৪৩. ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্ম্মার রম্যবন গঠন ও তন্মধ্যে রাম-সীতার কেলি

ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্ম্মার রম্যবন গঠন ও তন্মধ্যে রাম-সীতার কেলি

শ্রীরাম করেন রাজ্য ধর্ম্মপরায়ণ।
রাজ্যে নাহি দুর্ভিক্ষ কি অকাল মরণ।।
শ্রীরাম বলেন ভরত শুনহ বচন।
করহ রাজ্যের চর্চ্চা লয়ে সভাজন।।
যুদ্ধ করে অবসাদ হয়েছে আমার।
অন্তঃপুরের রব আমি দিয়া রাজ্যভার।।
কিছু দিন বিশ্রাম করিব আছে মন।
তিন ভাই মিলে কর প্রজার পালন।।
মন দিয়া শুন ভাই বচন আমার।
সাবধানে থাকিয়া পালিবে রাজ্যভার।।
অন্তঃপুরে রব আমি করিয়াছি মনে।
সদা সাবধানেতে পালিবে প্রজাগণে।।
যোড়হাতে ভরত করেন নিবেদন।
সেবক হইয়া রাজ্য করেছি পালন।।
চৌদ্দ বৎসর রাজ্য ছাড়ি করিলে গমন।
পাদুকা করিয়া রাজা পালি প্রজাগণ।।
সাক্ষাতে আপনি আছ রাজ্যের ঈশ্বর।
ত্রিভুবন ভিতরেতে কারে নাহি ডর।।
সুখে অন্তঃপুরে তুমি থাক মনোরথে।
সেবক হইয়া রাজ্য পালিবে ভরতে।।
ভরতের বাক্যে তুষ্ট হৈল রঘুনাথ।
আলিঙ্গন দিলা রাম প্রসারিয়া হাত।।
তিন ভাই শ্রীরামে করিল প্রণিপাত।
অন্তঃপুরে চলিলেন প্রভু রঘুনাথ।।
অন্তঃপুরে গেলেন রাম হরষিত মন।
সীতা করিলেন রামের চরণ বন্দন।।
রাম বলে, শুন সীতা আমার বচন।
লঙ্কাপুরে যেমন সোণার অশোকবর।।
দেবকন্যা লয়ে রাবণ তথা কেলি করে।
তাহার অধিক পুরী রচিব সুন্দরে।।
তুমি আমি তাহে কেলি করিব দুজন।
নানা বর্ণ বহু পুষ্প করিব রোপণ।।
শ্রীরামের আনন্দেতে ব্রহ্মা পুলকিত।
ডাক দিয়া বিশ্বকর্ম্মে আনিল ত্বরিত।।
ব্রহ্মা বলেন বিশ্বকর্ম্মা কর অবধান।
শ্রীরামের অশোকবন করহ নির্ম্মাণ।।
ব্রহ্মার বচনে বিশ্বকর্ম্মা হরষিত।
অযোধ্যা-নগরে আসি হৈল উপনীত।।
বসিয়াছে রঘুনাথ হরষিত মন।
হেনকালে বিশ্বকর্ম্মা বন্দিলা চরণ।।
ব্রহ্মা পাঠাইয়া মোরে দিল তব স্থান।
সুবর্ণের অশোকবন করিতে নির্ম্মাণ।।
মনে মনে বিশ্বকর্ম্মা করেন যুকতি।
নির্ম্মায়ে অশোকবন জন্মাব পিরীতি।।
সোণার অশোকবন করিল নির্ম্মাণ।
দেখিতে সুন্দর বড় হইল সেই স্থান।।
সুবর্ণের বৃক্ষ সব ফল ফুল ধরে।
ময়ূর ময়ূরী নাচে ভ্রমর গুঞ্জরে।।
সুললিত পক্ষীনাদ শুনিতে মধুর।
নানা বর্ণ পক্ষী ডাকে আনন্দ প্রচুর।।
বিকশিত পদ্মবন শোভে সরোবরে।
রাজহংসগণ তথা আসি কেলি করে।।
সরোবর চারিপাশে সুবর্ণের গাছ।
জলজন্তু কেলি করে নানা বর্ণ মাছ।।
মণি-মাণিক্যেতে বান্ধা যত গাছের গুঁড়ি।
স্থানে স্থানে স্থাপিয়াছে রত্নময় পিঁড়ি।।
চন্দ্রোদয় হয় যেন আকাশ উপরে।
তেমনি উদ্যান-বন পুরীর ভিতরে।।
বিশ্বকর্ম্মা নির্ম্মাণ করিল অশোকবন।
ত্রিভুবন জিনি স্থান অতি সুশোভন।।
অশোকবন দেখি রাম হইলেন সুখী।
প্রবেশ করেন তাহে লইয়া জানকী।।
অশোকের বৃক্ষতলে চলিলেন রঙ্গে।
জানকীরে লইয়া তথা বসাইলা সঙ্গে।।
শত শত বিদ্যাধরী সীতার যে দাসী।
নানা মতে সেবা করে রঘুনাথে তুষি।।
সীতা-রূপ দেখি রাম হরষিত মনে।
সীতারে তোষেণ রাম মধুর বচনে।।
বিদ্যাধরীগণ আইল অপ্সরা বিমলা।
প্রথম যৌবনী তারা জিনি শশীকলা।।
বিদ্যাধরীগণ আছে শ্রীরামের পাশে।
সীতারে দেখিয়া রাম অন্যে নাহি বাসে।।
প্রথম যৌবনী সীতা লক্ষ্মী-অবতরী।
ত্রৈলোক্য জিনিয়া রুপ পরমা-সুন্দরী।।
এত রূপ দিয়া সীতায় সৃজিলা বিধাতা।
কাঁচা স্বর্ণ বর্ণরূপে আলো করে সীতা।।
দেখিয়া সীতার রূপ যুড়ায় যে আঁখি।
চন্দ্রবদন রামচন্দ্র সীতা চন্দ্রমুখী।।
পূর্ণ-অবতার রাম সীতা মনোহরা।
চন্দ্রের পাশেতে যেন শোভা পায় তারা।।
আনন্দে আছেন রাম সীতা সম্ভাষণে।
রাজকর্ম্ম এড়ি রাম কেলি রাত্রি দিনে।।
সীতার সেবাতে রাম সদা তুষ্টমতি।
শচীর সেবাতে যেন তুষ্ট শচীপতি।।
একেক দিবসে সীতা একেক মূর্ত্তি ধরে।
এক দিন অন্যরূপ বিষ্ণু-ভাণ্ডিবারে।।
সাত হাজার বর্ষ রাম সীতাদেবী সঙ্গে।
ষড়ঋতু বঞ্চন করেন নানা রঙ্গে।।
নিদাঘকালেতে চৈত্র বৈশাখ যে মাসে।
আনন্দে ডুবেন রাম কেলি রঙ্গরসে।।
বিকশিত পদ্ম শোভে চারি সরোবরে।
মধুলোভে নলিনীতে ভ্রমর গুঞ্জরে।।
রৌদ্রেতে পৃথিবী পুড়ে রবি সে প্রবল।
সীতার সঙ্গেতে রাম সদা সুশীতল।।
বরিষা দেখিয়া রাম পরম কৌতুকী।
জলজন্তু কলরব তৃষিত চাতকী।।
প্রমত্ত ময়ূর নাচে ময়ূরীর সঙ্গে।
অশোকবণেতে রাম বঞ্চিলেন রঙ্গে।।
সীতার সঙ্গেতে রাম পরম উল্লাস।
বরিষা হইল গত শরৎ প্রকাশ।।
আসিয়া শরৎ ঋতু প্রকাশ হইল।
নির্ম্মল চন্দ্রমা আর কুমুদ ফুটিল।।
ফুটিল কেতকী দেখি অতি সুশোভন।
ছাড়িল বরিষা ডাক শরৎ গর্জ্জন।।
মন্দ মন্দ বরিষণ বায়ু বহে ধীরে।
আনন্দেতে শরৎ বঞ্চিলা রঘুবরে।।
কার্ত্তিকে হেমন্ত ঋতু আইসে সঘনে।
হিমময় বরিষণ অশোকের বনে।।
সুরঙ্গ নারঙ্গ ফল বিস্তর সুন্দর।
নারিকেল সমুদয় ফল বহুতর।।
পরম হরিষ রাম সুখের বিশেষ।
এরূপে শ্রীরামের হেমন্ত হৈল শেষ।।
শিশির উদয়ে যে প্রবল হৈল শীত।
শীতকাল পেয়ে রাম পরম পিরীত।।
দিনে দিনে মলিন হইল শশধর।
রজনী প্রবল হৈল অতি ভয়ঙ্কর।।
দেখি কোটি সূর্য্য-তেজ ধরে রঘুবর।
দূরে গেল শীত রাম করেন বিহার।।
উদয় বসন্ত ঋতু সর্ব্ব ঋতু সার।
কৌতুক-সাগরে রাম করেন বিহার।।
ফুটিল অশোক যে মাধবী নাগেশ্বর।
প্রমত্ত ময়ূর নাচে গুঞ্জরে ভ্রমর।।
পরম কৌতুকী রাম দেখি ঋতুরাজ।
কেলিরস বিনা রামের কিছু নাহি কাজ।।
এইরূপে দোঁহে সাত হাজার বৎসর।
রাত্রি দিন কেলিরসে থাকে নিরন্তর।।
পঞ্চমাস গর্ভ হৈল সীতার উদরে।
কৌতুকে শ্রীরাম কিছু জিজ্ঞাসে সীতারে।।
গর্ভবতী হৈলে কিবা খেতে অভিলাষ।
কোন্ দ্রব্য খাবে সীতা করহ প্রকাশ।।
লাজে হেঁটমাথা করে সীতা চন্দ্রমুখী।
দ্রব্যে অভিলাষ নাহি সংসারেতে দেখি।।
এক দ্রব্য খাইতে মোর হইয়াছে মন।
একদিন আজ্ঞা পাইলে যাই তপোবন।।
যমুনার কূলে শ্রাদ্ধ করে মুনিগণে।
খাইতাম সে তণ্ডুল মুনিক্যা সনে।।
মুনিপত্নী সঙ্গে যেতাম স্নান করিবারে।
হংস খেদাড়িয়া পিণ্ড খাইতাম তীরে।।
যোগী ঋষি মুনি তথা করে পিণ্ডদান।
হংসেতে ভাঙ্গিয়া পিণ্ড করে খান খান।।
সত্য করিয়াছি আমি মুনি-পত্নী স্থানে।
দেশে গেলে সম্ভাষ করিব তব সনে।।
এই সত্য পালিবারে দেহ যে মেলানি।
নানা ধনে তুষিব সে মুনির রমণী।।
সীতার কথায় রাম বিস্ময় যে মনে।
কালি দিব মেলানি যাইতে তপোবনে।।