০৩. প্রথম নাম—পৌলস্ত্যবধ – তৃতীয় প্রকরণ

০৩. তৃতীয় প্রকরণ – প্রথম নামপৌলস্ত্যবধ

বাল্মীকি মহাকাব্য রচনা করে প্রথমে নামকরণ করেছিলেন পৌলস্ত্যবধ।

কাব্যং রামায়ণং কৃৎস্নং সীতায়াশ্চরিতং মহৎ।
পৌলস্ত্যবধ ইত্যেবং চকার চরিতব্ৰতঃ॥ ৭ ((১.৪.৭)

অর্থাৎ, রাম ও সীতার সকল চরিত-সম্বলিত পৌলস্ত্যবধ নামক এই কাব্য (লবকুশকে) শিখাইলেন।

উপরোক্ত শ্লোকটিতে সীতার চরিত একথা স্পষ্টভাবে বলা আছে, কিন্তু রাম শব্দের সঙ্গে অয়ন শব্দটি যুক্ত করায় রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।

অয়ন অর্থ গমন, আশ্রয়, পথ, মার্গ (জ্যোতিষে) সূর্যর গতি। সূর্যবংশীয় রামকে সূর্য ধরা হলে বলা যায় রামায়ণ শব্দে সূর্যর অয়নকে এই শ্লোকে নির্দেশ করা হয়েছে। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলির আলোচনায় প্রমাণ দেওয়া হবে বৈদিক পর্জন্যদেবের মত রামও মেঘবর্ষণ দেবতা।

কয়েক শতাব্দীর ধ্যানধারণা অনুসরণে রামকাহিনী আমাদের চিন্তার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে ‘পৌলস্ত্য’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে লঙ্কেশ্বর রাবণের কথা স্মরণে আসে। কিন্তু অগস্ত্যরও একটি নাম পৌলস্ত্য। অগস্ত্যর পিতা পুলস্ত্য এবং মাতা কদমকন্যা হবির্ভূ।

রামায়ণে (৭. ২) অবশ্য পুলস্ত্যর ঔরসে তৃণবিন্দুর কন্যার গর্ভে বিশ্রবার জন্মের উল্লেখ আছে। এ কাহিনীর বক্তা অগস্ত্য স্বয়ং।

অগস্ত্য একটি নক্ষত্র। কালপুরুষ নক্ষত্রের প্রায় ৪৫° (পয়তাল্লিশ) অংশ দক্ষিণে ও ১৫° (পনের) অংশ পূর্বদিকে এবং লুব্ধক নক্ষত্রর প্রায় ৩৬° (ছত্ৰিশ) অংশ দক্ষিণে ও অত্যল্প পশ্চিমে অগস্ত্য নক্ষত্রর অবস্থান। এই নক্ষত্রর পূর্বপাশ্বে একটু দূরে ছায়াপথ তথা সুরগঙ্গা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে।

“সিংহ রাশির ২৩° অংশে সূৰ্য্য থাকিলে যদি সূর্য্যের সহিত অগস্ত্যের উদয় হয়, তাহা হইলে সিংহ হইতে বিলোমক্ৰমে সপ্তম রাশিতে (কুম্ভ রাশিতে) সূৰ্য্য অস্তগত হইবার সময় অগস্ত্যের উদয় হইবে। বস্তুতঃ সূৰ্য্য যদি শতভিষা নক্ষত্রে থাকেন, তাহা হইলেই তাঁহার অস্তগমনের সঙ্গে সঙ্গে অগস্ত্যের উদয় হইবে।”(১)

“অগস্ত্যের উদয়ে বর্ষাকালের আরম্ভ, বোধ করি, ইহা হইতেই অগস্ত্য কুম্ভসম্ভব হইয়াছেন। কৃত্তিকায় বিষুবন ধরিলেও অগস্ত্যের উদয়ের সহিত বর্ষারম্ভ বলিলে কোন দোষ হয় না।”(২)

খৃঃ পূঃ ৪০০০ অব্দে যখন বাসন্ত-বিষুব ছিল মৃগশিরা নক্ষত্রে, তখন দক্ষিণায়নাদি হত উত্তর-ফল্গুনী নক্ষত্রে। দক্ষিণায়নাদি হতে বৰ্ষাঋতু গণন করা হয়।

সুতরাং অতি প্রাচীনকালে সূর্য ও অগস্ত্য নক্ষত্রর একত্রে উদয়কালের সঙ্গে বর্ষাগমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এই ধারণা কৃত্তিকা নক্ষত্রে বাসন্ত-বিষুব অনুষ্ঠানের কালেও অটুট ছিল।

বর্ষ সমাগমের সঙ্গে অগস্ত্যর এই সম্পর্ক-সম্বন্ধীয়-ধারণা পরবর্তী আরও কিছুকাল মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করবে সেটা এমন কিছু বিচিত্র নয়।

রামায়ণের কালে দেখা গেল, বৰ্ষাঋতুর শেষ অধ্যায়ে অগস্ত্য নক্ষত্রর উদয় হচ্ছে। সুতরাং এই নক্ষত্রর পূর্ব-ঐতিহ্য অবশ্যই নষ্ট হল।

বৰ্তমানকালে উত্তরায়ণে অর্থাৎ সূর্যর উত্তরদিকে পৃথিবীর অয়নের সময় গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ ঋতুর প্রথমার্ধ পর্যন্ত অগস্ত্য নক্ষত্র দিনের আকাশে সূর্যালোকে অদৃশ্য থাকে। দক্ষিণায়নের নিশিথে শরতের দ্বিতীয়ার্ধে, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতুতে অগস্ত্য নক্ষত্রকে দক্ষিণ দিগন্তে দেখা যায়।

বাল্মীকি সূর্যর অয়ন তথা মেঘের গমনাগমনের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিতব্য কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল একটি লোক-সংগীতকে উপজীব্য করে মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। মহাকাব্য রচনাকালে বর্ষা সমাগমের সঙ্গে অগস্ত্য নক্ষত্রর সম্পর্কহীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করার কারণে প্রথমে কাব্যটির নাম ‘পৌলস্ত্যবধ’ দিয়ে কাব্যের কৃষি-চরিত্রটি স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু পরবর্তীকালে কাব্যরচনা সমাপ্ত করে কাব্যর অন্তর্নিহিত মূল ঐতিহাসিক বক্তব্যর প্রতি রহস্যে ইংগিত দেওয়ার জন্য, মনে হয় বাল্মীকি

মহাকাব্যর নূতন নামকরণ করেন–রামায়ণ।

রামায়ণ শব্দটিতে সূর্যর অয়ন তথা মেঘের গমনাগমন যেমন বুঝায়, তেমনি ব্যক্তি রামের কার্যাবলীকেও ইংগিত করে।

‘পৌলস্ত্যবধ’ শব্দে এই দ্বৈত ইংগিত সুস্পষ্ট ছিল না।

 

অগস্ত্য সম্পকিত পুরাণ কথা এই প্রসঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে। অগস্ত্য বিন্ধ্য অতিক্রম করে দক্ষিণে গিয়ে আর ফেরেননি। কালক্রমে এই কাহিনীর বিন্ধ্য, ভারতবর্ষের মধ্যস্থলের পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত বিন্ধ্য পর্বতমালার সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছে। ফলে অনেকে মনে করেন অগস্ত্য নামক জনৈক আর্যঋষি দাক্ষিণাত্যে আর্যসংস্কৃতি প্রচারে গিয়ে আর ফেরেননি।

কিন্তু জ্যোতিষে বিন্ধ্য শব্দে বিষুব বুঝানো হয়।

বিন্ধ্য = বিধ (ভেদ করা) + য (কর্তৃ) নিপাতন সিদ্ধ। অর্থ, ব্যাধ। ভেদক বললেও ব্যকরণগত ভুল হয় না।

সুদূর অতীতে বাসন্ত-বিষুব হতে শারদ-বিষুব উত্তরায়ণ বা দেবযান এবং পরবর্তী অংশ দক্ষিণায়ন বা পিতৃযান হিসাবে গণ্য করা হত।

সুতরাং মৃগশিরা ও তৎ-পূর্ববতী নক্ষত্রে বাসন্ত-বিষুব অনুষ্ঠান কালে সূর্যর উত্তরায়ণ তথা দেবযান কালে অগস্থ্য নক্ষত্রর উদয় হত।

পরবর্তীকালে সূর্যর ক্লান্তিপথের দুই অয়নের গণনার পরিবর্তন ঘটে। তখন উত্তরকাষ্ঠ হতে দক্ষিণকাষ্ঠী পর্যন্ত সূর্যপথকে দক্ষিণায়ন এবং পরবর্তী অংশে উত্তরায়ণ ধরা হল।

দক্ষিণায়ানদি পূর্ব-ফল্গুনী নক্ষত্রর পূর্ববতী নক্ষত্রে এলে দক্ষিণায়নাদি অর্থাৎ বর্ষাঋতু গণনা শুরুর অনেক পরে অগস্ত্য নক্ষত্রর উদয় হত।

নক্ষত্র স্থির, অয়ন ও বিষুব চলমান। ঘড়ির কাঁটা যেদিকে চলে সেই দিকে অয়ন ও বিষুব এক নক্ষত্র হতে পরবর্তী নক্ষত্রে পশ্চাদ্‌গামী হয়।

সুতরাং সূর্যর দক্ষিণায়নাদির পরে অগস্ত্য নক্ষত্রর উদয় হওয়ার কাহিনী তৈরী হল অগস্ত্যর দক্ষিণদিকে গমন। তখন বৰ্ষাঋতুর আগমন বাতার ঘোষক হিসাবেও অগস্ত্যর প্রসিদ্ধি লুপ্ত হল। কিন্তু পূর্ব-সূত্র হারিয়েও অদ্যাবধি কুম্ভসম্ভব, ঘটোদৃভব, কলশীভব ইত্যাদি নামে অগস্ত্য চিহ্নিত হয়ে আছে।

অনুরূপভাবেই দক্ষিণায়নাদির ইংগিত বহন করত বলে অগস্ত্যর আরেক নাম হয়েছিল মান।

মান অর্থ পরিমান। অয়ন নিদেশিক ছিল বলেই মান নামকরণ।

রাত্রির আকাশের অধিপতি বরুণ এবং দিবাভাগের অধিপতি মিত্র। দিবা ও রাত্রির সংযোগ অর্থাৎ সন্ধ্যা বা ঊষাকালে অগস্ত্য নক্ষত্রর উদয়, এই কারণে অগস্ত্যকে মিত্রাবরণের সন্তান বলা হয়েছে। ছায়াপথের পশ্চিমে অগস্ত্য নক্ষত্রর অবস্থান। পুরাণে আছে ঊর্বশীকে দেখে মিত্র ও বরুণের রেতঃপাত হলে সেই রেতঃ কুম্ভে রক্ষা করা হলে বশিষ্ঠ ও অগস্ত্যর জন্ম। এই কাহিনীতে ঊর্বশী ছায়াপথ, বরুণ কুম্ভরাশিস্থ শতাভিষা নক্ষত্র। সূর্যর এক নাম মিত্র। সুতরাং সূর্য কুম্ভরাশিতে শতাভিষা নক্ষত্রে অস্তগত হলে বর্ষার পূর্বে ছায়া পথের পশ্চিম পার্থে অগস্ত্য নক্ষত্রর উদয় হত। এই নৈসর্গিক তথ্যের ভিত্তিতে অগস্ত্য নক্ষত্রর ঘটোস্তব ইত্যাদি নামকরণ ও জন্মকাহিনী।

অগস্ত্য নক্ষত্রর উদয় শতভিষা নক্ষত্র সংশ্লিষ্ট কারণে অগস্ত্যর এক নাম বারুণি হয়েছে।(৩)

বেদে অগস্ত্য নক্ষত্রকে দিব্যনৌকা বলা হয়েছে।(৪) সমুদ্রচুলুক নামেও অগস্ত্যকে অভিহিত করা হয়েছে।(৫) চুলুক অর্থ গণ্ডুষ, কর্দম, গোত্র প্রবর্তক মুনি।

পুরাণে আছে অগস্ত্য দেবগণের অনুরোধে এক গণ্ডুষে সমুদ্র শোষণ করলে দেবগণ সমুদ্রগর্ভে লুক্কায়িত কালকেয় নামক দৈত্যকুলকে বিনাশ করেন।

অগস্ত্য নক্ষত্রর পূর্বপাশ্বে ছায়াপথ ছিন্নবিচ্ছিন্ন। এই নৈসর্গিক অবস্থার রূপক কাহিনী অগস্ত্যর এক গণ্ডুষে সমুদ্র শোষণ। সমুদ্র শব্দে ছায়াপথ বুঝায়। ( পূর্বপৃষ্ঠার ছবি দ্রষ্টব্য )

মনে হয় জহ্নুমুনির এক গণ্ডুষে গঙ্গা শোষণ কাহিনীটিও এই নৈসর্গিক ঘটনার আরেকটি রূপক।

সেক্ষেত্রে অগস্ত্য এবং জহ্নুমুনি একই।

অগস্ত্যর এই বিভিন্ন স্বরূপ সাধারণভাবে সূর্যক্লাস্তি সংশ্লিষ্ট এই নক্ষত্রর উদয়ের সঙ্গে বৰ্ষাঋতুর বহুকালের সম্পর্কের তথ্য উদ্‌ঘাটিত করছে।

বালমীকির কালে বর্ষা তথা কৃষিকাজের সঙ্গে অগস্ত্য নক্ষত্রর উদয়ের কোন সম্পর্ক ছিল না।

একারণে বাল্মীকি রচিত পৌলস্ত্যবধ তথা রামায়ণে কৃষিভিত্তিক তথ্যকে উপজীব্য করা হয়েছে একথা দাবী করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *