০২. লক্ষ্মণের চতুর্দ্দশ-বর্ষ ব্রহ্মচর্য্য, নিদ্রাজয় ও উপবাস বৃত্তান্ত কথন

মহামুনি অগস্ত্য যে বৈসেন দক্ষিণে।
রাক্ষসের বৃত্তান্ত সকল মুনি জানে।।
রাক্ষসের কথা কহে অগস্ত্য মহামুনি।
সভাখণ্ড শুনিছেন সহ রঘুমণি।।
অগস্ত্য বলেন রাম জিজ্ঞাসি তোমারে।
কিরূপে করিলে যুদ্ধ লঙ্কার ভিতরে।।
ধনুর্দ্ধারী তুমি আর ঠাকুর লক্ষ্মণ।
কোন্ কোন্ বীরে বধ কৈলে কোন্ জন।।
শ্রীরাম বলেন মুনি নিবেদি চরণে।
করিলাম বহু যুদ্ধ ভাই দুইজনে।।
বধেছি রাক্ষস কত না যায় গণন।
শমন সমান পরাক্রম সর্ব্বজন।।
রাবণ কুম্ভকর্ণে আমি করেছি নিধন।
অতিকায় ইন্দ্রজিতে বধেছে লক্ষ্মণ।।
মুনি বলে শুন রাম নিবেদি তোমারে।
ইন্দ্রজিৎ বড় বীর লঙ্কার ভিতরে।।
ইন্দ্রে বেন্ধে এনেছিল লঙ্কার ভিতরে।
ব্রহ্মা আসি মাগিয়া লইল পুরন্দরে।।
থাকিয়া মেঘের আড়ে যুঝে অন্তরীক্ষে।
মেঘনাদ সমান বাণের নাহি শিক্ষে।।
তাহারে করেন বধ ঠাকুর লক্ষ্মণে।
লক্ষ্মণ সমান বীর নাহি ত্রিভুবনে।।
রাম কন কি কহিলে মুনি মহাশয়।
মহাবীর কুম্ভকর্ণ রাবণ দুর্জ্জয়।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব রণে নাহি ধরে টান।
হেন রাবণ ছেড়ে ইন্দ্রজিতের বাখান।।
মুনি বলে, রঘুনাথ কহি তব ঠাঁই।
ইন্দ্রজিৎ সম বীর ত্রিভুবনে নাই।।
চৌদ্দ বর্ষ নিদ্রা নাহি যায় যেইজন।
চৌদ্দ বর্ষ স্ত্রীমুখ না করে দরশন।।
চৌদ্দ বর্ষ যেই বীর থাকে অনাহারে।
ইন্দ্রজিতে সেইজন বধিবারে পারে।।
শ্রীরাম বলেন মুনি কি কহিলে তুমি।
চৌদ্দ বর্ষ লক্ষ্মণেরে ফল দিছি আমি।।
সীতা সহ চৌদ্দ বর্ষ করেছে ভ্রমণ।
কেমনে সীতার মুখ না দেখে লক্ষ্মণ।।
কুটীরেতে বঞ্চিতাম সীতার সহিতে।
থাকিত লক্ষ্মণ ভাই ভিন্ন কুটীরেতে।।
চৌদ্দ বর্ষ কিরূপেতে নিদ্রা নাহি যায়।
কেমনে এমন কথা করিব প্রথ্যয়।।
মুনি বলে সভামধ্যে আনহ লক্ষ্মণ।
হয় নয় জিজ্ঞাসা করহ নারায়ণ।।
রাম বলে শীঘ্র যাহ সুমন্ত্র সারথি।
সভামধ্যে লক্ষ্মণেরে আন শীঘ্রগতি।।
চলিল সুমন্ত্র তবে শ্রীরামের বোলে।
লক্ষ্মণ বসিয়া আছে সুমিত্রার কোলে।।
সমুন্ত্র সারথি গিয়া নোঙাইল মাথা।
যোড় হাত করি বলে শ্রীরামের কথা।।
সুমন্ত্রের কথা শুনি কহেন লক্ষ্মণ।
বনদুঃখ বুঝি সুধাবেন নারায়ণ।।
আগেতে লক্ষ্মণ পিছে সুমন্ত্র সারথি।
