০৪১. ইন্দ্রজিতের সহিত যুদ্ধে বিভীষণ ও হনুমান ব্যতীত সসৈন্যে শ্রীরাম ও লক্ষ্মণের পতন

কুপিল সে ইন্দ্রজিৎ নীলের বচনে।
কোপে গালি পাড়ে বীর যত আসে মনে।।
আজি যদি রহে বেটা তোমার জীবন।
তবে রাজা করিস্ রাক্ষস বিভীষণ।।
এত বলি মেঘনাদ মেঘে হয় ‍লুকি।
মেঘের আড়েতে যুঝে মেঘনাদ ধানুকী।।
আকাশে থাকিয়া করে বাণ বরিষণ।
জর্জ্জর করিয়া বিন্ধে যত কপিগণ।।
খাণ্ডা ও ডাঙ্গস টাঙ্গী ছুরি এক ধারা।
চারিভিতে পড়ে যেন আকাশের তারা।।
নানা অস্ত্র বানরেরে করয়ে প্রহার।
সর্ব্বাঙ্গ বহিয়া পড়ে রুধিরের ধার।।
হস্ত পদ কাটে, বানর পড়ে কোটি কোটি।
গড়াগড়ি যায় ভূমে কামড়ায় মাটি।।
পলাইয়া যায় কেহ, মনে করে অন্ত।
ছুতা করে পড়ে কেহ সিটকিয়া দন্ত।।
কেহ পড়ে সেতুবন্ধে, গায়ে মাখে বালি।
দূরে গিয়া কেহ বা রাজারে পাড়ে গালি।।
ভাল ছিল বালি রাজা গুণের সাগর।
আপনার পুত্র সম পালিত বানর।।
বালি রাজার খাইয়া পরিয়া গেল কাল।
এত দিন নাহি ছিল এমন জঞ্জাল।।
আড়াই দিনের মধ্যে পেয়ে ছত্র-দণ্ড।
লঙ্কাতে বানর আনি কৈল লণ্ডভণ্ড।।
রাম সুগ্রীবের আর কিসের উপরোধ।
ইন্দ্রজিতের সঙ্গে নাহি করি বিরোধ।।
কপির ক্রন্দন শুনি ইন্দ্রজিৎ হাসে।
প্রহারে অসংখ্য বাণ থাকিয়া আকাশে।।
বরিষে অসংখ্য বাণ আগুণের কণা।
পড়িল যে নীলবীর সহ নিজ সেনা।।
রক্তে নদী বহিছে দেখিতে ভয়ঙ্কর।
বানর সহস্র কোটি পড়ে পূর্ব্বদ্বার।।
পূর্ব্বদ্বার জিনিয়া কুমার মেঘনাদ।
দক্ষিণদ্বারেতে গিয়া করে সিংহনাদ।।
দক্ষিণ দুয়ারে বানর কোন্ বীর জাগে।
পরিচয় কর যুদ্ধ দেহ মোর আগে।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র বলে অঙ্গদ প্রভৃতি।
মরিতে আইলি বেটা নিশাভাগ রাতি।।
নাহিক আহার নিদ্রা নাহি সুখ-আশ।
যাবৎ রাবণ-বংশ না হয় বিনাশ।।
আজি তোরে মারিয়া মারিব তোর পিতা।
বিভীষণের উপরে ধরাব দণ্ড-ছাতা।।
ছারখার করিব লুটিয়া লঙ্কাপুরী।
বিভীষণের কোলে দিব রাণী মন্দোদরী।।
কোপে ইন্দ্রজিৎ শরবের বাক্য শুনে।
গালি পাড়ে মেঘনাদ যত আসে মনে।।
আজিকার যুদ্ধে যদি রহে ত জীবন।
তবে রাজা করিস্ রাক্ষস বিভীষণ।।
এত বলি মেঘনাদ মেঘেতে লুকায়ে।
বরিষে অসংখ্য বাণ বিক্রম করিয়ে।।
আকাশে থাকিয়া করে বাণ বরিষণ।
জর্জ্জর করিয়া বিন্ধে যত কপিগণ।।
ব্রহ্ম-অস্ত্র প্রহারে ব্রহ্মার পেয়ে বর।
বাণ ফুটে মূর্চ্ছাগত অসংখ্য বানর।।
বড় বড় বানর হইল অচেতন।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র পড়ে বালির নন্দন।।
আশী কোটি বানর পড়ে দক্ষিণ দ্বারেতে।
বানরের রক্তে নদী বহে খরস্রোতে।।
জিনিয়া দক্ষিণ দ্বার চলে মেঘনাদ।
উত্তর দ্বারেতে গিয়া ছাড়ে সিংহনাদ।।
উত্তর দ্বারেতে কোন্ কোন্ বেটা জাগে।
পরিচয় দেহ তা দারুণ নিশাভাগে।।
ধূম্রাক্ষ বানর ছিল রাত্রি জাগরণে।
ডাকিয়া উত্তর করে মেঘনাদ সনে।।
অসংখ্য বানর তোর আছে পথ চেয়ে।
আপনি সুগ্রীব রাজা রয়েছে জাগিয়ে।।
অন্ন জল না খাই, না যাই নিদ্রা রেতে।
যাবৎ রাক্ষস-বংশ না পারি মারিতে।।
আজি তোরে মারিয়া মারিব তোর পিতা।
বিভীষণের উপরে ধারব দণ্ড ছাতা।।
কোপে জ্বলে ইন্দ্রজিৎ বানর-বচনে।
গালি পাড়ে মেঘনাদ যত আসে মনে।।
আজিকার যুদ্ধে আগে বাচুঁক জীবন।
তবে রাজা করিস্ রাক্ষস বিভীষণ।।
এত বলি মেঘনাদ মেঘেতে লুকায়ে।
বানর কটক বিন্ধে সন্ধান পূরিয়ে।।
