২৭. বালি ও রাবণের যুদ্ধ

বালি ও রাবণের যুদ্ধ

শুনিয়া মুনির বাক্য রামের উল্লাস।
কহ কহ বলি রাম করেন প্রকাশ।।
সেথা হৈতে আর কোথা গেল দশানন।
কহ কহ শুনি প্রভু অপূর্ব্ব কথন।।
মুনি বলে সদা দুষ্ট ‍যুদ্ধ-চিন্তা করে।
বালির নিকটে গেল কিষ্কিন্ধ্যা-নগরে।।
ভুবন জিনিয়া ভ্রমে নাহি অবসাদ।
বালির দুয়ারে গিয়া ছাড়ে সিংহনাদ।।
বালির দুয়ারে দেখে অনেক বানর।
আপনার পরিচয় কহে লঙ্কেশ্বর।।
লঙ্কার রাবণ আমি দশমুণ্ড ধরি।
বাঞ্ছা করি বালির সহিত ‍যুদ্ধ করি।।
বলিল বানরগণ ওরে দুরাচার।
এমন বচন মুখে না আনিস্ আর।।
বালির দুয়ারে দেখে অনেক বানর।
আপনার পরিচয় কহে লঙ্কেশ্বর।।
লঙ্কার রাবণ আমি দশমুণ্ড ধরি।
বাঞ্ছা করি বালির সহিত ‍যুদ্ধ করি।।
বলিল বানরগণ ওরে দুরাচার।
এমন বচন মুখে না আনিস্ আর।।
হইলে বালির সনে তোর দরশন।
দশমুণ্ড খণ্ড করি বধিবে জীবন।।
যে বীর করিয়া দর্প যুদ্ধ চাহে আসি।
হেথা দেখ তা সবার হাড় রাশি রাশি।।
সন্ধ্যা করিতেছে বালি দক্ষিণ-সাগরে।
কিছু কাল থাক যদি যাবে যমঘরে।।
মহাপরাক্রম বালি খ্যাত ত্রিভুবনে।
তৃণ জ্ঞান নাহি করে সহস্র রাবণে।।
বালির বিক্রম-কথা শুন নিশাচর।
দুর্জ্জয় শরীর বালি বলের সাগর।।
প্রভাতে উঠিয়া বালি অরুণ-উদয়।
চারি সাগরেতে সন্ধ্যা করে মহাশয়।।
আকাশে উপাড়ি ফেলে পর্ব্বত শিখর।
পুনঃ হাত পসারিলে লুফে সে সত্বর।।
সপ্ত দ্বীপ ভ্রমে বালি এক নিমিষেতে।
কি কব অন্যের, বায়ু না পারে ছুঁইতে।।
অমর হয়েছে হেন কর অহঙ্কার।
পড়িলে বালির হাতে যাবে যমঘর।।
কুপিল রাবণ রাজা দুয়ারীর তরে।
উত্তরিল গিয়া শীঘ্র দক্ষিণ-সাগরে।।
সুমেরু পর্ব্বত যেন সাগরের কূলে।
সূর্য্যের কিরণ যেন রাঙ্গা মুখ জ্বলে।।
সত্তর যোজন দেহ উভেতে দীঘল।
উভ লেজ স্পর্শ করে গগন মণ্ডল।।
দূরে থাকি রাবণ নেহালে আছে বালি।
শজারুর দৃষ্টে যেন সিংহ মহাবলী।।
নিঃশব্দে বালির কাছে চলিল রাবণ।
সিংহের নিকটে যায় শৃগাল যেমন।।
অকস্মাৎ বালি রাজ মেলিল নয়ন।
দেখিলেন নিকটেতে আইসে রাবণ।।
মনে মনে হাসিল বুঝিয়া অভিপ্রায়।
আসিতেছে আশা করি জিনিবে আমায়।।
বালি বলে দশানন মরিবি নিশ্চয়।
মরিবার আশে এস প্রাণে নাহি ভয়।।
ব্রহ্মার বরেতে হইয়াছে অহঙ্কার।
আজি রে রাবণ তোরে করিব সংহার।।
কেমনে ফিরিয়া যাবি ঘরে আপনার।
পড়িলি আমার হাতে রক্ষা নাহি আর।।
