০৬৪. রাবণের দ্বিতীয়বার যুদ্ধে গমন

শোকের উপরে শোক পাইল রাবণ।
বসিলে সোয়াস্তি নাই করেন শয়ন।।
ইন্দ্রজিৎ-শোক তবু নহে পাসরণ।
আপনি সাজিল রাজা করিবারে রণ।।
স্ত্রীলোকের ক্রন্দন শুনিয়া ঘরে ঘরে।
অভিমানে পরিপূর্ণ রাজা লঙ্কেশ্বরে।।
অমূল্য রতনে করে বিচিত্র সাজন।
সর্ব্বাঙ্গ ভূষিত করে রাজ-আভরণ।।
মেঘের বরণ অঙ্গ, ধবল উত্তরী।
মৃগমদে পরিলেক সুগন্ধি কস্তুরী।।
দশ ভাগে দশ মণি করে ঝলমল।
চন্দ্রসম কুড়ি কর্ণে কুড়িটা কুণ্ডল।।
নানা অস্ত্রে সাজিলেক মনোহর বেশে।
চৌদ্দ হাজার নারী আসি ধরে আশে পাশে।।
ইন্দ্রজিৎ-শোকে রাজা হয়েছে কাতর।
চক্ষের কোণেতে নাহি চাহে লঙ্কেশ্বর।।
ধনুর্ব্বাণ লয়ে রাবণ যায় মহাক্রোধে।
রাণী মন্দোদরী আসি পশ্চাত বিরোধে।।
আপনার দোষে রাজা কৈলে বংশনাশ।
রামের সীতা রামে দেহ থাকুক গৃহবাস।।
মন্দোদরী পানে রাজা ফিরিয়া না চায়।
মৃত্যুকালে রোগী যেন ঔষধ না খায়।।
নিকট মরণ তার কি করে ঔষধে।
না রহে রাবণ মন্দোদরীর প্রবোধে।।
স্বামী প্রদক্ষিণ করি পড়িল মঙ্গল।
মন্দোদরী-চক্ষে জল করে ছল ছল।।
অন্তরে বুঝিয়া রাণী কান্দিল প্রচুর।
দশ হাজার সতিনীতে নিল অন্তঃপুর।।
বৃহন্দের বহির্গত হইল রাজন।
রথ লয়ে সারথি যোগায় ততক্ষণ।।
কনক রচিত রথ সুবর্ণের চাকা।
রথের উপরে শোভে নেতের পতাকা।।
বিচিত্র নির্ম্মাণ রথ অষ্ট ঘোড়া বহে।
রথের উপরে উঠি দশানন কহে।।
ধনুক ধরিতে লঙ্কায় যে যে বীর জানে।
ছোট বড় সাজিয়া আসুক মোর সনে।।
ইন্দ্রজিৎ পড়ে রণে বীর-চূড়ামণি।
আর কারে পাঠাইব যাইব আপনি।।
পদ্মকোটি ঠাট ছিল লঙ্কার ভিতর।
সাজিল রাবণ সনে করিতে সমর।।
পশ্চিম দুয়ারে আছে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
যুঝিবার সেই দ্বারে গেলেন রাবণ।।
দাণ্ডায়েছে রাবণ ধনুকে দিয়া চাড়া।
বায়ুবেগে সারথি চালায়ে দিল ঘোড়া।।
সিংহনাদ ছাড়ি রণে প্রবেশে রাবণ।
ভঙ্গ দিয়া পলায় যতেক কপিগণ।।
গন্ধমাদন সেনাপতি হৈল আগুয়ান।
বিমুখ করিল রাবণ মেরে পঞ্চ বাণ।।
নীল বানরে দশানন দেখিয়া সম্মুখে।
তিন বাণ বিন্ধিলেক নীলবীর বুকে।।
ত্রিশ বাণে পড়িল কুমুদ মহাবীর।
নয় বাণে বিন্ধে জাম্ববানের শরীর।।
গয় গবাক্ষে বিন্ধিলেক দশ দশ বাণে।
দুই শত বাণে বিন্ধে বীর হনুমানে।।
আশী গোটা বাণ খেয়ে অঙ্গদ পড়িল।
পঞ্চদশ বাণে বীর সুষেণে বিন্ধল।।
বানর কটক পড়ে নাহি লেখাজোখা।
পড়িল বানর যত নাহি তার সংখ্যা।।
সারথির আজ্ঞা দিল রাজা দশানন।
পশুর সঙ্গেতে যুদ্ধ নাহি প্রয়োজন।।
রথ লহ রাম আর লক্ষ্মণের কাছে।
সে উভয়ে মারিয়া বানর মারি পিছে।।
রাবণের আজ্ঞা পেয়ে সারথি সত্বর।
চালাইয়া দিল রথ রামের গোচর।।
রথখান আসে যেন বিদ্যুৎ চমকে।
লক্ষ লক্ষ স্বর্ণঘণ্টা বাজে চারিদিকে।।
রথ-শব্দে বানর পলায় লাখে লাখে।
পার্ব্বতীয় পাখী যেন উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে।।
হাতে ধনু রাবণ গেল রামের সম্মুখে।
বৈকুণ্ঠের নাথ রাম দশানন দেখে।।
দক্ষিণে অক্ষয় তূণ বামেতে কোদণ্ড।
বিষ্ণু-অবতার রাম দুবাহু প্রচণ্ড।।
সুন্দর নাসিকা রামের চৌরস কপাল।
ফল মূল খান তবু বিক্রমে বিশাল।।
সুন্দর ধনুক বাণ বিচিত্র গঠন।
রামের শরীরে রাবণ দেখে ত্রিভুবন।।
শ্রীরামের সর্ব্ব অঙ্গ নিরখিয়া দেখে।
পর্ব্বত সমুদ্র সর্প দেখে লাখে লাখে।।
মনে মনে চিন্তা করে রাজা দশানন।
একান্ত জানিনু রাম দেব নারায়ণ।।
যদিচ রামের হাতে হয়ত মরণ।
একান্ত বৈকুণ্ঠে যাব না যায় খণ্ডন।।
বিরস হইয়ে কেন হইব বিমুখ।
রামের সম্মুখে গেল পাতিয়া ধনুক।।