৪৫. সীতার বনবাস

সীতার বনবাস

পাত্র মিত্র সবাকারে দিলেন মেলানি।
অভিমানে শ্রীরামের চক্ষে পড়ে পানি।।
নিদাঘ-সময় রবি অতি খরতর।
সরোবরে স্নান হেতু যান রঘুবর।।
একেশ্বর যান কেহ নাহিক সহিত।
সরোবর-কূলে গিয়া হৈলা উপনীত।।
পর্ব্বত জিনিয়া সেই সরোবর-পাড়।
চারিধারে শোভিছে বিচিত্র ফুলঝাড়।।
দক্ষিণে রজক বস্ত্র কাচে স্বর্ণপাটে।
স্নান হেতু চলে রাম উত্তরের ঘাটে।।
অঙ্গ ডুবাইয়া রাম শিরে ঢালে পানি।
দ্বন্দ্ব হয় রজকের শুনেন কাহিনী।।
দুই জনে কথা কহে শ্বশুর জামাই।
এই দুই জন বিনা আর কেহ নাই।।
শ্বশুর বলিছে তুমি কুলেতে কুলীন।
সর্ব্বগুণ ধর তুমি ধোপেতে ধুপিণ।।
নিজ গোত্র প্রধান আছিল তব পিতা।
ধনী মানী দেখে তোরে দিলাম দুহিতা।।
কোন্ দোষে করে কন্যা, মার কোন্ ছলে।
আমার বাটীতে একা এলো রাত্রিকালে।।
একেশ্বরী এল কন্যা পাই বড় ভয়।
পিতৃগৃহে যুবা-কন্যা শোভা নাহি পায়।।
জামাতারে এত যদি বলিল শ্বশুর।
বাকছলে জামাতা সে বলিছে প্রচুর।।
যে বাক্য কহিলে তুমি সহিতে না পারি।
থাকুক তোমার গৃহে তোমার ঝিয়ারী।।
দ্বিতীয় প্রহর নিশি কেহ নাই সাথী।
কাহার আশ্রমে কালি বঞ্চিলেক রাতি।।
পৃথিবীর রাজা রাম সম্বরিতে পারে।
রাবণ হরিল সীতা ফিরে আনে ঘরে।।
রাম হেন নহি আমি পৃথিবীর পতি।
জ্ঞাতি বন্ধু খোঁটা দিবে আমি হীনজাতি।।
শ্বশুর ঘরেতে গেল শুনিয়া বচন।
থাকিয়া উত্তর ঘাটে শুনে নারায়ণ।।
ভদ্র যত বলিল রামের মনে লয়।
রাম বলে ভদ্রের বচন মিথ্যা নয়।।
রজকের মুখে শুনি নিষ্ঠুর বচন।
ঘরে চলিলেন রাম বিরস বদন।।
মনেতে ভাবেন রাম অনেক বিষাদ।
সীতা লয়ে পড়ে হেথা আর পরমাদ।।
পঞ্চমাস গর্ভ আছে সীতার উদরে।
জায়ে জায়ে একঠাঁই বসেছেন ঘরে।।
সীতার মাথায় কেহ দিতেছে চিরুণী।
সীতারে জিজ্ঞাসা করে যতেক রমণী।।
সীতারে চাহিয়া বলে যত নারীগণ।
দশ মুণ্ড কুড়ি হস্ত কেমন রাবণ।।
তোমা লয়ে লঙ্কাপুরে করেছে দুর্গতি।
ভূমিতে লিখহ তার মুণ্ডে মারি লাথি।।
সীতা বলে সে ছারে না দেখি কোন কালে।
ছায়ামাত্র দেখিয়াছি সাগরের জলে।।
তথাপি জিজ্ঞাসা করে যত নারীগণ।
জলেতে দেখেছ ছায়া কেমন রাবণ।।
রাবণ লিখিতে সীতার মনে হইল সাধ।
বিধির নির্ব্বন্ধ হেথা পড়িল প্রমাদ।।
হাতে খড়ি ধরে সীতা দৈবের নির্ব্বন্ধ।
দশ মুণ্ড কুড়ি হস্ত লিখে দশস্কন্ধ।।
গর্ভবতী-নারী হাই উঠে সর্ব্বক্ষণ।
সদাই অলস সীতা ভূমিতে শয়ন।।
সুখের সাগরে দুঃখ ঘটায় বিধাতা।
নেতের অঞ্চল পাতি শুইলেন সীতা।।
