ইন্দিরা – ০৬-১০

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : সুবো

কৃষ্ণদাস বাবু কলিকাতায় কালীঘাটে পূজা দিতে আসিয়াছিলেন। ভবানীপুরে বাসা করিলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার খুড়ার বাড়ী কোথায়? কলিকাতায় না ভবানীপুরে?”
তাহা আমি জানিতাম না।
জিজ্ঞাসা করিলেন, “কলিকাতায় কোন্ জায়গায় তাঁহার বাসা?”
তাহা আমি কিছুই জানিতাম না—আমি জানিতাম, যেমন মহেশপুর একখানি গণ্ডগ্রাম, কলিকাতা তেমনই একখানি গণ্ডগ্রাম মাত্র। একজন ভদ্রলোকের নাম করিলেই লোকে বলিয়া দিবে। এখন দেখিলাম যে, কলিকাতা অনন্ত অট্টালিকার সমুদ্রবিশেষ। আমার জ্ঞাতি খুড়াকে সন্ধান করিবার কোন উপায় দেখিলাম না। কৃষ্ণদাস বাবু আমার হইয়া অনেক সন্ধান করিলেন, কিন্তু কলিকাতায় একজন সামান্য গ্রাম্য লোকের ওরূপ সন্ধান করিলে কি হইবে?
কৃষ্ণদাস বাবু কালীর পূজা দিয়া কাশী যাইবেন, কল্পনা ছিল। পূজা দেওয়া হইল, এক্ষণে সপরিবারে কাশী যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। আমি কাঁদিতে লাগিলাম। তাঁহার পত্নী কহিলেন, “তুমি আমার কথা শুন। এখন কাহারও বাড়ীতে দাসীপনা কর। আজ সুবী আসিবার কথা আছে, তাকে বলিয়া দিব, বাড়ীতে তোমায় চাকরাণী রাখিবে।”
আমি শুনিয়া আছড়াইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলাম। “শেষ কি কপালে দাসীপনা ছিল!” আমার ঠোঁট কাটিয়া রক্ত পড়িতেছিল। কৃষ্ণদাস বাবুর দয়া হইল সন্দেহ নাই, কিন্তু তিনি বলিলেন, “আমি কি করিব?” সে কথা সত্য—তিনি কি করিবেন? আমার কপাল!
আমি একটা ঘরের ভিতর গিয়া একটা কোণে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলাম। সন্ধ্যার অল্প পূর্বে কৃষ্ণদাস বাবুর গিন্নী আমাকে ডাকিলেন। আমি বাহির হইয়া তাঁহার কাছে গেলাম। তিনি বলিলেন, “এই সুবো এয়েছে। তুমি যদি ওদের বাড়ী ঝি থাক, তবে বলিয়া দিই।”
ঝি থাকিব না, না খাইয়া মরিব, সে কথা ত স্থির করিয়াছি—কিন্তু এখনকার সে কথা নহে— এখন একবার সুবোকে দেখিয়া লইলাম। “সুবো” শুনিয়া আমি ভাবিয়া রাখিয়াছিলাম যে “সাহেবসুবা” দরের একটা কি জিনিস—আমি তখন পাড়াগেঁয়ে মেয়ে। দেখিলাম, তা নয়—একটি স্ত্রীলোক—দেখিবার মত সামগ্রী। অনেকদিন এমন ভাল সামগ্রী কিছু দেখি নাই। মানুষটি আমারই বয়সী হইবে। রঙ্ আমা অপেক্ষা যে ফরসা তাও নয়। বেশভূষা এমন কিছু নয়, কাণে গোটাকতক মাকড়ি, হাতে বালা, গলায় চিক, একখানা কালাপেড়ে কাপড় পরা। তাতেই দেখিবার সামগ্রী। এমন মুখ দেখি নাই। যেন পদ্মটি ফুটিয়া আছে—চারি দিক্ হইতে সাপের মত কোঁকড়া চুলগুলা ফণা তুলিয়া পদ্মটা ঘেরিয়াছে। খুব বড় বড় চোখ—কখন স্থির, কখন হাসিতেছে। ঠোঁট দুইখানি পাতলা রাঙ্গা টুকটুকে ফুলের পাপড়ির মত উল্টান, মুখখানি ছোট, সবশুদ্ধ যেন ফুটন্ত ফুল। গড়নপিটন কিরকম, তাহা ধরিতে পারিলাম না। আমগাছের যে ডাল কচিয়া খায়, সে ডাল যেমন বাতাসে খেলে, সেই রকম তাহার সর্বাঙ্গ খেলিতে লাগিল—যেমন নদীতে ঢেউ খেলে, তাহার শরীরে তেমনই কি একটা খেলিতে লাগিল—আমি কিছু ধরিতে পারিলাম না, তার মুখে কি একটা যেন মাখান ছিল, তাহাতে আমাকে যাদু করিয়া ফেলিল। পাঠককে স্মরণ করিয়া দিতে হইবে না যে, আমি পুরুষ মানুষ নহি—মেয়ে মানুষ—নিজেও একদিন একটু সৌন্দর্যগর্বিতা ছিলাম। সুবোর সঙ্গে একটি তিন বছরের ছেলে—সেটিও তেমনি একটি আধফুটন্ত ফুল। উঠিতেছে, পড়িতেছে, বসিতেছে, খেলিতেছে, হেলিতেছে, দুলিতেছে, দৌড়াইতেছে, হাসিতেছে, বকিতেছে, মারিতেছে, সকলকে আদর করিতেছে।
আমি অনিমেষলোচনে সুবোকে ও তার ছেলেকে দেখিতেছি দেখিয়া, কৃষ্ণদাস বাবুর গৃহিণী চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, “কথার উত্তর দাও না যে—ভাব কি?”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “উনি কে?”
গৃহিণী ঠাকুরাণী ধমকাইয়া বলিলেন, “তাও কি বলিয়া দিতে হইবে? ও সুবো, আর কে?” তখন সুবো একটু হাসিয়া বলিল, “তা মাসীমা, একটু বলিয়া দিতে হয় বৈ কি? উনি নূতন লোক, আমায় ত চেনেন না।” এই বলিয়া সুবো আমার মুখপানে চাহিয়া বলিল, “আমার নাম সুভাষিণী গো—ইনি আমার মাসীমা, আমাকে ছেলেবেলা থেকে ওঁরা সুবো বলেন।”
তার পরকথা সূত্রটা গৃহিণী নিজ হস্তে তুলিয়া লইলেন। বলিলেন, “কলিকাতার রামরাম দত্তের ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে। তারা বড় মানুষ। ছেলেবেলা থেকে ও শ্বশুরবাড়ীই থাকে— আমরা কখন দেখিতে পাই না। আমি কালীঘাটে এসেছি শুনে আমাকে একবার দেখা দিতে এসেছে। ওরা বড়মানুষ। বড়মানুষের বাড়ী তুমি কাজকর্ম করিতে পারিবে ত?”
আমি হরমোহন দত্তের মেয়ে, টাকার গদিতে শুইতে চাহিয়াছিলাম— আমি বড়মানুষের বাড়ী কাজ করিতে পারিব ত? আমার চোখে জলও আসিল; মুখে হাসিও হাসিল।
তাহা আর কেহ দেখিল না—সুভাষিণী দেখিল। গৃহিণীকে বলিল, “আমি একটু আড়ালে সেসকল কথা ওঁকে বলি গে। যদি উনি রাজি হন, তবে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব।” এই বলিয়া সুভাষিণী আমার হাত ধরিয়া টানিয়া একটা ঘরের ভিতর লইয়া গেল। সেখানে কেহ ছিল না। কেবল ছেলেটি মার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইয়া গেল। একখানা তক্তপোষ পাতা ছিল। সুভাষিণী তাহাতে বসিল—আমাকে হাত ধরিয়া টানিয়া বসাইল। বলিল, “আমার নাম না জিজ্ঞাসা করিতে বলিয়াছি। তোমার নাম কি ভাই?”
