৩৮. রাবণের স্বর্গ জিনিতে গমন

রাবণের স্বর্গ জিনিতে গমন

অগস্ত্য বলেন রাম কর অবধান।
ইন্দ্র রাবণের যুদ্ধ কহি তব স্থান।।
কৌতুকে রাবণ রাজা আছে লঙ্কাপুরে।
দেব দানবের কন্যা লয়ে কেলি করে।।
পরনারী লয়ে কেলি করে দশানন।
হেনকালে রাবণেরে বলে বিভীষণ।।
তুমি বলে হরে আন পরের সুন্দরী।
মধুদৈত্য আসি তব ভগ্নী কৈল চুরি।।
যত পাপ কর তুমি তোমারে সে ফলে।
কুম্ভনশী ভগ্নী তব দৈত্যে হরে নিলে।।
প্রহস্ত মামার কন্যা নামে কুম্ভনশী।
রাত্রিতে করিল চুরি মধুদৈত্য আসি।।
অপমান শুনি তবে করিছে বিষাদ।
লঙ্কাপুরে কি করিতে আছে মেঘনাদ।।
সুমেরু কাটিয়া পাড়ে মেঘনাদের বাণে।
এত অপমান করে তার বিদ্যমানে।।
তুমি আছ বিভীষণ ভাই মহোদর।
এত বীর সবে আছ লঙ্কার ভিতর।।
কারো শক্তি নাহি যুদ্ধ করে দৈত্য সনে।
তোমা সবাকারে ধিক্ কি ফল জীবনে।।
কুম্ভকর্ণ বীর যদি লঙ্কাপুরে জাগে।
ভুবনের শত্রু নাহি আসে তার আগে।।
দিগ্বিজয় করে আইলাম ত্রিভুবন।
থাকুক দৈত্যের কাজ পলায় দেবগণ।।
ত্রিভুবন জিনিয়া আইনু একেশ্বর।
ভগিনী রাখিতে নার ঘরের ভিতর।।
কুম্ভকর্ণ আর আমি আছি দুই জন।
মেঘনাদ আদির বিক্রম অকারণ।।
লজ্জা পেয়ে রাবণেরে বলে বিভীষণ।
কারো দোষ নাহি দোষ দেহ অকারণ।।
মেঘনাদ যজ্ঞ করে হইয়া তপস্বী।
ফল মূল খাই আমি থাকি উপবাসী।।
কুম্ভকর্ণ নিদ্রা যায় হৈয়া অচেতন।
সন্ধান পাইয়া হানা দিল দৈত্যগণ।।
রাবণ বলে যজ্ঞ কেন করে মেঘনাদ।
যজ্ঞ লাগি লঙ্কাপুরে এতেক প্রমাদ।।
মেঘনাদের কথা যত কহে বিভীষণ।
বিচিত্র যজ্ঞের কথা শুনিছে রাবণ।।
বিচিত্র যজ্ঞের স্থান বটবৃক্ষতলা।
মেঘনাদ যজ্ঞ করে নামে নিকুম্ভিলা।।
অনাহারে যজ্ঞশালে রাত্রি দিন থাকে।
দ্বাদশ বৎসর স্ত্রীর মুখ নাহি দেখে।।
স্বর্ণ নামে আছিল প্রধান পুরোহিত।
তাহারে লইয়া যাগ করয়ে ত্বরিত।।
ন্যাস করি পুরোহিত অগ্নিকুণ্ড পূজে।
অগ্নি আসি অধিষ্ঠান হন মন্ত্র-তেজে।।
অধিষ্ঠান হয়ে অগ্নি রহিলা সম্মুখে।
মেঘনাদ পূজা দেয় দশানন দেখে।।
যজ্ঞের আহুতি খেয়ে অগ্নি সন্তোষ।
মেঘনাদে বর দেন হয়ে পরিতোষ।।
অগ্নি বলে মেঘনাদ বর দিনু তোরে।
যজ্ঞ করি যথা তথা যাহ যুঝিবারে।।
পরাজয় না হইবে আমি ‍দিনু বর।
অন্তরীক্ষে যুঝিবে রিপুর অগোচর।।
যজ্ঞে আমি বর দিনু তব বিদ্যমান।
এতেক বলিয়া অগ্নি গেল নিজ স্থান।।
চমৎকার লাগিল যে দেখিয়া রাবণে।
রাবণ বলে মেঘনাদ চল মোর সনে।।
ত্রিভুবন জিনিলাম আমি একেশ্বর।
তোমারে লইয়া আমি জিনি পুরন্দর।।
ত্রিভুবন উপরেতে ইন্দ্র হয় রাজা।
ইন্দ্রেরে জিনিলে সবে করে মোর পূজা।।
সাক্ষাতে দেখিব তোর যজ্ঞের পরীক্ষে।
ইন্দ্র সনে কেমনেতে যুঝ অন্তরীক্ষে।।
আপন কটক লয়ে চলহ সত্বর।
শীঘ্রগতি উঠ গিয়া রথের উপর।।
চৌদ্দ বর্ষ অনাহারে আছে মেঘনাদ।
মধুপান করিয়া ঘুচিল অবসাদ।।
নয় হাজার রাণী তার পরমা সুন্দরী।
দেব দানবের কন্যা রূপে বিদ্যাধরী।।
অন্তঃপুরে নাহি যায় সে চৌদ্দ বৎসর।
প্রকাশ না করে লাজে রাজার গোচর।।
নারী-সম্ভাষণে পুত্র নাহি গেল লাজে।