ভাবিতে ভাবিতে রাম যান অন্তঃপুরী।
রামে দেখি বাহির হইল যত নারী।।
সীতা-পাশে দেখি রাম লিখিত রাবণ।
সত্য অপযশ মম করে সর্ব্বজন।।
পড়িয়া আমার হাতে জন্মে গেল দুঃখে।
তবু উচ্চ বচন নাহিক সীতার মুখে।।
সাধে কি সীতার জন্য লোকে করে বাদ।
সীতাত্যাগী হব আমি আর নাহি সাধ।।
সীতারে দেখিয়া রাম আগত বাহিরে।
মনোদুঃখে তাঁহার নয়নে অশ্রু ঝরে।।
সত্য হেতু পিতা মম আমা পুত্রে বর্জ্জে।
সত্য কার্য্য করি যদি লোকে নাহি গঞ্জে।।
সীতা সম রূপ গুণ কোথাও না শুনি।
রূপ গুণ দেখি তারে না দিনু সতিনী।।
সীতা লাগি বলিলেন পিতা দশরথে।
আপনি আসিয়া ব্রহ্মা দিলা হাতে হাতে।।
দেশে আনিলাম সীতা করিয়া আশ্বাস।
হেন সীতা লাগি লোকে করে উপহাস।।
উপহাস করে লোকে সহিতে না পারি।
ডাক দিয়া রঘুনাথ আনিল দুয়ারী।।
দুয়ারী ডাকিয়া রাম বলেন বচন।
ভরত লক্ষ্মণ শত্রুঘনে ঝাট আন।।
পাইয়া রামের আজ্ঞা সে দ্বারী সত্বর।
তিন জনে আনি দিল রামের গোচর।।
তিন ভাই আসিয়া বন্দিল শ্রীচরণ।
তিন ভায়ে লয়ে যুক্তি করেন তখন।।
যে কর্ম্ম করিলে লজ্জা পায় সভা-ভাগ।
আমা সবাকার যুক্তি করি পরিত্যাগ।।
শ্রীরাম বলেন কেন না দেহ উত্তর।
সীতা লাগি লজ্জা পাই সভার ভিতর।।
অপযশ কত সব নারীর কারণ।
অকীর্ত্তি হইলে বর্জ্জি তোমা তিন জন।।
আমার বচন শুন ভাই রে লক্ষ্মণ।
সীতা লয়ে রাখ গিয়া মুনি-তপোবন।।
বাল্মীকির তপোবন খ্যাত চরাচরে।
দেশের বাহিরে সীতা লয়ে রাখ দূরে।।
কালি সীতা বলিয়াছে আমারে আপনি।
নানা রত্নে তুষিবে সে মুনির ব্রাহ্মণী।।
এই কথা কহ গিয়া প্রাণের লক্ষ্মণ।
রামের আজ্ঞায় তুমি চল তপোবন।।
এ কথা কহিলে তার পড়িবেক মনে।
সীতা যাবে আপনি মুনির তপোবনে।।
শীঘ্র যাহ লক্ষ্মণ আমার কর হিত।
রথে তুলি লয়ে যাহ সুমন্ত্র সহিত।।
তুমি আর সীতাদেবী সুমন্ত্র সারথি।
আর যেন কোন জন না যায় সংহতি।।
এত যদি নিষ্ঠুর বলিল রঘুনাথ।
তিন ভায়ের মুণ্ডে যেন পড়ে বজ্রাঘাত।।
হাহাকার করি লক্ষ্মণ ছাড়য়ে নিঃশ্বাস।
কি দোষেতে সীতারে দিবে হে বনবাস।।
তুমি স্বামী থাকিতে হইবে অনাথিনী।
কেমনে বঞ্চিবে বনে হয়ে রাজরাণী।।
বিনা দোষে সীতারে না দিও মনস্তাপ।
রঘুবংশ নষ্ট হবে সীতা দিলে শাপ।।
দেশের বাহির না করিহ সতী স্ত্রী।
সীতা ছাড়া হৈলে হবে হত লক্ষ্মীশ্রী।।
যদি রঘুনাথ সীতা করিবে বর্জ্জন।
ভিন্ন গৃহে রাখ সীতা এই নিবদেন।।
শ্রীরাম বলেন ভাই না কর বিষাদ।
সীতা গৃহে থাকিলে হইবে অপবাদ।।
দিলাম আমার দিব্য তাহা পরিহর।
সীতার লাগিয়া কেন কহ বার বার।।
শ্রীরামের কথাতে লক্ষ্মণের লাগে বয়।
সুমন্ত্রে আনিয়া তবে কথাবার্ত্থা কয়।।
রথ সহ সুমন্ত্রেরে রাখিয়া দুয়ারে।
লক্ষ্মণ প্রবেশ করে সীতার আগারে।।
অশ্রুজলে লক্ষ্মণের সর্ব্ব অঙ্গ তিতে।
লক্ষ্মণে দেখিয়া পরিহাস করে সীতে।।
আইস দেবর আজি বড় শুভদিন।
এবে সে দেবর তুমি হয়েছে প্রবীণ।।
চৌদ্দ বৎসর একত্রেতে বঞ্চিলাম বনে।
রাজ্যশ্রী পাইয়া তুমি পাসরিলে মনে।।
কহিয়াছি কত মন্দ-কথা অবিনয়।
তেকারণে দেবর হে হয়েছ নির্দ্দয়।।
বৈসহ বৈসহ দেবর সীতাদেবী বলে।
বার্ত্তা কহ দেবর হে আছত কুশলে।।
তোমারে দেখিয়া মম সদা পড়ে মনে।
উত্তর না দেহ কেন বিরস বদনে।।
লক্ষ্মণ বলেন যত বল অনুচিত।
তোমা দরশনে মন আছয়ে নিশ্চিত।।
রাজার মহিষী তুমি থাক অন্তঃপুরী।
সেবকেতে আজ্ঞা বিনা আসিতে না পারি।।
সীতারে প্রণাম করি বন্দিলা চরণ।
ভাগ্যফলে পাইলাম তোমার দর্শন।।
আশীর্ব্বাদ করিলেন সীতা ঠাকুরাণী।
কি কারণে অন্তঃপুরে আইলা হে তুমি।।
অকস্মাৎ দেবর হে কেন আগমন।
মনেতে বিস্ময় হৈনু না জানি কারণ।।
লক্ষ্মণ বলেন মাতা কর অবধান।
শ্রীরামের আজ্ঞাতে আইনু তব স্থান।।
কালি তুমি কহিয়াছ রাম-বিদ্যমানে।
সাক্ষাৎ করিতে যাবে মুনিপত্নী সনে।।
আইলাম তব স্থানে এই সে কারণ।
মম সঙ্গে চল বাল্মীকির তপোবন।।
মণি রত্ন ধন লহ যেবা লয় চিতে।
নানা রত্ন লয়ে আসি উঠ দিব্য-রথে।।
এত শুনি সীতাদেবী হইল উল্লাস।
স্বরূপ কহিলে তুমি কিবা উপহাস।।
লক্ষ্মণ বলেন মাতা বুঝহ আডন।
তোমা দুজনার কথা আমি কিসে জানি।।
কহিতে এমন কথা কে সাহস করে।
পরিহাস করিতে তোমারে কেবা পারে।।
ইহা শুনি সীতাদেবী চলিলা ভাণ্ডারে।
নানা রত্ন আনিলেন অতি যত্ন করে।।
হীরা মণি মাণিক্যের আভরণ আনি।
লইয়া চন্দন গন্ধ সীতা ঠাকুরাণী।।
নানা রত্ন-লঙ্কার সীতাদেবী লয়ে।
পট্টবস্ত্রে বান্ধিলেন আনন্দিত হয়ে।।
বহুমূল্য ধন লয়ে সীতাদেবী নড়ে।
পরম কৌতুকে সীতা রথে গিয়া চড়ে।।
এমন সময় সীতায় বলেন লক্ষ্মণ।
তুমি আমি সুমন্ত্র সারথি তিন জন।।
রামের আছয়ে আজ্ঞা যাব গুপ্তবেশে।
বাল বৃদ্ধ যুবা কেহ নাহি জানে দেশে।।
সীতা সঙ্গে যেতে চাহে অনেক রমণী।
সবারে আশ্বাস দেন সীতা ঠাকুরাণী।।
মায়া সম্বরিয়া সবে থাক নিজ ঘরে।
মুনিপত্নী প্রণমিয়া আসিব সত্বরে।।
রথেতে চড়িলা সীতা মনের হরিষে।
সবে ঘরে চলি গেল সীতার আশ্বাসে।।
সীতারূপে আলো করে দ্বাদশ যোজন।
সীতা বিনা অন্ধকার রামের ভবন।।
দুর্ব্বল হইল লোক ছাড়ে রাজলক্ষ্মী।
রাজ্যখণ্ডে অমঙ্গল হইতেছে দেখি।।
নদী স্রোত ছাড়ে, লোক ছাড়িল আহার।
দিবস দুপুরে হৈল ঘোর অন্ধকার।।
সূর্য্যের কিরণ ছাড়ে পৃথিবী-মণ্ডল।
সীতার বিদায় দেখি বৃক্ষ ছাড়ে ফল।।
ভরত শত্রুঘ্ন ছাড়ে রামের নিকট।
সীতা লয়ে যায় লক্ষ্মণ করিয়া কপট।।
সীতা বলে, আজি কেন দেখি অমঙ্গল।
নাহি জানি রঘুনাথ চিন্তে অকুশল।।
শাশুড়ীরে না কহিলাম আসিবার কালে।
বুঝি তাঁর মনোদুঃখ হৈল সেই ফলে।।
বামেতে দেখেন সর্প, দক্ষিণে শৃগাল।
অমঙ্গল দেখি সীতা হন উতরোল।।
নানা অমঙ্গল লক্ষণ কেন দেখি পথে।
না যাব অযোধ্যা ফিরে হেন লয় চিতে।।
সীতার বচনে লক্ষ্মণ হেঁট কৈল মাথা।
রামের ভয়েতে কিছু না কহিল কথা।।
অধোমুখে কাঁদে লক্ষ্মণ চক্ষে পড়ে পানি।
উত্তর না করে লক্ষ্মণ সীতা-বাক্য শুনি।।
সীতা বলে কেন তব বিরস বদন।
দেশে ফিরে যাব রথ চালাহ লক্ষ্মণ।।
আপনি বিদায় হব প্রভুর চরণে।
তবে সে যাইব বাল্মীকির তপোবনে।।
লক্ষ্মণ বলেন, সীতা না হও ব্যাকুল।
হের দেখ আইলাম যমুনার কূল।।
বিধির নির্ব্বন্ধ কর্ম্ম খণ্ডন না যায়।
এ কূলে রাখিয়া রথ নদী-পারে যায়।।
পার হৈয়া যায় বাল্মীকির তপোবন।
আগে সীতাদেবী যান পশ্চাতে লক্ষ্মণ।।
কান্দিতেছে লক্ষ্মণ মনেতে পেয়ে ভয়।
লক্ষ্মণের ক্রন্দনেতে সীতা ভীতা হয়।।
কি দুঃখ হইল মনে দেবর লক্ষ্মণ।
কি কারণে উচ্চৈঃস্বরে করিছ ক্রন্দন।।
লক্ষ্মণ কহেন কব কেমন সাহসে।
রামের আজ্ঞায় তোমায় আনি বনবাসে।।
মহাত্রাস পান সীতা শুনিয়া কাহিনী।
শ্রাবণের ধারা সীতার চক্ষে পড়ে পানি।।
এত দূরে আসি মোরে বলিলা লক্ষ্মণ।
কপটে আনিলে বাল্মীকির তপোধন।।
ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক রাম সংসারে প্রশংসা।
দেশে রেখে নাহি কেন করিল জিজ্ঞাসা।।
না দিবেন দেশের মধ্যেতে যদি স্থান।
পরীক্ষা করিয়া কেন কৈলা অপমান।।
যমুনায় ত্যজি প্রাণ তোমার সম্মুখে।
রঘুবংশে কলঙ্ক ঘুচক সর্ব্বলোকে।।
পাঁচ মাস গর্ভ মোর দেখ বিদ্যমান।
আমি মৈলে মরিবেক রামের সন্তান।।
আমা লাগি প্রভু লজ্জা পাইয়া সভায়।
বিনা অপরাধে ত্যাগ করিলা আমায়।।
রাম হেন স্বামী হোক জন্মজন্মান্তরে।
আমি মৈলে কোটি নারী মিলিবে তাঁহারে।।
সীতার ক্রন্দন শুনি ঠাকুর লক্ষ্মণ।
দুইজনে বসিলা কাল্মীকির তপোবন।।
লক্ষ্মণ বিদায় মাগে করি যোড়হাত।
কান্দিয়া বলেন সীতা কোথা রঘুনাথ।।