২৯. রাবণ কর্ত্তৃক যমের পরাজয়

রাবণ কর্ত্তৃক যমের পরাজয়

লোকের যাতনা ভাবি দশানন চিন্তে।
বন্দীমুক্ত করে সে মারিয়া যমদূতে।।
শরাঘাতে রাবণ করিছে চূরমার।
যমদূতে মারি করে বন্দীর উদ্ধার।।
যত পাপ করে লোক ভুঞ্জিবে সে তারি।
পাপেতে বান্ধিয়া আনে গলে দিয়া দড়ি।।
পাপের কারণে পাপী চক্ষে নাহি দেখে।
পাপ-দোষে আরবার পড়িল নরকে।।
দশানন বলে বন্দী করিনু উদ্ধার।
আরবার কেন তারে করিছ প্রহার।।
দূত বলে রাবণ আমারে কেন গঞ্জে।
আপনার পাপ লোক আপনি সে ভুঞ্জে।।
ইহলোক রাবণ তুমি যত কত পাপ।
পরলোক এমনে ভুঞ্জিবে পরিতাপ।।
পরলোক তব সনে হেথা হবে দেখা।
তখন তোমার সনে হবে লেখাজোখা।।
কুপিল রাবণ রাজা দূতের বচনে।
সন্ধান পূরিয়া বাণ যমদূতে হানে।।
যমের কিঙ্কর যত নানা অস্ত্র ধরে।
শেল জাঠি মুদগর ফেলিছে তদুপরে।।
যমদূত সকল সহজে ভয়ঙ্কর।
রাবণের সনে যুদ্ধ করিল বিস্তর।।
বড় বড় শালগাছ ফেলিছে পাপর।
ভাঙ্গিল রথের চাকা রাবণ ফাঁফর।।
ব্রহ্মার বরেতে রথ অক্ষয় অব্যয়।
যত ভাঙ্গে তত হয় নাহি অপচয়।।
নানা শিক্ষা জানে সেই ব্রহ্মার কারণ।
বিচক্ষণ শেলে রাবণ করিছে তারণ।।
তিতিল রাবণ-অঙ্গ আপন শোণিতে।
রাবণের গা বহিয়া রক্ত পড়ে স্রোতে।।
যমের কিঙ্কর সব বড়ই চতুর।
রাবণের সনে রণ করিল প্রচুর।।
নীল হরিতাল-বাণ যমদূতে মারে।
মূর্চ্ছিত হৈয়া রাবণ রথ হৈতে পড়ে।।
ছটফট করিতেছে বাণের জ্বালায়।
কুড়ি চক্ষু রাঙ্গা করি দূতপানে চায়।।
থাক থাক করি তারে গর্জ্জিছে রাবণ।
পাশুপত-বাণ এড়ে রুষিয়া তখন।।
আলো করি আসে বাণ অগ্নি অবতার।
যমদূত পুড়ে সব হইল সংহার।।
পুড়িয়া মরিল যমদূত অগ্নিতেজে।
রাবণের রথোপরে জয়ঢাক বাজে।।
রথোপরে সিংহনাদ ছাড়িছে রাবণ।
বাহির হইল রথে রবির নন্দন।।
রাঙ্গামুখ রথখান অষ্ট ঘোড়া বহে।
ত্বরিতে আসিয়া রাবণের অগ্রে বহে।।
যে মূর্ত্তিতে যমরাজ পৃথিবী সংহারে।
সে মূর্ত্তিতে যমরাজ আইল সমরে।।
কালদণ্ড মহা অস্ত্র যমের প্রধান।
যুঝিবার বেলা আসি হৈল অধিষ্ঠান।।
যমেরে কহিছে প্রভু কর আজ্ঞা দান।
পরশিরা রাবণেরে করি খান খান।।
পরশিয়া কিবা কাজ দরশনে মরে।
আজ্ঞা কর আমি গিয়া মারি লঙ্কেশ্বরে।।
যম বলে মৃত্যু দেখ সংগ্রাম সরস।
দণ্ড হাতে মারি পাড়ি রাবণ রাক্ষস।।
তোমার সংগ্রাম আজি ক্ষণেক থাকুক।
মারি পাড়ি রাবণেরে দেখহ কৌতুক।।
কালদণ্ড-মুখে উঠে অগ্নি খরশান।
যার দরশনে লোকে হারায় পরাণ।।
চারিভিতে অস্ত্র যায় সর্পের আকার।
কালদণ্ড-অস্ত্রে কারো নাহিক নিস্তার।।
হেন কালদণ্ড যম তুলে নিল হাতে।
তাহা হৈতে সর্প বাহিরায় চারিভিতে।।
অজগর কালসর্প শঙ্খিনী চিত্রাণী।
মুখে বিষ অগ্নি তার শিরে জ্বলে মণি।।
সর্পের বিকট দন্ত স্পর্শ মাত্র মরি।