যজ্ঞস্থল হৈতে বীর যুঝিবারে সাজে।।
শতকোটি হস্তী নড়ে অর্ব্বুদ কোটি ঘোড়া।
তের অক্ষৌহিণী সাজে জাঠি ও ঝকড়া।।
সারথি জানিল আজি সংগ্রামে গমন।
সংগ্রামের রথখান করিল সাজন।।
সাজায়ে আনিল রথ অতি মনোহর।
সংগ্রামের অস্ত্র তুলে রথের উপর।।
বীরদাপে মেঘনাদ রথে গিয়া চড়ে।
হস্তী ঘোড়া ঠাট কত নড়ে মুড়ে মুড়ে।।
নিজ ঠাটে মেঘনাদ করিছে সাজনি।
মেঘনাদের বাদ্যভাণ্ড তিন অক্ষৌহিণী।।
রাজার ছত্রিশ কোটি মুখ্য সেনাপতি।
সাজিয়া রাবণ সঙ্গে চলে শীঘ্রগতি।।
মহোদর মহাপাশ খর ও দূষণ।
তালভঙ্গ সিংহবর ঘোর দরশন।।
মহাবাহু শুকবাহু আর যজ্ঞধূম।
বাঁকামুখ মেঘমালী দুর্জ্জয় বিক্রম।।
শুক সারণ শার্দ্দূল চলিল বিদ্যুন্মালী।
শোণিতাক্ষ বিড়ালাক্ষ বলে মহাবলী।।
চলে ষট্ নিষট্ সে বিক্রমকেশরী।
রাবণের সৈন্য যত কহিতে না পারি।।
রথে গজে অশ্বেতে কুমারভাগে নড়ে।
শিক্ষামত যে যাহার বাহনেতে চড়ে।।
অক্ষয়কুমার আদি চলে দেবান্তক।
বীরবাহু অতিকায় চলে নরান্তক।।
নানা অস্ত্রে সাজি চলে কুমার ত্রিশিরা।
রথের সাজনি কত মাণ্যিক্যাদি হীরা।।
কুম্ভকর্ণ-পুত্র কুম্ভ নিকুম্ভ দুজন।
যাহাদের ভয়েতে কম্পিত ত্রিভুবন।।
কনক রচিত রথ প্রভাকর জ্যোতি।
চড়ে তাহে প্রধান যতেক সেনাপতি।।
তিনকোটি সাজায়ে চলিল তাজি ঘোড়া।
শত অক্ষৌহিণী ঠাট জাঠি ও ঝকড়া।।
মুদগর মুষল টাঙ্গি খাণ্ডা খরশান।
বাছিয়া বাছিয়া তোলে খরতর বাণ।।
মকরাক্ষ চলিল দুর্জ্জয় ধনুর্দ্ধর।
তার সম বীর নাই লঙ্কার ভিতর।।
কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ হৈল সেই দিনে।
ইন্দ্রে জিনিবারে চলে রাবণের সনে।।
এক দিন জাগে ছয় মাসের অন্তর।
নিদ্রাভঙ্গ হয়ে উঠে ক্ষুধায় কাতর।।
ছয় মাস ক্ষুধাতে না খায় অন্ন জল।
নিদ্রা ভাঙ্গি উঠে বীর ক্ষুধায় বিকল।।
সাত শত খাইলেক মদের কলসী।
পর্ব্বত প্রমাণ মাংস খায় রাশি রাশি।।
অর্দ্ধেক লঙ্কার ভোগ করিল ভক্ষণ।
সাজিল যে কুম্ভকর্ণ করিবারে রণ।।
ভূমিকম্প হয় যেন দেখি ভয় করে।
টলমল করে লঙ্কা কটকের ভরে।।
রাবণের রথ লৈয়া যোগায় সারথি।
রাজহংসে বহে রথ পবনের গতি।।
হস্তী ঘোড়া নড়ে ঠাট কটক অপার।
সপ্তদ্বীপা পৃথিবীতে লাগে চমৎকার।।
ইন্দ্রে জিনিবারে করে এতেক সাজনি।
নিজ ঠাট রাবণের শত অক্ষৌহিণী।।
ইন্দ্রে জিনিবারে সবে করিল গমন।
চারিদিকে নানা শব্দে বাজিছে বাজন।।
শত লক্ষ কাঁশী তিন লক্ষ করতাল।
সহস্রেক ঘণ্টা বাজে শুনিতে রসাল।।
ভেরী ও ঝাঁঝরী বাজে তিন কোটি কাড়া।
আগে চলে লক্ষ লক্ষ দামামা দগড়া।।
খঞ্জনী খমক বাজে লক্ষ লক্ষ বীণা।
অসংখ্য রাক্ষসী ঢাক না হয় গণনা।।
ঢেমচা খেমচা বাজে ঝম্প কোটি কোটি।
সাত লক্ষ দগড়েতে ঘন পড়ে কাঠি।।
বিরানব্বই লক্ষ বীণা তিন কোটি শঙ্খ।
দোহারী মোহারী শাণী গণিতে অসঙ্খ্য।।
পাখোয়াজ সেতারা ঢোল তিন লক্ষ কাঁসী।
খঞ্জনীতে মিলাইতে দুই লক্ষ বাঁশী।।
গভীর শব্দেতে বাজে অসঙ্খ্য মাদল।
প্রলয়-কালেতে যেন হয় গণ্ডগোল।।
রাবণের সাজনে দেবতা চমৎকার।
মহাশব্দে রথেতে সাগর হৈল পার।।