আকাশে থাকিয়া করে বাণ বরিষণ।
জর্জ্জর করিয়া বিন্ধে যত কপিগণ।।
মারে কাটে বানরেরে কেহ নাহি দেখে।
উত্তর দ্বারেতে বানর পড়ে লাখে লাখে।।
বানর-কটক পড়ে বীর চূড়ামণি।
আছুক অন্যের কাজ সুগ্রীব আপনি।।
রক্তে নদী বহে ঠাট পড়িল বিস্তর।
অসংখ্য বানরে পড়ে সুগ্রীব-বানর।।
মেঘের আড়েতে চলে বীর মেঘনাদ।
পশ্চিম দুয়ারে গিয়া করে সিংহনাদ।।
পশ্চিম দুয়ারে কোন্ কোন্ বীর জাগে।
ত্বরিতে আসিয়া যুদ্ধ দেহ নিশাভাগে।।
হনুমান বীর ছিল রাত্রি জাগরণে।
ডাকিয়া উত্তর করে মেঘনাদ সনে।।
সেনাপতিগণ জাগে নাহি পরিমাণ।
বড় বড় বীর জাগে পর্ব্বত প্রমাণ।।
জাগিছে সুষেণ বেজ রাজার শ্বশুর।
জাগিতেছে কোটি কোটি বানর প্রচুর।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ জাগে সংসার-পূজিত।
আমি হনুমান জাগি শুন ইন্দ্রজিৎ।।
নাহিক আহার নিদ্রা জাগি দিবা রাতি।
যাবৎ না মারিব লঙ্কার অধিপতি।।
তোরে বধ করিয়া বধিব তোর পিতা।
বিভীষনের উপরে ধরাব দণ্ড-ছাতা।।
বিভীষণে সমর্পিব কনক লঙ্কাপুরী।
কেলি করিবারে দিব রাণী মন্দোদরী।।
এত শুন মেঘনাদ মহাকোপে মনে।
হনুমানে গালি পাড়ে যত আসে মনে।।
রামের তরে ডাক দিয়া বলে মেঘনাদ।
দেশেতে জীয়ন্তে যাবে না করিহ সাধ।।
ইন্দ্রজিৎ নাম মোর ত্রিভুবনে জানে।
কোন্ বেটা নিস্তার না পাইবে মোর বাণে।।
এত বলি লুকাইল মেঘের আড়ালে।
আকাশ হইতে বাণ ঝাঁকে ঝাঁকে ফেলে।।
আকাশে থাকিয়া বাণ করে বরিষণ।
জর্জ্জর করিয়া বিন্ধে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
শেল শূল মুষল মুদগর একধারা।
চারিদিকে পড়ে যেন আকাশের তারা।।
জাঠা জাঠি ঝকড়া কর্ণিকা একধার।
বরিষণ করে আর বলে মার মার।।
রামেরে যতেক বিন্ধে তাহা নাহি মনে।
সহ সহ বলি রাম কহেন লক্ষ্মণে।।
বজ্রের সমান বাণ অসংখ্য বরিষে।
পড়িল লক্ষ্মণ বীর শ্রীরামের পাশে।।
খুরপার্শ্ব অর্দ্ধচন্দ্র দুই বাণের নাম।
সেই দুই বাণ ফুটে পড়িল শ্রীরাম।।
চারি দ্বারে পড়ে ঠাট শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
রাজপ্রসাদ লইতে চলিল পিতৃস্থান।।
আগুসাড়ি পথে পড়ে চন্দনের ছড়া।
তাহার উপরে পাতে নেতের পাছড়া।।
হাতেক প্রমাণ পড়ে পুষ্প পারিজাত।
আজ্ঞা পেয়ে পবন সুগন্ধি বহে বাত।।
দাণ্ডায় বাপের আগে বীর-অবতার।
বাপের চরণে মাথা নোঙায় তিনবার।।
কহিল সকল, যত করিল সংগ্রাম।
পড়িল সকল সৈন্য সহিত শ্রীরাম।।
পড়িল লক্ষ্মণ আর বীর হনুমান।
বানর-কটক পড়ে নাহি পরিমাণ।।
সুগ্রীব অঙ্গদ পড়ে নীল সেনপতি।
পড়িল সে জাম্ববান ভল্লুক প্রভৃতি।।
গন্ধমাদন শরভ সুষেণ আদি বীর।
সমুদ্রের কূলে সবে লোটায় শরীর।।
চারি দ্বারে পড়িয়াছে বানরের থানা।
আজি রণে জীয়ন্ত নাহিক একজনা।।
সুগ্রীব বানরে আর নাহি তব ডর।
ঘরপোড়া বানর গিয়াচে যমঘর।।
হরিষে যুদ্ধের কথা কহে মেঘনাদ।
চুম্ব দিয়া রাবণ করিল আশীর্ব্বাদ।।
রাজপ্রসাদ মেঘনাদ পাইল বিস্তর।
বিচিত্র নির্ম্মাণ দিল রত্নের টোপর।।
বলয় কঙ্কণ দিল মাণিক্য রতন।
পঞ্চশব্দে বাদ্য বাজে না যায় গণন।।
নানা রত্ন ধন দিল মস্তকের মণি।
স্বর্গ-বিদ্যাধরী দিল সহস্র কামিনী।।
রাজপ্রসাদ দিল রাজ্য করে লণ্ডভণ্ড।
সবে মাত্র নাহি দিল নব ছত্র দণ্ড।।
রাজপ্রসাদ পাইয়া প্রবেশে অন্তঃপুরী।
নারীভাগ লয়ে গৃহে খেলে পাশাসারি।।