০৪৫. হনুমান কর্ত্তৃক ঔষধ আনয়ন এবং শ্রীরাম, লক্ষ্মণ ও বানরগণের প্রাণদান

এত পরিশ্রমে হনু ঔষধ না পায়।
কোপে কড়মড় দন্ত কটমট চায়।।
হনুমান বলে, আমি শ্রীরামের দাস।
না দিয়া ঔষধ বেটা করে উপহাস।।
ক্ষুদ্র তুই প্রস্তর পর্ব্বত কেটা বলে।
তোর মত কত শত ডুবায়েছি জলে।।
এত বলি ধরি টানে পবন-নন্দন।
চড় চড় শব্দে ছিঁড়ে লতার বন্ধন।।
বড় বড় বৃক্ষ সব উপাড়িয়া পড়ে।
পালে পালে বনজন্তু ধায় উভরড়ে।।
কত শত মুনি ঋষির হইল তপোভঙ্গ।
সিংহের উপরে চেপে পড়িছে মাতঙ্গ।।
শার্দ্দূল উপরে পড়ে কুক্কুর শৃগাল।
নেউল মূষিক সাপ একই মিশাল।।
ভূত প্রেতে পিশাচ পলায় লয়ে প্রাণ।
আতঙ্কেতে যক্ষ বলে রক্ষ ভগবান।।
প্রলয় পাড়িল পলাবার নাহি পথ।
মূর্ত্তিমান হয়ে দেখা দিলেন পর্ব্বত।।
ঋষিরূপে আসি হনুমানের সাক্ষাতে।
জিজ্ঞাসিল হনুমানে মধুর বাক্যেতে।।
কে তুমি কোথায় থাক বীর-চূড়ামণি।
পর্ব্বত ধরিয়া কেন কর টানাটানি।।
হনুমান বলে, আমি পবনের সুত।
সুগ্রীবের অনুচর শ্রীরামের দূত।।
হরেছে রামের সীতা দুষ্ট দশানন।
রঘুনাথ করেছেন সাগর বন্ধন।।
লঙ্কাতে হতেছে যুদ্ধ শ্রীরাম রাবণে।
পড়েছেন রঘুনাথ ইন্দ্রজিতের বাণে।।
রঘুনাথ মূর্চ্ছাগত ঠাকুর লক্ষ্মণ।
সুগ্রীব অঙ্গদ আদি যত কপিগণ।।
অচৈতন্য হয়ে সবে আছে লঙ্কাপুরে।
জাম্ববান পাঠাইল ঔষধের তরে।।
মহৌষধি আছে এই পর্ব্বত উপরে।
না দিল ঔষধ মেরু কোন্ অহঙ্কারে।।
প্রাণপণে করিব রামের উপকার।
পর্ব্বত লইয়া যাব সাগরের পার।।
ঋষি বলে সাম্য হও পবন-নন্দন।
আমি দেখাইয়া দিব ঔষধের বন।।
এত বলি সঙ্গে করি লয়ে সেইখানে।
দেখাইয়া দিল গিয়া ঔষধ যেখানে।।
চারি জাতি ঔষধ লইয়া হনুমান।
উভলেজ করিয়া সারিল দুই কাণ।।
লাফ দিয়া বীর গিয়া উঠিল আকাশে।
লঙ্কাপুরে উপনীত চক্ষুর নিমিষে।।
বিশল্যকরণী আর সুবর্ণকরণী।
অস্থিসঞ্চারিণী আর মৃতসঞ্জীবনী।।
এই চারি ঔষধ লইয়া হনুমান।
চারি দ্বারে ভ্রমণ করয়ে স্থানে স্থান।।
চারি ঔষধের ঘ্রাণ যতদূর যায়।
বানর কটক সব উঠিয়া দাঁড়ায়।।
নিদ্রাভঙ্গে উঠে যেন মেলিয়া নয়ন।
সেইরূপে উঠিলেন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
সুগ্রীব উঠিল বানরের অধিপতি।
দ্বিবিদ কুমুদ উঠে সৈন্যের সংহতি।।
নল নীল উঠিল অঙ্গদ যুবরাজ।
গয় ও গবাক্ষ উঠে কটক-সমাজ।।
যার নাকে লাগে অস্থিসঞ্চারিণী-গুঁড়া।
কটকের হাত পা আসিয়া লাগে যোড়া।।
অস্থিসঞ্চারিণী-গন্ধ প্রবেশয়ে নাকে।
চারি দ্বারের বানর উঠিল ঝাঁকে ঝাঁকে।।
সুবর্ণ করণী গন্ধ সুকোমল অতি।
সুন্দর শরীর হৈল পূর্ব্বের আকৃতি।।
সকল বানর উঠে দিয়া অঙ্গ ঝাড়া।
হনুমানে কহে সবে হাত করি যোড়া।।
তোমার সমান বীর ত্রিভুবনে নাই।
তোমার প্রসাদে সবে মৈলে প্রাণ পাই।।
রাম বলে, হনুমান যে গুণ তোমার।
শত যুগে শুধিতে নারিব তব ধার।।
কি দিব প্রসাদ বল আছে কিবা ধন।
হনুমানে কোল দিলা শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
রাম বলে, হনুমান তুমি ভক্ত বীর।
তোমাতে আমাতে ভেদ নাহিক শরীর।।
সর্ব্বজনে করে হনুমানের বাখান।
হনুমান হৈতে সবে পাইলাম প্রাণ।।
মিথ্যা হৈল যত যুদ্ধ কৈল ইন্দ্রজিৎ।
কৃত্তিবাস গাহিলেন লঙ্কাকাণ্ড-গীত।।