মারিতে আইসে যেই তারে আমি মারি।
যে জন সমর চাহে সেই জন অরি।।
আমায় জিনিতে এস মরিবার আশে।
হেন সাধ কর বেটা পুনঃ যাবি দেশে।।
নির্জীব করিব আজি তোরে লঙ্কেশ্বর।
লেজে বান্ধি ডুবাইল চারিটা সাগর।।
লেজেতে বান্ধিব আজি দুষ্ট দশাননে।
কৌতুক দেখুক আজি এ তিন ভুবনে।।
সর্প-দরশনে যেন বিনতা-নন্দন।
রাবণের দেখি বালি করেন গর্জ্জন।।
পাছু দিয়া দশানন ধরিল কাঁকালি।
লেজে বান্ধি রাবণেরে গগনে উঠে বালি।।
দশ মুণ্ড কুড়ি হাত করে নড়বড়।
ভুজঙ্গ ধরিয়া যেন গরুড়ের রড়।।
ফাঁফর রাক্ষসগণ চায় চারিভিতে।
মেঘ যেন ধেয়ে যায় সূর্য্য আচ্ছাদিতে।।
অতি শীঘ্র যায় বালি পবনের বেগে।
রাক্ষস না পায় লাগ অবসাদে ভাগে।।
পূর্ব্বদিকে সাগর যোজন চারিশত।
তথা গিয়া সন্ধ্যা করে বালি শাস্ত্রমত।।
সেই স্থানে সন্ধ্যা করি উঠিল আকাশে।
লেজেতে রাবণ নড়ে সর্ব্বলোকে হাষে।।
লেজের বন্ধন হেতু রাবণ মূর্চ্ছিত।
ঝলকে ঝলকে মুখে উঠিল শোণিত।।
লেজের সহিত তারে থুয়ে কক্ষতলি।
উত্তর সাগরে সন্ধ্যা করে রাজা বালি।।
তথায় করিয়া সন্ধ্যা উঠিল গগন।
লেজে বদ্ধ রাবণেরে দেখে সর্ব্বজন।।
রাবণের দুর্গতিতে সবে হাস্য করে।
পশ্চিম সাগরে বালি গেল তার পরে।।
ডুবায় বান্ধিয়া লেজে বালি লঙ্কেশ্বরে।
এত জল খাইল যে পেটে নাহি ধরে।।
আকট বিকট করে পড়িয়া তরাসে।
রাবণ জলের মধ্যে, বালিতো আকাশে।।
চারি সাগরেতে সন্ধ্যা করি মন্ত্র পড়ে।
রাবণে লইয়া বালি কিষ্কিন্ধ্যায় নড়ে।।
দেশে গিয়া বালিরাজ রাবণেরে এড়ে।
হাসি বলে কোথা থেকে আইলে এধারে।।
রাবণ বলিছে আমি বীরকে পরখি।
তোমা হেন বীর আমি কোথাও না দেখি।।
বরুণ পবন আর তুমি যে বানর।
তিন জন দেখিলাম একই সোসর।।
দেখাইল সপ্তদ্বীপ পৃথিবীর অন্ত।
তোমায় আমায় সিংহ পশুর বৃত্তান্ত।।
আমা হেন বীরে তুমি বান্ধিলে লাঙ্গুড়ে।
চারি সাগরের সন্ধ্যা ধ্যান নাহি নড়ে।।
বলে টুটা পাই যদি আছাড়িয়া মারি।
আমা হৈতে অধিক পাইলে মিতা করি।।
আজ হৈতে তুমি মোর ভাই সহোদর।
মোর লঙ্কা তোমার সে ভোগের ভিতর।।
উভয়ে মিতালি করে অগ্নি করি সাক্ষী।
উভয়ে উভয় প্রতি হইলেক সুখী।।
শ্রীরাম সে উভয়ে পড়িল তব বাণে।
যে জানে তোমার তত্ত্ব সেই সব জানে।।
শুনিয়া মুনির কথা শ্রীরামের হাস।
গাহিল উত্তরকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।