“ভাই!” যদি দাসীপনা করিতে পারি, তবে ইহার কাছে পারি, মনে মনে ইহা ভাবিয়াই উত্তর করিলাম, “আমার দুইটি নাম—একটি চলিত, একটি অপ্রচলিত। যেটি অপ্রচলিত, তাহাই ইঁহাদিগকে বলিয়াছি; কাজেই আপনার কাছে তখন তাহাই বলিব। আমার নাম কুমুদিনী।”
ছেলে বলিল, “কুনুডিনী।”
সুভাষিণী বলিল, “আর নাম এখন নাই শুনিলাম, জাতি কায়স্থ বটে?”
হাসিয়া বলিলাম, “আমরা কায়স্থ।”
সুভাষিণী বলিল, “কার মেয়ে, কার বউ, কোথায় বাড়ী, তাহা এখন জিজ্ঞাসা করিব না। এখন যাহা বলিব, তাহা শুন। তুমি বড়মানুষের মেয়ে, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি—তোমার হাতে গলায়, গহনার কালি আজিও রহিয়াছে। তোমাকে দাসীপনা করিতে বলিব না—মি কিছু কিছু রাঁধিতে জান না কি?”
আমি বলিলাম, “জানি। রান্নায় আমি পিত্রালয়ে যশস্বিনী ছিলাম।”
সুভাষিণী বলিল, “আমাদের বাড়ীতে আমরা সকলেই রাঁধি। (মাঝখান থেকে ছেলে বলিল, “মা, আমি দাঁদি”) তবু, কলিকাতার রেওয়াজমত একটা পাচিকাও আছে। সে মাগীটা বাড়ী যাইবে। (ছেলে বলিল, “ত মা বালী দাই”) এখন মাকে বলিয়া তোমাকে তার জায়গায় রাখাইয়া দিব। তোমাকে রাঁধুনীর মত রাঁধিতে হইবে না। আমরা সকলেই রাঁধিব, তারই সঙ্গে তুমি দুই এক দিন রাঁধিবে। কেমন রাজি?”
ছেলে বলিল, “আজি? ও আজি?”
মা বলিল, “তুই পাজি।”
ছেলে বলিল, “আমি বাবু, বাবা পাজি।”
“অমন কথা বলতে নেই বাবা!” এই কথা ছেলেকে বলিয়া আমার মুখপানে চাহিয়া হাসিয়া সুভাষিণী বলিল, “নিত্যই বলে।” আমি বলিলাম, “আপনার কাছে আমি দাসীপনা করিতেও রাজি।”
“আপনি কেন বল ভাই? বল ত মাকে বলিও। সেই মাকে লইয়া একটু গোল আছে। তিনি একটু খিট্“‍খিটে—তাঁকে বশ করিয়া লইতে হইবে। তা তুমি পারিবে—আমি মানুষ চিনি। কেমন রাজি?”
আমি বলিলাম, “রাজি না হইয়া কি করি? আমার আর উপায় নাই।” আমার চক্ষুতে আবার জল আসিল।
সে বলিল, “উপায় নাই কেন? রও ভাই, আমি আসল কথা ভুলিয়া গিয়াছি। আমি আসিতেছি।”
সুভাষিণী ভোঁ করিয়া ছুটিয়া মাসীর কাছে গেল—বলিল, “হাঁ গা, ইনি তোমাদের কে গা?”
ঐটুকু পর্যন্ত শুনিতে পাইলাম। তাঁর মাসী কি বলিলেন, তাহা শুনিতে পাইলাম না। বোধ হয়, তিনি যতটুকু জানিতেন, তাহাই বলিলেন। বলা বাহুল্য, তিনি কিছুই জানিতেন না; পুরোহিতের কাছে যতটুকু শুনিয়াছিলেন, ততটুকু পযর্ন্ত। ছেলেটি এবার মার সঙ্গে যায় নাই—আমার হাত লইয়া খেলা করিতেছিল। আমি তাহার সঙ্গে কথা কহিতেছিলাম। সুভাষিণী ফিরিয়া আসিল।
ছেলে বলিল, “মা, আঙ্গা হাত দেখ্।”
সুভাষিণী হাসিয়া বলিল, “আমি তা অনেক্ষণ দেখিয়াছি।” আমাকে বলিল, “চল গাড়ি তৈয়ার। না যাও, আমি ধরিয়া লইয়া যাইব। কিন্তু যে কথাটা বলিয়াছি—মাকে বশ করিতে হইবে।”
সুভাষিণী আমাকে টানিয়া লইয়া গিয়া গাড়িতে তুলিল। পুরোহিত মহাশয়ের দেওয়া রাঙ্গাপেড়ে কাপড় দুইখানির মধ্যে একখানি আমি পরিয়াছিলাম—আর একখানি দড়িতে শুকাইতেছিল—তাহা লইয়া যাইতে সময় দিল না। তাহার পরিবর্তে আমি সুভাষিণীর পুত্রকে কোলে লইয়া মুখচুম্বন করিতে করিতে চলিলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ : কালির বোতল

মা—সুভাষিণীর শাশুড়ী। তাঁহাকে বশ করিতে হইবে—সুতরাং গিয়াই তাঁহাকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইলাম, তার পর এক নজর দেখিয়া লইলাম, মানুষটা কি রকম। তিনি তখন ছাদের উপর অন্ধকারে, একটা পাটী পাতিয়া, তাকিয়া মাথায় দিয়া শুইয়া পড়িয়া আছেন, একটা ঝি পা টিপিয়া দিতেছে। আমার বোধ হইল, একটা লম্বা কালির বোতল গলায় গলায় কালি ভরা, পাটীর উপর কাত হইয়া পড়িয়া গিয়াছে। পাকা চুলগুলি বোতলটির টিনের ঢাকনির* মত শোভা পাইতেছে। অন্ধকারটা বাড়াইয়া তুলিয়াছে।
আমাকে গৃহিণী ঠাকুরাণী বধূকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এটি কে?”
বধূ বলিল, “তুমি একটি রাঁধুনী খুঁজিতেছিলে, তাই একে নিয়ে এসেছি।”
গৃহিণী। কোথায় পেলে?
বধূ। মাসীমা দিয়াছেন।
গৃ। বামন না কায়েৎ?
ব। কায়েৎ।
গৃ। আঃ, তোমার মাসীমার পোড়া কপাল। কায়েতের মেয়ে নিয়ে কি হবে? এক দিন বামনকে ভাত দিতে হলে কি দিব?
ব। রোজ ত আর বামনকে ভাত দিতে হবে না—যে কয় দিন চলে চলুক—তার পর বামনী পেলে রাখা যাব—তা বামনের মেয়ের ঠ্যাকার ব—আমরা তাঁদের রান্নাঘরে গেলে হাঁড়িকুড়ি ফেলিয়া দেন—আবার পাতের প্রসাদ দিতে আসেন! কেন, আমরা কি মুচি?
আমি মনে মনে সুভাষিণীকে ভূয়সী প্রশংসা করিলাম—কালিভরা লম্বা বোতলটাকে সে মুঠোর ভিতর আনিতে জানে দেখিলাম। গৃহিণী বলিলেন, “তা সত্যি বটে মা—ছোট লোকের এত অহঙ্কার সওয়া যায় না। তা এখন দিন কতক কায়েতের মেয়েই রেখে দেখি। মাইনে কত বলেছে?”
ব। তা আমার সঙ্গে কোন কথা হয় নাই।
গৃ। হায় রে, কলিকালের মেয়ে! লোক রাখতে নিয়ে এসেছ, তার মাইনের কথা কও নাই?
আমাকে গৃহিণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি নেবে তুমি?”
আমি বলিলাম, “যখন আপনাদের আশ্রয় নিতে এসেছি, তখন যা দিবেন তাই নিব।”
গৃ। তা বামনের মেয়েকে কিছু বেশী দিতে হয় বটে, কিন্তু তুমি কায়েতের মেয়ে—মায় তিন টাকা মাসে আর খোরাকপোষাক দিব।
আমার একটু পাইলেই যথেষ্ট—সুতরাং তাহাতে সম্মত হইলাম। বলা বাহুল্য যে, মাহিয়ানা লইতে হইবে শুনিয়াই প্রাণ কাঁদিয়া উঠিল। আমি বলিলাম, “তাই দিবেন।”
মনে করিলাম, গোল মিটিল—কিন্তু তাহা নহে। লম্বা বোতলটায় কালি অনেক। তিনি বলিলেন, “তোমার বয়স কি গা? অন্ধকারে বয়স ঠাওর পাইতেছি না—কিন্তু গলাটা ছেলেমানুষের মত বোধ হইতেছে।”
আমি বলিলাম, “বয়স এই ঊনিশ কুড়ি।”
গৃ। তবে বাছা, অন্যত্র কাজের চেষ্টা দেখ গিয়া যাও। আমি সমত্ত লোক রাখি না।
সুভাষিণী মাঝে হইতে বলিল, “কেন মা, সমত্ত লোকে কি কাজ কর্ম পারে না?”
গৃ। দূর বেটী পাগলের মেয়ে। সমত্ত লোক কি লোক ভাল হয়?
*Capsule
সু। সে কি মা! দেশসুদ্ধ সব সমত্ত লোক কি মন্দ?
গৃ। তা নাই হলো—তবে ছোট লোক যারা খেটে খায় তারা কি ভাল?
এবার কান্না রাখিতে পারিলাম না। কাঁদিয়া উঠিয়া গেলাম। কালির বোতলটা পুত্রবধূকে জিজ্ঞাসা করিল, “ছুঁড়ী চলল না কি?”
সুভাষিণী বলিল, “বোধ হয়।”
গৃ। তা যাক গে।
সু। কিন্তু গৃহস্থ বাড়ী থেকে না খেয়ে যাবে? উহাকে কিছু খাওয়াইয়া বিদায় করিতেছি।
এই বলিয়া সুভাষিণী আমার পিছু পিছু উঠিয়া আসিল। আমাকে ধরিয়া আপনার শয়নগৃহে লইয়া গেল। আমি বলিলাম, “আর আমায় ধরিয়া রাখিতেছ কেন? পেটের দায়ে, কি প্রাণের দায়ে, আমি এমন সব কথা শুনিবার জন্য থাকিতে পারিব না।”
সুভাষিণী বলিল, “থাকিয়া কাজ নাই। কিন্তু আমার অনুরোধে আজিকার রাত্রিটা থাক।”
কোথায় যাইব? কাজেই চক্ষু মুছিয়া সে রাত্রিটা থাকিতে সম্মত হইলাম। একথা ওকথার পর সুভাষিণী জিজ্ঞাসা করিল, “এখানে যদি না থাক, তবে যাবে কোথায়?”
আমি বলিলাম, “গঙ্গায়।”
এবার সুভাষিণীও একটু চক্ষু মুছিল। বলিল, “গঙ্গায় যাইতে হইবে না, আমি কি করি তা একটুখানি বসিয়া দেখ। গোলযোগ উপস্থিত করিও না—আমার কথা শুনিও।”
এই বলিয়া সুভাষিণী হারাণী বলিয়া ঝিকে ডাকিল। হারাণী সুভাষিণীর খাস ঝি। হারাণী আসিল। মোটাসোটা, কালো কুচকুকচে, চল্লিশ পার, হাসি মুখে ধরে না, সকলটাতেই হাসি। একটু তিরবিরে। সুভাষিণী বলিল, “একবার তাঁকে ডেকে পাঠা।”
হারাণী বলিল, “এখন অসময়ে আসিবেন কি? আমি ডাকিয়া পাঠাই বা কি করিয়া?”
সুভাষিণী ভ্রূভঙ্গ করিল, “যেমন করে পারিস—ডাক গে যা।”
হারাণী হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। আমি সুভাষিণীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ডাকিতে পাঠাইলে কাকে? তোমার স্বামীকে?”
সু। না ত কি পাড়ার মুদি মিন্ি‍সেকে এই রাত্রে ডাকিতে পাঠাইব?
আমি বলিলাম, “বলি, আমায় উঠিয়া যাইতে হইবে কি না, তাই জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম।”
সুভাষিণী বলিল, “না। এইখানে বসিয়া থাক।”
সুভাষিণীর স্বামী আসিলেন। বেশ সুন্দর পুরুষ। তিনি আসিয়াই বলিলেন, “তলব কেন?” তার পর আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “ইনি কে?”
সুভাষিণী বলিল, “ওঁর জন্যই তোমাকে ডেকেছি। আমাদের রাঁধুনী বাড়ী যাবে, তাই ওঁকে তার জায়গায় রাখিবার জন্য আমি মাসীর কাছ হইতে এনেছি। কিন্তু মা ওঁকে রাখিতে চান না।”
তাঁর স্বামী বলিলেন, “কেন চান না?”
সু। সমত্ত বয়স।
সুভার স্বামী একটু হাসিলেন। বলিলেন, “তা আমায় কি করিতে হইবে?”
সু। ওঁকে রাখিয়ে দিতে হইবে।
স্বামী। কেন?
সুভাষিণী, তাঁহার নিকট গিয়া, আমি না শুনিতে পাই, এমন স্বরে বলিলেন, “আমার হুকুম।” কিন্তু আমি শুনিতে পাইলাম। তাঁর স্বামীও তেমনই স্বরে বলিলেন, “যে আজ্ঞা।”
সু। কখন পারিবে।
স্বামী। খাওয়ার সময়।
তিনি গেলে আমি বলিলাম, “উনি যেন রাখাইলেন, কিন্তু এমন কটু কথা সয়ে আমি থাকি কি প্রকারে?”
সু। সে পরের কথা পরে হবে। গঙ্গা ত আর এক দিনে বুজিয়ে যাইবে না।
রাত্রি নয়টার সময়, সুভাষিণীর স্বামী (তাঁর নাম রমণ বাবু) আহার করিতে আসিলেন। তাঁর মা কাছে গিয়া বসিল। সুভাষিণী আমাকে টানিয়া লইয়া চলিল, বলিল, “কি হয় দেখি গে চল।”
আমরা আড়াল হইতে দেখিলাম, নানাবিধ ব্যঞ্জন রান্না হইয়াছে, কিন্তু রমণ বাবু একবার একটু করিয়া মুখে দিলেন, আর সরাইয়া রাখিলেন। কিছুই খাইলেন না। তাঁর মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছুই ত খেলি না বাবা!”
পুত্র বলিল, “ও রান্না ভূতপ্রেতে খেতে পারে না। বামন ঠাকুরাণীর রান্না খেয়ে খেয়ে অরুচি জন্মে গেছে। মনে করেছি কাল থেকে পিসীমার বাড়ী গিয়ে খেয়ে আসব।”
তখন গৃহিণী ছোট হয়ে গেলেন। বলিলেন, “তা করিতে হবে না যাদু! আমি আর রাঁধুনী আনাইতেছি।”
বাবু হাত ধুইয়া উঠিয়া গেলেন। দেখিয়া সুভাষিণী বলিলেন, “আমাদের জন্য ভাই ওঁর খাওয়া হইল না। তা না হোক—কাজটা হইলে হয়।”
আমি অপ্রতিভ হইয়া কি বলিতেছিলাম, এমন সময়ে হারাণী আসিয়া সুভাষিণীকে বলিল, “তোমার শাশুড়ী ডাকিতেছেন।” এই বলিয়া সে খামখা আমার দিকে চাহিয়া একটু হাসিল। আমি বুঝিয়াছিলাম, হাসি তার রোগ, সুভাষিণী শাশুড়ীর কাছে গেল, আমি আড়াল হইতে শুনিতে লাগিলাম।
সুভাষিণীর শাশুড়ী বলিতে লাগিল, “সে কায়েৎ ছুঁড়ীটে চলে গেছে কি?”