দণ্ড দেখি ত্রিভুবন কাঁপে থরহরি।।
বাণ-মুখে অগ্নি জ্বলে লোকের তরাস।
সর্ব্বলোকে দেখে দশাননের বিনাশ।।
ডাক দিয়া যমেরে করিতেছে বাখান।
রাবণ মরিলে দেবগণ পায় ত্রাণ।।
আজি যদি যম তুমি মারহ রাবণে।
তোমার প্রসাদে বেড়াইবে দেবগণে।।
দেবতা সহিত ব্রহ্মা ছিল অন্তরীক্ষে।
যম-হাতে দণ্ড দেখে আইল সমক্ষে।।
শমনেরে চতুর্ম্মুখ কহেন বচন।
ক্ষান্ত হও যমরাজ না করিও রণ।।
রাবণ পাইল বর নাহি তব মনে।
রাবণে হঠাৎ তুমি মারিবে কেমনে।।
দণ্ড সৃজিলাম আমি মৃত্যুর কারণ।
যাহার আঘাতে লুপ্ত হয় ত্রিভুবন।।
যাহার দর্শন মনে স্পর্শে কিবা কথা।
হেন দণ্ড রাবণে মারিবে কেন বৃথা।।
দণ্ড ব্যর্থ হবে, নাহি মরিবে রাবণ।
আমার বচন শুন না করিহ রণ।।
দণ্ড রাখ দণ্ড রাখ শুন দণ্ডধর।
রাবণেরে জয় দিয়া যাহ তুমি ঘর।।
যম বলে তব বরে সবার ঠাকুরাল।
লঙ্ঘিয়া তোমার বাক্য যাবে সে পাতাল।।
যমরাজ কালদণ্ড মৃত্যু তিনজন।
এ তিনের মূর্ত্তি দেখি কাঁপে ত্রিভুবন।।
যম কালদণ্ড মৃত্যু এ তিনের গন্ধে।
পলায় রাক্ষস-সৈন্য চুল নাহি বান্ধে।।
বড় বড় রাক্ষস রাবণের সোসর।
এ তিনের মূর্ত্তি দেখি হইল ফাঁফর।।
এ তিনের বিক্রম সহিবে কার প্রাণে।
পলায় রাক্ষস সব এড়িয়া রাবণে।।
অমাত্য পলায় সব এড়িয়া রাবণে।
একেশ্বর রাবণ রহিল মাত্র রণে।।
যুঝিবারে কাজ থাক দেখি যমরাজে।
হেন বীর নাহি যে সম্মুখ হৈয়া যুঝে।।
নির্ভয় রাবণ রাজা বিধাতার বরে।
যমের সম্মুখে যুঝে শঙ্কা নাহি করে।।
দশদিক দশানন ছাইলেক বাণে।
রাবণের বাণ যম কিছুই না জানে।।
জাঠি ঝকড়া শেল এড়ে রবির নন্দন।
রাবণ জর্জ্জের হয় তবু করে রণ।।
ছাইল যমের রথ রাবণের বাণে।
দশ বাণে সারথিরে বিন্ধে দশাননে।।
সন্ধান পূরিয়া সে ধনুকে যোড়ে শর।
সহস্রেক বাণ এড়ে যমের উপর।।
মৃত্যুর উপরে করে বাণ বরিষণ।
বাণ ব্যর্থ হয় দেখি চিন্তিত রাবণ।।
অতি মত্ত রাবণ সে বিধাতার বরে।
মৃত্যুর উপর বাণ ফেলে নাহি ডরে।।
মৃত্যুর নাহি যে মৃত্যু কি করিবে বাণে।
অবোধ রাবণ তবু যুঝে তাঁর সনে।।
মৃত্যু বাণ খাইয়া অধিক কোপে জ্বলে।
যোড়হাতে করিয়া যমের আগে বলে।।
নিবেদন করি প্রভু কর অবধান।
তোমার অস্ত্রের মধ্যে আমি সে প্রধান।।
মধুকৈটভাদি যত ছিল দৈত্যগণ।
বালি বলি মান্ধাতা করিয়াছিল রণ।।
পাইয়া ব্রহ্মার বর রাবণ দুর্জ্জয়।
তার সহ যুদ্ধ করা উঠিত না হয়।।
তোমার বচন প্রভু করি আমি দড়।
রণ ছাড়ি তব বাক্যে দিলাম আমি রড়।।
রথ হৈতে যমরাজ হৈল অদর্শন।
ধর ধর বলিয়া ডাকিছে দশানন।।
মন্দ মন্দ হাসিয়া রাবণ রাজা ভাষে।
যম পলাইয়া যায় আমার তরাসে।।
যম যদি পলাইল দেখিল রাবণ।
আমি যম জয়ী বলি ভাবে দশানন।।
কৃত্তিবাস কবিত্ব শুনিতে চমৎকার।
সর্ব্বলোকে রামায়ণ হইল প্রচার।।