৬৫. লবকুশের সহিত যুদ্ধে ভরত ও লক্ষ্মণের পতন

৬৫. দূত কর্ত্তৃক শ্রীরামচন্দ্রকে যুদ্ধে শত্রুঘ্নের পতনের সংবাদ প্রদান এবং শ্রীরামচন্দ্রের আদেশে ভরত, ও লক্ষ্মণের যুদ্ধে গমন পতন

পাত্র মিত্র সহ রাম আছে যজ্ঞস্থানে।
হেনকালে সাত জন গেল সেইখানে।।
সাতজন বার্ত্তা কহে গিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে।
দুই শিশু যুদ্ধ করে বাল্মীকির দেশে।।
লব কুশ নামেতে যে যমজ দুই ভাই।
ত্রিভুবন পরাজিত সে দোঁহার ঠাঁই।।
ভয় বাসি প্রভু বলিবারে বিবরণ।
সৈন্যসহ যুদ্ধেতে পড়িল শত্রুঘন।।
শুনিয়া শ্রীরাম অতি ভাবিত হইয়া।
জিজ্ঞাসা করেন তারে প্রমাদ ভাবিয়া।।
কহ দূত কার সঙ্গে ঘটিল এ রণ।
কি আশ্চর্য্য শত্রুঘ্নের সমরে পতন।।
দূত কহে মহারাজ দুই মুনিসুত।
যুদ্ধ করে সমরে সাক্ষাৎ যমদূত।।
তারা যদি যুদ্ধ করে তোমার সহিতে।
জিনিতে নারিবে প্রভু হেন লয় চিতে।।
ঘোড়া বন্দী করিল তাহারা দুই জন।
এতেক প্রমাদ পড়ে ঘোড়ার কারণ।।
সে কথা শুনিয়া রাম করেন চিন্তন।
প্রমাদ পড়িল দৈব না যায় খণ্ডন।।
সূর্য্যবংশে জন্মিল যতেক মহারাজ।
সমরে পড়িয়া কেহ না পাইল লাজ।।
অনরণ্য মহারাজে মারিল রাবণে।
সে রাবণ সবংশে পড়িল মোর বাণে।।
দুর্জ্জয় লবণ ছিল রাবণ-ভাগিনে।
দেব দৈত্য আদি যত কাঁপে সর্ব্বজনে।।
রাবণ হইতে কত বড় সে লবণ।
তাহারে মারিল মোর ভাই শত্রুঘন।।
রামেরে প্রবোধ দেন ভরত লক্ষ্মণ।
ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম এই যুদ্ধেতে মরণ।।
বিলাপ সম্বর প্রভু না কর বিষাদ।
কারো দোষ নাহি দৈবে পাড়িল প্রমাদ।।
পতিব্রতা সীতা তুমি বর্জ্জিলে যখন।
জেনেছি তখনি হবে বিধি-বিড়ম্বন।।
দেবতা জানেন যে সীতার নাহি পাপ।
বিনা দোহে বর্জ্জিলে সে তেঞি পাই তাপ।।
আজি যদি শ্রীরাম তোমার আজ্ঞা পাই।
শিশু ধরিবারে যাই মোরা দুই ভাই।।
এতেক বলিল যদি ভরত লক্ষ্মণ।
শ্রীরাম দিলেন আজ্ঞা উভয়ে তখন।।
যাও ভাই কল্যাণ করুন ত্রিলোচন।
সাবধানে দুই ভাই কর গিয়া রণ।।
শত্রুঘ্ন ভ্রাতার শোক সান্ধাইল বুকে।
পাছে পাই আর শোক মরি সেই দুখে।।
দুই ভাই কর যুদ্ধ যদি যুদ্ধ ঘটে।
দুই শিশু ধরে আন আমার নিকটে।।
বিদায় হইয়া যান ভরত লক্ষ্মণ।
চারি অক্ষৌহিণী সৈন্য করিল সাজন।।
মুখ্য-সেনাপতি গিয়া চড়িলেন রথে।
হস্তী ঘোড়া ঠাট কত চলে তার সাথে।।
জাঠি ঝকড়া শেল শূল মুষল মুদগর।
খাণ্ডা আর ডাঙ্গস দেখিতে ভয়ঙ্কর।।
দুর্জ্জয় নামেতে হস্তী আরোহে ভরত।
ধনুর্ব্বাণ পূর্ণ লক্ষ্মণের মহারথ।।
হস্তী ঘোড়া ঠাট কত চলিল অশেষ।
বাল্মীকির তপোবনে করিল প্রবেশ।।
কটক সমেত পড়ি আছে শত্রুঘন।
সেইখানে গেলেন শ্রীভরত লক্ষ্মণ।।
শৃগাল কুক্কুর আর শকুনি গৃধিনী।
কটকের মাংস নিয়া করে টানাটানি।।
ভরত লক্ষ্মণ দোঁহে করে অনুমান।
মহাযুদ্ধে আসিয়া হৈলাম অধিষ্ঠান।।
রণস্থলে দেখিলেন ভরত লক্ষ্মণ।
হাতে ধনু পড়িয়া আছেন শত্রুঘন।।
সৌমিত্রিরে দুই ভাই কোলে করি কাঁদে।
প্রাণ হারাইলে ভাই শিশুর বিরোধে।।
যমুনার কূলে ভাই মারিলে লবণ।
এখানে আসিয়া ভাই হারালে জীবন।।
রণস্থলে কান্দিছেন ভরত লক্ষ্মণ।
পাত্র মিত্র দেন দোঁহে প্রবোধ বচন।।
শোক করিবার বেলা নহে ত এখন।
সমরে আসিয়া শোক কর কি কারণ।।
সেই দুই শিশু মার পূরিয়া সন্ধান।
যুদ্ধস্থলে আসি শোক নহে ত বিধান।।
এতেক বচন শুনি ভরত লক্ষ্মণ।
ক্রন্দন সম্বরে দোঁহে স্থির করি মন।।
যুদ্ধার্থে কটক রহে পূরিয়া সন্ধান।
ভরত লক্ষ্মণ দোঁহে হৈল আগুয়ান।।
চারিদিকে রামসেনা রহে সাবধানে।
কটকের মহারোল সীতাদেবী শুনে।।
সীতা বলিলেন লব কুশ রে কেমন।
কি প্রমাদ পাড়িয়াছ ভাই দুই জন।।
কার সনে করিয়াছে বাদ বিসম্বাদ।
লব কুশ না জানি কি পাড়িলি প্রমাদ।।
শুনিয়া মায়ের কথা দুই ভাই হাসে।
মায়েরে প্রবোধ করে অশেষ বিশেষে।।
লব কুশ বলে মাতা না জান কারণ।
মৃগয়া করিতে রাজা আসে তপোবন।।
যত যত রাজা আছে চন্দ্র-সূর্য্যকুলে।
মৃগয়া করিতে সবে আসে এই স্থলে।।
অবশ্য রাজার সহ আইসে সামন্ত।
রাজার সৈন্যের রোলে তুমি কেন চিন্ত।।
আমা ‍দুই ভাই মুনি থুয়ে গেল দেশে।
কোন্ রাজা আসিয়াছে না জানি বিশেষে।।
মুনির আজ্ঞায় মোরা রাখি তপোবন।
নাহি জানি আসিয়াছ কোন্ মহাজন।।
আশ্রম হইলে নষ্ট মুনি দিবে দোষ।
বড় ভয় করি মা করিলে মুনি রোষ।।
প্রবোধিয়া মায়েরে তখন বাকছলে।
শীঘ্রগতি দুই ভাই যুঝিবারে চলে।।
তূণপূর্ণ বাণ নিল ধনু নিল হাতে।
মহাহ্লাদে দুই ভাই যায় সমরেতে।।
দুই ভাই গেল যথা ভরত লক্ষ্মণ।
তৃণজ্ঞান করে সব দেখি সেনাগণ।।
লব কুশে দেখি সেনা কম্পিত অন্তর।
গরুড়ে দেখিয়া যেন ভুজঙ্গের ডর।।
মনোহর দুই ভাই দূর্ব্বাদলশ্যাম।
সকল কটক বলে আইল দুই রাম।।
রাম যদি আসিতেন এখানে এখন।
তিন রাম এক স্থানে হইত মিলন।।
সেই তেজ সেই বল সেই ধনুর্ব্বাণ।
আকৃতি প্রকৃতি দেখি রামের সমান।।
এক রামে জিনিতে না পারে ত্রিভুবন।
দুই রাম ইহারা জিনিবে কোন্ জন।।
ভরত লক্ষ্মণ দোঁহে হইল বিস্ময়।
কে তোমরা দুই ভাই দেহ পরিচয়।।
হাসিয়া উত্তর করে দুই সহোদর।
জাতি কুলে মোদের তোমার কি বিচার।।
বারশত শিষ্য পড়ে বাল্মীকির ঠাঁই।
তাঁর শিষ্য আমরা যমজ দুই ভাই।।
সব শিষ্যে লয়ে মুনি গেল পরবাসে।
আমা ‍দুই ভাইকে রাখিয়া গেল দেশে।।
দশরথ ভূপতির পুত্র শত্রুঘন।
দেখ সৈন্যসহ তার সমরে পতন।।
দুই ভাই যুঝিলে পৃথিবী নাহি আঁটে।
কোন্ কার্য্যে আসিয়াছ মোদের নিকটে।।
কটক লইয়া কেন এলে তপোবন।
পরিচয় দেহ এলে কিসের কারণ।।
তাহা শুনি শ্রীভরত লক্ষ্মণের হাস।
মুখেতে তর্জ্জন মাত্র অন্তরে তরাস।।
চারি ভাই আমরা সবার জ্যেষ্ঠ রাম।
তিনের কনিষ্ঠ ভাই শত্রুঘন নাম।।
মধ্যম আমরা দুভাই ভরত লক্ষ্মণ।
শত্রুঘনে মারিয়া কি রাখিবে জীবন।।
এত যদি চারিজনে হৈল গালাগালি।
চারিজনে যুদ্ধ বাজে চারি মহাবলী।।
কুশ আর ভরতে বাজিল মহারণ।
মহাযুদ্ধ করে লব সহিত লক্ষ্মণ।।
ভরত লক্ষ্মণ-সৈন্য চারি অক্ষৌহিনী।
ভরত ডাকিয়া সৈন্যে বলেন আপনি।।
শিশুজ্ঞানে তোমরা না হও অন্যমন।
দুই ভাগ হয়ে যুদ্ধ কর সেনাগন।।
দুই অক্ষৌহিণী যুঝে ভরতের কাছে।
আর দুই অক্ষৌহিণী লক্ষ্মণের পিছে।।
মধ্যে দুই শিশু যে কটক চারিভিতে।
হ্স্তীস্কন্ধে ভরত লক্ষ্মণ মহারথে।।
লবের বাণের শিক্ষা বড় চমৎকার।
ধূম্রবাণ এড়ে দশ দিক্ অন্ধকার।।
জগৎ হইল সব অন্ধকারময়।
পলায় সকল ঠাট গণিয়া সংশয়।।
তিমির হইল হেন চক্ষে নাহি দেখে।
পর্ব্বত গুহার মধ্যে কেহ গিয়া ঢোকে।।
পলাইয়া যাইতে কাহার পা পিছলে।
ঝম্প দিয়া পড়ে কেহ নদ নদী জলে।।
কেহ কারে নাহি দেখে কেবা কোথা যায়।
লক্ষ্মণে এড়িয়া যত কটক পলায়।।
পলাইল সব ঠাট নাহিক দোসর।
সবেমাত্র লক্ষ্মণ রহেন একেশ্বর।।
এমন বাণের শিক্ষা নাহি কোন স্থানে।
কেবা শিখাইল, কোথা হইতে বা জানে।।
রাবণের কুমার সে বীর ইন্দ্রজিৎ।
ত্রিভুবন যার বাণে হইত কম্পিত।।
তাহারে মারিতে আমি না করিনু ভয়।
হইল শিশুর যুদ্ধে জীবন সংশয়।।
যে হউক সে হউক আজি রণ করি।
না করি প্রাণের ভয় মারি কিংবা মরি।।
সাহসে করিয়া ভর যুঝেন লক্ষ্মণ।
ধনুকে ব্রহ্মাগ্নি-বাণ যুড়েন তৎক্ষণ।।
জ্বলিয়া ব্রহ্মাগ্নি-বাণ উঠিল আকাশে।
অন্ধকার দূর হৈল পৃথিবী প্রকাশে।।
অন্ধকার দূর হৈল ঠাট দূরে দেখে।
সকল কটক এলো লক্ষ্মণ-সম্মুখে।।
লক্ষ্মণের বাণ-শিক্ষা বড় চমৎকার।
পলায়িত যত সৈন্য এল আরবার।।
লক্ষ্মণের বাণ দেখি লব পায় ত্রাস।
তার ত্রাস দেখিয়া লক্ষ্মণ পান আশ।।
লব বলে লক্ষ্মণ কি কর অহঙ্কার।
মোর ঠাঁই পড়িলে নিস্তার নাহি আর।।
আছয়ে অক্ষয় বাণ তূণের ভিতর।
ওর নাহি এড়ি বাণ শতেক বৎসর।।
তোমার কটক আছে এই সে ভরসা।
জল হেন শুষিব যে না রাখিব আশা।।
সংহারিব সকলেরে তোমা বিদ্যমানে।
অবশেষে তোমারে যে মারিব পরাণে।।
এতেক বলিয়া লব যোড়ে ধনুর্ব্বাণ।
সকল সামন্ত কাটি করে খান খান।।
ষট্চক্র-বাণ লব যুড়িল ধনুকে।
সিংহের গর্জ্জনে বাণ উঠে অন্তরীক্ষে।।
মহাশব্দে যায় বাণ তারা যেন ছুটে।
এক বাণে লক্ষ্মণের সব সৈন্য কাটে।।
ষটচক্র-বাণেতে এড়ায় যেই সব।
সে সকল সৈন্যে নাহি মারিলেন লব।।
রক্তময় হইল সকল যুদ্ধস্থল।
ভাদ্রমাসে গঙ্গা যেন করে টলমল।।
ডাকিয়া বলেন লব শুন হে লক্ষ্মণ।
কোথা গেল সৈন্য তব নাহি একজন।।
মারিলে যে ইন্দ্রজিৎ রাবণ-কুমারে।
তোমারে মারিয়া যশ রাখিব সংসারে।।
তোমারে মারিলে পরে মোর যশ রবে।
বলিয়া লক্ষ্মণজিৎ সর্ব্বলোকে কবে।।
লক্ষ্মণ বলেন লব একি অহঙ্কার।
মোর সনে যুদ্ধে তব নাহিক নিস্তার।।
কুপিয়া লক্ষ্মণ বীর এড়ে ব্রহ্মজাল।
সংসার করিল আলো অগ্নির উথাল।।
লব বীর বিষণ্ণ ভাবিছে মনে মন।
ধনুকে বরুণ-বাণ যুড়িল তখন।।
সন্ধান পূরিয়া লব সে বাণ এড়িল।
সমুদ্র-তরঙ্গ যেন গগনে লাগিল।।
ব্রহ্মজাল ব্যর্থ গেল চিন্তিত লক্ষ্মণ।
কি হবে আমার বুঝি সংশয় জীবন।।
লক্ষ্মণের যত শিক্ষা যত অস্ত্র জানে।
সন্ধান পূরিয়া বাণ এড়ে ততক্ষণে।।
সকল পৃথিবী হৈল বাণে অন্ধকার।
লক্ষ্মণের বাণ দেখি লাগে চমৎকার।।
চিন্তিত হইয়া লব তাবে মনে মন।
অক্ষয় অজিত বাণ যুড়িল তখন।।
সন্ধান পূরিয়া এড়ে তারা যেন ছুটে।
সেই বাণে লক্ষ্মণের মহাবাণ কাটে।।
এই বাণ ব্যর্থ গেল চিন্তিত লক্ষ্মণ।
মনে ভাবে শিশু নহে সাক্ষাৎ যে যম।।
অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ বাণ লক্ষ্মণ যে এড়ে।
কত দূরে গিয়া বাণ উখড়িয়া পড়ে।।
দেখিয়াত লক্ষ্মণের লাগে চমৎকার।
ফুরাইল সব বাণ তূণে নাহি আর।।
ফুরাইল সব অস্ত্র শূন্য হৈল তূণ।
দেখিয়া উদ্বিগ্ন বড় হইল লক্ষ্মণ।।
বলেন লক্ষ্মণ পরে লব বিদ্যমান।
এত দূরে মোর যুদ্ধ হৈল অবসান।।
সর্ব্বশাস্ত্র জান ‍তুমি বিচারে পণ্ডিত।
বুঝিয়া করহ কার্য্য যে হয় উচিত।।
শুনিয়া তাহার কথা লব বীর ভাষে।
অবশ্য মারিব তোমা না যাইবে দেশে।।
এক বাণ এড়ি আমি না ভাবিও মন্দ।
যা হোক তা হোক তব যে থাকে নির্ব্বন্ধ।।
এই বাণে যদি তুমি পাও পরিত্রাণ।
লক্ষ্মণ তোমার তবে না লইব প্রাণ।।
এ প্রতিজ্ঞা করিলাম শুনহ বচন।
এই বাণ ব্যর্থ গেলে না করিব রণ।।
পাশুপত-বাণ সে লবের মনে পড়ে।
তূণ হইতে বাণ নিয়া ধনুকেতে যোড়ে।।
বাসুকি তক্ষক যেন বাণের গর্জ্জন।
পাশুপাত বাণে বিন্ধি পড়িল লক্ষ্মণ।।
লক্ষ্মণে জিনিয়া যায় কুশের উদ্দেশে।
হেথা যুদ্ধ বাধিল ভরত আর কুশে।।
কুশের সহিত লব নাহি করে দেখা।
লুকাইয়া দেখে সে কুশের অস্ত্র-শিক্ষা।।
শত্রুঘ্ন মারিয়া কুশের বাড়িয়াছে আশ।
ভরতের সনে যুঝে নাহি করে ত্রাস।।
একা ভাই যদ্যপি জিনিতে নারে রণ।
নির্ম্মূল করিব যে না রহে এক জন।।
এতেক ভাবিয়া লব লুকাইয়া থাকে।।
ভরতের সহিত কুশের যুদ্ধ দেখে।।
ভরতের সঙ্গে ঠাট কটক বিস্তর।
চারিভিতে যুদ্ধ করে কুশ একেশ্বর।।
বেড়াপাক নামেতে কুশের এক বাণ।
সেই বাণে কুশ বীর পূরিল সন্ধান।।
বেড়াপাক-বাণ সে প্রবেশে পাকে পাক।
হাত পা কাটিছে কার কারো কাটে নাক।।
এক ঠাঁই মুণ্ড পড়ে, স্কন্ধ আর ঠাঁই।
ভরতের ঠাট পড়ে লেখাজোখা নাই।।
এক বাণে অরি-সৈন্য করিল সংহার।
পর্ব্বত-প্রমাণ ঠাট পড়িল অপার।।
রক্ত-নদী বহিল যে সংগ্রামের স্থানে।
এত সৈন্য পড়ে এড়াইল সাত জনে।।
উচ্চৈঃস্বর করি তারা ভরতেরে ডাকে।
পলাইয়া যায় কেহ ফিরে ফিরে দেখে।।
ভাবে তারা পরিত্রাণ পাইবে কেমনে।
ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম নহে ভঙ্গ দিতে রণে।।
ভরত বলেন কুশ ক্ষান্ত কর রণ।
দেশে পলাইয়া যায় এই অষ্ট জন।।
কুশ বলে ভরত না বল এ বচন।
কেমনে যাইবে দেশে এই অষ্ট জন।।
সাত জন যাক্ দেশে রামের গোচর।
বার্ত্তা পেয়ে রাম যেন আসেন সত্বর।।
শুনহ ভরত বীর আমার উত্তর।
ক্ষত্রিয় হইয়া কেন হইলে কাতর।।
মনে ভাব পলাইলে পবে অব্যাহতি।
যত কাল জীবে তব থাকিবে অখ্যাতি।।
পলাইয়া গেলে যে থাকিবে অপযশ।
যুঝিয়া মরিলে থাকে অনন্ত পৌরুষ।।
ভরত বলেন, কুশ ইহা মিথ্যা নয়।
শ্রীরামের রূপ দেখি তেঁই বাসি ভয়।।
শ্রীরামের তেজ বল তাঁরি ধনুর্ব্বাণ।
হারিলে তোমার ঠাঁই নাহি অপমান।।
কুশ বলে, রাম বলি কত গর্ব্ব কর।
রাম কি করিবেন যদ্যপি আজি মর।।
আজি তুমি পড়িবে যে আমার সংগ্রামে।
অতঃপর আসিয়া কি করিবেন রামে।।
আমার সমরে যদি জয়ী হন রাম।
তবে ব্যর্থ ধরি মোরা লব কুশ নাম।।
তোমারে ছাড়িয়া দিলে লব পাছে হাসে।
বলিবেন ভরতে কি না মারিলে ত্রাসে।।
কোন্ কালে ভাই মোর মারিল লক্ষ্মণ।
তোমারে মারিতে যে বিলম্ব এতক্ষণ।।
এক বাণ বিনা না এড়িব আর বাণ।
এক বাণে ভরত লইব তব প্রাণ।।
ভরত বলেন তব বুদ্ধি ভাল নয়।
শ্রীরামের রূপ দেখি তেঁই বাসি ভয়।।
কুশ বলে রাম হেন কোটি যদি আসে।
বাহুড়িয়া এক জন নাহি যাবে দেশে।।
ভরত বলেন কুশ দিলে গালাগালি।
শ্রীরামের নিন্দা কর সহিতে না পারি।।
শিশু হয়ে কুশ তব এতেক বড়াই।
আছুক রামের কার্য্য জিন মোর ঠাঁই।।
লব লব বলিয়া যে কর অহঙ্কার।
লক্ষ্মণের সমরে তাহার বাঁচা ভার।।
লক্ষ্মণের বাণে কারো নাহিক নিস্তার।
অবশ্য লক্ষ্মণ প্রাণ লয়েছে তাহার।।
লক্ষ্মণের বাণে লব যদ্যপি বাঁচিত।
আসিয়া তোমারে সে অবশ্য দেখা দিত।।
ভারতের কথা শুনি কুশ-বীর কয়।
কোন্ কালে লক্ষ্মণের হইয়াছে ক্ষয়।।
লক্ষ্মণ লবের বাণে পাইলে নিস্তার।
ভরত না হবে তবে তোমার সংহার।।
এত যদি দুই জনে হৈল গালাগালি।
দুই জনে যুদ্ধ বাজে দোঁহে মহাবলী।।
তিরাশী কোটি বাণ এড়িল ভরত।
দশদিক্ জল স্থল ঢাকিত পর্ব্বত।।
ভরতের বাণেতে হইল অন্ধকার।
দেখিয়া কুশের মনে লাগে চমৎকার।।
কুশ-বীর বাণ এড়ে ভরত-সম্মুখে।
ভরতের যত বাণ কাটে একে একে।।
সব বাণ ব্যর্থ গেল ভরত চিন্তিত।
ভরত গন্ধর্ব্ব-অস্ত্র এড়িল ত্বরিত।।
তিন কোটি গন্ধর্ব্ব জন্মিল এক বাণে।
কুশ সহ যুদ্ধ করে অতি সাবধানে।।
গন্ধর্ব্বের বিক্রমে কুশের লাগে ডর।
এড়িল অজয়জিৎ বাণ যে সত্বর।।
গন্ধর্ব্ব কুশের বাণে হইল সংহার।
দেখি ভরতের মনে লাগে চমৎকার।।
কুশ বলে ভরত আর কত বাণ এড়।
এই আমি বাণ এড়ি যম-ঘরে নড়।।
যুড়িল ঐষিক-বাণ কুশ যে ধনুকে।
সিংহের গর্জ্জনে সে উঠিল অন্তরীক্ষে।।
মহাশব্দ করি বাণ উঠিল আকাশে।
দেখিয়া ভরত ব্যস্ত হইলেন ত্রাসে।।
ভরত কাতর হয়ে ঊর্দ্ধ পানে চায়।
অতিবেগে পড়ে বাণ ভরতের গায়।।
ফুটিয়া ঐষিক-বাণ পড়িল ভরত।
পৃথিবীতে ধারা বহে রক্তস্রোত শত।।
ভরত কটক সহ পড়িলেন রণে।
ধেয়ে গেল লব সে কুশের বিদ্যমানে।।
রক্তে রাঙ্গা দুই ভাই করে কোলাকুলি।
জলে গিয়া শোণিতাঙ্গ ফেলিল পাখালি।।
সংগ্রামের বেশ থুয়ে বৃক্ষের কোটরে।
শূন্য হস্তে গেল দোঁহে মায়ের গোচরে।।
জানকী বলেন রে বিলম্ব কি কারণ।
কোন্ কার্য্যে লব কুশ ছিলে এতক্ষণ।।
লব কুশ বলে মাতা না জান বিশেষ।
মৃগয়া করিয়া রাজা গেল নিজ দেশ।।
এতেক প্রমাদ সীতা কিছু নাহি জানে।
মিথ্যা কহি মায়েরে প্রতারে দুই জনে।।
কোন চিন্তা নাহি মাগো তোমার প্রসাদে।
তপোবন রাখি মোরা মুনি-আশীর্ব্বাদে।।
মিষ্ট অন্ন পান দোঁহে করিল ভোজন।
সুগন্ধি চন্দন মাল্য পরিল তখন।।
পরম হরিষে ঘরে রহে দুই ভাই।
সাতজন পলাইয়া গেল রামঠাঁই।।