প্রণাম করিল গিয়া যথা রঘুপতি।।
লক্ষ্মণে বলেন রাম মোর দিব্য লাগে।
যে কথা জিজ্ঞাসি আমি কহ সভা-আগে।।
চৌদ্দ বৎসর একত্র ছিলাম তিন জন।
কেমনে সীতার মুখ না দেখ লক্ষ্মণ।।
তুমি ফল আনিতে থাকিতাম আমি ঘরে।
ফল দিয়া আপনি কি ছিলে অনাহারে।।
বনমধ্যে তুমি ভিন্ন কুটীরেতে ছিলে।
চৌদ্দ বর্ষ কিরূপেতে নিদ্রা নাহি গেলে।।
লক্ষ্মণ বলেন, শুন রাজীবলোচন।
পাপিষ্ঠ রাবণ সীতা হরিল যখন।।
দুইজনে ভ্রমি বনে করিয়া রোদন।
পাপিষ্ঠ রাবণ সীতা হরিল যখন।।
দুইজনে ভ্রমি বনে করিয়া রোদন।
ঋষ্যমূকে মা জানকীর পাই আভরণ।।
সুগ্রীবের অগ্রে ‍তুমি সুধালে যখন।
সীতার আভরণ কি চিনহ লক্ষ্মণ।।
আমি না চিনিনু সীতার হার কি কেয়ুর।
সবে মাত্র চিনিলাম চরণ নূপুর।।
সত্য প্রভু একত্র ছিলাম তিন জন।
শ্রীচরণ বিনা তাঁর না দেখি বদন।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ নিদ্রা না যাই কেমনে।
শুন শুন রঘুনাথ কহি তব স্থানে।।
তুমি আর মা জানকী কুটীরে থাকিতে।
আমি দ্বার রাখিতাম ধনুঃশর হাতে।।
আচ্ছন্ন করিল নিদ্রা আমার নয়নে।
ক্রোধ করি নিদ্রারে বিন্ধিনু এক বাণে।।
কহি শুন নিদ্রা তুমি আমার উত্তর।
এসো না আমার কাছে এ চৌদ্দ বৎসর।।
রাম যবে রাজা হবে অযোধ্যা-পুরেতে।
বসিবেন মা জানকী রামের বামেতে।।
ছত্রদণ্ড ধরি আমি দাঁড়াব দক্ষিণে।
সেই কালে এস নিদ্রা আমার নয়নে।।
তাহার প্রমাণ প্রভু কহি তব স্থানে।
তব বামে মা জানকী বৈসে সিংহাসে।।
আমি দাণ্ডাইনু ছত্র করিয়া ধারণ।
হাত হৈতে টলে ছত্র পড়িল তখন।।
ঐ কালে নিদ্রা আসি করিল ব্যাপিত।
ঈষৎ হাসিয়া আমি হইনু লজ্জিত।।
অনাহারে চতুর্দ্দশ বর্ষ ছিনু বনে।
তাহার প্রমাণ প্রভু কহি তব স্থানে।।
আমি গিয়া কাননেতে আনিতাম ফল।
তুমি প্রভু তিন অংশ করিতে সকল।।
পড়ে কি না পড়ে মনে রাজীব লোচন।
আমায় কহিতে ফল ধর রে লক্ষ্মণ।।
আমি ধরে রাখিতাম কুটীরেতে আনি।
খাইতে কখনো নাহি বল রঘুমণি।।
আজ্ঞা বিনা কেমনেতে করিব আহার।
চৌদ্দ বৎসরের ফল আছয়ে তোমার।।
শ্রীরাম বলেন ফল রেখেছ কেমন।
সভামধ্যে আনি দেহ প্রাণের লক্ষ্মণ।।
হনুমানে আদেশিলা ঠাকুর লক্ষ্মণ।
বন হৈতে ফল আন পবন-নন্দন।।
হনুমান গিয়া তবে দেখিল কাননে।
চৌদ্দবৎসরের ফল আছে পূর্ণ তূণে।।
দেখিয়া ফলের তূণ হনুমান বলে।
এই কোন্ কার্য্য হেতু আমারে পাঠালে।।
ক্ষুদ্র এক বানরেতে লয়ে যেতে পারে।
আমারে পাঠালে প্রভু অবিচার করে।।
এত যদি হনুর হইল অহঙ্কার।
হইল ফলের তূণ লক্ষগুণ ভার।।
নাড়িতে নারিল তূণ পবন-নন্দন।
সভামধ্যে উত্তরিল বিরস-বদন।।
হনু বলে প্রভু আমি না পারি বুঝিতে।
না পারি নাড়িতে তূণ আমার শক্তিতে।।
লক্ষ্মণের পানে চাহি রাজীবলোচন।
হাসিয়া বলেন তূণ আনহ লক্ষ্মণ।।
নিমিষে লক্ষ্মণ গিয়া ধরি বামহাতে।
আনিয়া রাখিল তূণ সবার সাক্ষাতে।।
শ্রীরাম বলেন শুন প্রাণের লক্ষ্মণ।
চৌদ্দ বৎসরের ফল করহ গণন।।
একে একে লক্ষ্মণ সে গুণেন সকল।
সবে মাত্র না মিলিল সপ্তদিনের ফল।।
শ্রীরাম বলেন শুন প্রাণের লক্ষ্মণ।
সপ্তদিন ফল তুমি করেছে ভক্ষণ।।
লক্ষ্মণ বলেন শুন দেব নারায়ণ।
সপ্তদিন ফল কে করেছে আহরণ।।
যেই দিন পিতার বিয়োগ-সমাচার।
বিশ্বামিত্র-আশ্রমে ছিলাম অনাহার।।
সেইদিন ফল নাহি করি আহরণ।
আর ছদিনের কথা শুন নারায়ণ।।
যে দিন হরিল সীতা পাপিষ্ঠ রাবণ।
শোকেতে আকুল ফল তোলে কোন্ জন।।
ইন্দ্রজিৎ যে দিন বান্ধিল নাগপাশে।
অচৈতন্যে গেল দিবা ফল না আইসে।।
চতুর্থ দিনের কথা নিবেদি চরণে।
ইন্দ্রজিৎ মায়াসীতা কাটিল যে দিনে।।
সেই দিন শোকানলে দগ্ধ দুই ভাই।
মনে করে দেখ প্রভু ফল আনি নাই।।
শক্তিশেল যে দিন মারিল দশানন।
অধৈর্য্য হইলে মম শোকে নারায়ণ।।
নিত্য নিত্য আমি ফল আনিতাম গোঁসাই।
নফর পড়িল ফল আনা হলো নাই।।
আর দিন প্রভু তব পড়ে কি না মনে।
পাতালে মহীর ঘরে বন্দী দুইজনে।।
জিজ্ঞাসহ সাক্ষী তার পবন-নন্দন।
সেই দিন ফল নাহি করি অন্বেষণ।।
সপ্তম দিনের কথা কি কহিব আর।
যে দিন রাবণ বধ আনন্দ অপার।।
আনন্দ-উৎসবে সবে হইনু চঞ্চল।
পুলকেতে পাসরিনু আনিবারে ফল।।
বিচার করিয়া দেখ জগৎ-গোঁসাই।
চতুর্দ্দশ বর্ষ আমি কিছু খাই নাই।।
তব মনে নিত্য ফল খাইত লক্ষ্মণ।
পূর্ব্বকথা কেন প্রভু হলে পাসরণ।।
বিশ্বামিত্র-স্থানে মন্ত্র পাই দুইজনে।
তুমি ভুলিয়াছ প্রভু আছে মম মনে।।
উপদেশ দিয়াছেন বিশ্বামিত্র ঋষি।
এ কারণে চতুর্দ্দশ বর্ষ উপবাসী।।
পালিয়া মুনির আজ্ঞা ভ্রমিতাম বনে।
এই হেতু ইন্দ্রজিৎ পড়ে মম বাণে।।
এত যদি বলিলেন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
লক্ষ্মণেরে কোলে করি রামের ক্রন্দন।।