সু। না—তার এখনও খাওয়া হয় নাই বলিয়া, যাইতে দিই নাই।
গৃহিণী বলিলেন, “সে রাঁধে কেমন?”
সুভা। তা জানি না।
গৃ। আজ না হয় সে নাই গেল। কাল তাকে দিয়া দুই একখানা রাঁধিয়ে দেখিতে হইবে।
সু। তবে তাকে রাখি গে।
এই বলিয়া সুভাষিণী আমার কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ভাই, তুমি রাঁধিতে জান ত?”
আমি বলিলাম, “জানি। তা ত বলেছি।”
সু। ভাল রাঁধিতে পার ত?
আমি। কাল খেয়ে দেখে বুঝিতে পারিবে।
সু। যদি অভ্যাস না থাকে তবে বল, আমি কাছে বসিয়া শিখিয়ে দিব।
আমি হাসিলাম। বলিলাম, “পরের কথা পরে হবে।”

অষ্টম পরিচ্ছেদ : বিবি পাণ্ডব

পরদিন রাঁধিলাম। সুভাষিণী দেখাইয়া দিতে আসিয়াছিল, আমি ইচ্ছা করিয়া সেই সময়ে লঙ্কা ফোড়ন দিলাম—সে কাশিতে কাশিতে উঠিয়া গেল, বলিল, “মরণ আর কি!”
রান্না হইলে বালকবালিকারা প্রথমে খাইল।সুভাষিণী ছেলে অন্ন-ব্যঞ্জন বড় খায় না, কিন্তু সুভাষিণীর পাঁচ বৎসরের একটি মেয়ে ছিল।সুভাষিনী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন রান্না হয়েছে, হেমা?”
সে বলিল, “বেশ! বেশ গো বেশ!” মেয়েটি বড় শ্লোক বলিতে ভালবাসিত, সে আবার বলিল, “বেশ গো বেশ,
রাঁধ বেশ,                                বাঁধ কেশ,
বকুল ফুলের মালা।
রাঙ্গা সাড়ী,                            হাতে হাঁড়ী
রাঁধছে গোয়ালার বালা।|
এমন সময়,                                    বাজল বাঁশী,
কদম্বের তলে।
কাঁদিয়ে ছেলে,                                          রান্না ফেলে,
রাঁধুনী ছোটে জলে।|”
মা ধমকাইল, “নে শ্লোক রাখ্।” তখন মেয়ে চুপ করিল।
তার পর রমণ বাবু খাইতে বসিলেন। আড়াল হইতে দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তিনি সমস্ত ব্যঞ্জনগুলি কুড়াইয়া খাইলেন। গৃহিণীর মুখে হাসি ধরে না। রমণ বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কে রেঁধেছে মা?”
গৃহিণী বলিলেন, “একটি নূতন লোক আসিয়াছে।”
রমণ বাবু বলিলেন, “রাঁধে ভাল।” এই বলিয়া তিনি হাত ধুইয়া উঠিয়া গেলেন।
তার পর কর্তা খাইতে বসিলেন। সেখানে আমি যাইতে পারিলাম না-গৃহিণীর আদেশমত বুড়া বামন ঠাকুরাণী কর্তার ভাত লইয়া গেলেন। এখন বুঝিলাম, গৃহিণীর কোথায় ব্যথা, কেন তিনি সমর্থবয়স্কা স্ত্রীলোক রাখিতে পারেন না। প্রতিজ্ঞা করিলাম, যত দিন এখানে থাকি, সে দিক মাড়াইব না।
আমি সময়ান্তরে লোকজনের কাছে সংবাদ লইয়াছিলাম, কর্তার কেমন চরিত্র। সকলেই জানিত, তিনি অতি ভদ্র লোক—জিতেন্দ্রিয়। তবে কালির বোতলটার গলায় গলায় কালি।
বামন ঠাকুরাণী ফিরিয়া আসিলে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে “কর্তা রান্না খেয়ে কি বললেন?”
বামনী চটিয়া লাল; চেঁচাইয়া উঠিয়া বলিল, “ও গো, বেশ রেঁধেছ গো, বেশ রেঁধেছ। আমরাও রাঁধতে জানি; তা বুড়ো হলে কি আর দর হয়! এখন রাঁধিতে গেলে রূপ-যৌবন চাই।”
বুঝিলাম, কর্তা খাইয়া ভাল বলিয়াছেন। কিন্তু বামনীকে নিয়া একটু রঙ্গ করিতে সাধ হইল। বলিলাম, “তা রূপযৌবন চাই বই কি বামন দিদি!—বুড়ীকে দেখিলে কার খেতে রোচে?”
দাঁত বাহির করিয়া অতি কর্কশ কণ্ঠে বামনী বলিল, “তোমারই বুঝি রূপযৌবন থাকিবে? মুখে পোকা পড়বে না?”
এই বলিয়া রাগের মাথায় একটা হাঁড়ি চড়াইতে গিয়া পাচিকা দেবী হাঁড়িটা ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন। আমি বলিলাম, “দেখিলে দিদি! রূপযৌবন না থাকিলে হাতের হাঁড়ি ফাটে।”
তখন ব্রাহ্মণী ঠাকুরাণী অর্ধনগ্নাবস্থায় বেড়ী নিয়া আমাকে তাড়া করিয়া মারিতে আসিলেন। বয়োদোষে কাণে একটু খাটো, বোধ হয় আমার সকল কথা শুনিতে পান নাই। বড় কদর্য প্রত্যুত্তর করিলেন। আমারও রঙ্গ চড়িল। আমি বলিলাম, “দিদি, থাম। বেড়ী হাতে থাকিলেই ভাল।”
এইসময়ে সুভাষিণী সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। বামনী রাগে তাহাকে দেখিতে পাইল না। আমাকে আবার তাড়াইয়া আসিয়া বলিল, “হারামজাদী! যা মুখে আসে তাই বলিবি! বেড়ী আমার হাতে থাকিবে না ত কি পায়ে দেবে নাকি? আমি পাগল!”
তখন সুভাষিণী ভ্রূভঙ্গ করিয়া তাহাকে বলিল, “আমি লোক এনেছি, তুমি হারামজাদী বলবার কে? তুমি বেরোও আমার বাড়ী থেকে।”
তখন পাচিকা শশব্যস্তে বেড়ী ফেলিয়া দিয়া কাঁদ কাঁদ হইয়া বলিল, “ও মা সে কি কথা গো! আমি কখন্ হারামজাদী বল্লেম! এমন কথা আমি কখন মুখেও আনি নে। তোমরা আশ্চর্য্য করিলে মা!”
শুনিয়া সুভাষিণী খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বামন ঠাকুরাণী তখন ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন—বলিলেন, “আমি যদি হারামজাদী বলে থাকি, তবে আমি যেন গোল্লায় যাই—
“(আমি বলিলাম, “বালাই! ষাট্!”)
“আমি যেন যমের বাড়ী যাই—”
(আমি। সে কি দিদি; এত সকাল সকাল! ছি দিদি! আর দুদিন থাক না।)
“আমার যেন নরকেও ঠাঁই হয় না—”
এবার আমি বলিলাম, “ওটি বলিও না, দিদি! নরকের লোক যদি তোমার রান্না না খেলে, তবে নরক আবার কি?”
