হাজার হইবে।
পশুপতি ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, পরে কহিলেন, “তাহাদিগের কথাবার্তা কি শুনিলে?”
শা। বিস্তর শুনিলাম-কিন্তু তাহার কিছুই আপনার নিকট নিবেদন করিতে পারিলাম না।
প। কেন?
শা। যাবনিক ভাষায় পণ্ডিত নহি।
পশুপতি হাস্য করিলেন। শান্তশীল তখন কহিলেন, “মহম্মদ আলি এখানে যে আসিয়াছিলেন, তাহাতে বিপদ আশঙ্কা করিতেছি |”
শা। তিনি অলক্ষিত হইয়া আসিতে পারেন নাই। তাঁহার আগমন কেহ কেহ জানিতে পারিয়াছে।
পশুপতি অত্যন্ত শঙ্কান্বিত হইয়া কহিলেন, “কিসে জানিলে?”
শান্তশীল কহিলেন, “আমি শ্রীচরণ দর্শনে আসিবার সময় দেখিলাম যে, বৃক্ষতলে এক ব্যক্তি লুক্কায়িত হইল। তাহার যুদ্ধের সাজ। তাহার সঙ্গে কথোপকথনে বুঝিলাম যে, সে মহম্মদ আলিকে এ পুরীতে প্রবেশ করিতে দেখিয়া তাহার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে, অন্ধকারে তাহাকে চিনিতে পারিলাম না |”
প। তার পর?
শা। তার পর দাস তাহাকে চিত্রগৃহে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিয়া আসিয়াছে।
পশুপতি চৌরাদ্ধরণিককে সাধুবাদ করিতে লাগিলেন; এবং কহিলেন, “কাল প্রাতে উঠিয়া সে ব্যক্তির প্রতি বিহিত করা যাইবেক। আজি রাত্রিতে সে কারারুদ্ধই থাক। এক্ষণে তোমাকে অন্য এক কার্য সাধন করিতে হইবে। যবন-সেনাপতির ইচ্ছা, অদ্য রাত্রিতে তিনি মগধরাজপুত্রের ছিন্ন মস্তক দর্শন করেন। তাহা এখনই সংগ্রহ করিবে|”
শা। কার্য নিতান্ত সহজ নহে। রাজপুত্র পিঁপড়ে মাছি নন।
প। আমি তোমাকে একা যুদ্ধে যাইতে বলিতেছি না। কতকগুলি লোক লইয়া তাঁহার বাড়ী আক্রমণ করিবে।
শা। লোকে কি বলিবে?
প। লোকে বলিবে, দস্যুতে তাঁহাকে মারিয়া গিয়াছে।
শা। যে আজ্ঞা, আমি চলিলাম।
পশুপতি শান্তশীলকে পুরস্কার দিয়া বিদায় করিলেন। পরে গৃহাভ্যন্তরে যথা বিচিত্র সূক্ষ্ম কারুকার্য-খচিত মন্দিরে অষ্টভুজা মূর্তি স্থাপিত আছে, তথায় গমন করিয়া প্রতিমাগ্রে সাষ্টাগ্রে প্রণাম করিলেন। গাত্রোত্থান করিয়া যুক্ত করে ভক্তিভাবে ইষ্টদেবীর স্তুতি করিয়া কহিলেন, “জননি! বিশ্বপালিনি! আমি অকূল সাগরে ঝাঁপ দিলাম- দেখিও মা! আমায় উদ্ধার করিও। আমি জননীস্বরূপা জন্মভূমি কখন দেবদ্বেষী যবনকে বিক্রয় করিব না। কেবলমাত্র এই আমার পাপাভিসন্ধি যে, অক্ষম প্রাচীন রাজার স্থানে আমি রাজা হইব। যেমন কণ্টকের দ্বারা কণ্টক উদ্ধার করিয়া পরে উভয় কণ্টককে দূরে ফেলিয়া দেয়, তেমনি যবন-সহাতায় রাজ্যলাভ করিয়া রাজ্য-সহায়তায় যবনকে নিপাত করিব। ইহাতে পাপ কি মা? যদি ইহাতে পাপ হয়, যাবজ্জীবন প্রজার সুখানুষ্ঠান করিয়া সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিব। জগৎপ্রসবিনি! প্রসন্ন হইয়া আমার কামনা সিদ্ধ কর |”
এই বলিয়া পশুপতি পুনরপি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন। প্রণাম করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন-শয্যাগৃহে যাইবার জন্য ফিরিয়া দেখিলেন-অপূর্ব দর্শন-
সম্মুখে দ্বারদেশ ব্যাপ্ত করিয়া, জীবনময়ী প্রতিমারূপিণী তরুণী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।
পশুপতি প্রথমে চমকিত হইলেন-শিহরিয়া উঠিলেন। পরক্ষণেই উচ্ছ্বাসোন্মুখ সমুদ্রবারিবৎ আনন্দে স্ফীত হইলেন।
তরুণী বীণানিন্দিত স্বরে কহিলেন, “পশুপতি!”
পশুপতি দেখিলেন-মনোরমা।

অষ্টম পরিচ্ছেদ : মোহিনী

সেই রত্নপ্রদীপদীপ্ত দেবীমন্দিরে, চন্দ্রালোকবিভাসিত দ্বারদেশে, মনোরমাকে দেখিয়া, পশুপতির হৃদয় উচ্ছ্বাসোন্মুখ সমুদ্রের ন্যায় স্ফীত হইয়া উঠিল। মনোরমা নিতান্ত খর্বাকৃতা নহে, তবে তাঁহাকে বালিকা বলিয়া বোধ হইত, তাহার হেতু এই যে, মুখকান্তি অনির্বচনীয় কোমল, অনির্বচনীয় মধুর, নিতান্ত বালিকা বয়সের ঔদার্যবিশিষ্ট; সুতরাং হেমচন্দ্র যে তাঁহার পঞ্চদশ বৎসর বয়:ক্রম অনুভব করিয়াছিলেন, তাহার অন্যায় হয় নাই। মনোরমার বয়:ক্রম যথার্থ পঞ্চদশ, কি ষোড়শ, কি তদধিক, কি তন্ন্যূন, তাহা ইতিহাসে লেখে না, পাঠক মহাশয় স্বয়ং সিদ্ধান্ত করিবেন।
মনোরমার বয়স যতই হউক না কেন, তাঁহার রূপরাশি অতুল-চক্ষুতে ধরে না। বাল্যে, কৈশোরে, যৌবনে, সর্বকালে সে রূপরাশি দুর্লভ। একে বর্ণ সোণার চাঁপা, তাহাতে ভুজঙ্গ-শিশুশ্রেণীর ন্যায় কুঞ্চিত অলকশ্রেণী মুখখানি বেড়িয়া থাকে; এক্ষণে বাপীজলসিঞ্চনে সে কেশ ঋজু হইয়াছে; অর্ধচন্দ্রাকৃত নির্মল ললাট, ভ্রমর-ভর-স্পন্দিত নীলপুষ্পতুল্য কৃষ্ণতার, চঞ্চল, লোচনযুগল; মুহুর্মুহু: আকুঞ্চন-বিস্ফোরণ-প্রবৃত্ত রন্ধ্রযুক্ত সুগঠন নাসা; অধরৌষ্ঠ যেন প্রাত:শিশিরে সিক্ত প্রাত:সূর্যের কিরণে প্রোদ্ভিন্ন রক্তকুসুমাবলীর স্তরযুগল তুল্য; কপোল যেন চন্দ্রকরোজ্জ্বল, নিতান্ত স্থির, গঙ্গাম্বুবিস্তারবৎ প্রসন্ন; শাবকহিংসাশঙ্কায় উত্তেজিতা হংসীর ন্যায় গ্রীবা- বেণী বাঁধিলেও সে গ্রীবার উপরে অবদ্ধ ক্ষুদ্র কুঞ্চিত কেশসকল আসিয়া কেলি করে। দ্বিরদ-রদ যদি কুসুমকোমল হইত, কিম্বা চম্পক যদি গঠনোপযোগী কাঠিন্য পাইত, কিম্বা চন্দ্রকিরণ যদি শরীরবিশিষ্ট হইত, তবে তাহাতে সে বাহুযুগল গড়িতে পারা যাইত-সে হৃদয় কেবল সেই হৃদয়েই গড়া যাইতে পারিত। এ সকলই অন্য সুন্দরীর আছে। মনোরমার রূপরাশি অতুল কেবল তাঁহার সর্বাঙ্গীন সৌকুমার্যের জন্য। তাঁহার বদন সুকুমার; অধর, ভ্রূযুগ, ললাট সুকুমার কপোল; সুকুমার কেশ। অলকাবলী যে ভুজঙ্গশিশুরূপী সেও সুকুমার ভুজঙ্গশিশু। গ্রীবায়, গ্রীবাভঙ্গীতে, সৌকুমার্য; বাহুতে, বাহুর প্রক্ষেপে, সৌকুমার্য; হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে সেই সৌকুমার্য; সুকুমার চরণ, চরণবিন্যাস সুকুমার। গমন সুকুমার, বসন্তবায়ুসঞ্চালিত কুসুমিত লতার মন্দান্দোলন তুল্য; বচন সুকুমার, নিশীথসময়ে জলরাশিপার হইতে সমাগত বিরহ-সঙ্গীত তুল্য; কটাক্ষ সুকুমার, ক্ষণমাত্র জন্য মেঘমালামুক্ত সুধাংশুর কিরণসম্পাত তুল্য; আর ঐ যে মনোরমা দেবীগৃহদ্বারদেশে দাঁড়াইয়া আছেন,-পশুপতির মুখাবলোকন জন্য উন্নতমুখী, নয়নতারা ঊর্ধ্বস্থাপনস্পন্দিত, আর বাপীজলার্দ্র, অবদ্ধ কেশরাশির কিয়দংশ এক হস্তে ধরিয়া, এক চরণ ঈষন্মাত্র অগ্রবর্তী করিয়া, যে ভঙ্গীতে মনোরমা দাঁড়াইয়া আছে, ও ভঙ্গীও সুকুমার; নবীন সূর্যোদয়ে সদ্য:প্রফুল্লদলমালাময়ী নলিনীর প্রসন্ন ব্রীড়াতুল্য সুকুমার। সেই মাধুর্যময় দেহের উপর দেবীপার্শ্বস্থিত রত্নদীপের আলোক পতিত হইল। পশুপতি অতৃপ্তনয়নে দেখিতে লাগিলেন।

নবম পরিচ্ছেদ : মোহিতা

পশুপতি অতৃপ্তনয়নে দেখিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে মনোরমার সৌন্দর্য-সাগরের এক অপূর্ব মহিমা দেখিতে পাইলেন। যেমন সূর্যের প্রখর করমালায় হাস্যময় অম্বুরাশি মেঘসঞ্চারে ক্রমে ক্রমে গম্ভীর কৃষ্ণকান্তি প্রাপ্ত হয়, তেমনই পশুপতি দেখিতে দেখিতে মনোরমার সৌকুমার্যময় মুখমণ্ডল গম্ভীর হইতে লাগিল। আর সে বালিকাসুলভ ঔদার্যব্যঞ্জক ভাব রহিল না। অপূর্ব তেজোভিব্যক্তির সহিত প্রগ্লআভ বয়সেরও দুর্লভ গাম্ভীর্য তাহাতে বিরাজ করিতে লাগিল। সরলতাকে ঢাকিয়া প্রতিভা উদিত হইল। পশুপতি কহিলেন, “মনোরমা, এত রাত্রিতে কেন আসিয়াছ?-এ কি? আজি তোমার এ ভাব কেন?”
মনোরমা উত্তর করিলেন, “আমার কি ভাব দেখিলে?”
প। তোমার দুই মূর্তি-এক মূর্তি আনন্দময়ী, সরলা বালিকা-সে মূর্তিতে কেন আসিলে না?-সেইরূপে আমার হৃদয় শীতল হয়। আর তোমার এই মূর্তি গম্ভীরা তেজস্বিনী প্রতিভাময়ী প্রখরবুদ্ধিশালিনী-এ মূর্তি দেখিলে আমি ভীত হই। তখন বুঝিতে পারি যে, তুমি কেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছ। আজি তুমি এ মূর্তিতে আমাকে ভয় দেখাইতে কেন আসিয়াছ?
ম। পশুপতি, তুমি এত রাত্রি জাগরণ করিয়া কি করিতেছ?
প। আমি রাজকার্যে ব্যস্ত ছিলাম-কিন্তু তুমি-
ম। পশুপতি, আবার? রাজকার্যে না নিজকার্যে?
প। নিজকার্যই বল। রাজকার্যেই হউক, আর নিজকার্যেই হউক, আমি কবে না ব্যস্ত থাকি? তুমি আজি জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন?
ম। আমি সকল শুনিয়াছি।
প। কি শুনিয়াছ?
ম। যবনের সঙ্গে পশুপতির মন্ত্রণা-শান্তশীলের সঙ্গে মন্ত্রণা-দ্বারের পার্শ্বে থাকিয়া সকল শুনিয়াছি।
পশুপতির মুখমণ্ডল যেন মেঘান্ধকারে ব্যাপ্ত হইল। তিনি বহুক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকিয়া কহিলেন, “ভালই হইয়াছে। সকল কথাই আমি তোমাকে বলিতাম – না হয় তুমি আগে শুনিয়াছ। তুমি কোন্ কথা না জান?”
ম। পশুপতি, তুমি আমাকে ত্যাগ করিলে?
প। কেন, মনোরমা? তোমারই জন্যই আমি এ মন্ত্রণা করিয়াছি। আমি এক্ষণে রাজভৃত্য, ইচ্ছামত কার্য করিতে পারি না। এখন বিধবাবিবাহ করিলে জনসমাজে পরিত্যক্ত হইব: কিন্তু যখন আমি স্বয়ং রাজা হইব, তখন কে আমায় ত্যাগ করিবে? যেমন বল্লালসেন কৌলিন্যের নূতন পদ্ধতি প্রচলিত করিয়াছিলেন, আমি সেইরূপ বিধবা-পরিণয়ের নূতন প দ্ধতি প্রচলিত করিব।
মনোরমা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “পশুপতি, সে সকল আমার স্বপ্ন মাত্র। তুমি রাজা হইলে, আমার সে স্বপ্ন ভঙ্গ হইবে। আমি কখনও তোমার মহিষী হইব না |”
প। কেন মনোরমা?
ম। কেন? তুমি রাজ্যভার গ্রহণ করিলে আর কি আমায় ভালবাসিবে? রাজ্যই তোমার হৃদয়ে প্রধান স্থান পাইবে!-তখন আমার প্রতি তোমার অনাদর হইবে। তুমি যদি ভাল না বাসিলে-তবে আমি কেন তোমার পত্নীত্ব-শৃঙ্খলে বাঁধা পড়িব?
প। এ কথাকে কেন মনে স্থান দিতেছ? আগে তুমি-পরে রাজ্য। আমার চিরকাল এইরূপ থাকিবে।
ম। রাজা হইয়া যদি তাহা কর, রাজ্য অপেক্ষা মহিষী যদি অধিক ভালবাস, তবে তুমি রাজ্য করিতে পারিবে না। তুমি রাজ্যচ্যুত হইবে। স্ত্রৈণ-রাজার রাজ্য থাকে না।
পশুপতি প্রশংসমান লোচনে মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন; কহিলেন, “যাহার বামে এমন সরস্বতী, তাহার আশঙ্কা কি? না হয়, তাহাই হউক। তোমার জন্য রাজ্য ত্যাগ করিব |”
ম। তবে রাজ্য গ্রহণ করিতেছ কেন? ত্যাগের জন্য গ্রহণে ফল কি?
প। তোমার পাণিগ্রহণ।
ম। সে আশা ত্যাগ কর। তুমি রাজ্যলাভ করিলে আমি কখনও তোমার পত্নী হইব না।
প। কেন, মনোরমা! আমি কি অপরাধ করিলাম?
ম। তুমি বিশ্বাসঘাতক-আমি বিশ্বাসঘাতককে কি প্রকারে ভক্তি করিব? কি প্রকারে বিশ্বাসঘাতককে ভালবাসিব?
প। কেন, আমি কিসে বিশ্বাসঘাতক হইলাম?
ম। তোমার প্রতিপালক প্রভুকে রাজ্যচ্যুত করিবার কল্পনা করিতেছ; শরণাগত রাজপুত্রকে মারিবার কল্পনা করিতেছ; ইহা কি বিশ্বাসঘাতকের কর্ম নয়? যে প্রভুর বিশ্বাস নষ্ট করিল, সে স্ত্রীর নিকট অবিশ্বাসী না হইবে কেন?
পশুপতি নীরব হইয়া রহিলেন। মনোরমা পুনরপি বলিতে লাগিলেন, “পশুপতি, আমি মিনতি করিতেছি, এই দুর্বুদ্ধি ত্যাগ কর |”
পশুপতি পূর্ববৎ অধোবদনে রহিলেন। তাঁহার রাজ্যাকাঙ্ক্ষা এবং মনোরমাকে লাভ করিবার আকাঙ্ক্ষা উভয়ই গুরুতর। কিন্তু রাজ্যলাভের যত্ন করিলে মনোরমার প্রণয় হারাইতে হয়। সেও অত্যাজ্য। উভয় সঙ্কটে তাঁহার চিত্তমধ্যে গুরুতর চাঞ্চল্য জন্মিল। তাঁহার মতির স্থিরতা দূর হইতে লাগিল। “যদি মনোরমাকে পাই, ভিক্ষাও ভাল, রাজ্যে কাজ কি?” এইরূপ পুন: পুন: মনে ইচ্ছা হইতে লাগিল। কিন্তু তখনই আবার ভাবিতে লাগিলেন, “কিন্তু তাহা হইলে লোকনিন্দা, জনসমাজে কলঙ্ক, জাতিনাশ হইবে; সকলের ঘৃণিত হইব। তাহা কি প্রকারে সহিব?” পশুপতি নীরব রহিলেন; কোন উত্তর করিতে পারিলেন না।
মনোরমা উত্তর না পাইয়া কহিতে লাগিল, “শুন পশুপতি, তুমি আমার কথায় উত্তর দিলে না। আমি চলিলাম। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে ইহজন্মে আমার সাক্ষাৎ হইবে না |”
এই বলিয়া মনোরমা পশ্চাৎ ফিরিল। পশুপতি রোদন করিয়া উঠিলেন।
অমনই মনোরমা আবার ফিরিল। আসিয়া, পশুপতির হস্তধারণ করিল। পশুপতি তাঁহার মুখপানে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, তেজোগর্ববিশিষ্টা, কুঞ্চিতভ্রূবীচিবিক্ষেপকারিণী সরস্বতী মূর্তি আর নাই; সে প্রতিভা দেবী অন্তর্ধান হইয়াছেন; কুসুমসুকুমারী বালিকা তাঁহার হস্তধারণ করিয়া তাঁহার সঙ্গে রোদন করিতেছে।
মনোরমা কহিলেন, “পশুপতি, কাঁদিতেছ কেন?”
পশুপতি চক্ষুর জল মুছিয়া কহিলেন, “তোমার কথায় |”
ম। কেন, আমি কি বলিয়াছি?
প। তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাইতেছিলে।
ম। আর আমি এমন করিব না।
প। তুমি আমার রাজমহিষী হইবে?
ম। হইব।
পশুপতির আনন্দসাগর উছলিয়া উঠিল। উভয়ে অশ্রুপূর্ণ লোচনে উভয়ের মুখপ্রতি চাহিয়া উপবেশন করিয়া রহিলেন। সহসা মনোরমা পক্ষিণীর ন্যায় গাত্রোত্থান করিয়া চলিয়া গেলেন।

দশম পরিচ্ছেদ : ফাঁদ

পূর্বেই কথিত হইয়াছে যে, বাপীতীর হইতে হেমচন্দ্র মনোরমার অনুবর্তী হইয়া যবন-সন্ধানে আসিতেছিলেন। মনোরমা ধর্মাধিকারের গৃহ কিছু দূরে থাকিতে হেমচন্দ্রকে কহিলেন, “সম্মুখে এই অট্টালিকা দেখিতেছ?”
হে। দেখিতেছি।
ম। এখানে যবন প্রবেশ করিয়াছে।
হে। কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়া মনোরমা কহিলেন, “তুমি এইখানে গাছের আড়ালে থাক। যবনকে এই স্থান দিয়া যাইতে হইবে |”
হে। তুমি কোথায় যাইবে?
ম। আমিও এ বাড়ীতে যাইব।
হেমচন্দ্র স্বীকৃত হইলেন। মনোরমার আচরণ দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইলেন। তাহার পরামর্শানুসারে পথিপার্শ্বে বৃক্ষান্তরালে লুক্কায়িত হইয়া রহিলেন। মনোরমা গুপ্তপথে অলক্ষ্যে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
এই সময়ে শান্তশীল পশুপতির গৃহে আসিতেছিল। সে দেখিল যে, এক ব্যক্তি বৃক্ষান্তরালে লুক্কায়িত হইল। শান্তশীল সন্দেহপ্রযুক্ত সেই বৃক্ষতলে গেল। তথায় হেমচন্দ্রকে দেখিয়া প্রথমে চৌর অনুমানে কহিল, “কে তুমি? এখানে কি করিতেছ?” পরে তৎক্ষণে হেমচন্দ্রের বহুমূল্যের অলঙ্কারশোভিত যোদ্ধৃবেশ দেখিয়া কহিল, “আপনি কে?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমি যে হই না কেন?”
শা। আপনি এখানে কি করিতেছেন?
হে। আমি এখানে যবনানুসন্ধান করিতেছি।
শান্তশীল চমকিত হইয়া কহিল, “যবন কোথায়?”
হে। এই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।
শান্তশীল ভীত ব্যক্তির ন্যায় স্বরে কহিল, “এ গৃহে কেন?”
হে। তাহা আমি জানি না।
শা। এ গৃহ কাহার?
হে। তাহা জানি না।
শা। তবে আপনি কি প্রকারে জানিলেন যে, এই গৃহে যবন প্রবেশ করিয়াছে?
হে। তা তোমার শুনিয়া কি হইবে?
শা। এই গৃহ আমার। যদি যবন হইতে প্রবেশ করিয়া থাকে, তবে কোন অনিষ্টকামনা করিয়া গিয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনি যোদ্ধা এবং যবনদ্বেষী দেখিতেছি। যদি ইচ্ছা থাকে তবে আমার সঙ্গে আসুন-উভয়ে চোরকে ধৃত করিব।
হেমচন্দ্র সম্মত হইয়া শান্তশীলের সঙ্গে চলিলেন। শান্তশীল সিংহদ্বার দিয়া পশুপতির গহে হেমচন্দ্রকে লইয়া প্রবেশ করিলেন এবং এক কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “এই গৃহমধ্যে আমার সুবর্ণ রত্নাদি সকল আছে আপনি ইহার প্রহরায় অবস্থিতি করুন। আমি ততক্ষণ সন্ধান করিয়া আসি, কোন্ স্থানে যবন লুক্কায়িত আছে |”
এই কথা বলিয়াই শান্তশীল সেই কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। এবং হেমচন্দ্র কোন উত্তর দিতে না দিতেই বাহির দিকে কক্ষদ্বার রুদ্ধ করিলেন। হেমচন্দ্র ফাঁদে পড়িয়া বন্দী হইয়া রহিলেন।

একাদশ পরিচ্ছেদ : মুক্ত

মনোরমা পশুপতির নিকট বিদায় হইয়াই দ্রুতপদে চিত্রগৃহে আসিল। পশুপতির সহিত শান্তশীলের কথোপকথন সময়ে শুনিয়াছিল যে, ঐ ঘরে হেমচন্দ্র রুদ্ধ হইয়াছিলেন। আসিয়াই চিত্রগৃহের দ্বারোন্মোচন করিল। হেমচন্দ্রকে কহিল, “হেমচন্দ্র, বাহির হইয়া যাও |”
হেমচন্দ্র গৃহের বাহিরে আসিলেন। মনোরমা তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে আসিল। তখন হেমচন্দ্র মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি রুদ্ধ হইয়াছিলাম কেন?”
ম। তাহা পরে বলিব।
হে। যে ব্যক্তি আমাকে রুদ্ধ করিয়াছিল, সে কে?
ম। শান্তশীল।
হে। শান্তশীল কে?
ম। চৌরাদ্ধরণিক।
হে। এই কি তাহার বাড়ী?
ম। না।
হে। এ কাহার বাড়ী?
ম। পরে বলিব।
হে। যবন কোথায় গেল?
ম। শিবিরে গিয়াছে।
হে। শিবির! কত যবন আসিয়াছে?
ম। পঁচিশ হাজার।
হে। কোথায় তাহাদের শিবির?
ম। মহাবনে।
হে। মহাবন কোথায়?
ম। এই নগরের উত্তরে কিছু দূরে।
হেমচন্দ্র করলগ্নকপোল হইয়া ভাবিতে লাগিলেন।
মনোরমা কহিল, “ভাবিতেছ কেন? তুমি কি তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবে?”
হে। পঁচিশ হাজারের সঙ্গে একের যুদ্ধ সম্ভবে?
ম। তবে কি করিবে-ঘরে ফিরিয়া যাইবে?
হে। এখন ঘরে যাব না।
ম। কোথা যাবে?
হে। মহাবনে।
ম। যুদ্ধ করিবে না, তবে মহাবনে যাইবে কেন?
হে। যবনদিগকে দেখিতে।
ম। যুদ্ধ করিবে না, তবে দেখিয়া কি হইবে?
হে। দেখিতে জানিতে পারিব, কি উপায়ে তাহাদিগকে মারিতে পারিব।
মনোরমা চমকিয়া উঠিলেন। কহিলেন, “বিশ হাজার মানুষ মারিবে? কি সর্বনাশ! ছি! ছি!”
হে। মনোরমা, তুমি এ সকল সংবাদ কোথায় পাইলে?
ম। আরও সংবাদ আছে। আজি রাত্রিতে তোমাকে মারিবার জন্য তোমার ঘরে দস্যু আসিবে। আজি ঘরে যাইও না।
এই বলিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।
 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : অতিথি-সৎকার

হেমচন্দ্র গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া এক সুন্দর অশ্ব সজ্জিত করিয়া তদুপরি আরোহণ করিলেন; এবং অশ্বে কশাঘাত করিয়া মহাবনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। নগর পার হইলেন; তৎপরে প্রান্তর। প্রান্তরেরও কিয়দংশ পার হইলেন, এমন সময়ে অকস্মাৎ স্কন্ধদেশে গুরুতর বেদনা পাইলেন। দেখিলেন, স্কন্ধে একটি তীর বিদ্ধ হইয়াছে। পশ্চাতে অশ্বের পদধ্বনি শ্রুত হইল। ফিরিয়া দেখিলেন, তিন জন অশ্বারোহী আসিতেছে।
হেমচন্দ্র ঘোটকের মুখ ফিরাইয়া তাহাদিগের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ফিরিবামাত্র দেখিলেন, প্রত্যেক অশ্বারোহী তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া এক এক শরসন্ধান করিল। হেমচন্দ্র বিচিত্র শিক্ষাকৌশলে করস্থ শূলান্দোলন দ্বারা তীরত্রয়ের আঘাত এককালে নিবারণ করিলেন।
অশ্বারোহিগণ পুনর্বার একেবারে শরসংযোগ করিল। এবং তাহা নিবারিত হইতে না হইতেই পুনর্বার শরত্রয় ত্যাগ করিল।
এইরূপ অবিরত হস্তে হেমচন্দ্রের উপর বাণক্ষেপ করিতে লাগিল। হেমচন্দ্র তখন বিচিত্র রত্নাদিমণ্ডিত চর্ম হস্তে লইলেন, এবং তৎসঞ্চালন দ্বারা অবলীলাক্রমে সেই শরজালবর্ষণ নিরাকরণ করিতে লাগিলেন; কদাচিৎ দুই এক শর অশ্বশরীরে বিদ্ধ হইল মাত্র। স্বয়ং অক্ষত রহিলেন।
বিস্মিত হইয়া অশ্বারোহিত্রয় নিরস্তর হইল। পরস্পরে কি পরামর্শ করিতে লাগিল। হেমচন্দ্র সেই অবকাশে একজনের প্রতি এক শরত্যাগ করিলেন। সে অব্যর্থ সন্ধান। শর একজন অশ্বারোহীর ললাটমধ্যে বিদ্ধ হইল। সে অমনি অশ্বপৃষ্ঠচ্যুত হইয়া ধরাতলশায়িত হইল।
তৎক্ষণাৎ অপর দুই জনে অশ্বে কশাঘাত করিয়া, শূলযুগল প্রণত করিয়া হেমচন্দ্রের প্রতি ধাবমান হইল। এই শূলক্ষেপযোগ্য নৈকট্য প্রাপ্ত হইলে শূলক্ষেপ করিল। যদি তাহারা হেমচন্দ্রকে লক্ষ্য করিয়া শূল ত্যাগ করিত, তবে হেমচন্দ্রের বিচিত্র শিক্ষায় তাহা নিবারিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তাহা না করিয়া আক্রমণকারীরা হেমচন্দ্রের অশ্বপ্রতি লক্ষ্য করিয়া শূলত্যাগ করিয়াছিল। ততদূর অধ:পর্যন্ত হস্তসঞ্চালনে হেমচন্দ্রের বিলম্ব হইল। একের শূল নিবারিত হইল, অপরের নিবারিত হইল না। শূল অশ্বের গ্রীবাতলে বিদ্ধ হইল। সেই আঘাত প্রাপ্তিমাত্র সে রমণীয় ঘোটক মুমূর্ষু হইয়া ভূতলে পড়িল।
সুশিক্ষিতের ন্যায় হেমচন্দ্র পতনশীল অশ্ব হইতে লম্ফ দিয়া ভূতলে দাঁড়াইলেন। এবং পলকমধ্যে নিজ করস্থ করাল শূল উন্নত কহিলেন, “আমার পিতৃদত্ত শূল শত্রুরক্ত পান না করিয়া কখন ফেরে নাই |” তাঁহার এই কথা সমাপ্ত হইতে না হইতে তদগ্রে বিদ্ধ হইয়া দ্বিতীয় অশ্বারোহী ভূতলে পতিত হইল।
ইহা দেখিয়া তৃতীয় অশ্বারোহী অশ্বের মুখ ফিরাইয়া বেগে পলায়ন করিল। সেই শান্তশীল।
হেমচন্দ্র তখন অবকাশ পাইয়া নিজ স্কন্ধবিদ্ধ তীর মোচন করিলেন। তীর কিছু অধিক মাংসভেদ করিয়াছিল -মোচন মাত্র অতিশয় শোণিতস্রুতি হইতে লাগিল। হেমচন্দ্র নিজ বস্ত্র দ্বারা তাহার নিবারণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহা নিষ্ফল হইল। ক্রমে হেমচন্দ্র রক্তক্ষতি হেতু দুর্বল হইতে লাগিলেন। তখন বুঝিলেন যে, যবন-শিবিরে গমনের অদ্য আর কোন সম্ভাবনা নাই। অশ্ব হত হইয়াছে-নিজবল হত হইতেছে। অতএব অপ্রসন্ন মনে, ধীরে ধীরে, নগরাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করিতে লাগিলেন।
হেমচন্দ্র প্রান্তর পার হইলেন। তখন শরীর নিতান্ত অবশ হইয়া আসিল – শোণিতস্রোতে সর্বাঙ্গ আর্দ্র হইল; গতিশক্তি রহিত হইয়া আসিতে লাগিল। কষ্টে নগরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। আর যাইতে পারেন না। এই কুটীরের নিকট বটবৃক্ষতলে উপবেশন করিলেন। তখন রজনী প্রভাত হইয়াছে। রাত্রিজাগরণ-সমস্ত রাত্রির পরিশ্রম-রক্তস্রাবে বলহানি-এই সকল কারণে হেমচন্দ্রের চক্ষুতে পৃথিবী ঘুরিতে লাগিল। তিনি বৃক্ষমূলে পৃষ্ঠ রক্ষা করিলেন। চক্ষু মুদ্রিত হইল-নিদ্রা প্রবল হইল-চেতনা অপহৃত হইল। নিদ্রাবেশে স্বপ্নে যেন শুনিলেন, কে গায়িতেছে,
“কণ্টকে গঠিল বিধি মৃণাল অধমে |”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *