৪৮. শ্রীরামের নিকট কুক্কুরের দুঃখ প্রকাশ

শ্রীরামের নিকট কুক্কুরের দুঃখ প্রকাশ

এত শুনি হরষিত লক্ষ্মণ ঠাকুর।
হেনকালে তথা এক আইল কুক্বুর।।
রক্ত-আঁখি কুক্কুরের সর্ব্বাঙ্গ ধবল।
পথশ্রান্তে উপবাসে হয়েছে বিকল।।
তিন পদে চলে তার এক পদ খণ্ড।
দণ্ডের আঘাতে শিরে রক্ত পুঞ্জ পুঞ্জ।।
তিন পদে চলিয়া আইল ধীরে ধীরে।
লক্ষ্মণে প্রণাম করে ভাসে অশ্রুনীরে।।
কুক্কুরে জিজ্ঞাসা করে ঠাকুর লক্ষ্মণ।
কি কারণে কুক্কুর হেথায় আগমন।।
কুক্কুর কহিছে শুন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
কহিব আমার দুঃখ শ্রীরাম-সদন।।
যদি আজ্ঞা দেন রাম ঘৃণা না করিয়া।
কহিব আমার দুঃখ সভামধ্যে গিয়া।।
লক্ষ্মণ গেলেন তবে রামের নিকটে।
কুক্কুরের বৃত্তান্ত কহেন করপুটে।।
দ্বারেতে কুক্কুর এক হৈল আগুসার।
সভাতে আসিতে চাহে কি আজ্ঞা তোমার।।
কুক্কুরে আনিতে রাম কহেন সত্বর।
কুক্কুরে আনিল তবে রামের গোচর।।
রাজ-ব্যবহারে কুক্কুর নোঙায় মাথা।
যোড়হাতে স্তব করে বলে নীতিকথা।।
তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি মহেশ্বর।
কুবের বরুণ তুমি যম পুরন্দর।।
তুমি চন্দ্র তুমি সূর্য্য তুমি দিক্পাল।
তোমার সকল সৃষ্টি তুমি পরকাল।।
তুমি বিষ্ণু-অবতার পতিত পাবনে।
সফল কুক্কুর দেহ তোমা দরশনে।।
রাম বলেন কত স্তুতি কর বারে বারে।
কোন্ কার্য্যে আসিয়াছ কহ তা আমারে।।
কান্দিয়া কুক্কুর বলে, অশ্রুজলে ভাসি।
বিনা অপরাধে মোরে মেরেছে সন্ন্যাসী।।
সন্ন্যাসীর দণ্ডাঘাতে হইয়া কাতর।
তিন উপবাসে আসি তোমার গোচর।।
কোন অপরাধ হেতু মোরে করে দণ্ড।
সন্ন্যাসীরে জিজ্ঞাসা করহ সভাখণ্ড।।
রাম বলে সভাখণ্ড শুনিলে উত্তর।
সন্ন্যাসীরে শীঘ্র আন আমার গোচর।।
ভালমন্দ বিচার করহ সর্ব্বজনে।
সন্ন্যাসী হইয়া জীব-হিংসে কি কারণে।।
রামের আজ্ঞাতে দূত চলিল সত্বরে।
কুক্কুর আসিয়া দেখাইল সন্ন্যাসীরে।।
হাতে কমণ্ডলু, স্কন্ধে মৃগছাল তার।
সন্ন্যাসীরে দেখে দূত করে নমস্কার।।
সন্ন্যাসীরে লয়ে গেল যথায় লক্ষ্মণ।
লক্ষ্মণ আনিয়া দিল রামের সদন।।
সন্ন্যাসীরে রঘুনাথ করেন জিজ্ঞাসা।
স্বধর্ম্ম ছাড়িয়া কেন কর জীব-হিংসা।।
অধর্ম্ম করিলে হয় নরকে নিবাস।
ক্রোধে অঙ্গ পরিপূর্ণ কিসের সন্ন্যাস।।
পরনিন্দা পরহিংসা পরম পাতক।
হিংস্রক সন্ন্যাসী হলে বিষম নরক।।
লোভ মোহ কাম ক্রোধ যেবা করে ত্যজ্য।
এমন সন্ন্যাসী হয় সংসারেতে পূজ্য।।
সন্ন্যাসী হইয়া ক্রোধ কর অকস্মাৎ।
কি দোষেতে কুক্কুরে করিলে দণ্ডাঘাত।।
যোড়হাতে কহে তবে সন্ন্যাসী-ব্রাহ্মণ।
দোষাদোষ আমার শুনহ নারায়ণ।।
সারাদিন সন্ধ্যা জপ করি গঙ্গাতীরে।
সন্ধ্যাকালে ভিক্ষা আশে যেতাম নগরে।।
ক্ষুধানলে পুড়ে অঙ্গ মেগে ফিরি ভিক্ষে।
পথ যুড়ে শুয়ে আছে কুক্কুর সম্মুখে।।
পথ ছাড় বলে ডাক দিই উচ্চৈঃস্বরে।
কপটে রহিল পথ না ছাড়িল মোরে।।
এক চক্ষে নিদ্রা যায় আর চোখে চায়।
ক্রোধে জ্বলি দণ্ডাঘাত করেছি মাথায়।।
এক কহিলাম আমি সভার ভিতরে।
যে হয় উচিত দণ্ড করহ আমারে।।
রাম বলে সভাখণ্ড করহ বিচার।
কাহারে বা দিব দণ্ড অপরাধ কার।।
যোড়হাত করে তবে সভাখণ্ড কয়।
আমাদের বুদ্ধিসাধ্য এইমত হয়।।
কারো নহে রাজপথ রাজ-অধিকার।
উত্তম অধম পথে চলে ত সংসার।।
যদি শীঘ্র কাজ থাকে যাবে এক পাশে।
সন্ন্যাসী হইল দোষী আপনার দোষে।।
শ্রীরাম বলেন তবে শুন সভাখণ্ড।
ধর্ম্মশাস্ত্রে সন্নাসীর কি করিব দণ্ড।।
যোড়হাতে রঘুনাথে বলে সভাখণ্ড।
গঙ্গাস্নান মানা করা সন্ন্যাসীর দণ্ড।।
কুক্কুর উঠিয়া বলে সভার ভিতরে।
কদাচিৎ দণ্ড নাহি কর সন্ন্যাসীর।।
আমার বচনে কিছু কর পুরস্কার।
কালিঞ্জরে সন্ন্যাসীরে দেহ রাজ্যভার।।
কুক্কুরের কথা শুনে সভাসদ হাসে।
সন্ন্যাসীরে রাজা করে কালিঞ্জর-দেশে।।
রাজ্য পেয়ে সন্ন্যাসী মাতঙ্গ-পৃষ্ঠে চড়ে।
রাজদণ্ডে সন্ন্যাসীর ঐশ্বর্য্য যে বাড়ে।।
আনন্দে সন্ন্যাসী যায় কালিঞ্জর-দেশে।
সন্ন্যাসীর বেশ দেখে সর্ব্বলোকে হাসে।।
পরিধান কৌপীন মস্তকে ছত্রদণ্ড।
রঘুনাথে জিজ্ঞাসা করেন সভাখণ্ড।।
আনিলে সন্ন্যাসী ধরে দণ্ড করিবারে।
কি কারণে রাজ্যপদ দিলে সন্ন্যাসীরে।।
রাম বলে রাজা দিনু কুক্কুর-বচনে।
যে বৃত্তান্ত ইহার কুক্কুর ভাল জানে।।
ইহা শুনি সভাখণ্ড জিজ্ঞাসে কুক্কুরে।
কুক্কুর বিনয় করি কহিছে সত্বরে।।
পূর্ব্বজন্মে কালিঞ্জরে আমি ছিনু রাজা।
নিত্য নিত্য করিতাম সদাশিব পূজা।।
নীলবর্ণ শিবলিঙ্গ তথা অধিষ্ঠান।
রাজা বিনা অন্যজনে পূজিতে না পান।।
বিশেষ প্রকারে পূজা করিয়া শঙ্করে।
প্রসাদ খাইতে হয় প্রত্যহ রাজারে।।
রাজারে শিবের শাপ আছয়ে এমন।
মরিলে কুক্কুরযোনি না হয় খণ্ডন।।
কালিঞ্জর-দেশে শিব বড়ই নিষ্ঠুর।
রাজা ছিনু এবে আমি হয়েছিল কুক্কুর।।
পাইয়া কুক্কুর-দেহ এতেক দুর্গতি।
তোমা দরশনে এবে হইবে নিষ্কৃতি।।
সবে বলে সন্ন্যাসীর বাড়িল বিষয়।
বিষয় এ নহে প্রভু বড়ই সংশয়।।
কালিঞ্জরে যেই জন হয় ত রাজন।
লোকান্তরে কুক্কুর হবে না হয় খণ্ডণ।।
কুক্কুর এতেক বলি রামে নমস্কারে।
বারাণসী চলিল কুক্কুর ধীরে ধীরে।।
প্রাণ ত্যজে কুক্কুর করিয়া উপবাস।
রাম দরশনে লাভ হৈল স্বর্গবাস।।