৩২. বলি কর্ত্তৃক রাবণের বন্ধন ও লাঞ্ছনা

বলি কর্ত্তৃক রাবণের বন্ধন ও লাঞ্ছনা

অগস্ত্যের কথা শুনি শ্রীরামের হাস।
কহ কহ বলি রাম করেন প্রকাশ।।
সেখা হৈতে আর কোথা গেল সে রাবণ।
কহ দেখি শুনি মুনি পুরাণ-কথন।।
মুনি বলে বলিরাজা পাতালেতে বৈসে।
দশানন গেল তথা জিনিবার আশে।।
পাতালে আবাস ঘর অতি ‍সুনির্ম্মিত।
দেখিয়া রাবণ রাজা হৈল চমকিত।।
সোণার প্রাচীর ঘর পর্ব্বত প্রমাণ।
বিষ্ণুর আজ্ঞায় বিশ্বকর্ম্মার নির্ম্মাণ।।
প্রহস্তকে পাঠায় রাবণ জানিবারে।
রাজ-আজ্ঞা পাইয়া প্রহস্ত গেল দ্বারে।।
বলির দুয়ারে দ্বারী স্বয়ং নারায়ণ।
শরীরের জ্যেতিঃ কোটি সূর্য্যের কিরণ।।
আছেন বসিয়া দ্বারে রত্ন-সিংহাসনে।
শ্বেত-চামরের বায়ু পড়ে ঘনে ঘনে।।
প্রহস্ত বিস্মিত হয়ে আসিয়া সত্বর।
নিবেদন করিছে শুনছে লঙ্কেশ্বর।।
দেখিতেছি মহারাজ দুয়ারে বলির।
পরম পুরুষ এক সুন্দর শরীর।।
আজানুলম্বিত বাহু ভুজ চতুষ্টয়।
শঙ্খ চক্র গদা শার্ঙ্গ তথি শোভা পায়।।
শ্যামল কোমল তনু সুপীত বসন।
তড়িত জড়িত যেন দেখি নবঘন।।
বক্ষঃস্থলে কৌস্তুভ শোভিত অতিশয়।
বনমালা তদুপরি করিছে আশ্রয়।।
শুনিয়া রাবণ যায় পুরুষের পাশে।
রাবণেরে দেখিয়া পুরুষ মৃদু হাসে।।
রূপে আলো করিতেছি বলির দুয়ার।
নিরখিয়া রাবণের লাগে চমৎকার।।
রাবণ বলিছে দ্বারী পলাবে কোথায়।
লঙ্কার রাবণ আমি যুদ্ধ দেও আমায়।।
শুনিয়া পুরুষ মৃদু হাসিয়া সম্ভাষে।
বলি সনে যুঝ ভিতর আবাসে।।
বীর মধ্যে বীর আমি মুনি মধ্যে মুনি।
ত্রিভুবন সব আমি দিবস রজনী।।
আমা সহ যুঝিবে শুনিতে উপহাস।
কালো সনে যুঝিতে না করি অভিলাষ।।
সমানে সমানে যুদ্ধ হয়ত উচিত।
তোমার আমার সনে যুদ্ধ অনুচিত।।
আমি বলি তোমারে শুনহ দশানন।
বলিকে জিজ্ঞাসা কর আমি কোন্ জন।।
এতেক শুনিয়া দশানন রাজা হাসে।
বলির নিকটে গেল ভিতর আবাসে।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিল বলি বসিতে আসন।
জিজ্ঞাসিল পাতালেতে এলে কি কারণ।।
সে বলে পাতালে বিষ্ণু রাখিল তোমারে।
সাজিয়া আইনু আমি বিষ্ণু জিনিবারে।।
বলি বলে হেন বাক্য নাহি বল তুণ্ডে।
ত্রিভুবন আইলে বন্ধন নাহি খণ্ডে।।
দুয়ারে যাঁহার সনে হৈল দরশন।
সে পুরুষ সৃজিলেন এই ত্রিভুবন।।
যাঁহার উপরে কারো নাহি অধিকার।
সকলি সৃজিয়া তিনি করেন সংহার।।
রাবণ বলিছে যম মৃত্যু কালদণ্ড।
ইহা হৈতে কোন্ জন আছে হে প্রচণ্ড।।
বলি বলে তাই কি করিবে যমরাজ।
ত্রিভুবনে কেহ নাহি পুরুষ-সমাজ।।
যম ইন্দ্র বরুণ যতেক লোকপাল।
পুরুষের প্রসাদেতে সকলে বিশাল।।
ইহার প্রসাদে দেব হয়েছে অমর।
তাঁর বড় বীর নাই ত্রৈলোক্য ভিতর।।
দানব রাক্ষস আদি বড় বড় বীর।
পুরুষ দর্শনে তাই কেহ নহে স্থির।।
সেই সে পুরুষবর স্বয়ং নারায়ণ।
তোমায় কিঞ্চিৎ কহি শুন রে রাবণ।।
সেই দেব নারায়ণ মধুকৈটভারি।
চতুর্ভুজ শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী।।
রাবণ শুনিয়া ইহা হইল বাহির।
পুরুষের দেখা নাই অদৃশ্য শরীর।।
রাবণ বলিল ত্রাসে হৈল অর্দশন।
পাইলে চাপড়ে তার বধিতাম জীবন।।
রাবণ আবার গেল পুরুষ উদ্দেশে।
উপস্থিত হইল সে ভিতর আবাসে।।
বলি বলে রাবণের নাহি পাই মন।
পুনঃ পুনঃ আবাসে আইসে কি কারণ।।
পাত্র লৈয়া বলি তবে করে অনুমান।
বিনা যুদ্ধে রাবণে করিব অপমান।।
বলিরে ধরিতে যায় রাবণ সেখানে।
আপনি বন্ধনে পড়ি গেল ততক্ষণে।।
বন্ধনে পড়িল দুষ্ট আপনার দোষে।
রাবণ পড়িল বন্দী বলিরাজা হাসে।।
রাবণ বন্দী দেখি তুষ্ট দেবগণ।
স্বর্গেতে দুন্দুভি বাজে পুষ্প বরিষণ।।
যত দেবকন্যা তারা করে হুলাহুলি।
বলির উপরে ফেলে পুষ্পের অঞ্জলি।।
ইন্দ্র আদি দেবগণ আর দেবঋষি।
স্বর্গবাসে নাচিয়া বেড়ায় স্বর্গবাসী।।
আজি হৈতে দেবগণ পাইল নিস্তার।
দেখিয়া রাক্ষসগণ করে হাহাকার।।
এই মত বন্দীশালে রহিল রাবণ।
কৌতুকে নাচিয়া বুলে যত দেবগণ।।
বলি ভূপতির আছে সাত শত দাসী।
দেখিলে মোহিত অন্যে পরমা রূপসী।।
উচ্ছিষ্ট অন্ন ব্যঞ্জন পূর্ণ স্বর্ণথালে।
পাখালিতে যায় তারা সাগরের জলে।।
রাবণ বলয়ে কন্যা শুনহ বচন।
এক মুষ্টি অন্ন দিয়া রাখহ জীবন।।
চেড়ী সব বলে শুন রাজা লঙ্কেশ্বর।
দিতেছি তুলিয়া অন্ন মেল ত অধর।।
দয়া করি চেড়ী অন্ন দিল যতক্ষণ।
মুখ প্রসারিয়া অন্ন খাইল রাবণ।।
রাবণ বলে শুন চেড়ী আমার বচন।
বারেক চুম্বন দিয়া রাখহ জীবন।।
এতেক বলিল যদি রাজা দশানন।
ত্রাসে পলাইয়া যায় যত চেড়ীগণ।।
চেড়ী বলে রাবণ তুমি হ মহারাজ।
উচ্ছিষ্ট খাইতে তুমি নাহি বাস লাজ।।
বন্ধন করিবে বলি ভেবেছিলে মনে।
আপনার বন্ধন লইলে ততক্ষণে।।
লজ্জা পাইয়া রাবণ করিল হেঁট মাথা।
রাবণ বন্ধন ছাড়ি পলাইল কোথা।।
যথায় যথায় আছে বিষ্ণু-অধিষ্ঠান।
তথা তথা রাবণ পাইল অপমান।।
অগস্ত্যের কথা শুনি শ্রীরাম কৌতুকী।
পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করেন হয়ে সুখী।।
সেথা হৈতে আর কোথা গেল ত রাবণ।
কত দেখি শুনি মুনি অপূর্ব্ব কথন।।