৬০. ইলা রাজার প্রতি মহেশের অভিশাপ

ইলা রাজার প্রতি মহেশের অভিশাপ

প্রজাপতি নৃপতির পুত্র গুণধর।
ইলা নাম ধরে সেই রাজ্যের ঈশ্বর।।
সর্ব্বগুণ ধরিয়া সে প্রজাগণে পালে।
সর্ব্বলোকে পূজে তাঁরে পৃথিবী-মণ্ডলে।।
সুদিন প্রবেশে যবে আইল মধুমাস।
মৃগ মারিবারে গেল পর্ব্বত কৈলাস।।
কৈলাসের প্রান্তভাগে বন মনোহর।
পার্ব্বতী লইয়া কেলি করেন শঙ্কর।।
পার্ব্বতী সহজে নারী শিব হয়ে নারী।
মনের আনন্দে দোঁহে জলকেলি করি।।
মহেশের শাপ তথা আছয়ে এমনি।
জলজন্তু বনজন্তু হয়েছে রমণী।।
পুরুষ মাত্রেতে কেহ নাহি সেই বনে।
পার্ব্বতী শঙ্কর কেলি করেন দুজনে।।
জলকেলি দুজনে করেন কুতূহলে।
ইলা রাজা সেই বনে গেল হেনকালে।।
ইলা রাজা উপনীত তাঁহার সমীপে।
গতমাত্রে স্ত্রী হইল শঙ্করের শাপে।।
যত অনুচর ছিল রাজার সংহতি।
সৈন্য সেনাপতি সবে হইল স্ত্রীজাতি।।
দেখিয়া রমণীজাতি যত অনুচরে।
লজ্জা পেয়ে ইলা রাজা আপনা পাসরে।।
সর্ব্বাঙ্গ বসনে ঢাকে হইয়া স্ত্রীজাতি।
শঙ্করের চরণেতে কৈল বহু স্তুতি।।
উঠ উঠ বলিয়া ডাকেন মহেশ্বর।
পুরুষ করিতে নারি চাহ অন্য বর।।
স্ত্রীজাতি হইয়া আমি করি জলকেলি।
মোরে লজ্জা দিতে কেন এখানে আইলি।।
তোর সঙ্গে আসিয়াছে যত অনুচর।
পুরুষ হইয়া সবে যাক নিজ ঘর।।
পুরুষ হইয়া সবে চলে গেলে দেশে।
তুমি থাক নারী হয়ে আপনার দোষে।।
শুনি রাজা মহেশের নিষ্ঠুর বচন।
পার্ব্বতীর পায়ে পড়ি করিল রোদন।।
পার্ব্বতী বলেন মম বাক্য নহে আন।
মাসেক পুরুষ হবে, করিব বিধান।।
মাসেক পুরুষ হবে না হবে অন্যথা।
মন দিয়া শুন তবে বলি এক কথা।।
যে মাসে পুরুষ হবে রবে সেইখানে।
নারী হলে সে কথা বিস্মৃত হবে মনে।।
যে যে মাসে পুরুষ হইবে নরপতি।
রমণী মাসেতে তাহা হইবে বিস্মৃতি।।
পুরুষ হইয়া রাজা গেল নিজ দেশে।
নারী হয়ে আরবার বনেতে প্রবেশে।।
পুরুষ হইল রাজা সহ অনুচর।
রমণী হইয়া রাজা ভ্রমে একেশ্বর।।
এতেক শুনিয়া যত সভাজন হাসে।
নারী হয়ে কেমনে বঞ্চিল এক মাসে।।
পুরুষ হইয়া পুনঃ কিরূপেতে বঞ্চে।
এমন দারুণ শাপ কত দিনে ঘুচে।।
রাম বলেন রাজা নারী হৈল যেই মাসে।
লজ্জিত হইয়া গিয়া কাননে প্রবেশে।।
বনের ভিতরে আছে ব্রহ্ম-জলাশয়।
বুধ তথা তপ করে চন্দ্রের তনয়।।
কনের কঠোর তপ বুধ মহাশয়।
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন হয়েছে উদয়।।
রমণী দেখিয়া বাড়ে পুরুষের রঙ্গ।
বুধ হেন তপস্বীর হৈল তপোভঙ্গ।।
ইলারে সম্ভাষে বুধ, কামে অচেতন।
কার কন্যা একাকিনী করিছ ভ্রমণ।।
চন্দ্রের কুমার আমি বুধ নাম ধরি।
তোমার রূপেতে প্রাণ ধরিতে না পারি।।
বুধের বচনেতে ইলার হৈল হাস।
বুধের সহিত বনে বঞ্চে এক মাস।।
পুরুষের অষ্টগুণ কামার্থী স্ত্রীলোকে।
বুধের সঙ্গেতে রহে শৃঙ্গার-কৌতুকে।।
কেলি-রসে মাসেক হইল অবশেষ।
হইল পুরুষ-মাস রাজার প্রবেশ।।
না জানে এ সব তত্ত্ব চন্দ্রের কুমারে।
আরবার তপ করে সরোবর তীরে।।
আপনার রাজ্য রাজার হইল স্মরণ।
পুত্র কন্যা জায়া ভাবি করিছে রোদন।।
বনবিন্ধ্য নামে পুত্র আছয়ে আমার।
শিশু হয়ে কেমনে পালিছে রাজ্যভার।।
ভাবিতে ভাবিতে তার গত এক মাস।
নারীরূপ হয়ে গেল চন্দ্র-পুত্র পাশ।।
পরশা সুন্দরী ইলা হয়েছে যুবতী।
রাত্রি দিন কেলি করে বুধের সংহতি।।
দিবা নিশি রঙ্গরসে দোঁহে কেলি করে।
কত দিনে গর্ভ হৈল ইলার উদরে।।
এক মাসে স্ত্রী হয়, পুরুষ আর মাসে।
পুরুষ-মাসেতে নাহি যায় বুধ পাশে।।
ইলা লয়ে বুধ গেল আপন ভবনে।
দেখিয়া ইলার রূপ সুখী মনে মনে।।
হইল পুরুষ-মাস আর মাসে নারী।
ইলা লয়ে গেল বুধ আপনার পুরী।।
রঙ্গরসে ভূপতির একমাস গেল।
পুরুষ-মাসেতে রাজা স্থানান্তর হৈল।।
নয় মাসে এক পুত্র প্রসবিলা ইলা।
পরম সুন্দর পুত্র রূপে শশিকলা।।
পুরুরবা নাম তার হৈল মতাতেজা।
শ্রাদ্ধকালে বিপ্রভাগে করে যাঁ পূজা।।
আরবার পুরুষ হইল দশ মাসে।
এ সকল কথা বুধ না জানে বিশেষে।।
একাদশ মাসেতে আরবার হৈল নারী।
বুধের সহিত বঞ্চে হইয়া সুন্দরী।।
বার মাসে পুরুষ হইল আরবার।
পুরুষ দেখিয়া বুধে লাগে চমৎকার।।
জিজ্ঞাসিতে ইলা রাজা দিলা পরিচয়।
পুরুষ জানিয়া বুধে ঘৃণা বড় হয়।।
পুরুষে রমণী-জ্ঞানে করেছি বিহার।
উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত কি করি ইহার।।
দ্বিজরাজ চন্দ্র, বুধ তাঁহার নন্দন।
আদেশেতে আইল সকল মুনিগণ।।
মুনিগণে লৈয়া বুধ করিলা যুকতি।
কিরূপেতে ইলা রাজা পাইবে নিষ্কৃতি।।
আমি কিসে পরিত্রাণ পাব এই পাপে।
বিবরিয়া মুনিগণ কহ ত স্বরূপে।।
মুনিগণ কহে শুন চন্দ্রের কুমার।
অজ্ঞানে করেছ কর্ম্ম কি পাপ তোমার।।
অশ্বমেধ-যাগে তুষ্ট সকল অমর।
অশ্বমেধ-যাগ কর, ইলা পাবে বর।।
মহাদেব-শাপে ইলার এতেক দুর্গতি।
মহাদেব তুষ্ট হৈলে পাবে অব্যাহতি।।
বুধ বলে যুক্তি বটে, না করি নিষেধ।
বুধের আশ্রমে ইলা করে অশ্বমেধ।।
আপনি আইলা শিব যজ্ঞ দেখিবারে।
ইলা রাজা পুরুষ হইল শিববরে।।
যজ্ঞ সাঙ্গ করি স্তব করেন বিস্তর।
তুষ্ট হয়ে ইলারে মহেশ দিলা বর।।
পুরুষ হইয়া গেল রাজ্যে আপনার।
আনন্দে আপন রাজ্য করে আরবার।।
শঙ্করের বরে তার বাড়িল সম্পদ।
যজ্ঞফলে ভূপতি হইল নিরাপদ।।
শ্রীরামের মুখে শুনি ইলার চরিত্র।
ভরত লক্ষ্মণ দোঁহে হর্ষেতে মোহিত।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের মধুর বচন।
উত্তরকাণ্ডেতে গাহিলেন রামায়ণ।।