০২. আদিশ্লোক—মা নিষাদ – দ্বিতীয় প্রকরণ

০২. দ্বিতীয় প্রকরণ – আদিশ্লোকমা নিষাদ

বাল্মীকি রামায়ণের প্রথম শ্লোক,
তপঃ সাধ্যায়নিরতং তপস্বী বান্ধিদাং বরম্।
নারদং পরিপপ্রচ্ছ বাল্মীকিমুনিপুঙ্গবম্॥ ১
(১.১.১)

অর্থাৎ, মহৰ্ষি বাল্মীকি তপোনিরত স্বাধ্যায়-সম্পন্ন বেদবিদদিগের অগ্রগণ্য মুনিবর নারদকে সম্বোধন করলেন।

নারদের নিকট বাল্মীকির জিজ্ঞাস্য ছিল সম্প্রতিকালে লোকে সর্বগুণে বিভূষিত শ্রেষ্ঠ কে?

উত্তরে নারদ রামের পরিচয় তথা জীবন বৃত্তান্ত শোনালেন।

কথোপকথন শেষে নারদ বিদায় নিলে বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে সঙ্গে নিয়ে অবগাহনের উদ্দেশ্যে জাহ্নবীর অদূরে তমসায় উপনীত হয়ে ভরদ্বাজকে কলস রেখে বল্কল দিতে বললেন। বল্কল নিয়ে তমসার বনে বিচরণকালে বাল্মীকি সুরতাসক্ত ক্ৰৌঞ্চমিথুন দেখলেন। হেনকালে অদৃশ্য ব্যাধ কর্তৃক ক্ৰৌঞ্চ নিহত হলে শোকাভিভূত বাল্মীকির কণ্ঠ হতে উদ্‌গীত হল,
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্ৰৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্॥১৫
( ১.২.১৫ )

এই শ্লোকটি আদিশ্লোক হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে। যদিও এটি রামায়ণের প্রথম কাণ্ডের দ্বিতীয় সর্গের পঞ্চদশতম শ্লোক। এই শ্লোকের প্রচলিত আক্ষরিক অর্থ, ‘রে নিষাদ! যেহেতু তুই, এই ক্ৰৌঞ্চমিথুনমধ্যে কামমোহিত ক্ৰৌঞ্চকে বধ করিয়াছিস, অতএব তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করিবি না।‘

শ্লোক উদ্‌গীত হওয়ার পর বাল্মীকি শিষ্যকে বললেন,—‘এই চতুস্পাদবদ্ধ, প্রতিপদে সমানাক্ষর ও বীণালয়-সমন্বিত বাক্য, শোক সময়ে আমার মুখ হইতে নিগত হইয়াছে, অতএব ইহা শ্লোকই হোক।

অতঃপর অবগাহনান্তে এই বিষয়ে চিন্তা করতে করতে বাল্মীকি আশ্রমে ফিরলে ব্রহ্মা উপস্থিত হন।

ব্ৰহ্মার উপস্থিতিতে আত্মমগ্ন বাল্মীকি ঐ শ্লোক উচ্চারণ করলে ব্ৰহ্মা এটি শ্লোক হিসাবে স্বীকার করে নিয়ে বাল্মীকিকে এইভাবে রামকথা রচনা করার নির্দেশ দিয়ে বর দিলেন বাল্মীকি রামের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকল প্রকাশ্য ও রহস্য তথ্য অবগত হবে।

এখানে লক্ষণীয় যে বাল্মীকি প্রথম নারদের নিকট রামকথা অবগত হয়েছিলেন। নারদের বিবৃত কাহিনীই উত্তরকাণ্ড বাদে বাকি ছয়টি কাণ্ডে বাল্মীকি বিস্তারিত করেছেন।

সুতরাং বাল্মীকি রামকথার স্রষ্ট নন। একটি তৎকালীন প্রচলিত কাহিনী অবলম্বনে বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন।

আদিশ্লোকটির আক্ষরিক অর্থ এবং পটভূমিকা অনুসারে মানতে হয় ক্ৰৌঞ্চমিথুনের পুরুষ-ক্ৰৌঞ্চ বধের দৃশ্যে মুহ্যমান বাল্মীকির কণ্ঠ হতে শ্লোকের আবির্ভাব ঘটেছিল।

কিন্তু এই শ্লোকটির অন্য অর্থও আছে।

মা অর্থ লক্ষ্মী।

নিষাদ, নিষদ এবং নিষাধ সমার্থক, যার অর্থ ধরা হয় পতি।

সুতরাং, মা নিষাদ শব্দের অর্থ লক্ষ্মীপতি অর্থাৎ নারায়ণ।

নার (জল)এ যার অয়ন (শয়ন, আশ্রয়)। সহজ কথায় মেঘ।

বসুন্ধরার কন্যা সীতা লক্ষ্মীর অংশজাত। সীতা অর্থ হলরেখ।

কৃষিকাজের সার্থকতা মেঘের বারিবর্ষণে, বিনা জলে কর্ষিত জমি বন্ধ্যা,-অ-লক্ষ্মী।

ক্ৰৌঞ্চ অর্থ রাক্ষস বিশেষ।

রক্ষ্‌ (রক্ষা করা) ধাতু নিষ্পন্ন রাক্ষস শব্দের অর্থ, যাহা হইতে (ধনাদি) রক্ষিত হয়।

প্রাণ-জগতের সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়ের মূলে দ্যাবাপৃথ্বী। স্থূলভাবে, দ্যৌঃ অর্থে অন্তরীক্ষের সূর্য এবং পৃথ্বী অর্থে কর্ষণযোগ্য ভূখণ্ড; এই দুয়ের সংযোগ মূলতঃ মানব সমাজের অগ্রগতির উৎস। গ্রীষ্মকালের প্রচও দাবদাহ জীব জগতের ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে। এই অবস্থার নিরসন হয় বর্ষা মেঘের আবির্ভাব ঘটলে। আদিশ্লোকে গ্রীষ্মকালীন দ্যাবাপৃথ্বীকে রহস্যে ক্ৰৌঞ্চ-মিথুন আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

দ্যৌঃ এবং পৃথ্বীকে আদিলোকে রাক্ষস অর্থে ধরে ক্ৰৌঞ্চমিথুন বলা হয়েছে। সূর্য এবং পৃথিবী সকল সময়েই মিথুনাবদ্ধ থাকলেও দক্ষিণায়নাদির প্রাক্‌কালে গ্রীষ্মঋতুতে সূৰ্যতেজে ধরিত্রী উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এই তপ্ত অবস্থাকে মহাকাব্যে কামমোহিত বলা হয়েছে।

অতএব, আদিলোকটির অর্থ দাঁড়ায়,—দ্যাবাপৃথ্বীর দ্যৌঃকে আচ্ছাদিত করে লক্ষ্মীপতি তুমি আবিভূত হয়ে শাশ্বত প্রতিষ্ঠালাভ কর।

এই অর্থে আদিশ্লোকটি মেঘবন্দন।

 

বলা যায় রামায়ণ মহাকাব্যর এইটি মঙ্গলাচরণ এবং আদিশ্লোকটি সমগ্র রামায়ণের বীজস্বরূপ।

 

রামকাহিনীর প্রথম বক্তা নারদ, সম্মতিদাতা ব্ৰহ্মা, রচনাকত বাল্মীকি এবং প্রয়োগকত লবকুশ।

নারদ,—নার (জল) + দা (দেওয়া)—ড কর্তৃ। যিনি জল দান করেন। অথবা, না (সৃষ্টিকতা) র (সংহারকতা) দ (পালনকতা)।

উভয় ক্ষেত্রেই ভাবার্থে অন্তরীক্ষ।

বল্মীক (উইঢিবি) শব্দ হতে উদ্ভূত বাল্মীকি অর্থে কাকরহীন ভূখণ্ড অর্থাৎ আবাদযোগ্য জমি এই ইংগিত করা যায়।

সুতরাং বলা যায় বাল্মীকি (আবাদযোগ্য ভূখণ্ড) একদা নারদের (অন্তরীক্ষের) নিকট জানতে চেয়েছিলেন এই বিশ্বে শ্রেষ্ঠ কে?

উত্তরে রামকথার অবতারণা, অর্থাৎ মেঘের শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করা যদি মেঘের বারিবর্ষণ না হত তাহলে পৃথিবীও চন্দ্রের মত প্রাণহীম থাকত। জলের আবির্ভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রাণের বিকাশ।

প্রাণ-জগতের শ্রেষ্ঠ জীব মানবজাতির ক্ৰমবিকাশে আবাদীজমিতে কৃষিকাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

কৃষিকাজ ঋতুচক্ৰ তথা মেঘচক্রের উপর নির্ভরশীল। বর্ষায় আশানুরূপ বর্ষণ না হলে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। অপরদিকে সীতা অর্থাৎ হলকর্ষত জমি লক্ষ্মীস্বরূপ হিসাবে গণ্য হবে তখনই, যখন রাম অর্থাৎ মেঘদেবতা আশীৰ্বাদস্বরুপ বারিবর্ষণে সীতাকে সিঞ্চিত করবে।

দ্যোঃ এবং পৃথ্বী আদি পিতা ও মাতা। দ্যৌঃ মেঘকে ধারণ করে, সুতরাং রাম দ্যৌঃ-এর পুত্র।

পৃথ্বীর বুকে হলকর্ষণ করলে সীতার আবির্ভাব ঘটে, একারণে সীতা বসুন্ধরা-কন্যা।

আদি পিতামাতার সূত্রে রাম ও সীতা ভাইবোন। কিন্তু বৰ্ষাঋতুতে বারিবর্ষণের সূত্র ধরে উভয়ের মধ্যে সংযোগসাধন না ঘটলে সৃষ্টি স্থিতিলাভ করতে পারে না। এক্ষেত্রে এদের সম্পর্ক দাঁড়ায় স্বামী-স্ত্রী। যেহেতু রামায়ণে সকল বস্তু এবং তথ্যকে মানবিক স্বৰূপে প্রকাশ করা হয়েছে, সেকারণে রাম (মেঘদেবতা) এবং সীতার (কৃষিশ্রী) মধ্যে দুই ধরণের সম্পর্ক আপাতঃদৃষ্টিতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। কিন্তু এই দুই সম্পর্ক বিজ্ঞানদৃষ্টিতে বিচার করলে প্রকৃত তথ্য উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না।

আদিশ্লোকের সমর্থক ব্রহ্মা।

নিরাকার ব্রহ্ম সাকার অবস্থায় ব্ৰহ্মা।

সুতরাং বাল্মীকির মেঘবন্দনার মধ্যেই পরবর্তী কার্যকারণ অর্থাৎ ফসল উৎপাদন নিহিত রয়েছে। এই কার্যকারণের প্রতি ইংগিত দেওয়ার জন্যই ব্ৰহ্মার সম্মতি।

রামায়ণের প্রয়োগকতা লবকুশ। লব ও কুশ শব্দ দুটির মধ্যেই কৃষিসত্তা অর্থাৎ উদ্ভিদের বীজ হতে আবির্ভাবের তথ্য লুকিয়ে রয়েছে।

 

নারদের নিকট রামকথা শোনার পর বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে নিয়ে জাহ্নবীর অদূরে তমসায় গমন করেন। সেখানে বাল্মীকি শিষ্যকে কলস রেখে বল্কল দিতে বলেন। তারপর তমসার বনে বিচরণকালে সুরতাসক্ত ক্ৰৌঞ্চমিথুনের পুরুষ-ক্লোঞ্চের নিধন-দর্শনে শ্লোকের আবির্ভাব।

এই বিবরণ জ্যোতিবিজ্ঞানের প্রতি ইংগিত দেয়।

রামায়ণের কালে সূর্য কর্কটরাশিতে এলে শ্রাবণ মাস বর্ষা ঋতুর প্রথম মাস। ক্ৰৌঞ্চমিথুন শব্দটি সূর্যর মিথুনরাশির পুনর্বসু নক্ষত্রে অবস্থান ইংগিত করছে। যুগ্ম-তারকা পুনর্বসু নক্ষত্র মিথুনের দোতক। পুনর্বসু নক্ষত্রর তারাগুলির সমন্বয়ে ক্ৰৌঞ্চমিথুন কম্পন করা যায়।

সূর্যর এই অবস্থানকাল গ্রীষ্মঋতুর শেষ মাস আষাঢ়। ধরে নেওয়া যেতে পারে তিথি অমাবস্যা, এক্ষেত্রেও মিথুন শব্দটি প্রয়োগ করা যায়। যেহেতু অমাবস্যায় সূর্য ও চন্দ্র সমসূত্রে থাকে।

জাহ্নবী অর্থে ছায়াপথ। জাহ্নবীর অদূরে অর্থে ছায়াপথের পূর্বদিকস্থ পুনর্বসু নক্ষত্র।

তমসা শব্দে বৃষ্টিহীন প্রচণ্ড গ্রীষ্মে ধ্বংসোন্মুখ পরিবেশকে বুঝানো হয়েছে। গ্রীষ্মঋতুর শেষে জলাশয় শুকিয়ে যায়, নদীর বুকে বালির চর জেগে ওঠে, বায়ুপ্রবাহ ও ভূ-পৃষ্ঠ রুক্ষ ও তপ্ত, জলাভাবে উদ্ভিদাদি শ্ৰীভ্রষ্ট ও মৃতপ্রায়, জীবজগৎ তৃষ্ণাত ও ক্লান্ত, আকাশের রং তাম্রবর্ণ।

এই ধ্বংসোম্মখে পরিস্থিতিতে বাল্মীকি বিচরণ করার কালে পুরুষ ক্ৰৌঞ্চ নিহত হয়।

নিহারিকাপ্রবহ হতে সূর্যর সৃষ্টি, একারণে দ্বিজ। সূর্যরশ্মি বিশাল বিশ্বে প্রসারিত, সুতরাং বিস্তৃতপক্ষ। গ্রীষ্মের আকাশের রং তাম্রবর্ণ, অতএব তাম্রশীর্ষ।

ক্ৰৌঞ্চ অর্থাৎ কোঁচবকের মিথুনকাল গ্রীষ্মঋতুর শেষে ও বর্ষার প্রথমে। সুতরাং ক্ৰৌঞ্চবধ অর্থে গ্রীষ্মের শেষে প্রথম আবিভূত মেঘ দ্বারা সূর্যর আচ্ছাদন।

সূর্য আড়াল হলেও ভূপৃষ্ঠ হতে তখনও তাপ বিকিরণ হয়। একারণে ক্ৰৌঞ্চের শোকে ক্রোঞ্চীর অস্থিরতা প্রকাশ করা।

তাম্রশীর্ষ বিস্তৃতপক্ষ দ্বিজ পুরুষ ক্ৰৌঞ্চ গ্রীষ্মকালীন সূর্যর প্রতীক। জ্যোতিবিজ্ঞান দৃষ্টিতে বাল্মীকিকে ব্ৰহ্মহৃদয় নক্ষত্র ধরা যায়।(১)

অদৃশ্য ব্যাধ শব্দ সেক্ষেত্রে লুব্ধক তারাকে ইংগিত করে।

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আদিশ্লোকের আবির্ভাবের পটভূমিকাটি চিন্তা করলে গ্রীষ্মকালীন পরিবেশে বৃষ্টির কামনায় মেঘবন্দনার স্বরূপ সুস্পষ্ট হয়।

যেহেতু রামায়ণে মেঘদৈবত রাম ও কৃষিশ্রী সীতার সকল চরিত্র আলোচিত হবে, সেকারণে বৰ্ষাঋতুর প্রাক্‌কালে মেঘবন্দনা করে মঙ্গলাচরণ করা হয়েছে।

 

আদিশ্লোকের মধ্যে সংগীত বিজ্ঞানের ইংগিত রয়েছে। বাল্মীকি বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিবিধ-অর্থবহ এই কাব্য বীণাতন্ত্রীলয়ে সংগীত শাস্ত্রানুসারে পঠিত ও গীত হবে।

পাঠ্যে গেয়ে চ মধুরং প্রমাণেস্ত্রিভিরম্বিতম্।
জাতিভিঃ সপ্তর্ভিযুক্তং তন্ত্রীলয়সমম্বিতম্॥ ৮
রসৈঃ শৃঙ্গারকরুণহাসারৌদ্রভয়ানকৈঃ।
বীরাদিভী রসৈর্যুক্তং কাবামেতদগায়তাম্॥ ৯ (১.৪.৮-৯)

অর্থাৎ, এই কাব্য পাঠ ও গানে মধুর, দুত, মধ্য ও বিলম্বিতরূপে ত্ৰিবিধ-প্রমাণ-সংযুক্ত ষড়জ ও মধ্যম প্রভৃতি সপ্তস্বর-সংযুক্ত, বীণালয়বিশুদ্ধ এবং শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর প্রভৃতি সমুদয় রসসংযুক্ত।

উপরোক্ত শ্লোক হতে সুস্পষ্ট যে রামায়ণের কালে সংগীতের ক্ষেত্রে স্থান, লয়, মূছন, জাতি, স্বর প্রভৃতির বিশেষ প্রচলন ছিল। কিন্তু দেখা যায় রামায়ণে বাল্মীকি কোথাও ‘রাগ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। সুতরাং বলা যায় তখন ‘রাগ’ শব্দটির প্রচলন হয়নি, কিন্তু যে কার্যকারণ হতে রাগ শব্দটির উদ্ভব, সেই কার্যকারণ অবশ্যই বর্তমান ছিল।

পণ্ডিতগণের মতে খৃঃ পূঃ ৬০০-৫০০ অব্দে সংগীতের ক্ষেত্রে চারটি ধারা বা সম্প্রদায় ছিল।

(১) ব্রহ্মা বা ব্ৰহ্মাভরত সম্প্রদায়,

(২) গন্ধৰ্ব নারদ সম্প্রদায়,

(৩) মুনি ভরত সম্প্রদায়,

(৪)  নন্দিকেশ্বর সম্প্রদায়।

কেউ কেউ ব্রহ্মাভরত ও মুনি ভরত সম্প্রদায়কে একই মনে করেন এবং তাঁদের মতে সম্প্রদায় চারটি নয়, তিনটি।

একথা স্বীকৃত যে নারদ, ভরত প্রভৃতি নামগুলি গোত্ৰনাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে পরবর্তীকালে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত।

ভরত বাল্মীকির সহসময়ী।(২)

আদিশ্লোকের পশ্চাদ্‌পটে দেখা যায় নারদ প্রথম রামকথা ব্যক্ত করেন। তারপর বাল্মীকির ক্ৰৌঞ্চবধ দর্শন ও শ্লোকের আবির্ভাব। পরে অবচেতন ভাবে ব্রহ্মার সম্মুখে ঐ শ্লোক উদ্‌গীত হলে ব্রহ্মা এটি সমর্থন করে রামায়ণ রচনার নির্দেশ দেন।

এখানে নারদ, ব্রহ্মা ও বাল্মীকি-শিষ্য ভরদ্বাজ নামগুলি প্রাচীন ভারতের সংগীতশাস্ত্র প্রবর্তকগণের প্রতি ইংগিত রাখছে।

ব্ৰহ্মা বৈদিক সংগীতরীতির এবং নারদ লৌকিক বা গান্ধৰ্বরীতির প্রবর্তক। নারদের রামকথাকে ধরে নেওয়া যায় তৎকালীন কৃষিভিত্তিক কোন প্রাচীন লোকসংগীতের মার্জিত রূপ।

নারদ লোকসংগীতের সুর ইত্যাদি মার্জিত করে মার্গসংগীত পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। নারদ বীণাযন্ত্রেরও উদ্ভাবক।

বাল্মীকির শিষ্যর নাম ভরদ্বাজ।

ভরত + জন্‌—ড কর্তৃ; ভরদ্বাজ অর্থে ভরতের পুত্র। শিষ্য সকল সময়েই পুত্রস্থানীয়। সুতরাং শিষ্য ভরদ্বাজের গুরু অবশ্যই ভরত। বাল্মীকি ও ভরত সমার্থক; ক্ষেত্র। কুশলব গান্ধৰ্ব সংগীত তত্ত্বে পারদর্শী ছিল।

তৌ তু গান্ধৰ্বতত্ত্বজ্ঞে স্থানমুচ্ছনকোবিদে।
ভ্রাতরে স্বরসম্পন্নেী গন্ধৰ্বাবিব বৃপিণেী॥ ১০ (১.৪.১০)

 

কুশলব বাল্মীকি আশ্রমে লালিত পালিত হয়েছে। তাদের রামায়ণ শিক্ষাও বাল্মীকির নিকট। সুতরাং বাল্মীকি অবশ্যই সংগীতে বিশেষতঃ গান্ধৰ্বরীতিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। মনে হয়, বাল্মীকি তার রামায়ণ গানে নারদীয় ও বৈদিক উভয় সংগীত ধারার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সংগীত বিজ্ঞানের সংস্কার সাধন করেছিলেন। এরই ইংগিত দেওয়া হয়েছে নারদের রামকথা কথনে, বাল্মীকির সুরারোপিত কাব্যছন্দের উদ্ভাবনে এবং ব্ৰহ্মার স্বীকৃতিদান ঘটনায়।

ব্ৰহ্মা জানতেন না শ্লোকের আবির্ভাবের পূর্বঘটনা। অথচ শ্লোকটির স্বীকৃতিদান করে ঐভাবে রামের চরিত্র বর্ণনের জন্য বাল্মীকিকে নির্দেশ দিলেন। অতএব শ্লোকটির শব্দার্থ এবং স্বর সংস্থান মেঘবন্দনার স্বরূপ সুস্পষ্ট করে তুলেছিল, এই কারণেই ব্ৰহ্মা রামকথা অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক লোকসংগীতের পরিমার্জিত গ্রন্থনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রামকথা শোনার পর বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে সংগে নিয়ে জাহ্নবীর অদূরে তমসায় গিয়েছিলেন অবগাহন কারণে। ভরদ্বাজের সংগে ছিল কলস। বাল্মীকি শিষ্যকে কলস রেখে বল্কল দিতে বললেন। বল্কল হাতে নিয়ে বিচরণের কালে ক্ৰৌঞ্চবধ দর্শন।

অবগাহন অর্থে স্নান। কিন্তু কোন কিছুর গভীরে প্রবেশ করা অথবা কোন চিন্তায় আত্মমগ্ন হওয়া অবগাহন শব্দে প্রকাশ করা যায়।

কলস—কল (মধুরাস্ফুট ধ্বনি)—শে + ড কর্তৃ।
কলস শব্দ দ্বারা মৃদংগ, খোল প্রভৃতি মৃত্তিকাধার জাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে বুঝানো যায়।

বল্কল—বল্‌ (আস্তরণ কর।) + কল; বৃক্ষত্ত্বক।

বীণার প্রতিশব্দ বল্লকী।

বল্লকী—বল (আস্তরণ করা) + ণকৃ কর্তৃ + ঈপ্‌।

উভয় শব্দ আস্তরণ করা শব্দজাত বিধায় রহস্য সৃষ্টির কারণে অবগাহন ও কলস শব্দের সংগে সামঞ্জস্য রেখে ‘বল্কল’ শব্দটি রূপকার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। তারযন্ত্র মূলতঃ বৃক্ষত্বক দিয়ে তৈরী হয়।

জাহ্নবী, তমসা, ক্ৰৌঞ্চ-মিথুন, অকর্দমতীর্থ প্রভৃতি শব্দ দ্বারা কাহিনীতে গ্রীষ্মকালীন প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে মেঘবন্দনার সময়কালকে যেমন নির্দেশ করা হয়েছে, তেমনি কলস, বস্কল, অবগাহন শব্দ দ্বারা সংগীত তথ্য সুচিহ্নিত।

দেখা যায় বাল্মীকির রামায়ণ রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল বহু অর্থবহ এই গীতিকাব্য অবলম্বন করে চারণের ছদ্মবেশে সীতার গর্ভজাত কুশ ও লবকে তাদের পিতা রাজা রামচন্দ্রর সম্মুখে উপস্থাপিত করা। এই উদ্দেশ্যে বিষয়বস্তু হিসাবে লোকসংগীতের রামকথাটির নব-রূপায়ন সম্পর্কে বাল্মীকি চিন্তা করেছিলেন।

গান্ধৰ্ব-সংগীত বিশেষজ্ঞ বাল্মীকি প্রথমে মৃদংগ জাতীয় বাদ্যযন্ত্র সহযোগে মেঘবন্দনার নতুন সুর সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনঃপুত না হওয়ায় তারযন্ত্রের শরণাপন্ন হন।

মেঘবন্দনার উপযুক্ত কাল গ্রীষ্মঋতুর শেষ পর্যায়ে; যখন মানুষ তথা জীবজগৎ মেঘ সমাগম ও বারিবর্ষণ ব্যাকুলভাবে কামনা করে। সংগীতের ভাব ও সুর (পরবর্তী কালে অর্থাৎ বর্তমান সময়ে যাকে রাগ বলা হয়) ঋতু তথা সময়কাল আশ্রিত। সুতরাং বাল্মীকি তৎকালীন প্রচলিত মেঘবন্দনা তথা মেঘগীতির সুরে বিবতন সাধনের চিস্ত ভাবনার কালে কলসজাতীয় বাদ্যযন্ত্র বর্জন করে তারযন্ত্র অবলম্বন করেছিলেন। এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হল শ্লোকের আবির্ভাব।

 

ক্ৰৌঞ্চবধ প্রসংগে শৃঙ্গার, বীভৎস, করুণ ও রৌদ্র রসের অবতারণা করা হয়েছে। এই রসগুলির আশ্রিত স্বর যথাক্রমে মধ্যম, নিষধ, ষড়্জ এবং ধৈবত ৷ এই চারটি স্বরের আদ্যাক্ষর নিয়ে আদিশ্লোকের প্রথম শব্দ —মা নিষাদ। মা শব্দটি স্বতন্ত্র রাখার হেতু মধ্যম বাদী বা গ্রহস্বর। নিষাদ শব্দের ‘দ’ অক্ষর ইংগিত করছে ধৈবত বর্জিত।

এই চারটি স্বরের উপর ভিত্তি করে প্রাচীনকালে ‘মেঘরাগ’ জাতীয় মেঘবন্দনা গাওয়া বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে বাদী মা (মধ্যম), সম্বাদী ষ (ষড়্‌জ), ঔড়বষাড়ব জাতি, ধ (ধৈবত) বর্জিত। ধ্রুবপদ।(৩) পণ্ডিতগণের মতে চার স্বরের রাগ অনার্য সংগীতের পর্যায়ে পড়ে।(৪)

বর্তমান কালের মেঘ তথা বর্ষা আশ্রিত মেঘরাগের প্রাচীন উল্লেখ একাদশ-দ্বাদশ খৃষ্টাব্দের আগে পাওয়া যায় না। কিন্তু মল্লার বা মল্লহার বা মলহার রাগের অস্তিত্ব পঞ্চম-সপ্তম খৃষ্টাব্দে ছিল।

দেশজ রাগগুলি কোন বিশেষ স্থান বা গোষ্ঠীকে নির্দেশ করে। সেক্ষেত্রে মল্লার দেশজ রাগ মল্পজাতি অথবা প্রাচীন মলদ দেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। গঙ্গার দক্ষিণে মলদরাজ্য এবং সেই অঞ্চলে মল্পগণের বসবাস উভয়ই ইতিহাস-সিদ্ধ।

খৃষ্টপূর্ব ৩য়-২য় শতকে রচিত জাতক কাহিনীর মৎস্য জাতকে (নং ৭৫) মেঘবর্ষণের উদ্দেশ্যে গীত মেঘগীতির উল্লেখ আছে। জাতকে ‘রাগ’ শব্দের উল্লেখ নাই; কিন্তু মেঘবর্ষণের উদ্দেশ্যে যে বিশেষ ধরণের সংগীত ছিল তার সুস্পষ্ট ইংগিত পাই। রামায়ণে সংগীত-তত্ত্বের উল্লেখ অনুসরণ করে পণ্ডিতগণ এই মহাকাব্য রচনার সময়কাল নির্ধারণ করেছেন খৃঃ পূঃ চতুর্থ শতক।(৫) সুতরাং খৃঃ পূঃ চতুর্থ শতকে রামায়ণের কালে মেঘবন্দন সংশ্লিষ্ট চারটি স্বর আশ্রিত মেঘগীতির অস্তিত্ব অন্‌-আর্য কোন সম্প্রদায়, বিশেষ করে কৃষিনির্ভরশীল সম্প্রদায়ের মধ্যে বৰ্তমান ছিল এই কথা সহজেই অনুমান করা যায়।

সুতরাং আদিশ্লোকের মধ্যে অন্তর্নিহিত সংগীত-তত্ত্বের ইংগিত অনুসরণ করে শ্লোকটির কৃষিসত্তা স্বীকার করতে হয়।

 

উপরোক্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মনে হয় না আদিকবি অবগাহনের উদ্দেশ্যে তমসা নামক নদীতীরে বল্কল হাতে বিচরণকালে কামমোহিত ক্ৰৌঞ্চ-মিথুনের ক্ৰৌঞ্চকে নিহত হতে দেখেছিলেন।

আদিশ্লোকটি বিবিধার্থবহ। এর মধ্যে নব উদ্ভাবিত ছন্দ, পরিমার্জিত স্বর-সংযোজন এবং মহাকাব্যর মূল বক্তব্য বিষয়ের ইংগিত রাখা হয়েছে। বর্তমান অর্থভেদ অনুসরণে ক্ৰৌঞ্চবধ ঘটনাটি মূল কাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন মনে হবে না।

বাল্মীকি রামকথার স্রষ্টা নন, মনে করি নারদও নন। প্রাচীনতম কালের কৃষিজীবি মানবগোষ্ঠীর মেঘদেবতার বন্দনায় স্বতঃস্ফূত আবেগের মধ্য দিয়ে এই কাহিনী আত্মপ্রকাশ করেছিল। সেই রামকথা একান্তভাবে মেঘদৈবত রাম ও কৃষিশ্রী সীতাকে অবলম্বন করে। নারদ সেই কাহিনীর সুর মাগ-সংগীতের অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। বাল্মীকি তাঁর প্রয়োজনমত কাহিনী ও সুর উভয়ই সর্বজনগ্রাহ্য করে ‘রামায়ণ’ রচনা করেন।

2 Comments
Collapse Comments

Good for all

Dr. Amit M. Bhattacharya October 1, 2022 at 12:56 pm

It may be useful for many who study ancient texts and philosophical propositions.
Not for all as the text and interpretations have lost their utility and so has gone time-barred.
It may be an intellectual exercise at the best with no relevance to the contemporary world view.
Please don’t kill your time and intellect by sticking to age-old time-barred things. It will cause more harm than good to the people. Sorry. I killed much of my precious time and energy just in reading it out just on recommendation of an old friend.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *