৬৪. লব-কুশের সহিত শত্রুঘ্নের যুদ্ধ ও পতন

লব-কুশের সহিত শত্রুঘ্নের যুদ্ধ ও পতন

শ্রীরাম বলেন ঘোড়া আন শত্রুঘন।
যজ্ঞ সাঙ্গ হৈল পূর্ণা দিব ত এখন।।
সৌমিত্রির আগে দূত কহে বারে বার।
মহারাজ ঘোড়া বন্দী হইল তোমার।।
শুনিয়া সৌমিত্রি বীর করেন বিষাদ।
বিধির নির্ব্বন্ধ কিবা পড়িল প্রমাদ।।
বিষম দক্ষিণ দিক বড়ই সঙ্কট।
কোন্ বীর যাবে আজি তাহার নিকট।।
অনেক শক্তিতে আমি মারিনু লবণ।
না জানি কাহার সনে পুনঃ হয় রণ।।
এতেক চিন্তিয়া তবে বীর শত্রুঘন।
অশ্বের উদ্দেশ হেতু করিল গমন।।
ঘোড়া লয়ে দুই ভাই খেলে বারে বার।
লব কুশে দেখিয়া তাহার চমৎকার।।
লব কুশ খেলা করে দেখি শত্রুঘন।
জিজ্ঞাসা করিল ঘোড়া বান্ধে কোন্ জন।।
কোন্ বেটা করিয়াছে মরিবার সাধ।
সবংশে মরিতে শ্রীরামের সঙ্গে বাদ।।
শত্রুঘ্নের কথা শুনি দুই ভাই ভাষে।
কি নাম ধরহ তুমি, থাক কোন্ দেশে।।
শত্রুঘ্ন বলেন মোর জন্ম সূর্য্যবংশে।
চারি ভাই থাকি মোরা অযোধ্যা-প্রদেশে।।
দাশরথি আমরা যে ভাই চারি জন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ শ্রীভরত শত্রুঘন।।
স্বয়ং বিষ্ণু রঘুনাথ ত্রিলোক-বিজয়ী।
রামের বিক্রম-কথা শুন তাহা কহি।।
রামের বাণেতে মরে লঙ্কার রাবণ।
মরিল আমার বাণে দুর্জ্জয় লবণ।।
জ্যেষ্ঠ ভাই আমার যে রণেতে পণ্ডিত।
তাঁর বাণে মরে অতিকায় ইন্দ্রজিৎ।।
যে সব মরিল বীর ত্রিভুবন জিনে।
আর কোন্ বীর ঝুঝে মোসবার সনে।।
এতেক বড়াই করে বীর শত্রুঘন।
রুষিয়া সে লব কুশ করিছে তর্জ্জন।।
চারি ভাই তোমরা , আমরা দুই ভাই।
আজি ঘোড়া লয়ে যাও মোরা তাই চাই।।
মরিবারে কেন এলে মোদের নিকটে।
কেমনে লইবে ঘোড়া পড়িলে সঙ্কটে।।
খুড়া ভাইপোতে গালি কেহ নাহি চিনে।
গালাগালি মহাযুদ্ধ বাজে তিন জনে।।
নানা অস্ত্র দুই ভাই ফেলে চারিভিতে।
শত্রুঘ্ন কাতর অতি না পারে সহিতে।।
শত্রুঘ্ন বলেন সৈন্য কোন্ কর্ম্ম কর।
সকল কটকে বেড়ি দুই শিশু মার।।
দুই অক্ষৌহিণী ছিল শত্রুঘ্নের ঠাট।
লব কুশে বেড়িয়া করিল বন্ধ বাট।।
লব কুশ বলে বীর না হও বিমুখ।
সকল কটকে মারি দেখহ কৌতুক।।
শত্রুঘ্ন বলেন দেখি তোমরা বালক।
বালকের সঙ্গে যুদ্ধ হাসিবেক লোক।।
কটক থাকিতে কেন যুঝিব আপনি।
আমার সহিত ঠাট দুই অক্ষৌহিণী।।
কটকের ঠাঁই যদি জয়ী হও রণে।
তবে যে যুদ্ধের যোগ্য হও মম সনে।।
শত্রুঘ্নের কথা শুনি দুই ভাই ভাষে।
আগে মারি কটক, তোমারে মারি শেষে।।
কুশ বলে লব তুমি এইখানে থাক।
কটক সংহারি আমি তুমি মাত্র দেখ।।
লবের আগেতে কুশ পাতিল ধনুক।
ভ্রাতার সমর লব দেখিছে কৌতুক।।
কুশের প্রধান বাণ বেড়াপাক নাম।
বেড়াপাক-বাণ কুশ পূরিল সন্ধান।।
পৃথিবীতে ফিরে বাণ কুমারের চাক।
সকল কটকে বেড়ি মারে বেড়াপাক।।
বেড়াপাক-বাণে কারো নাহিক নিস্তার।
বেড়াপাক-বাণে সব করিল সংহার।।
পড়িল সকল ঠাট নাহি একজন।
সবে মাত্র একাকী রহিল শত্রুঘন।।
ঠাঁই ঠাঁই কটক পড়িল গাদি গাদি।
সংগ্রামের স্থানে বহে শোণিতের নদী।।
ডাক দিয়া বলে কুশ শুন শত্রুঘন।
কোথা গেল সৈন্য তব নাহি একজন।।
লবের কনিষ্ঠ আমি রণ নাহি টুটে।
লব ভাই যুঝিলে পৃথিবী নাহি আঁটে।।
কুশের বচন শুনি বলেন শত্রুঘ্ন।
পলাইয়া যাব কি তোমারে দিব রণ।।
পলাইয়া গেলে পরে থাকিবে অখ্যাতি।
যদি যুদ্ধ করি তবে নাহি অব্যাহতি।।
কুশ বলে শত্রুঘন যুক্তি কর দৃঢ়।
যেই ইচ্ছা হয় তব সেই যুক্তি কর।।
শত্রুঘ্ন বলেন কুশ কিছু মিথ্যা নয়।
যত কিছু বল তুমি সব সত্য হয়।।
তোমার সহিত যুদ্ধে অবশ্য সংহার।
বুঝিতে না পারি তুমি কোন অবতার।।
তোমার সংগ্রামে কুশ কার বাপে তরি।
একবার যুদ্ধ করি মারি কিংবা মরি।।
কুশ বলে শত্রুঘ্ন মরণ দৃঢ় কর।
এই আমি বাণ এড়ি যাও যমঘর।।
লব বলে কুশ শুন আমার বচন।
তুমি সৈন্য মারিলে, আমি মারি শত্রুঘ্ন।।
কুশ বাণ এড়িল লবেরে করি পাছে।
সন্ধান পূরিয়া গেল সৌমিত্রির কাছে।।
কুশ বলে সৌমিত্রি হে এই বাণ ফেলি।
এ বাণ সহিতে পার তবে বীর বলি।।
সৌমিত্রি বলেন আগে আমি বাণ মারি।
সহিতে পারিলে তোমা বীর জ্ঞান করি।।
তিন লক্ষ বাণ বীর শত্রুঘন এড়ে।
আকাশ গমণে বাণ উখড়িয়া পড়ে।।
বাণবৃষ্টি করে দোঁহে, দোঁহে ধনুর্দ্ধর।
দোঁহে দোঁহে বিন্ধিয়া করিল জর জর।।
উভয়ের বাণ গিয়া গগনেতে উঠে।
উভয়ের বরিষে বাণ উভয়েতে কাটে।।
নানা অস্ত্র দুই জন করে অবতার।
চারিদিকে পড়ে বাণ অগ্নির সঞ্চার।।
সৌমিত্রি এড়েন তবে মহাপাশ-বাণ।
অর্দ্ধচন্দ্র-বাণে কুশ করে খান খান।।
এড়িল সকল বাণ সৌমিত্রি নিপুণ।
ফুরাইল সব বাণ শূন্য হৈল তূণ।।
বিষ্ণু-অস্ত্র শত্রুঘ্ন বীরের মনে পড়ে।
তূণ হৈতে তাহা নিয়া ধনুকেতে যোড়ে।।
নিরখিয়া কুশ বীর চিন্তে মনে মন।
মহাবিষ্ণু-বাণ যোড়ে ধনুকে তখন।।
বাণ দেখি শত্রুঘ্নের লাগে চমৎকার।
মহাবিষ্ণু-বাণে বিষ্ণু-বাণের সংহার।।
কুশ বলে শত্রুঘন আর বাণ আছে।
ফুরাল তোমার অস্ত্র আমি এড়ি পিছে।।
কুশেরে ডাকিয়া বলে বীর শত্রুঘন।
তোমায় আমায় এই হইল যে রণ।।
কারো পরাজয় নহে উভয়ে সোসর।
রণে ক্ষমা দিয়া যাই দুই জনে ঘর।।
সৌমিত্রির কথা শুনি কুশ বীর হাসে।
অবশ্য মারিব তোমা না যাইবে দেশে।।
মহাপাশ-বাণ কুশ যুড়িল ধনুকে।
সিংহের গর্জ্জনে বাণ উঠে অন্তরীক্ষে।।
সকল পৃথিবী হৈল অন্ধকারময়।
নিরখিয়া শত্রুঘ্নের লাগিল সংশয়।।
অন্ধকারে যুঝিতে না পারে শত্রুঘন।
যুঝিতে না পারে হয় মৃত্যু-দরশন।।
এক দুষ্টে রহিল সে ধনুর্ব্বাণ হাতে।
শত্রুঘ্নের মারিতে বাণ চলিল ত্বরিতে।।
মহাপাশ-বাণ তবে যায় নানা ছন্দে।
হাতে গলে শত্রুঘনে অবশেষে বান্ধে।।
গলায় লাগিল পাশ মৃত্যু-দরশন।
মহাপাশ-বাণাঘাতে পড়ে শত্রুঘন।।
শত্রুঘ্ন পড়িয়া রহে রণের ভিতর।
মহানন্দে দুই ভাই চলিলেক ঘর।।
কহিতে লাগিল গিয়া মায়ের গোচর।
দুই ভাই খেলিলাম এ দুই প্রহর।।
যত যত ভূপতি আইসে তপোবনে।
কৌতুকে খেলাই মাতা তা সবার সনে।।
দুই শিশু লয়ে সীতা করাইল স্নান।
অগুরু চন্দনে অঙ্গ করাল সুঘ্রাণ।।
মিষ্ট অন্ন করাইল দোঁহারে ভোজন।
বিচিত্র পালঙ্কে দোঁহে করাল শয়ন।।
দুই শিশু লয়ে সীতা রহিল সন্তোষে।
শত্রুঘ্নের বার্ত্তা লয়ে দূত গেল দেশে।।
এত সৈন্য মাঝে এড়াইল সাত জন।
দেশেতে গমন করে করিয়া ক্রন্দন।।