বুড়ী কাঁদিয়া সুভাষিণীর কাছে নালিশ করিল, “আমাকে যা মুখে আসিবে, তাই বলিবে, আর তুমি কিছু বলিবে না? আমি চল্লেম গিন্নীর কাছে।”
সু। বাছা, তা হলে আমাকেও বলিতে হইবে, তুমি এঁকে হারামজাদী বলেছ।
বুড়ী তখন গালে চড়াইতে আরম্ভ করিল, “আমি কখন্ হারামজাদী বল্লেম! (এক ঘা)—আমি কখন্ হারামজাদী বল্লেম!! (দুই ঘা)—আমি কখন্ হারামজতাদী বল্লেম!!! (তিন ঘা)” ইতি সমাপ্ত।
তখন আমরা বুড়ীকে কিছু মিষ্ট কথা বলিতে আরম্ভ করিলাম। প্রথমে আমি বলিলাম, “হাঁ গা বৌ ঠাকুরাণ—হারামজাদী বলতে তুমি কখন্ শুনিলে? উনি কখন্ এ কথা বললেন? কই আমি ত শুনি নাই।”
বুড়ী তখন বলিল, “এই শুনিলে বৌদিদি! আমার মুখে কি অমন সব কথা বেরোয়!”
সুভাষিণী বলিল, “তা হবে—বাহিরে কে কাকে বলিতেছিল, সেই কথাটা আমার কাণে গিয়া থাকিবে। বামুন ঠাকুরাণী কি তেমন লোক! ওঁর রান্না কাল খেয়েছিলে ত? এ কলিকাতার ভিতর অমন কেউ রাঁধিতে পারে না।”
বামনী আমার দিকে চাহিয়া বলিল, “শুনিলে গা?”
আমি বলিলাম, “তা ত সবাই বলে। আমি অমন রান্না কখনও খাই নাই।”
বুড়ী এক গাল হাসিয়া বলিল, “তা তোমরা বলবে বৈ কি মা! তোমরা হলে ভালমানুষের মেয়ে, তোমরা ত রান্না চেন। আহা! এমন মেয়েকে কি আমি গালি দিতে পারি—এ কোন বড় ঘরের মেয়ে। তা তুমি দিদি ভেবো না, আমি তোমাকে রান্না বান্না শিখিয়ে দিয়ে তবে যাব।”
বুড়ীর সঙ্গে এইরূপে আপোষ হইয়া গেল। আমি অনেক দিন ধরিয়া কেবল কাঁদিয়াছিলাম। অনেক দিনের পর আজ হাসিলাম। সে হাসিতামাসা দরিদ্রের নিধির মত, বড় মিষ্ট লাগিয়াছিল। তাই বুড়ীর কথাটা এত সবিস্তারে লিখিলাম। সেই হাসি আমি এ জন্মে ভুলিব না। আর কখন হাসিয়া তেমন সুখ পাইব না।
 তার পর গৃহিণী আহারে বসিলেন। বসিয়া থাকিয়া যত্নপূর্বক তাঁহাকে ব্যঞ্জনগুলি খাওয়াইলাম। মাগী গিলিল অনেক। শেষ বলিল, “রাঁধ ভাল ত গা! কোথায় রান্না শিখিলে?”
আমি বলিলাম, “বাপের বাড়ী।”
গৃ। তোমার বাপের বাড়ী কোথায় গা?
আমি একটা মিছে কথা বলিলাম। গৃহিণী বলিলেন, “এ ত বড় মানুষের ঘরের মত রান্না। তোমার বাপ কি বড় মানুষ ছিলেন?
আমি। তা ছিলেন।
গৃ। তবে তুমি রাঁধিতে এসেছ কেন?
আমি। দুরবস্থায় পড়িয়াছি।
গৃ। তা আমার কাছে থাক, বেশ থাকিবে। তুমি বড় মানুষের মেয়ে, আমার ঘরে তেমনই থাকিবে।
পরে সুভাষিণীকে ডাকিয়া বলিলেন, “বৌ মা, দেখো গো, এঁকে যেন কেউ কড়া কথা না বলে-আর তুমি ত বলবেই না, তুমি তেমন মানুষের মেয়ে নও।”
সুভাষিণীর ছেলে সেখানে বসিয়াছিল। ছেলে বলিল, “আমি কলা কতা বলিব।”
আমি বলিলাম, “বল দেখি!”
সে বলিল, “কলা চাতু (চাটু) হাঁলি—আল্ কি মা?”
সুভাষিণী বলিল, “আর তোর শাশুড়ী।”
ছেলে বলিল, “কৈ ছাছুলী?”
সুভাষিণীর মেয়ে আমাকে দেখাইয়া দিয়া বলিল, “ঐ তোর শাশুড়ী।”
তখন ছেলে বলিতে লাগিল, “কুনুডিনী ছাছুলী! কুনুডিনী ছাছুলী।”
সুভাষিণী আমার সঙ্গে একটা সম্বন্ধ পাতাইবার জন্য বেড়াইতেছিল। ছেলে-মেয়ের মুখের এই কথা শুনিয়া সে আমাকে বলিল, “তবে আজ হইতে তুমি বেহাইন হইলে।”
তার পর সুভাষিণী খাইতে বসিল। আমি তারও কাছে খাওয়াইতে বসিলাম। খাইতে সে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কয়টি বিয়ে, বেহান?”
কথাটা বুঝিলাম। বলিলাম, “কেন, রান্নাটা দ্রৌপদীর মত লাগিল না কি?”
সু। ও ইয়াস্! বিবি পাণ্ডব ফাষ্ট কেলাস বাবর্চি ছিল। এখন আমার শাশুড়ীকে বুঝিতে পারিলে ত?
আমি বলিলাম, “বড় নয়। কাঙ্গালের আর বড় মানুষের মেয়ের সঙ্গে সকলেই একটু প্রভেদ করে।”
সুভাষিণী হাসিয়া উঠিল। বলিল, “মরণ আর কি তোমার! এই বুঝি বুঝিয়াছ? তুমি বড় মানুষের মেয়ে বলে বুঝি তোমার আদর করেছেন?”
আমি বলিলাম, “তবে কি?”
সু। ওঁর ছেলে পেট ভরে খাবে, তাই তোমার এত আদর। এখন যদি তুমি একটু কোট কর, তবে তোমার মাহিনা ডবল হইয়া যায়।
আমি বলিলাম, “আমি মাহিনা চাই না। না লইলে যদি কোন গোলযোগ উপস্থিত হয়, এজন্য হাত পাতিয়া মাহিয়ানা লইব। লইয়া তোমার নিকট রাখিব, তুমি কাঙ্গাল গরীবকে দিও। আমি আশ্রয় পাইয়াছি, এই আমার পক্ষে যথেষ্ট।”

নবম পরিচ্ছেদ : পাকাচুলের সুখ দু:খ

আমি আশ্রয় পাইলাম। আর একটি অমূল্য রত্ন পাইলাম—একটি হিতৈষিণী সখী। দেখিতে লাগিলাম যে, সুভাষিণী আমাকে আন্তরিক ভালবাসিতে লাগিল–আপনার ভগিনীর সঙ্গে যেমন ব্যবহার করিতে হয়, আমার সঙ্গে তেমনই ব্যবহার করিত। তাঁর শাসনে দাস-দাসীরাও আমাকে অমান্য করিত না। এদিকে রান্নাবান্না সম্বন্ধেও সুখ হইল। সেই বুড়ী ব্রাহ্মণ—ঠাকুরাণী,-সোণার মা তিনি বাড়ী গেলেন না। মনে করিলেন, তিনি গেলে আর চাকরিটি পাইবেন না, আমি কায়েমী হইব। তিনি এই ভাবিয়া নানা ছুতা করিয়া বাড়ী গেলেন না। সুভাষিণীর সুপারিসে আমরা দুই জনেই রহিলাম। তিনি শাশুড়ীকে বুঝাইলেন যে, কুমুদিনী ভদ্রলোকের মেয়ে, একা সব রান্না পারিয়া উঠিবে না—আর সোণার মা বুড়া মানুষই বা কোথায় যায়? শাশুড়ী বলিল, “দুইজনকেই কি রাখিতে পারি? এত টাকা যোগায় কে?”
বধূ বলিল, “তা একজনকে রাখিতে গেলে সোণার মাকে রাখিতে হয়। কুমু এত পারবে না।”
গৃহিণী বলিলেন, “না না। সোণার মার রান্না আমার ছেলে খেতে পারে না। তবে দুইজনেই থাক।”
আমার কষ্টনিবারণ জন্য সুভাষিণী এই কৌশলটুকু করিল। গিন্নী তার হাতে কলের পুতুল; কেন না, সে রমণের বৌ—রমণের বৌর কথা ঠেলে কার সাধ্য? তাতে আবার সুভাষিণীর বুদ্ধি যেমন প্রখরা, স্বভাবও তেমনই সুন্দর। এমন বন্ধু পাইয়া, আমার এ দু:খের দিনে একটু সুখ হইল।
আমি মাছমাংস রাঁধি, বা দুই একখানা ভাল ব্যঞ্জন রাঁধি—বাকি সময়টুকু সুভাষিণীর সঙ্গে গল্প করি—তার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে গল্প করি; হলো বা স্বয়ং গৃহিণীর সঙ্গে একটু ইয়ারকি করি। কিন্তু শেষ কাজটায় একটা বড় গোলে পড়িয়া গেলাম। গৃহিণীর বিশ্বাস তাঁর বয়স কাঁচা, কেবল অদৃষ্টদোষে গাছকতক চুল পাকিয়াছে, তাহা তুলিয়া দিলেই তিনি আবার যুবতী হইতে পারেন। এই জন্য তিনি লোক পাইলেই এবং অবসর পাইলেই পাকা চুল তুলাইতে বসিতেন। এক দিন আমাকে এই কাজে বেগার ধরিলেন। আমি কিছু ক্ষিপ্রহস্ত, শীঘ্র শীঘ্রই ভাদ্র মাসের উলু ক্ষেত সাফ করিতেছিলাম। দূর হইতে দেখিতে পাইয়া সুভাষিণী আমাকে অঙ্গুলির ইঙ্গিতে ডাকিল। আমি গৃহিণীর কাছ হইতে ছুটি লইয়া বধূর কাছে গেলাম। সুভাষিণী বলিল, “ও কি কাণ্ড! আমার শাশুড়ীকে নেড়া মুড়া করিয়া দিতেছ কেন?”
আমি বলিলাম, “ও পাপ একদিনে চুকানই ভাল।”
সু। তা হলে কি টেঁকতে পারবে? যাবে কোথায়?
আমি। আমার হাত থামে না যে।
সু। মরণ আর কি! দুই একগাছি তুলে চলে আসতে পার না!
আমি। তোমার শাশুড়ী যে ছাড়ে না।
সু। বল গে যে, কই, পাকা চুল ত বেশী দেখিতে পাই না—এই বলে চলে এসো।
আমি হাসিয়া বলিলাম, “এমন দিনেডাকাতি কি করা যায়? লোকে বলবে কি? এ যে আমার কালাদীঘির ডাকাতি।”
সু। কালাদীঘির ডাকাতি কি?
সুভাষিণীর সঙ্গে কথা কহিতে আমি একটু আত্মবিস্মৃত হইতাম—হঠাৎ কালাদীঘির কথা অসাবধানে মুখ দিয়া বাহির হইয়াছিল। কথাটা চাপিয়া গেলাম। বলিলাম, “সে গল্প আর একদিন করিব।”
সু। আমি যা বলিলাম, তা একবার বলিয়াই দেখ না? আমার অনুরোধে।
হাসিতে হাসিতে আমি গিন্নীর কাছে গিয়া আবার পাকা চুল তুলিতে বসিলাম। দুই চারি গাছা তুলিয়া বলিলাম, “কৈ আর বড় পাকা দেখিতে পাই না। দুই এক গাছা রহিল, কাল তুলে দিব।”
মাগী এক গাল হাসিল। বলিল, “আবার বেটীরা বলে সব চুলই পাকা।”
সে দিন আমার আদর বাড়িল। কিন্তু যাহাতে দিন দিন বসিয়া বসিয়া পাকা চুল তুলিতে না হয়, সে ব্যবস্থা করিব মনে মনে স্থির করিলাম। বেতনের টাকা পাইয়াছিলাম, তাহা হইতে এক টাকা হারাণীর হাতে দিলাম। বলিলাম, “একটা টাকার এক শিশি কলপ কারও হাত দিয়া কিনিয়া আনিয়া দে।” হারাণী হাসিয়া কুটপাট। হাসি থামিলে বলিল, “কলপ নিয়ে কি করবে গা? কার চুলে দেবে?”
আমি। বামন ঠাকুরাণীর।
এবার হারাণী হাসিতে হাসিতে বসিয়া পড়িল। এমন সময়ে বামন ঠাকুরাণী সেখানে আসিয়া পড়িল। তখন সে, হাসি থামাইবার জন্য মুখে কাপড় গুঁজিয়া দিতে লাগিল। কিছুতেই থামাইতে না পারিয়া সেখান হইতে পলাইয়া গেল। বামন ঠাকুরাণী বলিলেন, “ও অত হাসিতেছে কেন?”
আমি বলিলাম, “ওর অন্য কাজ ত দেখি না। এখন আমি বলিয়াছিলাম যে, বামন ঠাকুরাণীর চুলে কলপ দিয়া দিলে হয় না? তাই অমন করছিল।”
বামন ঠা। তা অত হাসি কিসের? দিলেই বা ক্ষতি কি? শোণের নুড়ি শোনের নুড়ি ব’লে ছেলেগুলা খেপায়, তা সে দায়ে ত বাঁচব!”
সুভাষিণীর মেয়ে হেমা অমনই আরম্ভ করিল,
চলে বুড়ী,            শোণের নুড়ী,
খোঁপায় ঘেঁটু ফুল।
হাতে নড়ি,            গলায় দড়ী,
কাণে জোড়া দুল।
হেমার ভাই বলিল, “জোলা দুম!” তখন কাহারও উপর জোলা দুম পড়িবে আশঙ্কায় সুভাষিণী তাহাকে সরাইয়া লইয়া গেল।
বুঝিলাম, বামনীর কলপে বড় ইচ্ছা। বলিলাম, “আচ্ছা, আমি কলপ দিয়া দিব।”
বামনী বলিল, “আচ্ছা, তাই দিও। তুমি বেঁচে থাক, তোমার সোণার গহনা হোক। তুমি খুব রাঁধতে শেখ।”
হারাণী হাসে, কিন্তু কাজের লোক। শীঘ্র এক শিশি উত্তম কলপ আনিয়া দিল। আমি তাহা হাতে করিয়া গিন্নীর পাকা চুল তুলিতে গেলাম। গিন্নী জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাতে কি ও?”
আমি বলিলাম, “একটা আরক। এটা চুলে মাখাইলে সব পাকা চুল উঠিয়া আসে, কাঁচা চুল থাকে।”
গৃহিণী বলিলেন, “বটে, এমন আশ্চর্য আরক ত কখন শুনি নাই। মাখাও দেখি। দেখিও কলপ দিও না যেন।”
আমি উত্তম করিয়া তাঁহার চুলে কলপ মাখাইয়া দিলাম। দিয়া, “পাকা চুল আর নাই,” বলিয়া চলিয়া গেলাম। নিয়মিত সময় উত্তীর্ণ হইলে তাঁহার সমস্ত চুলগুলি কাল হইয়া গেল। দুর্ভাগ্যবশত: হারাণী ঘরঝাঁট দিতে দিতে তাহা দেখিতে পাইল। তখন সে ঝাঁটা ফেলিয়া দিয়া, মুখে কাপড় গুঁজিয়া হাসিতে হাসিতে সদর-বাড়ী চলিয়া গেল। সেখানে “কি ঝি? কি ঝি?” এই রকম একটা গোলযোগ হইলে, সে আবার ভিতর বাড়ীতে আসিয়া, মুখে কাপড় গুঁজিতে গুঁজিতে ছাদের উপর চলিয়া গেল। সেখানে সোণার মা চুল শুকাইতেছিল; সে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হয়েছে?” হারাণী হাসির জ্বালায় কথা কহিতে পারিল না; কেবল হাত দিয়া মাথা দেখাইতে লাগিল। সোণার মা কিছু বুঝিতে না পারিয়া, নীচে আসিয়া দেখিল যে, গৃহিণীর মাথার চুল সব কালো—সে ফুকুরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। বলিল, “ও মা! এ কি হলো গো! তোমার মাথার সব চুল কালো হয়ে গেছে গো! ওমা কে না জানি তোমায় ওষুধ করিল!”
এমন সময় সুভাষিণী আসিয়া আমাকে পাকড়াইল—হাসিতে হাসিতে বলিল, “পোড়ারমুখী, ও করেছ কি, মার চুলে কলপ দিয়াছ?”
আমি। হুঁ!
সু। তোমার মুখে আগুন! কি কাণ্ডখানা হয় দেখ!
আমি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক।
এমন সময়ে গৃহিণী স্বয়ং আমাকে তলব করিলেন। বলিলেন, “হাঁ গা কুমো! তুমি কি আমার মাথায় কলপ দিয়াছ?”
দেখিলাম, গৃহিণীর মুখখানা বেশ প্রসন্ন। আমি বলিলাম, “অমন কথা কে বল্লে মা!”
গৃ। এই যে সোণার মা বলছে!
আমি। সোণার মার কি? ও কলপ নয় মা, আমার ওষুধ।
গৃ। তা বেশ ওষুধ বাছা। আরসি একখানা আন দেখি।
একখানা আরসি আনিয়া দিলাম। দেখিয়া গৃহিণী বলিলেন, “ও মা, সব চুল কালো হয়ে গেছে। আ:, আবাগের বেটী, লোকে এখনই বলবে কলপ দিয়েছে।”
গৃহিণীর মুখে হাসি ধরে না। সেদিন সন্ধ্যার পর আমার রান্নার সুখ্যাতি করিয়া আমার বেতন বাড়াইয়া দিলেন। আর বলিলেন, “বাছা! কেবল কাচের চুড়ি হাতে দিয়া বেড়াও, দেখিয়া কষ্ট হয়।” এই বলিয়া তিনি নিজের বহুকালপরিত্যক্ত এক জোড়া সোণার বালা আমায় বখশিস করিলেন। লইতে, আমার মাথা কাটা গেল—চোখের জল সামলাইতে পারিলাম না। কাজেই “লইব না” কথাটা বলিবার অবসর পাইলাম না।
একটু অবসর পাইয়া বুড়া বামন ঠাকুরাণী আমাকে ধরিল। বলিল, “ভাই, আর সে ওষুধ নেই কি?”
আমি। কোন্ ওষুধ? বামনীকে তার স্বামী বশ করবার জন্যে যা দিয়েছিলেন?
বা। দূর হ! একেই বলে ছেলে বুদ্ধি। আমার কি সে সামগ্রী আছে?
আমি। নেই? সে কি গো? একটাও না?
বা। তোদের বুঝি পাঁচটা করে থাকে?
আমি। তা নইলে আর অমন রাঁধি? দ্রৌপদী না হলে ভাল রাঁধা যায়! গোটা পাঁচেক যোটাও না, রান্না খেয়ে লোকে অজ্ঞান হবে।
বামনী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। বলিল, “একটাই যোটে না ভাই—তার আবার পাঁচটা! মুসলমানের হয়, যত দোষ হিন্দুর মেয়ের। আর হবেই বা কিসে? এই ত শোণের নুড়ী চুল! তাই বলছিলাম, বলি সে ওষুধটা আর আছে, যাতে চুল কালো হয়?”
আমি। তাই বল! আছে বৈ কি।
আমি তখন কলপের শিশি বামন ঠাকুরাণীকে দিয়া গেলাম। ব্রাহ্মণ ঠাকুরাণী, রাত্রিতে জলযোগান্তে শয়নকালে, অন্ধাকারে, তাহা চুলে মাখাইয়াছিলেন; কতক চুলে লাগিয়াছিল, কতক চুলে লাগে নাই, কতক বা মুখেচোখে লাগিয়াছিল। সকালবেলা যখন তিনি দর্শন দিলেন, তখন চুলগুলা পাঁচরঙ্গা বেড়ালের লোমের মত, কিছু সাদা, কিছু রাঙ্গা, কিছু কালো; আর মুখখানি কতক মুখপোড়া বাঁদরের মত, কতক মেনিবেড়ালের মত। দেখিবামাত্র পৌরবর্গ উচ্চৈ:স্বরে হাসিয়া উঠিল। সে হাসি আর থামে না। যে যখন পাচিকাকে দেখে, সে তখনই হাসিয়া উঠে। হারাণী হাসিতে হাসিতে বেদম হইয়া সুভাষিণীর পায়ে আছড়াইয়া পড়িয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “বৌঠাকুরাণী, আমাকে জবাব দাও, আমি এমন হাসির বাড়ীতে থাকিতে পারিব না—কোন্ দিন দম বন্ধ হইয়া মরিয়া যাইব।”
সুভাষিণীর মেয়েও বুড়ীকে জ্বালাইল, বলিল, “বুড়ী পিসী—সাজ সাজালে কে?
যম বলেছে,             সোণার চাঁদ
এস আমার ঘরে।
তাই ঘাটের সজ্জা        সাজিয়ে দিলে
সিঁদুরে গোবরে।”
একদিন একটা বিড়াল হাঁড়ি হইতে মাছ খাইয়াছিল, তাহার মুখে কালি ঝুলি লাগিয়াছিল। সুভাষিণীর ছেলে তাহা দেখিয়াছিল। সে বুড়ীকে দেখিয়া বলিল, “মা! বুলী পিচী হাঁলি কেয়েসে।”
অথচ বামন ঠাকুরাণীর কাছে, আমার ইঙ্গিতমত, কথাটা কেহ ভাঙ্গিল না। তিনি অকাতরে সেই বানরমার্জারবিমিশ্র কান্তি সকলের সম্মুখে বিকশিত করিতে লাগিলেন। হাসি দেখিয়া তিনি সকলকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “তোমরা কেন হাসচ গা?”
সকলেই আমার ইঙ্গিতমত বলিল, “ঐ ছেলে কি বলছে শুনচ না? বলে, বুলী পিচী হাঁলি কেয়েসে। কাল রাতে কে তোমার হাঁড়িশালে হাঁড়ি খেয়ে গিয়েছে, তাই সবাই বলাবলি করচে, বলি সোণার মা কি বুড়া বয়সে এমন কাজ করবে?”
বুড়ী তখন গালির ছড়া আরম্ভ করিল—“সর্বনাশীরা! শতেকক্ষোয়ারীরা! আবাগীরা!”—ইত্যাদি ইত্যাদি মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক তাহাদিগকে এবং তাহাদিগের স্বামী পুত্রকে গ্রহণ করিবার জন্য যমকে অনেকবার তিনি আমন্ত্রণ করিলেন—কিন্তু যমরাজ সে বিষয়ে আপাতত: কোন আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। ঠাকুরাণীর চেহারাখানা সেইরকম রহিল। তিনি সেই অবস্থায় রমণ বাবুকে অন্ন দিতে গেলেন। রমণ বাবু দেখিয়া হাসি চাপিতে গিয়া বিষম খাইলেন, আর তাঁহার খাওয়া হইল না। শুনিলাম রামরাম দত্তকে অন্ন দিতে গেলে, কর্তা মহাশয় তাঁহাকে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিলেন।
শেষ দয়া করিয়া সুভাষিণী বুড়ীকে বলিয়া দিল, “আমার ঘরে বড় আয়না আছে। মুখ দেখ গিয়া।”
বুড়ী গিয়া মুখ দেখিল। তখন সে উচ্চৈ:স্বরে কাঁদিতে লাগিল এবং আমাকে গালি পাড়িতে লাগিল। আমি বুঝাইতে চেষ্টা করিলাম যে, আমি চুলে মাখাইতে বলিয়াছিলাম, মুখে মাখাইতে বলি নাই। বুড়ী তাহা বুঝিল না। আমার মুণ্ডভোজনের জন্য যম পুন: পুন: নিমন্ত্রিত হইতে লাগিলেন। শুনিয়া সুভাষিণীর মেয়ে শ্লোক পড়িল-
“যে ডাকে যমে।
তার পরমাই কমে।
তার মুখে পড়ুক ছাই।
বুড়ী মরে যা না ভাই।”
শেষে আমার সেই তিন বৎসর বয়সের জামাতা, একখানা রাঁধিবার চেলা কাঠ লইয়া গিয়া বুড়ীর পিঠে বসাইয়া দিল। বলিল, “আমাল্ চাচুলী।” তখন বুড়ী আছাড়িয়া পড়িয়া উচ্চৈ:স্বরে কাঁদিতে লাগিল। সে যত কাঁদে, আমার জামাই তত হাততালি দিয়া নাচে, আর বলে, “আমাল চাচুলী, আমাল চাচুলী!” আমি গিয়া তাকে কোলে নিয়া, তার মুখচুম্বন করিলে তবে থামিল।

দশম পরিচ্ছেদ : আশার প্রদীপ

সেইদিন বৈকালে সুভাষিণী আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া নিভৃতে বসাইল। বলিল, “বেহান! তুমি সেই কালাদীঘির ডাকাতির গল্পটি বলিবে বলিয়াছিলে—আজিও বল নাই। আজ বল না—শুনি।”
আমি অনেক্ষণ ভাবিলাম। শেষ বলিলাম, “সে আমারই হতভাগ্যের কথা। আমার বাপ বড়মানুষ, একথা বলিয়াছি। তোমার শ্বশুরও বড়মানুষ—কিন্তু তাঁহার তুলনায় কিছুই নহেন। আমার বাপ আজিও আছেন—তাঁহার সেই অতুল ঐশ্বর্য এখনও আছে, আজিও তাঁহার হাতীশালে হাতী বাঁধা। আমি যে রাঁধিয়া খাইতেছি, কালাদীঘির ডাকাতিই তাহার কারণ।”
এই পর্যন্ত বলিয়া দুইজনেই চুপ করিয়া রহিলাম। সুভাষিণী বলিল, “তোমার যদি বলিতে কষ্ট হয়, তবে নাই বলিলে। আমি না জানিয়াই শুনিতে চাহিয়াছিলাম।”
আমি বলিলাম, “সমস্তই বলিব। তুমি আমাকে যে স্নেহ কর, আমার যে উপকার করিয়াছ, তাহাতে তোমাকে বলিতে কোন কষ্ট নাই।”
আমি বাপের নাম বলিলাম না, বাপের বাড়ীর গ্রামের নাম বলিলাম না। স্বামীর নাম বা শ্বশুরের নাম বলিলাম না। শ্বশুরবাড়ীর গ্রামের নাম বলিলাম না। আর সমস্ত বলিলাম, সুভাষিণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া পর্যন্ত বলিলাম। শুনিতে শুনিতে সুভাষিণী কাঁদিতে লাগিল। আমিও যে বলিতে বলিতে মধ্যে মধ্যে কাঁদিয়া ফেলিয়াছিলাম, তাহা বলা বাহুল্য।
সেদিন এই পর্যন্ত। পরদিন সুভাষিণী আমাকে আবার নিভৃতে লইয়া গেল। বলিল, “বাপের নাম বলিতে হইবে।”
তাহা বলিলাম।
“তাঁর বাড়ী যে গ্রামে, তাহাও বলিতে হইবে।”
তাও বলিলাম।
সু। ডাকঘরের নাম বল।
আমি। ডাকঘর! ডাকঘরের নাম ডাকঘর।
সু। দূর পোড়ারমুখী! যে গ্রামে ডাকঘর, তার নাম।
আমি। তা ত জানি না। ডাকঘরই জানি।
সু। বলি, যে গ্রামে তোমাদের বাড়ী, সেই গ্রামেই ডাকঘর আছে, না অন্য গ্রামে?
আমি। তা ত জানি না।
সুভাষিণী বিষণ্ণ হইল। আর কিছু বলিল না। পরদিন সেইরূপ নিভৃতে বলিল, “তুমি বড় ঘরের মেয়ে, কত কাল আর রাঁধিয়া খাইবে? তুমি গেলে আমি বড় কাঁদিব—কিন্তু আমার সুখের জন্য তোমার সুখের ক্ষতি করি, এমন পাপিষ্ঠা আমি নই। তাই আমরা পরামর্শ করিয়াছি—”
কথা শেষ না হইতে না হইতে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমরা কে কে?”
সু। আমি আর র-বাবু।
র-বাবু কি না রমণ বাবু। এইরূপে সুভাষিণী আমার কাছে স্বামীর নাম ধরিত। তখন সে বলিতে লাগিল, “পরামর্শ করিয়াছি যে, তোমার বাপকে পত্র লিখিব যে, তুমি এইখানে আছ, তাই কাল ডাকঘরের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম।”
আমি। তবে সকল কথা তাঁহাকে বলিয়াছ?
সু। বলিয়াছি—দোষ কি?
আমি। দোষ কিছু না। তার পর?
সু। এখন মহেশপুরেই ডাকঘর আছে, বিবেচনা করিয়া পত্র লেখা হইল।
আমি। পত্র লেখা হইয়াছে না কি?
সু। হাঁ।
আমি আহ্লাদে আটখানা হইলাম। দিন গণিতে লাগিলাম, কতদিনে পত্রের উত্তর আসিবে। কিন্তু কোন উত্তর আসিল না। আমার কপাল পোড়া—মহেশপুরে কোন ডাকঘর ছিল না। তখন গ্রামে গ্রামে ডাকঘর হয় নাই। ভিন্ন গ্রামে ডাকঘর ছিল—আমি রাজার দুলালী—অত খবর রাখিতাম না। ডাকঘরের ঠিকানা না পাইয়া, কলিকাতার বড় ডাকঘরে রমণ বাবুর চিঠি খুলিয়া ফেরত পাঠাইয়া দিয়াছিল।
আমি আবার কাঁদিতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু র-বাবু—নাছোড়। সুভাষিণী আসিয়া আমাকে বলিল, “এখন স্বামীর নাম বলিতে হইবে।”
আমি তখন লিখিতে শিখিয়াছিলাম। স্বামীর নাম লিখিয়া দিলাম। পরে জিজ্ঞাসা হইল, “শ্বশুরের নাম?”
তাও লিখিলাম।
“গ্রামের নাম?”
তাও বলিয়া দিলাম।
“ডাকঘরের নাম?”
বলিলাম, “তা কি জানি?”
শুনিলাম, রমণ বাবু সেখানেও পত্র লিখিলেন। কিন্তু কোন উত্তর আসিল না। বড় বিষণ্ণ হইলাম। কিন্তু একটা কথামনে পড়িল, আমি আশায় বিহ্বল হইয়া পত্র লিখিতে বারণ করি নাই। এখন আমার মনে পড়িল, ডাকাতে আমাকে কাড়িয়া লইয়া গিয়াছে; আমার কি জাতি আছে? এই ভাবিয়া, শ্বশুর স্বামী আমাকে প্রত্যাখ্যান করিবেন সন্দেহ নাই। সে স্থলে, পত্র লেখা ভাল হয় নাই। একথা শুনিয়া সুভাষিণী চুপ করিয়া রহিল।
আমি এখন বুঝিলাম যে, আমার আর ভরসা নাই। আমি শয্যা লইলাম।

1 Comment
Collapse Comments

khub valo laglo dukher onto dekhe….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *